পরিচয়
পরিচয়
মিসেস অলকানন্দা সেন, বয়স পঁয়তাল্লিশ, একটি বহুজাতিক সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত । স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে থাকেন যোধপুর পার্কের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। দৈনন্দিন কর্ম ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ রেখেছেন ঘন্টা খানেক সময়। মর্নিং ওয়াক , এটা ওনার বহু দিনের অভ্যাস । যদিও উনি বলেন, " শরীর স্বাস্থের উন্নতি হয় কি না বলতে পারব না- ওজন কমে বলেও মনে হয় না, কিন্তু এটা একরকম অভ্যাস, একটা ভাললাগা। রোজ সকালে পাড়ার কিছু পরিচিত মুখ দেখতে পাই । কেউ একলা হাঁটছেন, কেউ কেউ বা দলবদ্ধ ভাবে গল্প করতে করতে- পাশের ফ্ল্যাটের বরুণবাবু, সামনের বিল্ডিংয়ের সন্ধ্যা মাসিমা এরকম আরও অনেকে; এছাড়া কিছু নাম-না-জানা মানুষজন যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসে গেছেন পরিচিতের দলে"।
মিসেস সেন রোজ দেখেন দুটি অল্প বয়সী মেয়ে, বয়স সতেরো -আঠারো হবে, গল্প করতে করতে হাঁটছে- বেশ লাগে- হাসি মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কিন্তু ওদের পরিচয় জানা নেই, আলাপ করার সুযোগও হয় নি কখনও। আজ হাঁটার শেষে মিসেস সেন যে বেঞ্চে বসেছিলেন, ওরা এসে বসল ওনার পাশে। আলাপ করার লোভটা সামলাতে পারলেন না মিসেস সেন। জিজ্ঞাসা করলেন , " কোথায় থাকো তোমরা? রোজই দেখি তোমাদের"।
একটি মেয়ে উত্তর দিল, " এই তো পাশেই"।
মিসেস সেন: "কি পড়ছ?"
মেয়েটি উত্তর দিল , " এবার হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছি"।
মিসেস সেন: "বেশ। তোমাদের নাম কি?"
অন্য মেয়েটি চুপচাপ বসে ছিল। প্রথম মেয়েটিই উত্তর দিল, " আমি দীপা , " , বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল " ও মালা"।
মিসেস সেন: "সুন্দর নাম। কি ফিউচার প্ল্যান তোমাদের?"
দীপা: "আমি সাইন্স নিয়ে পড়ব, আই আই টি দেব, বিদেশে যেতে চাই। এরপর শুধু পড়াশুনা আর তারপর একটা ভাল চাকরি। তবে মালার অবশ্য সে সব প্ল্যান নয়, বিশেষ কিছুই প্ল্যান নয়।"
মিসেস সেন: "মালা , তুমি ভবিষ্যতে কি পড়তে চাও? কি করতে চাও?"
মালা: " আমি অনেক কিছু করতে চাই। নিজের পায়ে নিশ্চয়ই দাঁড়াতে চাই, সেইজন্য শিক্ষকতা করতে চাই। আমাদের দেশের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করতে চাই; এ বিষয় জানার আমার খুব আগ্রহ । আর আমার মাস্টারমশাই বলতেন, " মানুষ গড়ার কাজ"- আমি সেই কাজ করতে চাই ।
ওই যে ওদিকে যে বস্তিটা আছে, ওখানে গিয়ে কাজ করতে চাই, ওই বাচ্চাদের পড়াতে চাই, ওদের জন্য কিছু করতে চাই । এরকম কত মানুষের হয়তো আমাকে দরকার, ওদের পাশে দাঁড়াতে চাই আর অনেক মানুষকে আমার পাশে চাই....অনেক কিছু করতে চাই ।
মালা কথা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কিন্তু ওর এক একটি কথা জুড়ে যেন সত্যিই একটি মালা তৈরি হল, যে মালা পরানো হবে দেশমাতৃকার গলায়। মালার কথা শেষ হতে না হতেই দীপা বলল, " এবার উঠি"। মিসেস সেনকে বিদায় জানিয়ে ওরা দুজনে উঠে পড়ল। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মিসেস সেন ওদের কথাগুলোই ভাবতে লাগলেন ।
দুজন বন্ধুর জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন, লক্ষ্য ভিন্ন, কিন্তু নিজেদের জায়গায় হয়তো দুজনেই সঠিক। দীপা নিজের উন্নতির মধ্যে দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় আর মালা ছোট ছোট কাজের মধ্যে দিয়ে দেশের সেবা করতে চায়। বুদ্ধিদীপ্ত দুজোড়া চোখ, ওই হাসিমুখ, একজন প্রাণোচ্ছল, অন্য জন শান্ত, ধীর- কিন্তু দুজনেই নিজের নিজের লক্ষ্যে স্থির। দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর মানুষের কি সুন্দর বন্ধুত্বের নিদর্শন ।
উঠে পড়লেন মিসেস সেন - বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। কাল পনেরোই অগাস্ট - ছুটির দিন । ভেবেছিলেন কাল মর্নিং ওয়াক করতে যাবেন না; সারাদিন শুধু আরাম করবেন। মালার কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে । বাড়ি যেতে যেতে অনেকগুলো ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল- " কালকের দিনটা কি শুধুই আরাম করে কাটাব? মালার মত অনেক কিছু না করতে পারি, কিছু তো করতে পারি। কথায় বলে ' চ্যারিটি বিগিন্স এট হোম'। বাড়িতে রান্না করে সাধনা, ও রোজ বলে ওর মেয়ের খুব বই পড়ার শখ, কিন্তু ওর পক্ষে তো কিনে দেওয়া সম্ভব হয় না, ওকেই না হয় জিজ্ঞাসা করব ওর মেয়ে কি পড়তে চায়! সেখান থেকেই না হয় শুরু করি- কিছু তো করি?"
এইভাবেই হয় তো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম- দীপারা দেশে বিদেশে দীপ জ্বালিয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে আর মালারা এইভাবেই ভালবাসার মালা গেঁথে চলবে- আমরাও থাকি না ওদের সাথে- অনেক কিছু না হলেও কিছু তো করতে পারি