প্রাপ্তি:-
প্রাপ্তি:-
(১)
- "কিরে নেইলপলিশ লাগিয়ে রেখেছিস কেনো রাজরূপ?"
- "না, ওটা মানে.....আরে, ওই... আমার এক কাকাতো বোন আছে না ডিম্পি, ওর দুষ্টুমি আরকি।"
- "আর তুই নেইলপলিশটা পরেও আছিস, নেইল রিমুভার এর কথা জানিস না, না?"
কলেজ ক্যান্টিনে বসে সব বন্ধু বান্ধবীরা যখন মজা করছে তখন রাজরূপ চুপ করে ভাবতে থাকে, 'ডিম্পি লাগায় নি রে, আমিই লাগিয়েছি... বোঝাই কি করে তোদের আমার যে...'
- "চল রে, নেক্সট লেকচারের টাইম তো হয়ে গেলো।"
সবাই যখন উঠে দাঁড়ালো রাজরূপ বললো, "তোরা যা আমি আসছি একটু পর।"
- "আর কতো পরে আসবি রে তুই?" এক বন্ধু বলে উঠলো।
- "ছেড়ে দে, ছেড়ে দে...জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে নেইল পেইন্ট ওঠাবেন এখন বাবুমশাই, চল আমরা চলি।"
এই বলে হাসতে হাসতে বাকিরা বেরিয়ে গেল।
(২)
- "রাজু, ওঠ বাবু, ভর সন্ধ্যেবেলা শুয়ে আছিস..."
- "ওহ... মা! এসে পড়লে..."
- "হ্যাঁ রে, কি বৃষ্টি বল, ভাবছিলাম অফিস ফেরত অটো পাবো কিনা, হঠাৎ এমন বৃষ্টি শুরু হলো।"
- "মা, তোমার বৃষ্টি ভালো লাগে না?"
- "না রে বাবু, এখন আমার বৃষ্টি ভালো লাগার মানসিকতা নেই আর। মাসের শেষ, এত খরচাপাতি..."
- "তোর বাবা আজ বেঁচে থাকলে কি আর আমায় এত চিন্তা করতে হতো রে?"
- "এখন আর সংসারের ধকল সামলাতে পারিনা, বয়সও তো হচ্ছে। তোর ইঞ্জিনীয়ারিং এর পর ভালো একটা চাকরি পেলে তোর বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হবো..."
- "কিন্তু মা..."
- "হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি, তুই তোর নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করবি, তাই তো? তাই হবে, আমার কোন আপত্তি নেই সোনা।"
(৩)
- "মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এখন, সারাদিন এত খাটা-খাটনি করে। মাকে বলি কেমন করে?"
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে, রাজরূপের চোখে ঘুম নেই, কিছু একটা কথা সে প্রকাশ করতে চেয়েও করতে পারছে না কারো কাছে...
কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ছটফট করছে ওর মন... কিভাবে বলবে সবাইকে যে সে.... কিন্তু না বলেও যে থাকতে পারা যায় না, কি বলবে সে, কিভাবেই বা বলবে, শুনে কি ভাবে রিয়েক্ট করবে তার বন্ধুরা... এর থেকেও বেশী জরুরি হলো মা কি ব্যাপারটা মানতে পারবে?
(৪)
- "প্রজাপতি প্রজাপতি পাখনা মেলো; আমার এই মনের আধাঁর কোণে কোণে, রঙে রঙে রং মশাল জ্বালো... গাইতে গাইতে আয়নার সামনে দাড়িয়ে সাজছিল রাজরূপ, আজ রাজরূপদের কলেজ বন্ধ। মমতাদেবীও অফিসে। কিন্তু হঠাৎ..."
- "রাজু, কি করছিস এইসব!!!!"
আচমকা মমতাদেবীর ডাকে রাজরূপ হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে ফেরে....
- "মা, ত... তুমি...."
কপালে বিন্দী, চোখে কাজল, ঠোঁটে গাঢ় রং এর ছোঁয়া, পরনে মমতা দেবীর এক সালওয়ার কামিজ। মমতাদেবী হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন রাজরূপের দিকে...
(৫)
- "তুই কি পাগল নাকি? কি আবোল তাবোল বলছিস তুই বাবু? কি ছেলেখেলা করছিস? নিজের কথা না ভাবিস, আমার কথা তো ভাব। আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ, কষ্ট করে চাকরি করে দু পয়সা রোজগার করে সংসার চালাচ্ছি আর সাথে তোর পড়ালেখা, আর তুই কিনা আমায় বলছিস... ঠাকুর এ কি দিন দেখাচ্ছ আমায়?"
- "মা, আমার কথাটাও তো ভেবে দেখো একবার। আমি তোমায় অনেকবার বলতে চেয়েছি, কিন্তু বলতে পারিনি। মা, আমার ভালো লাগে মেয়েদের মতো সাজতে, ভালো লাগে মেয়েলি ধাঁচে কথা বলতে, হাঁটতে চলতে গাইতে...."
- "কিন্তু তুই আমার ছেলে, তুই মেয়ে নোস রাজু।"
- "ঠিক এজন্যেই তো তোমায় বলতে পারিনি মা, কাউকে কিছু বলতে পারিনি.. মা, একটাবার ভাবো, আমার দিকটা দেখো... আমি পারিনা বাকি ছেলেদের মতো স্বাভাবিক ভাবে থাকতে, ডিম্পি যখন আমায় বলে দাদা পুতুল খেলবি? আমার ভালো লাগে পুতুল খেলতে, পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে বাকি ছেলেদের সাথে আড্ডা দিতে মন চায়না মা। যখন ও বলে দাদা কিতকিত খেলবি, তখন আমার যে আনন্দ হয় তা পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলেও হয় না মা... "
- "তুই যা এখন রাজু, আমায় একা থাকতে দে.."
- "মা, কাঁদছ কেন?"
- "তুই যা না এখন, আমি... আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই..."
(৬)
- "মমতা, তোর রাজরূপের দিকটাও একবার ভেবে দেখা দরকার, ছেলেটার আর কে আছে বল তুই ছাড়া? এই সমাজের ভয়ে এতোদিন গুমরে-মুসরে ছিল ছেলেটা, নিজের মনের কথা খুলে বলতেও ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। তুই ওর পাশে দাঁড়াবি না? কে আছে রাজুর তুই ছাড়া? আমরা ছোট থেকেই ছেলেদের বলে আসছি তোমায় কিন্তু পড়ালেখার পর সংসারের কান্ডারী হতে হবে, হাল ধরতে হবে ঘর গৃহস্থালির, কখনো জানতে চেয়েছি কি ছেলেটা আদৌ কি করতে চায়? কি হতে চায়? শুরু থেকেই তো ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে দি আমরা..."
- "তুই ঠিক বলছিস শিল্পী, কিন্তু আমি সাধারন মেয়েমানুষ, ছেলেটাই তো ভরসা বল? ওর বাবা চলে যাবার পর একা হাতে মানুষ করছি, আমি কি করে মেনে নিই ব্যাপারটা? ভাবতেই তো কি রকম লাগছে, লোকজন জানাজানি হলে তো আরো হাসির পাত্র হবো আমরা! আমার যে দুশ্চিন্তায় দিন-রাত এক হওয়ার জোগাড়...."
- "কে এই লোকজন মমতা? ওদের চেয়ে আপন তোর নিজের ছেলে, রাজুকে ছেড়ে তুই ওদের কথা ভাবছিস? মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখ, লোকের কোথায় আদৌ কি কিছু আসবে যাবে তোর?"
(৭)
- "কি সুন্দর সাজিয়েছে অঞ্জলিকে, কি অপূর্ব দেখতে লাগছে.. শিল্পী দি, কে সাজালো গো অঞ্জলিকে? নববধূ সাজে কি চমৎকার লাগছে অঞ্জল কে।"
- "কে আবার? রূপা সাজিয়েছে রে.... "
- "তাই নাকি? এত্ত সুন্দর সাজাতে পারে রূপা জানতামই না গো।"
- "আজ জেনে গেলে তো? রূপা খুব সুন্দর সাজাতে পারে।"
- "সেই তো? ভাবা যায় না শিল্পী দি...."
- "আমিও ভাবতে পারিনি রে শিল্পী..."
- "আরে, মমতা... এসেছিস সই...."
- "অঞ্জলিকে বাবু এত্ত সুন্দর করে সাজিয়েছে, না দেখলে বুঝতেই পারতুম না। অপূর্ব লাগছে ওকে..."
- "এ সবই সম্ভব হলো তোর জন্যে মমতা, তুই যদি ঐ সময় রাজরূপের পাশে না দাঁড়াতি, তবে এই সুপ্ত প্রতিভাটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় যেত রে।"
- "হ্যাঁ রে শিল্পী..."
(৮)
বেশ অনেকদিন পর...
- "মা, এই নাও, তোমার চা।"
- "আরে বাবু...চায়ের সাথে নোনতা সুজিও বানালি, তোর হাতে জাদু আছে, কি ভালো বানিয়েছিস.."
- "সব তোমার কাছ থেকেই তো শিখেছি মা..."
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল..
- "হ্যালো, রূপা ম্যাম বলছেন?"
- "হ্যাঁ,বলছি।"
- "রূপা ম্যাম সামনেই একটি ইভেন্ট, তার জন্য মেকআপ আর্টিস হিসাবে আপনাকেই চাই ম্যাম।"
- "নিশ্চই, আপনি 'Makeup Magician' পেইজটিতে গিয়ে আপনার পছন্দের মেকআপ প্যাকেজটা সিলেক্ট করে বুকিং কনফার্ম করে নিতে পারেন, আমি আর আমার টিম সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবো।"
- "ওহ, থ্যাংক ইউ ম্যাম। আমি বুকিং কনফার্ম করে জানবো আবার।"
- "হ্যাঁ, নিশ্চই.. রাখলাম।"
- "তুই আমার উপর রাগ করে নেই তো বাবু? আমি তোকে অনেক অ-কথা কু-কথা শুনিয়েছিলাম..."
- "না মা.... তুমিই তো আমার ব্যাকবোন, তুমি না থাকলে আমি পারতুম না মা এই লড়াইটা একা লড়তে, নাও তো এখন চা টা তো খাও, জুড়িয়ে গেলো যে...
(৯)
মমতাদেবী চা উপভোগ করতে করতে ভাবছিলেন, রাজরূপ হউক বা রূপা, হোক না রূপান্তরকামী, ওনারই তো নাড়ি ছেড়া ধন... ''রাজরূপ যখন রূপা হয়ে খুশিতে আছে, ভালো আছে এই দেখে আমিও তো ভালো আছি। রাজু আমার কথা মতো ইঞ্জিনিয়ারিংও কমপ্লিট করেছে, নিজের পরিশ্রমে নিজেকে এক সফল মেকআপ আর্টিস্ট রূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিতও করতে পেরেছে, মা হয়ে এটাই তো চাইছিলাম আমি। আমার পুরো হৃদয় জুড়ে, আমার পুরো অন্তঃকরণ জুড়ে আমার ছোট্ট সোনাটাই যে আছে, মনের গহন কোণে শুধু সে এই তো বিরাজমান আছে এবং থাকবে। এই তো আমার পরম প্রাপ্তি। ঠাকুরের কাছে সদাই তো ওর মঙ্গল কামনা করি, ঠাকুর ওকে ভালো রাখুন''।মমতাদেবীর চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু বয়ে চলছে...