STORYMIRROR

TAMIM Ŵriter

Drama Others

3  

TAMIM Ŵriter

Drama Others

নিষ্পাপ

নিষ্পাপ

7 mins
177

আমি সেই তোমাদের পাড়ার ল্যাম্পপোস্ট, আজ আমার কুড়ি বছর হয়ে গেল। কিন্তু আমি খুশি যে এই মানুষের মত বাজে প্রাণীরা আমাকে এতদিন রেখেছে। আমি প্রত্যেক সন্ধে নামলে সেই পনেরো বছর আগের দেখা এক ছেলে যে মানুষের মতো প্রাণী কিন্তু খুবই ভালো।


আমার অতীত ছিল খুবই রহস্যময়, যখন সন্ধ্যা নামে পুড়ো পাড়া অন্ধকার হয়ে যেত আমার বাতি সন্ধা নামার এক ঘন্টা পর জ্বলে উঠতো, তার আগে তো কুকুর- বিড়াল আমার সামনে এসে মল- মুত্র ত্যাগ করে,পাড়ার ছেলেরা যেতে যেতে আমার উপরে পানের পিক ফেলে চলে যেত ,কিন্তু আমার দুঃখ প্রকাশ করতে পারতাম না, তারপরে এক রোগা মাথায় ঘন চুল ও গোল চশমা পড়ে হাতে ঝাঁটা ও এক বালতি জল ও একটি পাঠের মাদুর আর বইয়ের বাক্স নিয়ে আসতো ।প্রথমে জল আর ঝাঁটা দিয়ে ধুয়ে দেয় আমার ওপরে থাকা যখন পিক ধুয়ে ফেলে তখন মনে হয় সেই ছেলেটা কে জড়িয়ে ধরি কিন্তু আমার গায়ে বিদ্যুৎ বা মানুষের মতো হাত পা নেই তাই পারি না। তারপর ছেলেটা মাদুর টা ফেলে ভগবানের নাম নিয়ে বসিয়ে বলে, "হে বিধাতা সরস্বতী মা আপনার অসংখ্য ধন্যবাদ যে এই ল্যাম্পপোস্ট টা আমার বাড়ির পাশে করেছেন আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান যে এর পাশে বসে বিদ্যা কে স্মরণ করতে পারি কারন আমার বাড়িতে আলো নেই" বলে সে পড়াশোনা শুরু করে।


কিন্তু তার সেই ধ্বনি শুনে আমি খুব খুশি হলাম কেউ তো আমার মর্ম বুঝলো। আমার যখন কিছুক্ষণ পরেই আমার আলো নিভে যায় সে তখন সেই জায়গাটাকে প্রণাম করে চলে আসত। তখন আমার চোখ জল পূর্ণ হয়ে যায় আমি মানুষ তো না কিন্তু মানুষের থেকে ভালোই অনুভব করতে পারি। আবার শুরু হয় সেই বুদ্ধিহীন মানুষের অত্যাচার গাড়ি নিয়ে যখন যায় তার টাকা দিয়ে কাদা ছিটিয়ে চলে যায় আমি পুরো রাত দিন কষ্টের মুহূর্ত পালন করতে চলেছি। সকাল হয়েছে এক কুকুর পা তুলে যখন আমার গায়ে মূত্র ত্যাগ করল তখন"যা! যা!" করে এক চেনা স্বরে কে চেঁচিয়ে উঠলেন আমি পিছন ফিরে দেখি সেই ছেলেটি যে কাল এখানে এসেছিল। সে এসে বলল, "যা এই জায়গাটা নোংরা করে দিল" বলে সে সামনে থাকা কল থেকে জল নিয়ে সেই জায়গাটা পরিষ্কার করল।


আমি তখন ছেলেটির প্রতি এত খুশি হলাম কি বলব। সেই ছেলেটা যখন হেটে হেটে চলে যাচ্ছে তখন মনে হল যেন মনুষত্ব হেঁটে চলেছে। পরের দিন আবার সন্ধ্যা হয় আমি আবার মানুষের অত্যাচারে পিরিত হয়, আমার বাতি আবার জ্বেলে উঠল, তার অনেকক্ষণ হয়ে গেল কিন্তু তখনও সেই ছেলেটি এখানে আসেনি। আমি দীর্ঘ অপেক্ষা করার পরও সেই ছেলেটি দেখা মিলল না। কিছুক্ষণ পর আমার আলো নিভে যায়, আমি নিজের চোখের জল রুখতে পারলাম না। আমি পিক, কাদা, জল, মলমূত্র সহ্য করলাম। শুধু এই ভেবে যে সেই ছেলেটি আবার আসবে কিন্তু আজ সে আসলো না। পরের দিন সকাল হয়ে গেল লোকের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল কিন্তু তখনও সেই ছেলেটির দেখা মিলল না ।পুরো এক মাস হয়ে গেল কিন্তু সেই ছেলেটি দেখা মিলল না ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে এত কুয়াশা কিছু দেখাই যায়না, স্বঃ স্বঃ বাতাস বইছে, পুরো এলাকা নিঃশব্দ আর তখন কুয়াশার মধ্যে ঝাঁটা, বালতি, আর বইয়ের বাক্স নিয়ে একটা ছেলে আসছে আমি খুবই খুশি হলাম যে সেই ছেলেটি ফিরে আসল। কিন্তু কাছে আসল যখন দেখি এ তো অন্য ছেলে, সেই ছেলেটা না, সেও নিয়মিত আমার গায়ের নোংরা কলঙ্ক ওটাকে ধুয়ে ফেলে মাদুর বিছিয়ে বসে সেই ছেলেটা বলল, "সত্যিই তো অলক আমাকে ঠিক জায়গার খোঁজ দিয়েছিলো" তো আমি সেই ভদ্র ছেলেটির নাম জানলাম "অলক" তখন আমার যেন মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করলো যে অলক কোথায়? তারপর সে পড়ে উঠে চলে গেল। তখন পাশে একজন যেতে যেতে বলল, "প্রথমে তো অলক পরিষ্কার করত আর পড়তো তাকে তো খেয়ে নিয়েছে এবার আবিরকে খাবে" সেই কথা শুনে আমার বুকে ব্যথা হয়ে ওঠে। চোখ জলপূর্ণ। পরের দিন সকালে যখন আমি ভেবেছিলাম যে আমার উপর মাটি মল-মূত্র জল ফেলা হবে তখন আমি ভুল ছিলাম পাশ দিয়ে যাওয়া একটি ছেলে যখন আমার গায়ে পিক ফেলল তখন একজন ভদ্রলোক আসে আর বললো," ছেলেটা তুমি কি দেখতে পাও না যেটা ল্যাম্পপোস্ট আর তুমি এখানে পিক ফেললে, দাঁড়াও তোমার রুমাল বার করো পকেট থেকে আর পোস্টারের গায়ে লাগা পিকটা মুছে ফেলো"সেই ছেলেটি রুমাল বার করে আমার গায়ের পিক টা মুছে ফেলল। তখন থেকে নিয়মিতভাবে কেউই আমার গায়ে পিক, নোংরা, মলমূত্র, ত্যাগ কেউ করতনা। পুরো এলাকার চোখে বদল এর দৃষ্টি এনেছে সেই অলক কিন্তু সে কীভাবে যে ভগবানের প্রিয় হয়ে গেল আমি বুঝতে পারলাম না। পুরো এক মাস এই নিয়ম চলার পর হঠাৎ একদিন রাতে আবির এসে বসে বসে পড়ছিল আর আমার পাশের পোষ্টের তার ঠিক করছিল এক কর্মচারী। আর সেই কর্মচারী টি ভুল করে আমার পোস্ট এর তার কেটে দিলো সেই তার টি ছিড়ে গিয়ে আবিরের গায়ে পরলো আমি চেঁচাতে লাগলাম, "কেউ তো একে বাঁচাও" কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পেল না আবিরের চেঁচানো শুনে সবাই আসবে কিন্তু ততক্ষণে তার প্রাণ চলে যায়। সবাই এসে দাঁড়িয়ে গেল আবিরের মা বাবার কান্না আর তখন একজন ভদ্র মানুষ এসে বলল, "দেখেছ তো আবিরের মা তোমায় বললাম এই পোষ্টের নিচে পড়তে পাঠাওনি প্রথমে তো অলক কে তারপর আবার আবির কেও খেয়ে নিল" আমি কান্না অবস্থায় চেচিয়ে বললাম, "আমার দোষ না আমি কিছু করেনি কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পারল না" কাঁদতে লাগলাম কেউই কথা শুনল না। শুধুমাত্র বাজে মন্তব্য করতে থাকলো।

আজও আমি সেই গভীর শোকে। তখন থেকে সবাই আমার উপরে নোংরা, পচা ফল, সবজি, পিক ফেলে চলে যেত। সবাই ভাবতো আমি উচিত অশুভ। আজও আমি মানুষের নজরে খারাপ আমার পায়ের তলায় কত না নোংরা ফেলে উঁচু পাহাড় করে দিয়েছে। প্রত্যেক সন্ধ্যা নামলে মনে হত সেই ঝাঁটা, বালতি, বইয়ের বাক্স নিয়ে অলক ও আবির নরম পায়ে হেঁটে হেঁটে আসছে।

আজ কুড়ি বছর পরে এই রাস্তা বড়, চওড়া করার নোটিশ পরল তখন আমার মুখে এক সরকারি কাগজ আটকে দিল। একদিন এক নোংরা তোলার গাড়ি এসে আমার সামনে থেকে নোংরা তুলতে লাগল। আমি তখন ভাবলাম যে আজ আমাকে এই নোংরা থেকে মুক্তি করছে ঠিক অলক ও আবিরের রূপে অন্য একজন এসেছে। আমার সামনে থেকে নোংরা যখন তুলছেন তখন আবিরের মা চেঁচিয়ে বলল, "ভাই কবে নিয়ে যাবে পোস্টটাকে?" কর্মচারীটি বলল, "এই কয়েকদিন মানে সপ্তাহ খানিক পরে" আবিরের মা বলল, "হ্যাঁ ভাই নিয়ে যাও আর চাইনা এমন ল্যাম্পপোস্ট আলো দেয় না প্রাণ নেই আবার কাদের জানো যারা একে নোংরা হতে বাঁচায় তাদের। আমাদের দুই পাখি অলক আবিরকে এই তো মারল" বলে তিনি চোখে জল পূর্ণ অবস্থায় চলে গেল। তখন আমার যদি মানুষের মতো মুখ থাকত তো চিৎকার করে কাঁদতাম। তখন আমি না বলতে পারায় ভগবানকে দোষ দিচ্ছি, যে আমাদেরকে মানুষের মতো ভাবনা প্রকাশ করার কিছু দেও নি আর মানুষকে দিয়েছে তো সে সেই ভাবনার ভুল প্রকাশ করছে । মানুষের যত চাহিদা মেটায় আমরা। জল না পান করলে মানুষ বাঁচবে না তবুও জলকে অপচয় করছে, গাছ মানুষকে অক্সিজেন দেয় যার থেকে তারা বেঁচে আছে কিন্তু তবুও মানুষ গাছ কাটছে, আর আমার সাথে কি হলো একজন মানুষ আমার তার কেটে দিল আর কত যে আমারই দোষ, হল কারন আমার তার আমাদের কি মানুষের মত হাত আছে যে ধরে নেব। আমাদের কি ভাবনা প্রকাশ করার কোন অঙ্গ আছে, নেই না, তাহলে আমরা কি করব। আমার মুখের উপর আটকে থাকা কাগজ হাওয়ায় উড়ে চলে গেল। দিনরাত মানুষের মুখের মন্তব্য না শুনে থাকতে পারতাম না, কেউ তো আর ভাল মন্তব্য জারি করত না সবার মুখে অশুভ পোষ্ট নামে শুনতে পেতাম। আমাদের অনুভব নেই আমরা জড়বস্তু আমরা সেই জড়বস্তু যে মানুষের দ্বারা খারাপ হয়ে গেছি আজও আমার দুই নয়নের তারা অলক আবিরের কথা মনে পরে আর বুকটা জ্বালা করে ওঠে। তারা কেমন ভাবে আমার উপর থেকে পিক, কাদা, মূত্র পরিষ্কার করত। সব মানুষের মধ্যেই মায়া আছে কেউ প্রকাশ করে আর কেউ তো মায়া কে মায়া জাল হিসেবেই দেখে। আজ দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেল আজ, আজই আমাকে, আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা সামনে দেখি এক পুরসভার গাড়ি আসছে, গাড়িটি প্রথমে দেখে আমার মনটা ভেঙ্গে গেল কেমন যেন হচ্ছিল। গাড়িটি প্রথমে এসে থামল আমার সামনে, পুরো পাড়া তখন খুশি যে আমাকে নিয়ে চলে যাবে সবার মন্তব্য শুরু তখন হঠাৎ আবিরের মা এসে বলল, "দাঁড়াও ভাই এই পোস্টকে তুলে নিচ্ছে খুব শুভ কাজ নারিকেল ভেঙে তারপরে কাজ শুরু করতে হবে" সবাই খুশী বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ জলদি ভাঙ" আমি কাঁদছি। আবিরের মা নারকোল ভেঙ্গে বলল, "চলো কাজ শুরু করো" কর্মচারীরা যখন সব জিনিস পত্র আনতে গেল। আমি চিৎকার করে কাঁদছি আর বলছি, "আমায় কাটবে না দয়া করে, আমার অলক আবির এখানেই বসে পড়তো, আর তো কেউ আসবে না, এখন সবার বাড়িতে আলো এসে গেছে আমাকে এখানে থাকতে দাও" কিন্তু কেউ শুনতে পারল না। তখন এক বাচ্চা এসে বলল," মা পোস্ট এর কি কোন অনুভব হয় না" তার মা বলল, "কেন?" বাচ্চাটি বলল, "তোমরা কি জানো যে আবিরকে কে? মেরেছে, সেই পোস্ট কর্মী টা ভুল করে এই পোষ্টের তার কেটে দেয় তাই আবিরের মৃত্যু হয় এই পোস্টের কোন দোষ নেই" সবাই হতভম্ব হয়ে গেল, সব একেবারে চুপ, আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম তার মা বলল," তুই কি করে জানলি তোকে কে বললো তখন সেই ছেলেটি তার বাম দিকের আঙ্গুল তুলে বলল ওই তো ওইখান থেকে অলক ও আবির বলল" মা তাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল সবাই সেখান থেকে চলে গেল পুড়ো পাড়া নিঃশব্দ হয়ে গেল, সেইসব কর্মচারীরা জিনিসপত্র নিয়ে আসলো পুড়ো পাড়া বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে পুরো দড়ি বেঁধে যখন প্রথম করাত দিয়ে আমার গায়ে কাটতে লাগল তখন আমার চোখ থেকে জল বার হয়নি তখন আমি খুব খুশি ছিলাম কারণ অলক ও আবিরের চোখে আমি তখনও ভালো ছিলাম, আমাকে কেটে পৌরসভার গোডাউনে ফেলে দেয়। এটাই তো বাস্তব অতীত যতই ভালো হোক ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা বলা যায় না, আমাদের দেশে সেই অলক ও আবিরের মত ছেলে চাই। আমার অলক আবিরের সম্পর্ক অতীতের সম্পর্ক যার কোনো ভবিষ্যত নেই।



Rate this content
Log in

More bengali story from TAMIM Ŵriter

Similar bengali story from Drama