Shabab S

Drama Tragedy

3  

Shabab S

Drama Tragedy

নেপথ‍্যে

নেপথ‍্যে

5 mins
9.6K


১।।

ঘুম না এলেও দেওয়াল ঘেঁষে চোখ টিপে জিভ কামড়ে বিছানায় লেপ্টে থাকে মণি। মেঝের উপর মা তখনো গোঙাচ্ছে,নাইটি-টা কাঁধ থেকে ছিঁড়ে নেমে এসে কোমরের কাছে জড়ো হয়ে আছে। কলতলার টিমটিমে হলদে আলো ঘরের মধ‍্যে আরো খানিকটা ময়লা হ‍য়ে ঢুকে মায়ের গায়ে আলগোছে পরেছে, বাঁ দিকে মুখের কাছটা ফুলে গেছে ভীষণ, খয়েরী রক্তর ছোপ মুখে, কাঁধে, হাতে। দরজাটা আছড়ে বন্ধ করার শব্দে মণি নেমে আসে, গেলাসে জল নিয়ে গিয়ে মায়ের পাশে বসে, ভিজে গামছা দিয়ে চেপে ধরে ঠোঁটের কোণটা, তারপর সাবধানে ক্ষত বাঁচিয়ে জড়িয়ে ধরে গলা।ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মা আর বোবা মণির গলার কাছে জমে থাকা কষ্ট সব ভীষণ ধারায় নোনা পানি হয়ে নামতে থাকে। আশেপাশের বাড়িগুলির থেকে ভেসে আসে জানালা বন্ধের সাবধানী আওয়াজ‌... মণি প্রত‍্যেক বারের মতন টের পায় যে ওরা জানে, শোনে, দেখে কিন্তু আটকায় না..বাঁচায় না..আওয়াজ-টুকুও তোলে না..ওরাও সব তারি মতন বোবা।

২।।

বাস-স্ট‍্যান্ডের গা লাগোয়া পান গুমটির নরেন পাল যেদিন জুয়ার আসর থেকে আর বাড়ি ফিরল না তখন তার মেয়ের বয়স মোটে বারো আর বৌটিও নেহাতি নিরীহ আর ঘরোয়া, তায় আবার যুবতী ও সুন্দরী। দোকান চালানো কী ব‍্যবসা কারবারে একেবারেই আনাড়ি। তার ওপর আরো একটি কোলের মেয়ে তার মাসখানেকও হয়নি আচমকা একদিন খাট থেকে গরিয়ে পড়ে মাথায় চোট পেয়ে চিরতরে চলে গিয়ে থেকে সে যেন কেমনতরো পাথর হয়ে গেছিল। তাই পরেরদিন জুয়ার আড্ডা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ট্রান্সরমারের নীচের থেকে যখন নরেনের বডিটা পাওয়া গেল তার মেয়ের শোকে আধপাগল বৌ এর তখন আর আলাদা করে কোনো নতুন করে কোনো শোকের উদ্রেক কেউ দেখল না, কেবল বোবা বড় মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল, মরা স্বামীকে একবাট্টি ছুঁয়েও দেখলে না সে। সিঁদুর ঘুচলেও কপালের পাশে মরা স্বামীর আগের রাতের মারের দাগখানা লাল হয়ে জ্বলছে তখনো।

শ্রাদ্ধশান্তির রসদ তল্লাশি করতে করতে নরেনের বালিশের তলায়, আর আলমারীর লকার ঘেঁটে নয়নয় করেও হাজার তিরিশেক টাকা যখন বের করলেন হিতৈষীরা তখন দেখা গেল অনেকের-ই মনে পরে গেল যে নরেন কার কাছে কত টাকা কবে ঋণ করেছিল। মরা মানুষের ঋণমুক্তি না হলে আত্মার-ও মুক্তি ঘটে না তাই নরেনের পরিবারের এই ঘোর বিপদের সময়-ও একরকম বাধ‍্য হয়েই তারা টাকাগুলি পকেটস্থ করলেন। বডির মাথার পিছনে গভীর আঘাতের উৎস খুঁজতে গিয়ে পুলিস যখন নরেনের জুয়ারি স‍্যাঙাৎ বা খাতকদের সাথেসাথে কোনো পাওনাদার ছিল কিনা তার খোঁজ নিতে এল, তখন অবশ‍্য এদের মধ‍্যে আর কাউকে দেখা গেল না। নরেনের বৌ এর এলোমেলো মনে এসবের কোনো হিসেব ছিল না, আর যে ছোট মেয়েটির চোখ আর মন সবটুকুর হিসেব রেখেছিল তার ভাষা ছিল না।

সবকিছু মিটে যাবার পরেও দোকানটাতে মাকে নিয়ে বসেওছিল সে মাস দশেক। মাও চেষ্টা করছিলেন স্বাভাবিক হতে, খদ্দেরদের সঙ্গে টুকটাক কথা, হিসেব রাখা। কেউ মরা নরেনের নামে পুরোনো ধার-কর্জের দাবী আনলে পুলিসের নাম করে তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো অথবা কোনো খদ্দের বোবা মেয়ের বিধবা মা দেখে গায়ে পরে আহ্লাদ নেবার চেষ্টা করলে সেখানেও কাউকে পাত্তা করতে দিত না, কিন্তু কী করে যেন পাত্তা পেয়ে গেল সুরেন। সুরেন দাস। বাস-স্ট‍্যান্ডের পাশের সাইকেলের গ‍্যারাজে ঠিকেয় কাজ করত, মাঝে মাঝেই বিড়ি অথবা পানমশলার প‍্যাকেট নিতে,আর গল্প জুড়ত হাজার রকম। সে মদ খায় না, জুয়াও খেলে না।বড় ভাল লোক। আগ বাড়িয়েই এনে দিত দোকানের মাল, বা বাড়ির বাজার। মণি যখন মাকে আস্তে আস্তে ভাল হয়ে উঠতে দেখে ফের ইস্কুল যেতে শুরূ করল তখন ভালমানুষ সুরেন যেন আরো বেশী আপনার হয়ে উঠেছিল। মণি যখন বুঝল তখন বোঝাতে চেয়েছিল মাকে যে লোকটার নজর যেন কেমন, লোকটা যখন তাকে আদর করে তার ছোঁয়াটাও যেন ঠিক না কিন্তু মণির ভাষা নেই আর ভঙ্গী-টুকু মার চোখে পড়লো না। সাইকেল গ‍্যারেজের কর্মচারী যখন বিধবা মালকিনকে বিয়ে করে চলতি গুমটির মালিক হয়ে বসলো , তার ভালোমানুষির রঙ এর পরত খসে পরতে খুব বেশী সময় নিল না, তাও বছর ঘুরতে না ঘুরতে। দোকানের দায়ীত্ব যেচে নিয়েছিল সে, তারপর টাকাপয়সার গরমিল দেখে, সংসার খরচের টাকা বা মণির লেখাপড়ার টাকাটুকুতেও যখন টান পরতে লাগল, আর ভালমানুষ স্বামীর বিভিন্ন বদ নেশার কথা কানে আসতে লাগল, মণির মা চেষ্টা করেছিলেন আরো একবার ঘুরে দাঁড়ানোর, কিন্তু দোকানের সামনে থেকে অন্তত পচিঁশ তিরিশ জন লোকের সামনে দিনে দুপুরে তাকে রাস্তায় ফেলে মারলেও কেউ এগিয়ে আসেনি, অন্তত সুরেন তাকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত‌। মণির গায়ে যখন তখন হাত দেওয়াতেও কসুর করে না সে। আর প্রায় প্রত‍্যেক রাতে মণির ঘুমের ভান করে পরে থাকা শরীরে থাবা বাড়াবার চেষ্ট আর বাধা পেলেই তার মায়ের শরীরটাকে শ্বাপদ ক্ষিপ্রতায় ফালাফালা করা। মণি আটকানোর চেষ্টা করেও পারত না। সেদিন রাতেও মণিকে বাঁচাতে গিয়ে মার খাচ্ছিল মা। লম্বা চুলের গোছা ধরে বার বার দেওয়ালে মাথা ঠুকে প্রায় আধম‍রা করে ফেলে রেখে যখন ঝড়ের মতন বেরিয়ে গেল সুরেন, মণি আস্তে আস্তে নেমে এল মায়ের পাশে, জল খাইয়ে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একবার গেল রান্নাঘরে তারপর বেড়িয়ে গেল বাইরে -----যেমনটা গেছিল বছর দুয়েক আগে যেদিন তার বাবা অনান‍্য দিনের মত মারছিল মাকে, আর তারপর মুঠোয় টাকা নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিল জুয়ার ঠেকে‌।

তারও মাসখানেক আগে যেদিন মাকে মেঝেতে ফেলে লাথি মারছিল নরেন, ভয়ে বিছানায় চুপ করে ঘুমের ভান করে পরেছিল সে, তার কোল ঘেঁষে শুয়েছিল বছর দুয়েকের ছোট বোনটা..হঠাৎ চিৎকারে ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠেছিল সে আর সঙ্গে সঙ্গে মাতাল নরেনের বিরক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল একটা বোবা মেয়ের উপর আরো একটা মেয়ে হবার দুঃখ। পা ধরে আচমকা হিঁচড়ে টেনে নিয়ে আছাড় মেরেছিল সজোড়ে দেওয়ালে..কচি গলার কান্না নিমেষে থেমে গিয়েছিল। পরেরদিন নিজেই রটিয়েছিল মেয়ে খাট থেকে গড়িয়ে পরে গেছিল। মাকে ভয় দেখিয়েছিল মুখ খুললে মণিকেও.... আর মণির মুখ খোলার উপায় ছিল না, শুধু হাত পা নেড়ে যখন বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল বুঝেছিল এরা বুঝতে পারে, সব জানে..শুধু মুখ খোলে না, প্রতিবাদ করে না...এরাও সকলে স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে বোবা হয়ে যেতে পারে। মণিও বুঝে নিয়েছিল বোবার শত্রু নেই আর নিজের আওয়াজ নিজেকেই তুলতে হয়.। তাই মাস ঘুরতে না ঘুরতে নরেনের মাতাল পৌরূষ যখন চাপ চাপ রক্ত হয়ে তার মায়ের সারা গায়ে ফুটে উঠতে লাগল , মণি আর অপেক্ষা করার বিলাসিতা দেখাতে পারে নি....রান্নাঘরর কোণায় রাখা নালি পরিস্কারের মোটা লোহার রডটা টেনে নিয়ে বেড়িয়ে গেছিল নরেনের পিছু পিছ....... ঠিক আজ যেমন চুপিসারে সুরেনকে ধাওয়া করে এগিয়ে গেল সে.. কিছুটা দূরত্ব আর আড়াল রেখে .. যতক্ষণ না বাস-স্ট‍্যান্ডের আওতা পেরিয়ে বড় জল- ট‍্যাংকের পিছনের দিকে গিয়ে প‍্যান্টের চেন নামায় হালকা হবার জন‍্য.. আর সেই সুযোগে এগিয়ে যায় মণি

৩।।

সুরেনের বডিটা পরেরদিন সকাল ছ-টা নাগাদ প্রথম দেখ দেখেছিল ইউসুফ রুটিওলা..উপুড় হয়ে পরেছিল, প‍্যান্ট নামানো..আর মাথার পিছন জুড়ে জমাট বেঁধে চাপ রক্ত।


Rate this content
Log in

More bengali story from Shabab S

Similar bengali story from Drama