মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু'টি চোখে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু'টি চোখে
''হেই''
এভাবেই শুরু আমাদের।
আমি ব্যস্ত ছিলাম তখন খুব। সারাদিনের কাজ শেষে ফেইক আইডিতে ঢোকাও হয়নি আর তোমার মেসেজের উত্তরও করা হয়নি।
মাঝরাত্তিরে ঘুম ভাঙল। আমি পানি খাইনা; ঘুম না এলে মাথাটা হালকা ধুয়ে ফেলি; গর্দান, গলা, কান, বগলের তল, পানি দিয়ে মাসেহ করি; আর মুখ-হাত-পা ধুয়ে ফ্যানের নিচে বসি বা দাঁড়াই। এতে কেউ যেন আবার আমাকে মুহাম্মদের সুন্নতের একনিষ্ঠ ভক্ত না ভাবেন। আমি হলাম গিয়ে গৌতম বুদ্ধের জানপ্রাণ ভক্ত। বুদ্ধ হলেন শান্তি আর প্রগতির ধারক। ফ্যানের নিচে হাতে গামছা নিয়ে ফেইক আইডিতে ঢু মারলাম। অনেকগুলো আবেদনময় মেসেজ, বিনা কারণে তোমাকে রিপ্লাই দিলাম। সেই শুরু।
২০০২ সাল।
আমি প্রথম চোখের প্রেমে পড়ি। গান শুনি, চোখ যে মনের কথা বলে। গানটাকে মোটেও অর্থবহ মনে হয়নি তখন। তবে ভাবনা শুরু হয়। কিশোর গোয়েন্দা পড়ে জানতে পারি, চোখ দেখে মন পড়া যায়। অপরাধবিজ্ঞানীরা চোখের ভাষার অনুবাদ পড়তে পারেন। চোখ দেখে যে প্রেমে পড়া যায়, তা তখন ভাবিওনি, কোথাও পড়িওনি বা গানও শুনিনি। এটা ঠিক যে, আমার আর্থিক অবস্থা গান শুনতে পারার জন্য রেডিও কিবা ক্যাসেট প্লেয়ার কেনার বিপক্ষে ছিল। মোদ্দাকথা হল, ক্লাস টেন অবধি আমি চোখের ভাষা নিয়ে জানতাম।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর চাকরি জীবন; এই তিন জীবনে চোখের বেশ বিশদ রুপ আবিষ্কার করি। চোখের কাটা কাটা সৌন্দর্য, চোখ কি কাউকে কাটতে পারে? চোখ নাকি মনে দাগ কাটে? চোখ কি হৃদয়ের চেয়েও ধারালো নাকি হৃদয় নিজেই চোখের জন্য ধারসহ হয়? এসব জানাশোনা হয়।
পটলচেরা চোখের কথাও পড়লাম, শুনলাম, ও দেখলাম। কিন্তু পটলচেরার মানে বুঝিনি। পটল তো অনেক বড়, অন্তত মানবচক্ষুর চেয়ে। ওকে অর্ধেক করলে বা চিরে ফেললে যা হয় চোখ তারচয়েও ঢের ছোট বটে। যাহোক, জানার থলিতে জমা রাখলাম।
এবার বলি যৌনাবেদনময় চোখের কথা। যৌনাবেদনময় শব্দটার মূল কিন্তু যোনি। তাহলে যে চোখ যোনির দিকে আকৃষ্ট করে সেই চোখই কি যৌনাবেদনময় চোখ? অর্থটা বেশ খারাপ হল বটে।
এসব বাতুল কথাবার্তার মূল উদ্দেশ্য তোমার চোখের যে আছর ওপর হয়েছিল, তার প্রকৃতি ডাইসেক্ট করা।
তারপর তোমার সাথে সারারাত চ্যাট হল। সারারাত নয়, ভোর অব্দি। আমরা বোধহয় বেশ স্পিরিচুয়াল ছিলাম। ফেইক আইডিতে সাধারণত যৌনতা সংক্রান্ত কথা হয়। অন্তত আমি নিজে সবসময় এসব বিষয় নিয়েই কথা বলতাম। তোমার আমার চ্যাট ছিল সভ্য। আমরা দেখা করতে রাজি হলাম।
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১।
সকাল ১০ টা।
তুমি আমি উত্তজিত।
সেবার সাজেক যাচ্ছি।
কক্সবাজার থেকে পূরবী সার্ভিসে করে সোজা রাঙ্গামাটি শহর। শহর থেকে জীপে মিনস চান্দের গাড়িতে করে সাজেক। মেঘের দেশ।
আমাদের ড্রাইভার মিং। ধুরন্দর কাবিল। "উড়াইয়া দে" স্লোগানটা চট্টগ্রামী ভাষায় হবে, "উরাই দে"। সে উরাই দিচ্ছিল গাড়ি। রাস্তা তো আর রাস্তা নয়, মনে হয় আমরা রোলার কোস্টারে। এরকম উরাই দেওয়া একটা জার্নিতে সহভ্রমক কেনি গেয়ে উঠে, " কি নামে ডেকে, বলব তোমাকে, মন্দ করেছে আমাকে, ঐ দু'টি চোখে"। ঠিক তখনি আমি বুঝতে পারি,একেবারেই প্রথমবারের মত,আমি কতটা মন্দভাবে তোমার চোখের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
পুনশ্চঃ আচ্ছা,একসাথে ভ্রমণের সহযাত্রী কে বা ভ্রমনসঙ্গীকে কি সহযাত্রী বলা যায়?কবি আলমাহমুদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করার প্রতিবাদে আমি আমার সমস্ত অভিধান পুড়িয়ে ফেলায় একটু বিপদে আছি দেখলাম।
তুমি ১০ টার বদলে ১১টায় এসে হাজির। বলেছিলে, মা'কে দাঁতের ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলে। কী চমৎকার একটা পবিত্র ভাব নিয়ে তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়ালে। আমি তোমার চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবছিলাম কবি হাফিজ কি তবে আরকেটু ভাবতে পারতেন?
কবি হাফিজ লিখেছিলেন,
"আগর আ দুস্ত শিরাজরে, বদস্ত আরদ দিলে মারা
বখালে হিন্দয়শ বখশম, সমরকন্দ ওয়া বুখারা।"
আর আমিও তোমাকে নিয়ে লিখলাম,
"তোমার চোখে রেখে চোখ
শিরদাঁড়া সোজা
দাঁড়াব আমি
সহস্র হিরোশিমা গলে যাক
হারাবেনা তুমি;
তুমি আমারই
তোমাতে আমাতে হয়ে গেছে যোগ
তুমি আমার এক আজীবন ঝোঁক।"
হাফিজের সামনে আমার এই কবিতা মিউ মিউ করবে, তাতে কি, এ আমার প্রেমের জন্য আমার কথা। তুমি আমার, আমার ঐ ভাঙা চোরা কবিতাও আমার।

