STORYMIRROR

অরি 🌝

Inspirational Others Children

3  

অরি 🌝

Inspirational Others Children

লাল দেওয়াল

লাল দেওয়াল

6 mins
179


কাজ থেকে ফিরে এসেই অনিরুদ্ধ লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিলো । সারাদিন অফিসের বসের কিচকিচ বাড়িতে তনিমার পেচপেচ.... শুনে শুনে ও ভীষণ ক্লান্ত । প্রতিদিন ওই এক রুটিন ।


তনিমা এখন বেডরুমে শুয়ে আছে । ও অনিরুদ্ধর জন্য ডিনার টেবিলে সাজিয়ে চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছে শুতে যাওয়ার আগে । আসলে অনিরুদ্ধর প্রায় সব দিনই আসতে লেট হওয়ায় ও নিজেই তনিমাকে বলেছিলো ওর জন্য ওয়েট না করতে । প্রথম প্রথম তনিমা মানা করলেও পরে ওর কথা শুনে ওর কথা মতোই কাজ করতে লাগলো ।


ওদের বিয়ের বেশি বছর না হলেও এই প্রথমদিককার মতো এখন ওরা অতটাও সময়কাটাতে পারে না । তাই নিয়ে ওর আর তনিমার মধ্যে প্রায় বাগবিতোন্ডা বাধে । ও জানে তনিমা ওর জায়গা দিয়ে ভুল না । কিন্তু অফিসের চাপে আর বাস ট্যাক্সির নিত্য দৈহিক পরিশ্রমের জন্য ও তনিমাকে সময়ে দিতে পারে না ।


এইসবই ওর মাথায় ঘুরছে... তখন ওর নজর গিয়ে পড়লো সোফার বিপরীতের ওই লাল দেয়ালে টাঙানো ওর ছেলেবেলার ফটোতে ।

তনিমার লাল রং প্রিয় বলে ওরা নতুন ফ্ল্যাটে লিভিং রুমে একটা দেয়ালের রং লাল রাখে... আর তাতে তনিমা নিজের ক্রিয়েটিভিটি লাগিয়ে এই নানারকম আকৃতির ফটোফ্রেম ও আরো নানা রকম দেয়াল সাজানোর উপকরণ ব্যবহার করে ওই দেওয়ালকে সাজিয়েছিল ।


ফটোটা ও ওর মা বাবার সাথে দিঘার সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে তুলেছিল.... যখন ও ক্লাস ফাইভ এ পরে । ওর মনে পড়লো... ও আর ওর মা প্রতিদিন ওর বাপিকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও ওদের সাথে সময়ে কাটানোর জন্য বলতো... কিন্তু ওর বাপি ফায়ার ডিপার্টমেন্টে কাজ করায়... যখন তখন ছুটি ম্যানেজ করতে পারতেন না । ফলে প্রায়শই ওর বাপি আর মায়ের মধ্যে এই নিয়ে ঝামেলা হতো । পরে অবশ্যই ওর বাপি ওর মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মিটমাট করে নিতেন আর ওকেও নানারকম জিনিসের ঘুষ দিয়ে মানিয়ে নিতেন । এইটা মনে পড়তেই ওর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । তখন জীবন কত সরল ছিল । এখন কার মতো এতো জটিলতা... সমস্যায় মোড়া ছিল না । তখন ওর যা লাগতো বাপির কাছে আবদার করলে পেয়ে যেত । অবশ্যই সে আবদার মোটেই অন্যায় আবদার ছিল না । ওর বাপি ওকে সব দিলেও সেটাই দিতো যা ছিল প্রয়োজনীয় । বাড়তি কোনো কিছুই ওর বাপি ওকে দিতেন না । 




ক্লাস ফাইভ এ গরমের ছুটির সময়ে একদিন ও আর ওর মা জেদ ধরে যে ওদের দীঘা নিয়ে যেতেই হবে ঘুরতে এই গরমের ছুটিতে । না নিয়ে গেলে ওরা অনশন করবে । অনিরুদ্ধের বাবা দুজনকে হাজার বুঝিয়ে শেষমেশ হার মেনে ঠিক করেন যে ওদের ঘুরতে নিয়ে যাবেন । অন্তত পাঁচ দিনের জন্য হলেও নিয়ে যাবেন ।

সেদিন অনিরুদ্ধ আর ওর মা খুব আনন্দ করেছিল ওদের এই ছোট জয়ের খুশিতে ।


দেখতে দেখতে ওদের দীঘা যাবার সময় চলে এলো । ওরা দীঘা বাসে করে যাবে ঠিক করেছিল। পরেরদিন সকালে সাতটায় বাস ছাড়বে । সেদিন ও আনন্দ আর উত্তেজনার বশে 

শুতে পারছিলো না । আসলে বলা ভালো সেইরাত নিদ্রাদেবী ওর চোখে ভর করেননি ওর আনন্দ দেখে ! ও শেষমেশ উঠে বসার ঘরে গিয়ে দেখে ওর বাবা আর মা কিছু নিয়ে আলোচনা করছে ।


ও ওখান থেকে চলে না গিয়ে চুপটি মেরে ওদের কথা শুনতে থাকে । বেশকিছুক্ষন ওর বাবা মা এদিক ওদিকের কথা বলছিলো... শেষে ও উঠে নিজের ঘরে যাবে তখনই ও শুনতে পেলো....


-" কি গো... শোনো তোমার এতদিনের ছুটি ম্যানেজ কি করে করলে? পরে চাকরিতে টানাটানি হবে না তো ? "


- " না... না... একটুআধটু সমস্যা হবে সে আমি না হয় ম্যানেজ করে নেবো । কিন্তু তুমি দেখলে.. 

ছেলে আমাদের ঘুরতে যাবে শুনে কত আনন্দ পেয়েছিলো! "


-" সে আর বলতে... বাবুর জন্যই আমিও তোমায় জোরাজুরি করি.. তুমি কি রাগ করেছো? "


- " আহঃ! রাগ করবো কেন? দেখো ও ওর জায়গায় ঠিক । আর আমি সত্যিই তোমাদেরকে একদমই সময় দিতে পারিনা... আমি ভেবে দেখলাম কাজের চাপ তো সবসময় থাকবে.. কিন্তু পরিবারের সাথে এইরকম সময় কাটানোর সুযোগ আবার কবে পাবো তার ঠিক নেই তাই আমিও ঠিক করি এবার আমরা সবাই ঘুরতে যাবো । আনন্দ মজা হইহুড়লোর করবো সবাই মিলে ।"


- " তুমি না খুব ভালো জানো । "


-" বাবা গিন্নি... তুমি আজ জানলে তোমার বর কত ভালো!"


-" ধ্যাৎ!খালি মজা... যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো কাল তাড়াতাড়ি উঠে বেরোতে হবে । "


-" যো হুকুম গিন্নি । "


বলে ওনারা শুতে চলে গেলেন ।


অনিরুদ্ধ সব কথা শোনে... ওর খুব ভালো লেগেছিলো যে ওর বাবা ওদের এতো ভালোবাসে । ও ঠিক করেছিল ও একদম ওর বাপির মতো হবে বড়ো হয়ে । ও নিজের পরিবারকে সময় দেবে ।


এইসব মনে পড়তেই অনিরুদ্ধ একটু নড়ে উঠে ঠিক হয়ে সোফায় বসলো ।মনের মধ্যে কিছু একটা ভেবে নিয়ে ও ফোন হাতে নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো ।


পরেরদিন রোববার হওয়ায় ওর অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই । ও প্রায় সাড়ে আটটার কাছে ঘুম থেকে উঠলো । দেখলো তনিমা অনেক আগেই উঠে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে কিচেনে । ও মনে মনে হেসে উঠে ফ্রেস হতে গেলো ।


প্রায় নটার কাছে তনিমা ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকলে.. ও ডাইনিং এ আসে তারপর দুজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসে ।


অন্যান্যদিনের মতোই ওরা কথা বলতে বলতে খাচ্ছিলো... তখন ও তনিমাকে বলল ওদের দুজনের বাবা-মা আজকে দুপুরে আসবে.... লাঞ্চে । তনিমা কিছু একটা ভাবলো... তারপর বললো..


-" মা বাবা আসছে তাহলে তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে বাজারে যাও আর মাছ আর বাকি জিনিস নিয়ে এস। আমি রান্না শুরু করি । নাহলে ওদের আসার আগে শেষ হবে না । "


-" আহঃ...! তনু শান্ত হও তো । ওরা বাইরের কোনো লোক না । ওরা আমাদের আপন তাই ওতো হুরুহুড়ি করার কিছু নেই। আর দুই মায়েরাই বলেছে আজকে ওনারা ওনাদের স্পেশাল কিছু রান্না নিয়ে আসবে তাই তুমি ওতো টেনশন নিও না । সব হয়ে যাবে বেশি কিছু বানাতে হবে না । তুমি আরামসে ধীরে সুস্থে কাজ করো । " বলে ও খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে চলে গেলো ।



দুপুরে....


বেলের ট্রিং ট্রিং আওয়াজে... তনিমা তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলতে গেলো... দরজা খুলে ও চমকে গেলো ।


-" বান্টি.... সারিকা... তোরা আর মা বাবা.....! তোরা আসবি অনি বলেনি.... ধুরর তোমরা সকলে বাইরে না দাঁড়িয়ে ভেতরে আসো ।"


সবাই মুচকি মেরে হাসতে হাসতে ঘরের ভিতরে ঢুকলো । এরই মধ্যে অনিরুদ্ধ বেরিয়ে এলে....


-" বাহঃ তোমরা... চলে এসেছো! আচ্ছা আসার সময় কোনো অসুবিধা হয়নি তো? "


-" না গো জিজু আমরা সবাই একসাথেই এসেছি । কোনো সমস্যা হয়নি । "


-" হ্যাঁ রে আমরা সবাই বেশ মজা করতে করতে এলাম । চলো এবার একটু আড্ডা দেওয়া যাক সকলে মিলে । আর তনু মা তুমি কিছু বলছো না কেন? আমাদের আসা কি তোমার ভালো লাগেনি?"


-" না... বাবা এরম কিছু না । উল্টে তোমরা আসায় আমি খুব খুশি আমি তো সারাদিনই একা থাকি । আমার ভালো লাগে না । আমি শুধু বেশ চমকে গেছি তাই । তোমরা আসায় আমার খুব ভালো লাগলো । কিন্তু এরম করে হঠাৎ করে সবাই একসাথে? "


- " আররে তোর মন ভালো করার জন্য কাল রাতে জিজু আমাদের সকলকে ফোন করে ডেকেছিল । বললো তনুর মন একদমই ভালো নেই আমরা জেনো কাল সকালেই চলে আসি। কিন্তু সবার সময়ের সমস্যার জন্য আমরা দুপুরে এলাম। কেমন লাগলো এই সারপ্রাইজ দি? "


-" খুব ভালো । " জল ভর্তি চোখে মুখে হাসি নিয়ে তনিমা বললো । তারপর অনিরুদ্ধের দিকে তাকালে ও ওকে চোখ মেরে দিলে ও চোখ বড়ো বড়ো করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল ।


এরপর ওরা সকলে সেই সারাটাদিন আড্ডা দিয়ে মজা করে নানারকম খেলা খেলে একেবারে রাতে ডিনার করে চলে যায় ।


ঐদিনের পর দিয়ে সকলেই প্রতি রোববার একসাথে দেখা করে আর সারাটাদিন একসাথে কাটায় ।


আজ শনিবার তনিমা ওই লাল দেয়ালে কিছু নতুন ফটো লাগছিলো... কাজ শেষ করে ও চলে গেলে অনিরুদ্ধ দূর থেকে ওই লাল দেয়ালে টাঙানো নতুন ছবিগুলোর দিকে দেখছিলো । ছবি গুলো সব ওদের সেইদিনকার একসাথে তোলা । একটা প্রশান্তির হাসি ওর ঠোঁটে ছেয়ে গেলো ।







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational