Partha Pratim Guha Neogy

Romance Tragedy

4.5  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Tragedy

জীবনের আসল নির্যাস

জীবনের আসল নির্যাস

8 mins
590


বই পড়ার নেশা একটা কঠিন নেশা- এতে মন বড় তৃপ্ত হয়। সবচেয়ে বড় আনন্দ হল পরিতৃপ্তি, যেটা বোধহয় একটা ভালো বই পড়ার আনন্দেই পাওয়া সম্ভব। এই অন্তর্নিহিত আনন্দের জন্য বার বার ছুটে আসা এই বই পাড়ায়। এখানে ঘুরতে পারলে মন একদম ভরে যায়, চারিদিক বইতে ভর্তি - ভাবতেই সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। এরকম বই দেখতে দেখতে হাত গেল পুরানো একটা বইয়ের দিকে। 


পুরনো একটা বইয়ের মলাট উল্টে চমকে গেলাম। অন্য কারো ক্ষেত্রে কি ঘটতো জানি না, আমার বেলায় তাই ঘটলো। ১৯৮৭ সালে বইটি একজন স্বামী তার স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলো। রুশ উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ বই। কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের বাজার থেকে সস্তায় দুর্লভ বই কেনার শখ আমার অনেক দিনের। পুরনো বইয়ের গন্ধ আমাকে মাতাল করে, অদ্ভুত এক টান পুরনো বইয়ের প্রতি। এখানে এমন বই পাওয়া যায় যা এখন আর লাইব্রেরীতে বিক্রি হয় না। বইটির নাম দময়ন্তী । প্রচ্ছদে সবুজ ফসলের মাঠে এক জীবন সংগ্রামী নারীর ছবি। বাংলায় অনুবাদের কারণেই হয়তো প্রচ্ছদ শিল্পী এক বাঙালি নারীর মুখ কল্পনা করে এঁকেছেন। আর নাম দময়ন্তী হওয়ার কারণে মনেই হচ্ছিলো না বইটি অনুবাদ। আসল কথায় আসি, চমকে গেলাম বইয়ের মলাট উল্টে। একত্রিশ বছর আগে স্বামী তার স্ত্রীকে বইটি উপহার দিয়েছিলো, স্ত্রীকে কিছু আবেগের কথা লেখা আছে প্রচ্ছদের পিছনের সাদা পৃষ্ঠায়। পড়ে যা মনে হলো স্বামী কদিন পরেই দেশের বাইরে যাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য। স্ত্রীর পেটে সন্তান, সে জানে না সন্তান পুত্র নাকি কন্যা হবে। হাতে আঁকা দুটি শিশুর মুখ, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে শিশুর। নিচে ফাউন্টেইন পেনে স্বাক্ষর অসময় সেন, ২৭ বাবু বাগান লেন , ঢাকুরিয়া , তারিখ ২৪/০৩/১৯৮৭ ইং। বিশ টাকায় বইটি কিনে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকি।

আমি কোথায় যাচ্ছি ঠিক জানি না। একত্রিশ বছর আগের অসময় সেনের একটা কাল্পনিক মুখ আঁকি মনে মনে। আটাশ কি ত্রিশ বয়সী যুবক। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী। ঘন কালো গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল... 


বাস ধরে প্রথমে কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা, তারপর আবার অন্য বাসে ঢাকুরিয়া। ঢাকুরিয়া বাস স্টপেজে নেমে হেঁটে আমি মনের অজান্তেই চলে আসি বাবু বাগান লেন । বাম দিকে তাকিয়ে ২৭ নাম্বার একই হোল্ডিঙে এই শতকের শুরুর দিকে তৈরি চারটা উঁচু দালান দেখতে পেলাম। যখন দেশে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ব্যাবসা জমজমাট সে সময়ের তৈরি এই আবাসিক দালান গুলো। 


আমি কিছুটা অবাক হলাম, আমার কি এখানে আসার কথা ছিলো? নাকি হাতের বইটি আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে! আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি –তুমি কি অসময় সেনকে খুঁজতে এসেছো? মন থেকে উত্তর এলো –জানি না...

মানুষের মনে বড়ই অদ্ভুত কারিগরি কাজ করে যার সম্পর্কে সে মানুষটা নিজেও অজ্ঞাত। মন ভিতর থেকে ফুঁসলিয়ে মানুষটাকে দিয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেয়। এতক্ষণে আমিও নিশ্চিত হলাম আমার মন আমাকে দিয়ে অসময় সেনের সন্ধান করার চেষ্টা করছে। 


বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে তখন। রাস্তার উল্টো দিকে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে আছি দালান গুলোর দিকে। এখনো কি অসময় সেন এখানে বাস করেন? আমি কি কিছু জানতে চাইবো এই লোকটার বিষয়ে? আমি জানি আমার মন তীব্র ভাবে অসময় সেনকে খুঁজতে চাইছে কিন্তু কারো কাছে তার সন্ধান করতে চাওয়ার জড়তা মুখে। হাতের বইটা নাড়াচাড়া করে ফিরে আসলাম। সেদিন রাতে অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের বিষয় অসময় সেন আর তার পরিবার… কিছু স্বপ্নের কথা ঘুম ভেঙে ধারাবাহিক ভাবে কিছুই মনে থাকে না। এলোমেলো স্বপ্ন। 


পরদিন বিকেলে বেরিয়ে আবার সেই চায়ের দোকানে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দুইবার চা খেলাম। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকা চারটি দালানের দিকে। মাঝ বয়সী চায়ের দোকানদার আড়চোখে আমাকে খেয়াল করছে। তার দিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিতে দেখলাম। মুহূর্তেই দোকানদারের মনের অবস্থা বুঝতে পারলাম –সামনে দেশের সাধারণ জাতীয় নির্বাচন, গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ঘোরাফেরা করছে। গায়ে কালো জ্যাকেট, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ কিছু একটার সন্ধানে আছে... আমাকে দেখে তার মনে তেমন কিছুই মনে হচ্ছে। গতকাল একবার এসে তার দোকানেই ঘণ্টা খানেক বসেছিলাম, পরপর দুই দিন এমন নতুন মুখ সন্দেহজনকই বটে। 


দোকানে লোকজন আসছে চা সিগারেট কিনছে চলে যাচ্ছে। গতকাল যেমন তিন চার জন লোকের লাগাতার আড্ডা ছিলো আজ নেই! কেউ এসে বসছে না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে চা দোকানীর কোন ইশারা ইঙ্গিত থাকতে পারে। একটু ফাঁকা পেয়ে আমি আরেকটা সিগারেট চাইলাম। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঠোটে সিগারেট নিয়ে দোকানের ঝুলে থাকা লাইটারে ধরিয়ে দোকানদারকে বললাম –আচ্ছা, আমাকে একটা তথ্য দিতে পারেন? আড়চোখে তার দিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম তার চোখে ভয় আর আতংকের ছাপ, আমার প্রশ্নটা শুনেই তার গলা কেমন শুকিয়ে আসছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এই দোকানের আশেপাশে চরস,গাঁজা সহ নানা ধরণের মাদকের জমজমাট ব্যবসা আছে। আর এইসবের তথ্য তার কাছে আছে। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো –কি তথ্য স্যার?

-অসময় সেন নামে কাউকে চেনেন আপনি? আমি বললাম। প্রশ্ন শুনে সে হ্যাঁ কি না বলবে এই নিয়ে ইতস্তত বোধ করছে দেখেই বুঝতে পারলাম আমি বোধহয় সন্ধান পেয়ে গেছি। সন্ধান আমি পেয়ে গেছি এটা নিশ্চিত, তবে তার মিথ্যে কথা থেকেই একটা নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া গেলো। সে অসময় সেন সম্পর্কে ঠিকই জানে কিন্তু উত্তর দিলো –স্যার আমি এই এলাকায় আইছি বেশী দিন হয় নাই, এই নামে কাউকে চিনি না। তবে স্যার এই এলাকায় চল্লিশ বছর ধরে আছে সুশীল কাকা , সে বলতে পারবে। হাতের আঙুল উঁচিয়ে দেখালো –ঐযে দুই নম্বর বিল্ডিঙটা দেখতেছেন, ঐ বিল্ডিং এর দারোয়ান সে। আমি সেদিন চলে আসলাম। একটা উত্তেজনা নিয়ে কাটলো ঘুমের আগ পর্যন্ত। কিন্তু রাতে ভালো ঘুম হলো।

পরদিন বিকেলে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হলো। জ্যাকেট না পরে কোট গায়ে দিলাম। নিচে নীল সাদা চেক শার্ট। শেভ করে মুখটা পরিষ্কার করতে হলো। পকেটে একটা কলম ঢুকিয়ে নিলাম। দময়ন্তী বইটা খাকী একটা খামে ভরে ঠিক সন্ধ্যাবেলা দুই নাম্বার বিল্ডিং এর গেটে ঢুকলাম। গার্ড রুম থেকে সত্তরের কাছাকাছি বয়সী এক বৃদ্ধকে দেখে বুঝতে পারলাম তিনিই সুশীল কাকা। কাছে এসে নমস্কার করলেন , আমি নমস্কারের উত্তর দিয়ে বললাম –আপনি নিশ্চয়ই সুশীল কাকা।

-হ্যা, আপনি কার কাছে আসছেন?

-আমি আসলে আপনার সাথেই একটু কথা বলবো।

-আমার সাথে? কি বিষয়ে? একটু অবাক হয়ে বললেন।

-আসুন না একটু বসি কোথাও। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে কথা বলতে হবে তো।

সুশীল কাকা গার্ড রুমের পাশেই তার থাকার ছোট্ট ঘরটায় নিয়ে গেলেন। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে তিনি বিছানায় বসলেন। -বলুন তো, শুনি কি কথা? আমার দিকে গভীর আগ্রহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন।

আমি পূর্বেই চিন্তা করে এসেছিলাম কিভাবে শুরু করবো। এটাও নিশ্চিত ছিলাম যে দোকানদার জেনে বুঝে ঠিক জায়গাতেই পাঠিয়েছে আমাকে। আমি সরাসরি খাম থেকে বইটা বের করে বললাম –চাচা, এই বইটা অসময় বাবুর । তিনি তাঁর স্ত্রী ছবিকে এই বইটা উপহার দিয়েছিলেন... আমি এই বইটা উনার হাতে ফিরিয়ে দিতে চাই।

আকবর চাচা বইটা হাতে নিয়ে এতোটাই অবাক হলেন যে, একবার আমার দিকে আরেকবার বইটার দিকে তাকিয়ে কি বলবেন কিছু বুঝতে পারছিলেন না। পাতা উল্টে হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পারলেন এটা অসময় বাবুর নিজের হাতের লেখা। তাঁর হাতে লেখা কতো চিঠি নিয়ে পোস্টবক্সে ফেলে এসেছে! সুশীল কাকার চোখ দেখে খানিকটা ভেজা ভেজা মনে হলো আমার কাছে। তিনি যেন একই সাথে অনেক ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছেন। চোখটা উজ্জ্বল হয়ে যেতে দেখলাম যেন তাঁর হাতে একটা মানুষের ত্রিশ বছরের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়ার একটা ঔষধ পেলেন। -এই বই আপনি কোথায় পেলেন? কাঁপা কণ্ঠে বললেন সুশীল কাকা।

-বইটা আমি ফুটপাত থেকে কিনেছি। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে অসময় বাবু সম্পর্কে। এবং আমি নিজ হাতে বইটা উনার হাতে তুলে দিতে চাই। এই উপকার টুকু করবেন আমার জন্য?

-সেই ব্যবস্থা না হয় করে দিলাম, কিন্তু... তাঁর সম্পর্কে... কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন –আপনি এমন একটা জিনিস নিয়ে এসেছেন... আপনাকে না বলেও পারছি না। চোখ থেকে চশমাটা খুলে বিছানায় রাখলেন। শুনুন তাহলে, উকিল সাহেব মারা যাওয়ার মাস ছয়েক আগে মা হারা একমাত্র ছেলেকে ছেলের পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করিয়ে বউ করে ঘরে আনলেন। ছবি ম্যাডাম পড়তেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সাহেব তখন যাদবপুর থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। ম্যাডাম দেখতে পরীর মতো সুন্দরী ছিলেন। বিয়ের বছর খানেক পরই পেটে সন্তান আসলো। স্ত্রীর পেটে চার মাসের সন্তান রেখেই সাহেব লন্ডন চলে গেলেন পি এইচ ডি করতে। কিন্তু মাস ছয়েক পর লন্ডনের পড়াশোনা শেষ না করেই ফিরে আসতে হলো সাহেবকে। এইটুকু বলে থেমে গেলেন সুশীল কাকা।

-কেন?

-আমাকে উকিল সাহেবই গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন, উনার এখানেই কাজ করেছি। তারপর অসময় বাবুর খোঁজ খবর দৈনন্দিন প্রয়োজন এখনো আমাকেই দেখতে হয়। সেই সূত্রে এই পরিবারের ভিতর বাহির সব কিছুই আমার জীবনেরও একটা অংশ। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একজন ভালো মানুষ। তাই, সত্যিটা আর গোপন রাখছি না আপনার কাছে। ম্যাডাম পেটের সন্তান নিয়েই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুরনো বন্ধুর হাত ধরে আমেরিকায় চলে যায়। সেখানে সন্তান হলে নাকি তাদের সিটিজেনশীপ পেতে সুবিধা হয়। তার বন্ধু হীরেন আগে থেকেই সেখানে ছিলো। মাঝে মাঝে দেশে আসা যাওয়া করতো।

-অসময় বাবু নিজের সন্তানকে ফিরিয়ে আনলেন না কেন?

-দুঃখটা তো সেখানেই, পেটের সন্তানের বাবা নাকি ছিলো হীরেন ...

-অসময় বাবু এখন কোথায় আছেন?

-আছেন, এই বিল্ডিঙের পিছনে বাবার আমলের পুরনো বাড়িতে। প্রথম দিকে বেশ অনেক বছর মাথা উঁচু করেই চলছিলেন। প্রায় দেড় যুগ হলো আস্তে আস্তে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কারো সাথে দেখা করেন না। বাইরে যান না। দেশ সমাজ রাজনীতি কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই। মোবাইল কম্পিউটার ইন্টারনেট কোন প্রযুক্তির সাথেই সম্পর্ক নেই। বিশাল ঘর ভর্তি বই... এই নিয়েই থাকেন। জানেন? গত বিশ বছর ধরে আমি বাবুকে হাসতে দেখিনি ।

-আমি কি অসময় বাবুর সাথে একটু দেখা করার সুযোগ পাবো?

-এভাবে তো হবে না, বইটা নিয়ে আমি যাচ্ছি আপনি বসুন এখানে কিছুক্ষণ। সুশীল কাকা বইটা নিয়ে পাশের গলি দিয়ে বাসায় গেলেন। মিনিট দশেক পর ফিরে এসে দূর থেকে আমাকে ইশারায় ডাকলেন –আসুন তাড়াতাড়ি! জাদু মন্ত্রের মতো পরিবর্তন দেখছি হঠাৎ! আসুন!

আকবর চাচার হাতে বইটা দেখছি না। আমার বুকের ভিতর হৃদকম্পনের শব্দ আমি যেন নিজ কানে শুনতে পাচ্ছি! আমি আকবর চাচার পিছনে যাচ্ছি মনের ভিতর এক উত্তেজনা নিয়ে।

অনেক পুরনো বাড়ি। বারান্দায় নক্সা করা তিনটা পিলার, বাড়িটা কতো বছরের পুরনো তা অনুমান করা গেলো না। বিশাল বারান্দায় লোহার গ্রীল, দেখে মনে হচ্ছে এক সময় এই গ্রীলটা ছিলো না। বারান্দা পেরিয়ে মাঝখানে বসার ঘর। এর পর বেশ বড় একটা ঘর, চার পাশে হাজার হাজার দেশি বিদেশী বই। মাঝখানে একটা টেবিল। আমাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে আসলেন। খদ্দরের পাঞ্জাবীর উপরে চাদর গায়ে। আমি কল্পনায় যে মুখটা দেখেছিলাম তার সাথে অনেক মিল! শুধু রবি ঠাকুরের মতো পাকা দাড়ি গোঁফ। মাথায় প্রায় অর্ধেক চুল নেই। আমাকে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে পাশের একটা চেয়ারে বসালেন। পাথরের মতো জমে থাকা একটা মুখে অনেক বছর পর একটা হাসির রেখা দেখে সুশীল কাকা চোখে জল ধরে রাখতে পারলেন না। আমি মানুষটাকে জীবনে প্রথম দেখলেও বুঝতে পারলাম তাঁর বুকে হাজার বছরের জমাটবদ্ধ বরফ গলে খরস্রোতা নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে। টেবিলের দুই পাশে দুটি ল্যাম্প থেকে আলো এসে পড়ছে টেবিলের মাঝখানে। বইয়ের মলাট উল্টে নিজের হাতের লেখাটা হাতের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখছেন বার বার। অসময় বাবুর চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে ভিজে গেলো তাঁর নিজের হাতে একত্রিশ বছর আগের লেখার উপর। বহুদিন এমন করে পাথরের কান্না দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার।

ঘণ্টা দুয়েক প্রাণ খুলে আড্ডা দিয়ে বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে আসলাম। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার ছায়ার সাথে হেঁটে চলেছি আমি উদ্দেশ্যবিহীন মানুষ। যার জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। আগামী কাল নিয়ে ভাবনা নেই। যা হওয়ার হবে যা ঘটার ঘটবে... পরিকল্পনা গুলো মানুষকে এলোমেলো করে, লোভী করে স্বার্থপর করে... মাঝে মাঝে অসময় বাবুর মতো মানুষের সান্নিধ্য হঠাৎ করে ভাগ্যে জুটে গেলে এটাই বুঝি জীবনের আসল নির্যাস।এরকম ভালো মানুষ মানুষকে বাসতে পারে? কুর্নিশ অসময় বাবুকে তার এই মহান ভালোবাসার জন্য।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance