হলুদ আলো
হলুদ আলো


ছেলে মেয়ে দুটোকে বেশ কয়েকদিন ধরেই আমি দেখছি। ওদের ওপর চোখ পড়ার একটা কারণ হলো যে এই পরিবেশে ওরা বেশ বেমানান। এটা কলকাতা শহরের একটা বড় নামি হাসপাতাল। নামি এবং দামি। বিশাল বড় কার পার্কিং এ নানান মডেলের গাড়িi যারা নামেন তাদের অসুখটা একরকম হলেও পোশাক আষাক আর চাল চলন অন্য রকম। দেখলেই বোঝা যায় যে এনারা মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ থেকে অন্তত বঞ্চিত নন।
এখানে ওরা সত্যি বেমানান।দুজনেরই সস্তার জামা কাপড়, চোখে মুখে একটা ভয়, একটু যেন সংকুচিত হয়ে থাকা, সব মিলিয়ে বোঝা যায় যে ওরা এই পরিবেশের নয়।
আমি আজ একমাস ধরে এই হাসপাতালের পার্টটাইম বাসিন্দা। কারণটা আমার বাবা। বাবার বয়স আসি ছুঁইছুঁই। নানান রোগের শিকার। বর্ষাটা একটু জমিয়ে পড়তেই ডবল নিমোনিয়া। বাড়িতে সামলাতে না পেরে হাসপাতাল। প্রথমদিকে সব ভাইবোনেরাই ছুটোছুটি করেছিল। তারপর একটু ভালোর দিকে গেলে যা হয়, সবাই যে যার জগতে। আমি বড় মেয়ে, সংসার নেই, তার ওপর সবে রিটায়ার করেছি। তাই আমার ওপরেই নিয়মিত দেখাশোনার দ্বায়িত্বটা বর্তেছে।
সত্যি বলতে কি আমিও একটা কাজ পেয়েছি। এদের এখানে সকালে একটা ভিসিটিং আওয়ার আছে। আমি মাঝবেলায় এসে একবার দেখে আসি বাবাকে । আমার লড়াকু বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ। হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যে ছেড়েও দেবে।
বাবাকে দেখে এসে আমি হাসপাতাল চত্বরে ঘুরে বেড়াই। কখনো লবিতে বসে বই পড়ি। লাঞ্চ খাই , কফি খাই, তারপর বিকেলে আর একবার বাবাকে দেখে সন্ধেয় বাড়ি ফিরি। কোনোদিন হয়তো অন্য কেউ আসে। নয়তো আমি বাবার কাছে বসি। কথা বলি। বাবাও দু একটা কথা বলে। এখনো বেশ দুর্বল। তবে ভালোর দিকে।
আজ একমাস ধরে নানান রকম লোক দেখি। কেউ কেউ আলাপ জমায়। জানতে চায় পেশেন্ট কেমন আছে। নিজেদের কথা বলতে চায়। আমিও শুনি।কেউ আবার লবিতে বসেই কান্নাকাটি করে। কেউ বেশ খুশি। বুঝতে পারি তাদের রোগী ভালোর দিকে। কেউ বা বিলি ব্যবস্থা বা খরচ নিয়ে ক্ষুব্ধ।
কতকগুলো মুখ আবার একদম অন্ধকার হতে হতে একদিন হারিয়ে যায়। কি হলো বোঝা যায় না। হয়তো বা কোনো অনন্তর হাতে তাদের ভালোবাসার ধনকে তুলে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। হেরে যায় সেই চিরন্তন লড়াইতে।
সবচেয়ে ভালো লাগে যখন নতুন কোনো অতিথি বাড়ি যায়। ছোট্ট এক জীবন বিরাট এ পৃথিবীতে পা রাখে I বুকের ভেতর তখন একটু হলেও একটা না পাওয়ার কষ্ট এই ষাট বছরের মনটাকে উদাস করে দেয়।
এই ছেলেমেয়ে দুটোও আমার মতো সারাদিন হাসপাতাল চত্বরে বসে থাকে। ক্যান্টিনে যায় বটে তবে কোনোদিন কোনো কিছু কিনতে দেখিনি। ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো বের করে খায়। কোনো দিন রুটি, কোনোদিন মুড়ি, চিড়ে। রাস্তার ধারের ঝুপড়ি থেকে চা খায় কখনো সখনো।
আমার খুব কৌতূহল হয় ওদের নিয়ে। ক্যান্টিনে বসলে আমি ওদের কাছাকাছি টেবিল খুঁজি। কান পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করি। একদিন ওদের পেছন পেছন গিয়ে জানতে পারলাম যে ওদের রোগী আইসিউতে ভর্তি।
মেয়েটা কথা প্রায় বলেই না। যা বলার ছেলেটাই বলে। নিজের টিফিন খুলে ছেলেটা মেয়েটার টিফিনে খাবার দেয়। মনে হয় ওরা বন্ধু। হয়তো বা আর একটু বেশি। মেয়েটা বিরক্ত হয়। খাবার ফিরিয়ে দেয়। ছেলেটা নাছোড়।
' খা না। মা করেছে। দেখ ভালো লাগবে। '
মেয়েটা অনিচ্ছায় মুখে তোলে। কথা বলে না। কৃতজ্ঞতা জানায় না।
' চিন্তা করিসনা। কাকু ভালো হয়ে যাবেন। ' ছেলেটা শান্তনা জানায়।
মেয়েটা টেবিলের জলের রেখায় আঁকিবুকি কাটে। চোখ তোলেনা। হয়তো মনে করে যে চোখের জলটা গড়িয়ে পড়লে ছেলেটা দেখতে পাবে।
আমার কৌতূহল বাড়ে। পয়সা নেই বোঝা যায়। তবু এই হাসপাতালে কিভাবে চিকিৎসা হচ্ছে ওর বাবার ? কি হয়েছে ওনার? কত বয়স? কে চালায় ওদের সংসার?
আর এই ছেলেটা? এতো অবহেলা সত্ত্বেও যে আসে ? কে ও?
প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর কিলবিল করে। কিন্তু আলাপ করতে সাহস হয় না। যদি কথা না বলে!
কথা বলেনা। ছেলেটা একটু আধটু। মেয়েটা চুপ। আমি ভানু গোয়েন্দার মতো ওদের পেছনে ঘুরি।
এক দিন এক বয়স্ক ভদ্রলোক আসেন। ছেলেটা আলাদা বসে উদাস ভাবে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা ওর দিকে তাকায় না। চলে গেলে আবার একসঙ্গে। ছেলেটা বীরের মতো হাসে। আমি বুঝতে পারি বাড়ির আপত্তি।
খেতে খেতে টুকটাক কথা বলে ছেলেটা।মেয়েটার চোখ ফোলা। কেঁদেছে মনে হয়। হাতের বইটার আড়ালে কান খাড়া আমার।
টিফিন খুলেছে দুজনে। মেয়েটার মুখে বুলি।
'রোজ আসিস কেন তুই? চাকরি যাবে তো !'
' বাহ্ ! নাইট করলাম না কত গুলো? ওরা তো খুশিই। কাঁদছিস কেন? কাকু তো ভালো হয়ে উঠবেন। '
মেয়েটা ভুরু কোঁচকায়।
' ভালো হলে তোর কি? তুই কি ভাবছিস বাবা তোকে মেনে নেবে ? আবার দূর করে দেবে।'
' সে পরে দেখা যাবে। এখন তো ভালো হোন। '
' তোকে দূর ছাই করে। তোর এতো কিরে। '
' করুক না। তোর বাবা তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। '
'কিচ্ছু ঠিক হবে না। '
ছেলেটা কথা বাড়ায় না। তরকারি ঢেলে দেয় ওর টিফিনে।
' তুই কি দিয়ে খাবি ?'
' হয়ে যাবে। খা না। '
মেয়েটা কিছু না বলে উঠে যায়। ছেলেটা বোকার মতো বসে থাকে। আমি অবাক। আচ্ছা মেয়েতো। কি হলো রে বাবা। একে নিয়ে ঘর করাই তো মুশকিল হবে।
মেয়েটা ফিরে আসে একটু বাদে। হাতে একটা বাটি। কিছু কিনলো কি?
আমি চেয়ার থেকে ঝুকে পড়ি। বাটি মধ্যে র হলুদ ঝোলে ভাসছে একটা লাল ডিম্।
মেয়েটা ছেলেটার দিকে বাটিটা এগিয়ে দেয়। নিচু গলায় হুকুমের সুরে বলে , ' খেয়ে নে। '
' তুই একটু নে। '
'লাগবে না। '
আমি আবার বই নামাই।
ছেলেটা পরম যত্নে ডিমের কুসুমটা কাটে। চামচের ডগায় আধখানা তুলে বাড়িয়ে ধরে।
' তুই কুসুম ভালোবাসিস। আমি জানি। '
মেয়েটা তাকায় । ছেলেটা দাঁত ছড়িয়ে হাসে। কোথা থেকে একটা আলো ছড়ায়। আধখানা হলুদ কুসুমে আলো ঠিকরোয়। চামচটা আর একটু বাড়িয়ে ধরে ছেলেটা। দুচোখে মিনতি।
মেয়েটা হাত বাড়ায়।