গল্প–মিনুর প্রেম
গল্প–মিনুর প্রেম
'এই যে বাপন, এই কাগজটা তোমার দিদিকে দিয়ে দিও। একটা পড়ার নোটস আছে। মনে করে দিও কিন্তু। আর এই নাও তোমার জন্য একটা লজেন্স ।' বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাপনের হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল অসীমদা
অসীমদা বাপনকে ইদানিং খুব ভালোবাসছে। মাঝে মধ্যেই লজেন্স, চকোলেট, বেলুন এইসব দেয় আর গাল টিপে আদর করে।বাপনেরও অসীমদাকে খুব ভালো লাগে। কিন্তু ওর মা অসীমদাকে একদম পছন্দ করে না। সেদিন অসীমদা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দিদি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বলে মা দিদির চুলের মুঠি ধরে কি মারলো। সেদিন রাতে দিদি কিছু খায়নি। বাপনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে খুব কেঁদেছিল সারারাত।
ক্লাস থ্রিতে পড়া বাপন দিদিকে খুব ভালোবাসে। দিদি ছাড়া তার চলেই না। তাই মা যখন দিদিকে মারছিল ওরও খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কেন যে মা রেগে যাচ্ছে তার কিছুই মাথা মুন্ডু বুঝতে পারে না সে। মা বলে অসীমদা একটি বখাটে ছেলে। আচ্ছা বখাটে মানে কী? ওটা কি খুব খারাপ কথা? কিন্তু যে তাকে লজেন্স, বেলুন এইসব দেয় সে খারাপ হবে কেন?
প্রতিদিন রাত্রিবেলায় দিদির পাশে শুয়ে কতো গল্প শোনে বাপন। কখনও ঠাকুমার ঝুলি , কখনও গোপাল ভাঁড় , বীরবলের হাসির গল্প ,রাক্ষসের গল্প ,রাজা রাণী আরো কতো কি ।কতো রকম প্রশ্ন , দিদি ভাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সব উত্তর দেয় ।
প্রতিদিন রাত্রে শোবার আগে , ঠাম্মির পায়ে তেল মালিশ করে , ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মশারি টাঙিয়ে দেয় দিদি। সেদিন ও দিদি, রেগে রাত্রে খাবার না খেলেও, ঠাম্মির তেল মালিশ করে ওষুধ খাইয়েছিল । মশারি টাঙিয়ে ঠাম্মির ওষুধ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিল । আলোটা না নেভায় ঠাম্মি শুধায়
――"কি রে দিদিভাই ? কিছু বলবি ? "
――" কিছু না ঠাম্মি । তুমি শুয়ে পড়ো ।আমি আলো নিভিয়ে দিচ্ছি ।"
আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে । বাপন দেখেছে মা আজ সন্ধ্যায় দিদিকে উত্তম মধ্যম দিয়েছে । দিদি শুধু নীরবে চোখের জল ফেলেছে । দিদির মনটা ভালো নেই । তাই আজ গল্প শুনতে চাইলো না । আসলে দিদি আজ অসীমদার সাথে কলেজ থেকে পার্কে গেছিলো । পাড়ার সুখময় কাকু , দিদিদের পার্কে দেখে মা কে ফোন করে জানিয়েছিল । মা তো রেগে আগুন । ঘরে ঢুকতেই তুলোধোনা করেছেন । হাজার জিজ্ঞাসাতেও মুখ খোলেনি দিদি । এতো বারণ সত্ত্বেও কেন দেখা করেছে ? মা বলে দিয়েছেন কাল থেকে কলেজ যাওয়া বন্ধ । বাবা অফিসের কাজে দিল্লী গেছেন । কাল ফিরবেন ।যাবার আগে বার বার বলেছেন " শোন মিনু , ঐ বখাটে ছেলের সঙ্গে একদম মিশবি না । আমি ফিরে কোনো নালিশ শুনতে চাই না । " মিনু জলভরা চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে বাবার কথাগুলো শুনেছে ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানে পুজোর ফুল তোলে মিনু । গান গাইতে গাইতে গাছে জল দেয় । কিন্তু আজ এতো বেলা হয়ে গেল এখনো মিনুর কোনো আওয়াজ নেই । ঠাম্মির পুজোর ফুল তোলা হয়নি । দু-বার দিদিভাই বলে ডাক দিয়েছেন । কোনো সাড়া নেই । ভাবছেন হয়তো শরীর ভালো নেই , "আহা ! আজ রবিবার একটু ঘুমাক । কাল মায়ের কাছে খুব বকুনি খেয়েছে ।"
সবিতাদেবী আজ সকাল সকাল রান্না চাপিয়েছেন । অফিসের কাজ সেরে স্বামী রাজধানীতে ফিরছেন । ঘরে ঢুকেই জলখাবার খাবেন । আটটা বেজে গেল এখনো মিনুটা ওঠেনি । কাল বোধহয় একটু বেশি বকাবকি করেছি মেয়েটাকে । যাই একটু আদর করে আসি । বাবার কাছে তো বকুনি খাবেই । এই ভেবে মেয়ের ঘরে এসে দেখেন মেয়ে এখনো মরার মতো ঘুমাচ্ছে ।
―― "এই মিনু ! ওঠ ! মিনু....."
গায়ে হাত দিতেই চমকে ওঠেন । শরীর ঠাণ্ডা । চিল চীৎকার করে ওঠেন ।
" মিনু তোর কি হয়েছে ? কে কোথায় আছো দেখো আমার মিনুর কি হয়েছে । কথা বলছে না । ওমা গো , কি হবে গো ....." বলে কাঁদতে থাকেন । মায়ের চিৎকারে বাপন ঘুম থেকে উঠে পড়ে । দেখে মা দিদির পাশে বসে মরা কান্না কাঁদছে । ঠাম্মি পড়িমরি করে ছুটে আসেন । " কি হয়েছে বৌমা ? " বিছানায় মিনুর শরীর দেখে আঁতকে ওঠেন । বোঝেন সাঙ্ঘাতিক কিছু হয়েছে । দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমের ওষুধের শিশি দেখেন । একটিও বড়ি নেই । মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন । এদিকে ততক্ষণে পাড়া প্রতিবেশী চিৎকার শুনে বাড়িতে হাজির ।
মিনুর বাবা ঘরে ঢুকে এতো লোকজন দেখে ঘাবড়ে যান । জিজ্ঞাসা করেন " কি হয়েছে ? এতো ভীড় কেন ? "
ঠাম্মি বলে ওঠেন ――" ওরে আমাদের কপাল পুড়েছে । মিনু , আমার ঘুমের সব ওষুধ খেয়ে নিয়েছে । "
সময় নষ্ট না করে মিনুর বাবা এম্বুলেন্সে করে অচৈতন্য মিনুকে সোজা হাসপাতালে ভর্তি করলেন ।
"ডাক্তারবাবু আমার মেয়েকে বাঁচান । মায়ের বকা খেয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে । আমি কথা দিচ্ছি আর হবে না । ওকে বাঁচান । "
ডাক্তারবাবু বললেন ――" দেখুন আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, তবে অনেক দেরি করে ফেলেছেন । চব্বিশ ঘণ্টার আগে কিছু বলতে পারছি না ।"
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিনুর বাবা । মেয়েকে বকাবকি করলেও ভীষণ ভালোবাসেন । সামনে মেয়ের জন্মদিন তাই একটি মুক্তোর সেট নিয়ে এসেছেন । কিন্তু " মিনু মা তুই একি করলি ? কেন করলি ? একবারও বাবার কথা চিন্তা করলি না ? " মনে মনে বিড়বিড় করেন ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । মিনুর বাবা সুজয় ব্যানার্জী ঠাঁই বসে আছেন রিসেপশনে । হঠাৎ ডাক্তারবাবু এসে বললেন " মি: ব্যানার্জী ! এ যাত্রায় আপনার মেয়ে বেঁচে গেল । আমরা স্টমাক ওয়াশ করে দিয়েছি । জ্ঞান ফিরছে । একটু পরে কেবিনে ঢুকে মেয়েকে দেখতে পাবেন ।"
ব্যানার্জীবাবু উঠে গিয়ে ডাক্তারের হাত চেপে ধরলেন । " আপনাকে আমি কি বলে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না ডাক্তারবাবু ।"
――"ঠিক আছে মেয়ের খেয়াল রাখবেন তাহলেই হবে । আর হ্যাঁ, মিনতি কি ক্রিকেট খেলা, অসীম এসব বলছিল । ঠিক বুঝলাম না । আমি রাত্রে আরেকবার আসবো ।"
কেবিনে ঢুকে মেয়েকে দেখে ব্যানার্জীবাবু হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন । ডাক্তার নার্স ছুটে এলো । "কি করছেন মি: ব্যানার্জী ? কণ্ট্রোল ইওরসেলফ । আপনি এরকম করলে মেয়েকে সামলাবেন কি করে ? "
চোখের জল মুছে ব্যানার্জীবাবু বললেন
―― " ইটস্ ওকে ।" সবিতাদেবী বার বার ফোন করেই যাচ্ছেন । রাগে দুঃখে ব্যানার্জীবাবু ফোন কেটে দিচ্ছেন ।
মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে ভালো আছে দেখে বাড়ি ফিরেছেন ব্যানার্জীবাবু । সারাদিন খুব ধকল গেছে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে গিন্নীকে বললেন । "আর কোনো দিন মেয়েকে বোকবে না । যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যেত আর ফিরে পেতাম না মিনুকে । "
ভোরবেলা ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো ব্যানার্জীবাবুর । " হাসপাতাল থেকে কোনো দুঃসংবাদ নয় তো ? "
"হ্যালো মিনতি ব্যানার্জীর বাড়ির লোক বলছেন ? হ্যালো .....? হ্যালো......?"
কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে ফোনটা ধরলেন ব্যানার্জীবাবু ।
" আমি মানবসেবা হাসপাতালের রিসেপশন থেকে বলছি । আপনারা সাতটার মধ্যে হাসপাতালে চলে আসুন ।"
" কি হয়েছে ? আমার মেয়ে কেমন আছে ? "
"না, না, আপনার মেয়ের কিছু হয়নি। ও ঠিক আছে । "
" তাহলে এতো ভোরে ফোন ? "
" ডাক্তারবাবু বলেছেন টিভিতে ন'টার থেকে কি দেখাবে । আপনাদের সাথে ডাক্তারবাবুও দেখবেন ।"
কথাটা শুনে ব্যানার্জীবাবু অবাক হয়ে গেলেন ।
গিন্নীকে বলে দুজনে তৈরী হয়ে হাসপাতালে চলে এলেন । মিনুর কেবিনে ঢুকে অবাক । ডাক্তারবাবু চা নিয়ে সোফায় বসে ।সামনে টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলছে । কিন্তু সাউন্ড বন্ধ । মিনু বিছানায় উঠে বসেছে । " আসুন আসুন মি: ব্যানার্জী । "
" কি ব্যাপার ডাক্তারবাবু ? কিছুই বুঝতে পারছি না।"
" আপনার মেয়ে তো কামাল করে দিয়েছে মশাই। আপনার তো গর্ব করা উচিত মেয়ের জন্য । ঐ যে ছেলেটি ব্যাট করছে ওকে চেনেন ? " খুব ভালো করে লক্ষ্য করে বললেন " না, মানে হ্যাঁ । দু একবার দেখেছি । অসীম , আমাদের ঐ দিকে কোথাও থাকে ।"
" ও উজ্জ্বল রায় । বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলছে ।পরশু আপনার মেয়ে নিজের আংটি বিক্রি করে উজ্জ্বলের কটক যাবার গাড়ি ভাড়া যোগাড় করে দিয়েছে । ওর বাবা বাড়ি বাড়ি পেপার দেয় । ছেলেটা খুব ভালো খেলছে, দেখুন। "
ব্যানার্জীবাবু এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না ।
মিনুর মুখে হাসি ফুটেছে দেখে ব্যানার্জী দম্পতি খুশি । মা এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন । "হ্যাঁ রে, মায়ের উপর এখনো রাগ করে আছিস ? " মায়ের কোনো কথাই ওর কানে ঢুকছে না । টিভির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিনু ।
বিকালে ডাক্তারবাবু আবার এলেন । ততক্ষণে অসীম সেঞ্চুরি করে ফেলেছে । মিনু শুয়ে শুয়েই খেলা দেখছে । ডাক্তারবাবু মিনুকে বললেন " রঞ্জিতে বাংলা জিতবেই । কটক থেকে উজ্জ্বল ফিরলে আমার বাড়িতে তোমাদের দুজনের নেমন্তন্য রইলো । " পরদিন বিকালে মিনুর ছুটি হয়ে গেল। অসীম কিছু জানতেই পারলো না । বাংলা রঞ্জিতে জিতে গেছে । অসীম ভীষণ খুশি । বার কয়েক ফোন করেও মিনুর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি । গাড়িতে আস্তে আস্তে বাবা বললেন " মিনু ছেলেটি পড়াশোনায় ভালো না হলেও দারুণ ব্যাটিং করে । ওকে একদিন ঘরে আস্তে বলিস । " মিনুর চোখে আনন্দাশ্রু ।।