Santanu Dey

Romance

3  

Santanu Dey

Romance

এক আকাশের নীচে

এক আকাশের নীচে

4 mins
791


এক: 


"তাহলে আগামী পরশু?"


"হ্যাঁ সেটাই ঠিক থাক আপাতত..", রিপ্লাই দেওয়ার পর হোয়াটাসঅ্যাপটা বন্ধ করে ফোনটা ডেস্কের ওপর রাখলো সম্যক। তারপর ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে লইয়ারের দেওয়া ডিভোর্সের ফাইনাল পেপার গুলোর দিকে আরেকবার চোখ বোলাতে শুরু করলো। কোনো মামলা মোকদ্দমা নয়, না কোনো খোরপোষের দাবি, মিউচুয়াল এই ডিভোর্সে দেবীকা আর সম্যক কেউই কোনো ঝামেলায় যেতে চায়নি। প্রেম আর বিয়ে মিলিয়ে বারো বছরের সম্পর্ক সম্যক আর দেবীকার। কিন্তু অনেক উথাল পাথাল দিয়ে পরিণতি প্রাপ্ত এই সম্পর্কটা গত তিন বছরে সম্পর্কটা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সমস্যার মূল কারন ওদের মধ্যে বহু কাঙ্খিত একটা সন্তানের অনুপস্থিতি। সবরকম মেডিক্যাল টেস্ট আর অপশন কনসাল্ট ওরা করেছে। কিন্তু ডক্টর জানিয়ে দিয়েছেন দেবীকার পক্ষে মা হাওয়া কোনোদিনও সম্ভব নয়। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা সম্যকও মানতে পারেনি। কিন্তু দেবীকার পাশে থেকেছে। কঠিন হাতে সামলে নিয়েছে বাবা মায়ের উদাস মুখ আর আত্মীয় স্বজনদের চাপা আলোচনা।


"কিরে, কফি খেতে যাবি?", সতীর্থ সুদীপ্তর ডাকে চমকে উঠলো সম্যক।

"হ্যাঁ চল যাওয়া যাক।"


দুই:


নিউটাউন এর এই অফিস থেকে উল্টাডাঙায় বাড়ি ফেরাটা আস্তে আস্তে অসহ্য হয়ে আসছে। একটার পর একটা ওলা ক্যানসেল হাওয়ার পর একটা হলুদ ট্যাক্সি পেয়েছে দেবীকা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ার অভ্যেসটাও অনেকদিন হল নেই দেবীকার। চিরকালই সম্যক এর গাড়িতে ফেরার অভ্যাস। বিয়ের আগে উল্টাডাঙায় ছেড়ে দিয়ে সম্যক সোজা চলে যেত লেকটাউনের নিজের পৈত্রিক বাড়িতে। আর বিয়ের পর তো একসাথেই যাতায়াত। খুব ভালো চালায় গাড়িটা সম্যক। স্যালারির টাকা জমিয়ে অনেক সখ করে কেনা গাড়ি। বিয়ের পর দেবীকা বলেছিল আরেকটু বড় গাড়ি কেনার কথা। অফিসের অনেকেরই সেডান ক্লাস গাড়ি। দুজনে মিলে তো পারেও ওরা। মুখে আঙুল চাপা দিয়ে সম্যক সেদিন বলেছিল, "উহু, ভালোবাসার জিনিস এভাবে ছাড়া যায়না। তাছাড়া বেশ তো চলছে।"

পুরোনো কথা মনে করতে করতে খটকা লাগলো দেবীকার। আজ এত সহজে দেবীকার জেদের কাছে কীকরে নতি স্বীকার করে নিচ্ছে সম্যক?

হ্যাঁ, ডিভোর্সের জেদটা দেবীকারই। বিবাহিত জীবনের খুব প্রথম দিকেই জানতে পেরেছিল যে ওরা বাবা মা হতে পারবে না। একটা মেয়ের কাছে এটা যে কত বেদনার সেটা দেবীকা বুঝেছে এই কয়েকটা বছরে। সম্যকের কাছেও জিনিসটা যে কঠিন সেটা বোঝে দেবীকা। তাই অনেকবার সামলেছে নিজেকে। ভেবেছে দুজন মিলে একসাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবে। অ্যাডপশনটা সম্যকের রক্ষনশীল পরিবারে কারোরই সেরকম পছন্দ নয়। বিশেষ করে সম্যকের বাবার। দেবীকাও তাই জোর করেনি কোনোদিন। সব চাওয়াই যে পাওয়া হবে এরকম সৌভাগ্য দেবীকার নয়। কিন্তু কখনও নিজের বন্ধু বান্ধবী আবার কখনও বা আত্মীয় স্বজনদের কারো কোলে বাচ্চা দেখে চোখের জল বাঁধ মানেনি।


ইদানীং সম্যকও কিকরম নিস্পৃহ হয় আসছিল ওদের বিবাহিত জীবনে। মুখে কিছু না বললেও, ব্যবহারে বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে ওদের সম্পর্কে আগের মত মাধুর্য্য আর নেই। সম্যক যন্ত্রের মত কর্তব্য পালন করে যায়। রাগ প্রকাশ করত না কিছুতেই। তাছাড়া সারাদিনে কর্মব্যস্ত দুটো মানুষের কথাবার্তাই বা কতটুকু হয়‌ যখন ইচ্ছেগুলো ক্লান্তির ছলনায় ভুলে থাকে। কিন্তু রাতের যে বিছানা, যেখানে দুটো মানুষের মন ও শরীরের মাঝে দূরত্বটা কমে আসার কথা, সেখানে দূরত্বটা খুব বেশি করে বোঝা যাচ্ছিল। শেষ মেষ মাস তিনেক আগে লেকটাউন এর শ্বশুর বাড়ি থেকে উল্টাডাঙ্গায় বাপের বাড়িতে চলে আসে দেবীকা।

এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেলো দেবিকা।


তিন :  


আজ সকাল থেকে মনটা আনচান করছে সম্যকের। বারো বছরের ইতিহাসের শেষ দিন আজ। মাস তিনেক হল দেবীকা আর সম্যক একসাথে থাকেনা। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়েও সম্যক কিছু বলেনি। কেনো বলেনি তার কারন নিজেও জানেনা। সেদিন মনে হয়েছিল একসাথে থাকাটা একটা অভ্যাস শুধু। হয়ত একটা বিরক্তিকর অভ্যাস। গত তিনমাসে সেই অভ্যাসটার ডাক কমেনি, কিরকম যেনো কামড়ে বসেছে উল্টে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে ঘরে একটা ধূপের গন্ধ পেত সম্যক। বাজার থেকে জ্যাসমিন ধূপ বাছাই করে কিনে আনতো দেবীকা।

গন্ধটার বোধহয় অভ্যেস হয়ে গেছে সম্যকেরও। কিংবা ভালোলাগা। এক ছাদের নীচে থাকা মানুষের ভালোলাগা গুলোও একরম হয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। ধূপটাও আজকাল তাই নিজেই জ্বালায়। কিন্তু গন্ধটা আগের মত লাগেনা। দেবীকার শরীরের, ভেজা চুলের একটা গন্ধ ছিলো। তিনমাসের অনুপস্থিতিতে সেটা বেশি করে টের পায় সম্যক।


"আজ আমাকে পিক আপ করতে পারবে?" একটা এসএমএস ঢুকলো সম্যকের ফোনে।

"ঠিক আছে..", সম্যক উত্তর দিল।


আজ শেষ দিন বল। তাই কিছুতেই না করবেনা ঠিক করেছে সম্যক। ভাবতে ভাবতে স্নান ঘরে ঢুকলো।


চার:


অফিস শেষে আজ সম্যক ও দেবীকা দুজনেই অফিস পাড়া সংলগ্ন এই ক্যাফেটায় এসেছে। অফিস ফেরত সম্যকই তুলে নিয়েছে দেবীকাকে। একটা পার্কের ভেতর এই ওয়াটার সাইড ক্যাফে। এককালে দেবীকা আর সম্যকের খুব পছন্দের জায়গা ছিল এটা। কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর আসা হয়নি এদিকে। সময় বদলায়, ছোটোখাটো ভালোলাগা পছন্দগুলো প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের চলার পথ থেকে ছিটকে যেতে থাকে। জীবনে বেশি কিছু পাওয়ার প্রতিযোগীতাটাই বোধহয় ছলনা। আসে পাশের টেবিলে কিছু কম বয়সি অফিসের ছেলে মেয়ে বসে।

সম্যক দেবিকার মিউচুয়াল ডিভোর্স। কাগজ গুলোতে সই করতে সময় লাগলো না। অর্ডার দেওয়া কফিটাও পরেই রইলো টেবিলে। সব শেষে অ্যাপ ক্যাব বুক করার জন্য ফোনটা ওপেন করলো দেবিকা।

"আমিই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি", দেবীকাকে ক্যাব বুক করতে দেখে সম্যক বললো।

"তুমি আবার ওদিকে কষ্ট করে কেনো যাবে?"


"কিসের আর কষ্ট, গাড়িইতো চালাবো। আর বাড়ির ছাদটা পাকাপাকি ভাবে চেঞ্জ হচ্ছে শুধু দেবীকা, আমরা থাকবো তো এক আকাশের নীচেই।"


বিল মিটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো দুজন।

সম্যক গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটে চললো নিউটাউন এর ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ছোট্ট শো'পিসটার দিকে চোখ পড়লো দেবীকার। অনেকদিন পর খেয়াল হল এটার কথা। দেবীকারই দেওয়া গিফ্ট, বিয়ের আগের। কোনো অকেশনে নই। এমনিই সময়ে অসময়ে টুকটাক জিনিস কিনত সম্যকের জন্য দেবীকা।


ড্যাশবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালার কাঁচের বাইরে তাকালো দেবীকা। দূরে জ্বল জ্বল করছে আধুনিক কলকাতার হাইরাইজ বিল্ডিং গুলো। ফোর লেনের ফাঁকা রাস্তায় জ্বলছে নিয়ন আলো। 


"গাড়িটা দাঁড় করাবে একবার প্লিজ?"

"এখানে?"

"হ্যাঁ এখানেই।"

সম্যক সাইড করে গাড়ি দাঁড় করাতে, দেবীকা গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। সম্যক আস্তে আস্তে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দুরন্ত বেগে বেড়ে ওঠা এই শহরের হলুদ আলোর রাস্তায় খেয়াল করতে পারলো, দেবীকার চোখের কোনায় জল। আরেকটু পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো সম্যক। দেবীকার হাত একটু উঠে এসে আঙুলগুলো ছুঁয়ে উঠলো সম্যকের। ভালোবাসা বোধহয় এখনও কিছুটা বাকি আছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance