Sabita Ray Biswas

Inspirational

3  

Sabita Ray Biswas

Inspirational

ডুপ্লিকেট

ডুপ্লিকেট

10 mins
301


কে ? হাসছে কে ? উঠে দাঁড়াও | এটা ক্লাব নয়, স্কুল | পড়াশোনা ভালো না লাগলে স্কুলে আসবেনা | বোর্ডের দিকে মুখ করে ট্রিগোনোমেট্রি ফর্মূলা লেখায় মন দিলেন প্রশান্ত স্যার |

                        

                              Sin 2(x) = 2 sin x cos x

                                        Sin 2(x) = 2 sin x cos x

                                        Sin 2(x) = 2 sin x cos x


প্রশান্ত স্যার একই ফর্মূলা বারবার লিখে চলেছেন | তাই দেখে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা অ্যাঞ্জেলিনা সাহস সঞ্চয় করে বলল, স্যার—স্যার- প্রশান্ত স্যার সামনে ঘুরে কড়া চোখে তাকালেন | অ্যাঞ্জেলিনা তোতলাতে তোতলাতে বোর্ডের দিকে আঙুল তুলে কোনরকমে বলল, স্যার বোর্ডে—বোর্ডে--| এবার স্যার ধমক দিয়ে বলে উঠলেন বোর্ডে কি ? সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাস একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো, স্যার বোর্ডে ভুল | ভুল ? কি বলছে ছেলেমেয়েগুলো ? প্রশান্ত স্যারের ভুল ধরছে | আসলে নতুন এসেছে তো ! তাই এখনো চিনে উঠতে পারেনি অনিল স্মৃতি বিদ্যাপীঠের অঙ্কের শিক্ষককে | ৩৬ বছর ধরে এই স্কুলে অঙ্ক করাচ্ছেন তিনি | আজ পর্যন্ত কোনদিন কারো সাহস হয়নি স্যারের মুখের উপর কথা বলতে | অথচ এই পুঁচকে ছেলেমেয়েগুলোর এত সাহস ! প্রশান্ত স্যারের ভুল ধরছে |

প্রবল অনিচ্ছাতেই অন্যমনস্কভাবে বোর্ডের দিকে ঘুরে তাকালেন স্যার | একি ! এসব কি লিখেছেন তিনি ! একই ফর্মূলা বারকয়েক লিখেছেন | এটা কি করে হলো ? তাহলে সত্যিই কি তিনি স্মৃতিশক্তি হারাচ্ছেন?


সেদিন টিচার্স রুমে নতুন এক শিক্ষক বলছিল, স্যার আপনার ঘাড়টা যেন সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে | স্পনডাইলোসিস হয়নি তো ? মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা, হাত ঝিঁ ঝিঁ, আঙ্গুল অবশ হওয়া এসব হয় ? ডাক্তার দেখান স্যার, ডাক্তার দেখান | গাছ গাছড়া খেয়ে কি আর সব জিনিস সারে ? তাহলে আর গাদা গাদা টাকা খরচ করে লোকে ডাক্তারি পড়ে কেন ?


 স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরেই ছেলে বৌমার ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন | কই তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না | এবারে ঘাড়টা একবার বাঁদিকে হেলালেন তারপর ডান দিকে | টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে তাকালেন নিজের প্রতিবিম্বের দিকে | মাথাটা সত্যিই যেন একটু ঝুঁকে আছে | সেই উন্নত শির শালপ্রাংশু চেহারাটা আর নেই | কেমন যেন জীর্ণ শুকনো ভাব | জোরে হাওয়া দিলেই বাকল খসে পড়বে, মট করে ডাল ভেঙে যাবে |


কতক্ষণ যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, হেমলতা এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন | এসব কি হচ্ছে ? বুড়ো বয়সে ভীমরতি ? ছেলের বৌয়ের আয়নায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিলে ? তা দেখার যখন অতই শখ একটা বড় আয়না কেনো | কতদিন বললাম, একটা ড্রেসিং টেবিল কেনো | কাপড় পরতে অসুবিধা হয় | সিঁদুর কৌটো, চিরুনী, পাউডার এসবও রাখা যায় | তা শুনলে আমার কথা ? সেই এক জেদ, অকারণে বড়লোকি কোরো না | ছোটো আয়নাতে অসুবিধা কি ? এখন নিজেই দেখো, অসুবিধা আছে কি নেই ? নিজের শরীরটা ভালো করে দেখতে কার না ইচ্ছে করে !


ছিঃ!ছিঃ! কি লজ্জা ! কি লজ্জা ! বৌমা মুচকি হেসে বলল, মা এবার একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেই ফেলুন | বাবা তিন মাস পরে রিটায়ার করবেন, ভালোই টাকা পাবেন | আপনি তো রোজই আমার ঘরে গিয়ে শাড়ি পরেন, এবার থেকে বাবাও যদি ---


হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক | আর তিন মাস, তিন মাস – না, না, তিন নয়, দু’মাস বাইশ দিন | ষাটবছর হয়ে গেল তবে ! ঠোঁটকাটা ওই ছোকরা মাস্টার রণদেব বলছিল, স্যার আপনার নিশ্চয়ই জল মেশানো আছে বয়সে | আজকাল ষাট বছরে কারো চেহারা এরকম হয় না | নির্ঘাত আপনার সত্তর পঁচাত্তর হবে | কি স্যার, ঠিক বলিনি ? টিচার্স রুমের অন্য শিক্ষকরাও সঙ্গত করেছিল, সত্যি রণদেব তোমার জহুরীর চোখ বলতে হবে | হা—হা—হা—হা—হা—

ওদের এই হাসির জবাব দিতে পারেননি প্রশান্ত স্যার |

কি করেই বা দেবেন ! সত্যিই তো স্যার জানেন না | স্কুলের রেকর্ডে ওনার ডেট অব বার্থ যেটা আছে সেটা ঠিক কিনা ! ভাইবোন মিলে আঠেরো জন, তবে ছয় জন ছোট বয়সেই মারা যায় | বেশ মনে আছে স্যারের, বড় দিদির ছেলে প্রানতোষের সঙ্গে ছোটবেলায় কত খেলেছেন | দুজনে একই বয়সী ছিলেন | অতগুলো ভাই বোন, আত্মীয় কুটুম্ব, বাড়ির কামলা সব মিলিয়ে এক এক বেলাতে প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জনের পাত পড়ত | মাকে দেখেছেন, হয় রসুইঘরে, নয় আঁতুড়ঘরে | কে খেলো, কে খেলো না সেসব খেয়াল রাখত না কেউ | খিদে পেলে খাবে এমনই ধারণা ছিল | কেউ একজন খেয়ে উঠে গেলে সেই পাতেই চারটি ভাত ঢেলে দিত পিসি | বালবিধবা ওই পিসি না থাকলে হয়তো ঠিক করে খাওয়াযই হতোনা প্রশান্তর | বড় দাদা প্রসাদ স্কুলে যেত | প্রসাদ একদিন প্রশান্ত আর নিশান্তকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল | কিন্তু কয়েকদিন স্কুলে যাবার পরে নিশান্তকে আর নিয়ে যেতে পারল না | ওই সময়েই হয় সে বাড়ি থাকতো না, নয় তার প্রচন্ড পেট ব্যথা করত | কিন্তু প্রশান্ত ছিল ভালো ছেলে, দাদার সঙ্গে রোজ স্কুলে যেত |


খুব কষ্ট হত স্কুলে যেতে | সেই কোন সকালে ফেনা ভাত খেয়ে দু’ভাই রওনা দিত শোনতালা গ্রাম থেকে | পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে তবে স্কুলে পৌঁছানো যেত | বর্ষাকালে জলে ভরে যেত রাস্তার খানিকটা অংশ, তখন সেটাকে ডোবা বলতো সবাই | নৌকাও চলেনা, হেঁটেও যাওয়া যায় না | যেতে হত অনেক ঘুরে | আসা যাওয়ায় দশের জায়গায় চৌদ্দ কিলোমিটার হত | প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব বেলাল হোসেন | ইংরেজি অঙ্ক দুটোই নিতেন | আট কিলোমিটার হেঁটে আসা যাওয়া করতে হত তাকেও | কিন্তু কোনদিন দেরী করে আসেননি | অন্যদের দেরী করে আসাটাও মেনে নিতেন না | সে শিক্ষক ছাত্র যেই হোক না কেন | সেই বেলাল স্যারের কাছে নিয়মানুবর্তিতার পাঠ নেওয়া প্রশান্ত স্যার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকুরী জীবনে কোনদিন কোন কাজে দেরী করেননি,অবহেলা করেন নি |


স্কুলে পাট ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে, আলপথ দিয়ে যাওয়া যেত | যখন প্রশান্ত সিরাজগঞ্জ কলেজে ভর্তি হলেন অঙ্কে অনার্স নিয়ে, সেই সময় সিরাজগঞ্জে ছাত্রদের মেস ছিল দু’একটা | কিন্তু প্রসাদ, প্রশান্ত মেসে থাকতে পারেনি | মাসে মাসে যে টাকা দিতে হবে, সেই টাকাটা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না | মোটা চালের ভাত, ডালের অভাব ছিল না | মাছ এর অভাবও ছিল না | করতোয়া নদী ছিল কাছেই | তাই অন্য বাঙ্গালীদের মতোই মাছ ভাতের অভাব না থাকলেও কাঁচা টাকার অভাব ছিল |


গ্রাম পেরিয়ে এসে করোতোয়া নদী পেরোতে হত | সেখান থেকে তিন কিলোমিটার হাঁটার পর উল্লাপাড়া স্টেশন | উল্লাপাড়া থেকে সত্তর কিমি দূরে সিরাজগঞ্জ | স্টেশন থেকে দেড় কিলোমিটার হাঁটলেই কলেজ |


গ্রাম থেকে কলেজ যাতায়াতের বর্ণনা কয়েকটি বাক্যে যত সহজে করা গেল তেমন সহজ ছিল না | সিরাজগঞ্জে অঙ্ক করাতেন স্যার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | তিনিও বেলাল স্যারের মতই খুব কড়া ছিলেন | ছাত্রদরদী শিক্ষকের মনটা ছিল খুব নরম, সেটা বুঝতে পারতেন প্রশান্ত | অঙ্ক বোঝানোর সময় প্রশান্তর মনোযোগ নজর এড়াত না সৈয়দ স্যারের |


ঘুম ভাঙলেই সিরাজগঞ্জ যেন চুম্বকের মতো টানত প্রশান্তকে | ঈদের ছুটিতেও মনে হত কবে যে শেষ হবে ছুটি! সেটা কি শুধুমাত্র অঙ্কের টানে ? না কি সে ? যে প্রথম দিনই অঙ্ক ক্লাস শেষ হওয়ার পর এগিয়ে এসে মুখের ওপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে বলেছিল আমি রাবেয়া, রাবেয়া খাতুন | স্যারের বোঝানো অঙ্কটা কিছুতেই ধরতে পারছিনা | আপনাকে দেখলাম ভালই বুঝেছেন, প্লিজ একটু বুঝিয়ে দেবেন | প্রশান্ত খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন | গ্রামেই কোনদিন অনাত্মীয় মেয়ের সঙ্গে কথা বলেননি | কলেজে ভর্তির প্রথম দিনই একটা অচেনা মেয়ে ওর সঙ্গে এগিয়ে এসে কথা বলছে, এটা এতটাই আকস্মিক যে প্রশান্ত কি করবে বুঝতে পারছিল না | কিন্তু রাবেয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল ঠিক আছে আপনার অসুবিধা থাকলে পরে এটা নিয়ে কথা বলবো |


ঠিক তখনই প্রশান্তর মনের ভেতর থেকে কে যেন বলেছিল না, না, পরে নয় | এই তো সময় | এরপরে অনেকবার রাবেয়ার মুখোমুখি হয়েছে প্রশান্ত, কিন্তু ওর চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি | তবে পায়ের দিকে তাকিয়ে থেকেছে কতদিন ! ক্লাসের ফাঁকে বা করিডর দিয়ে রাবেয়া যখন হেঁটে যেত, প্রশান্ত সকলের নজর এড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে রাবেয়ার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতো | কোন মেয়ের পা যে এত সুন্দর হতে পারে ভাবতেই পারেনা প্রশান্ত | ঠিক যেন লক্ষ্মীঠাকুরের পা, হেঁটে গেলে পদ্মফুল ফুটে উঠবে |


খুব কাছের বন্ধু ব্যোমকেশ মজুমদার ধরে ফেলেছিল প্রশান্তর এই গোপন চরণপ্রীতির ব্যাপারটা | প্রশান্তর মাথায় চাঁটি মেরে বলেছিল, ওরে বাবা ও হল জজ সাহেবের মেয়ে, দুধ দিয়ে গোসল করে | নরম কার্পেট ছাড়া পা পাতে না | ওর পা লক্ষ্মী ঠাকুরের মত কিরে ! তার থেকেও সুন্দর, কারণ লক্ষ্মীঠাকুর গরীবের গোবর নিকানো উঠোনেও পা রাখে |


ঠিকই বলেছিল ব্যোমকেশ | ব্যোমকেশ খবর রাখতো খুব | রাবেয়া ছাড়াও মাহেলা আর সাজেদা পড়তো ওদের সঙ্গে | ওদের অবস্থাও ভাল ছিল, তবুও ওরা রাবেয়াকে এড়িয়ে চলত | হয়তো রাবেয়া জজ সাহেবের মেয়ে বলেই | কিন্তু আশ্চর্য মেয়ে রাবেয়া, সকলের সঙ্গে এত সহজ ভাবে মিশতো, হয়তো এই জন্যই প্রশান্তর রাবেয়াকে অত ভাল লাগত | কিন্তু রাবেয়া প্রশান্তকে পছন্দ করত কেন ? সেটা কি প্রশান্ত ভালো অংক বোঝাত বলে?


রাবেয়া যে প্রশান্তর প্রেমে পড়েছে সেটা প্রশান্ত বোঝার আগেই বুঝেছিল ব্যোমকেশ, বলেছিল ওরে প্রশান্ত রাবেয়া যে তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে রে ! প্রশান্ত ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, চুপ্ চুপ্ | কে কোথায় শুনে ফেলবে, শেষমেষ হয়তো এই জন্যই রাবেয়ার বাবা প্রশান্ত কে জেলে পুরে দেবে | সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বেঁধে যেতে পারে | কিন্তু মনের কথাটা যে মিথ্যে নয় সেটা প্রশান্ত বুঝেছিল ডিগ্রী পরীক্ষার শেষ দিন | পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসছিল প্রশান্ত, মনটা একইসাথে খুশি আবার দুঃখীও | খুশি, কারণ এরপরে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবে বলে, আর দুঃখী বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হবে তাই-----


 ছাড়তে হবে রাবেয়াকেও | হয়তো আর কোনোদিনই রাবেয়ার সঙ্গে দেখা হবে না | দেখা, শুধু দেখা | ওইটুকুতেই যে কি সুখ ছিল ! তার বেশি ভাববার সাহস কোথায়? সেটুকুও আর রইল না | প্রশান্তকে ব্যোমকেশ খবর দিয়েছে লন্ডনের কিংস কলেজে ভর্তি হবে রাবেয়া |


একটু দাঁড়ান |

 এ তো রাবেয়ার গলা | হ্যা, তাইতো | প্রশান্তকে দাঁড়াতে বলছে, কিন্তু কেন? ভাবনাটা সম্পূর্ণ হবার আগেই রাবেয়া এসে প্রশান্তর মুখোমুখি দাঁড়ালো | আগের মতোই প্রশান্তর চোখ চলে গেল রাবেয়ার পায়ের দিকে | গোলাপী সালোয়ার পরেছে রাবেয়া | স্যান্ডেল ও গোলাপী | যেন একজোড়া পদ্মফুল ফুটে আছে |


আপনার কলমটা দিন | কলম? হ্যাঁ, কলম | দিন | পকেট থেকে এক টাকায় কেনা কলমটা কুন্ঠাভরে রাবেয়ার হাতে দিলো প্রশান্ত | এই একটাই কলম প্রশান্তর, এটা দিয়েই পরীক্ষা দিয়েছে ও | কলমটা নিয়ে রাবেয়া ওর ব্যাগে রেখে দিলো | প্রশান্ত কি বলবে বুঝতে পারছে না | রাবেয়া ওর গোলাপী ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে বললো, আমি জানি এই কলমটা আপনার খুব প্রিয়, তাই নিলাম | প্রশান্ত অস্ফুটে বলল আমার আর কলম নেই |


রাবেয়ার টানা টানা চোখ দুটো খুব সামান্য সময়ের জন্য ম্লান হয়ে গেল, কিন্তু সামলে নিল | ব্যাগ থেকে ভীষণ দামী শেফার্স কলম বের করে প্রশান্তর হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা রাখুন | তারপর আর ফিরে তাকায়নি | কলেজ গেটের বাইরে অপেক্ষারত বিদেশী ফোর্ড মাসট্যাং এ উঠে পড়েছিল | নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল প্রশান্ত স্যারের | পাশেই ছিল সুখময় স্যার | গায়ে হাত রেখে বললো, কেন আসছে স্কুলে? তোমার তো অনেক ছুটি জমে আছে, সব নষ্ট হয়ে যাবে | বাড়ি থেকে একটু রেস্ট নাও | জীবনটা তো ছাত্রদের পিছনেই দিয়ে দিলে | চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে এলো প্রশান্ত স্যারের | সত্যিই তাই | কোনোদিন ছাত্রদের কথা ছাড়া কিচ্ছু ভাবেননি, সেজন্য স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবাই ওনার প্রতি অসন্তুষ্ট | কেবল এই সুখময় বোঝেন প্রশান্ত স্যারের কষ্টটা ঠিক কোথায়?

অবক্ষয়! অবক্ষয়! সত্যিই কি ভারতবর্ষে এগোচ্ছে নাকি ফিরে যাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে | আজকাল আর খবরের কাগজ দেখতে ইচ্ছে করে না | পরের পিরিয়ড অফ | তাই টিচার্স রুমে বসেছিলেন প্রশান্ত স্যার | নতুন শিক্ষক শিক্ষিকারা কয়েকজন মোবাইল নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিল | তার মধ্যে ওই রণদেব ও আছে | হঠাত বলে বসল, আচ্ছা স্যার আপনার নামটা কে রেখেছিলো বলুনতো! তাকে একবার পেন্নাম করব | আপনি তো স্যার নামেই বিখ্যাত | স্যার প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ | তবে আসল নয় ডুপ্লিকেট | বলেই হো হো করে হেসে উঠলো রণদেব | চন্দ্রিমা, জিওগ্রাফির টিচার, ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল ছিঃ! ছিঃ! এসব কি হচ্ছে রণদেব ! তুমি স্যারের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে পারো না | আর ক’দিন পরে স্যার অবসর নেবেন | তারপরে বলল, ক্ষমা চাও স্যারের কাছে | কেন ক্ষমা চাইবো কেন? আমি কি কিছু ভুল বলেছি? এবার শিক্ষকসুলভ ভঙ্গিতে চন্দ্রিমা বলল, ভুল কি ঠিক, সেটা বোঝার মত ক্ষমতা তোমার নেই রণদেব | যা বললাম সেটা করো |


ভালো করে প্রশান্ত স্যার তাকালেন চন্দ্রিমা নামের নতুন আসা শিক্ষিকাটির দিকে | ওর কন্ঠস্বর অনেকটা রাবেয়ার মতো না! আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে রাবেয়া ও প্রতিবাদ করেছিল সিরাজগঞ্জ কলেজে | খয়রুল ইসলাম প্রশান্তর সহপাঠী ছিল | সেও নাম নিয়ে এইরকমই ঠাট্টা করেছিল |


 না, ওই নামের মিল ছাড়া কোনো মিলই নেই ডক্টর প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের সঙ্গে | এরকম স্বপ্ন দেখার সাহস ও ছিলনা প্রশান্তর | সম্ভব ও ছিল না | কিন্তু রাবেয়া পৌঁছতে পেরেছে মহলানবীশ স্যারের পদধূলি ধন্য কিংস কলেজে | সেখানকার ফেলো ছিলেন ডক্টর মহলানবীশ | এখন ওখানেই আছে রাবেয়া | অনেকদিন আগে এই খবরটা দিয়েছিল ব্যোমকেশ | ও থাকে ইউএসএ, একটা কনফারেন্সে দেখা হয়েছিল রাবেয়ার সঙ্গে | শত ব্যস্ততার মাঝেও ব্যোমকেশ চিঠি লিখতে ভোলেনা কলেজ জীবনের এই মুখচোরা বন্ধুটিকে |


ব্যোমকেশের চিঠিগুলো রাবেয়ার দেওয়া শেফার্স কলমের মতই খুব যত্নে গোপনে রেখেছেন প্রশান্ত | চিঠিগুলো পুরোপুরি ব্যোমকেশের নয়, রাবেয়ারও | যেখানে লেখা আছে আজ যেখানে পৌঁছেছে রাবেয়া, তার পেছনে অনেকখানি অবদান আছে প্রশান্তর | প্রশান্তর জন্যই অংকের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল রাবেয়ার | এখন রাবেয়ার আন্ডারে দুটি ছেলে রিসার্চ করছে যারা একসময় অনিল স্মৃতি বিদ্যাপীঠে প্রশান্ত স্যারের ছাত্র ছিল |


সৈয়দ সাহেবের খুব প্রিয় ছাত্র ছিলেন প্রশান্ত | স্যার বলতেন, তোমার মত ছাত্রদের মাঝেই আমি বেঁচে থাকব, তেমনি তুমিও | মিলিয়ে নিও আমার কথাটা | ঠিক তাই, প্রশান্তর কত ছাত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে | তাদের কেউ কেউ বাড়িতে এলে স্যারকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে যায় |


সবাই রণদেব, খয়রুল নয় | রণদেব খয়রুলের চোখে প্রশান্ত যাই হোন না কেন, রাবেয়ার কাছে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ একজনই | ডুপ্লিকেট নয় অরিজিনাল |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational