Sabita Ray Biswas

Others

3  

Sabita Ray Biswas

Others

বেগম সাহেবার থান

বেগম সাহেবার থান

6 mins
331



বাপরে বাপ ই কি ঝড়! উড়ি নি যাবে নাকি? গরুডা যে কমনে গেল? একন কি করি? ঘর পানে যাবো? না: গরুডারে না নিয়ি যাই কি করি? পোয়াতি গরু! ওরে আল্লারে, দিয়া নল্কাচ্ছে কি! কানে তালা ধরে গেল | ই কি! ই কি! কাপড়খানা উইড়ে নে গেল যে! খপরে বলেছেল ঘরে থাকতি | এই গরুডা দড়ি না ছিঁড়লি এমন বেড়ম্বনায় পড়তি হত না |


আমফানের দাপটে নূরজাহান বেগমের বাকি কথাগুলো আর শোনা গেলনা | শোনা যাবে কি করে? বেগম তখন দুরন্ত বাতাসের তালে নাচছেন | মিছে কথা নয়, সনাতন মোহন্তর নিজের চোখে দেখা | মোহন্তর বাড়ি মিনাখাঁর দক্ষিন পারগা গ্রামের আবেদালির মাঠের ধারে | আমফান ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল মোহন্ত | সেখান থেকে বাড়ি এসেছিল টাকাগুলো নিতে | মাটির ছোট হাঁড়িতে করে কটা টাকা ঘরের মেঝেতে পুঁতে রেখেছিল | মোহন্ত ভেবেছিল কেউ যদি নিয়ে নেয়! সেই ভয়ে টাকাগুলো বেশ করে ট্যাঁকে গুঁজে ফিরছিল ত্রাণশিবিরে | মাঝমাঠে চেপে ধরল আমফান | ঝড়ের থেকে, বজ্রপাত থেকে বাঁচতে গোঁসাই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল মাটিতে | ঠিক তখনই দেখতে পেল সেই দৃশ্য!


নূরজাহান বেগম মাটি থকে অন্তত বিশ ফুট উঁচুতে উঠে ঘুরপাক খাচ্ছে | ঘুরপাক খেতে খেতে মস্ত বটগাছের দিকে উড়ে গেল | মোহন্ত ওই দেখে মুচ্ছো গেল | চোখ খুলল সেই খুঁকড়ো ডাকা ভোরে | যদিও সেদিন আর একটাও খুঁকড়ো ডাকেনি | মোহন্ত গাঁয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল সব ফাঁকা, সব শূণ্য | একটা বাড়িও আস্ত নেই | গাছ নেই একটাও | কিন্তু বটগাছটা দাঁড়িয়ে আছে | ডালপালা মেলে নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে | আমফান বটগাছের একটা ঝুরি ও ছুঁতে পারেনি | কিন্তু বটগাছের ওপরে ও কে?


মাটি থেকে বিশ পঁচিশ ফুট ওপরে দু হাত দিয়ে বটগাছকে জড়িয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে নূরজাহান বেগম | বটগাছের গা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে এসে পড়ছে গুঁড়িতে | মোহন্ত দু হাত মাথায় তুলে চললো গ্রামের দিকে | হরি হে তুমি এ কি দেখালে হরি! দয়াল তোমার এ কি লীলা!


যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল ছুটে এলো | ঘর বাড়ি ভেঙ্গে গেছে সকলের | চাপা পড়েছে হাঁস মুরগী | বাদ যায়নি গরু ছাগল ও | সেই সব শোক তাপ ভুলে সবাই জড়ো হল বটগাছের তলায় | তারপর সেই দৃশ্য দেখে কেউ মুচ্ছো গেল. কেউ হায় আল্লা এ কি দেখালে! এ তোমার আজব খেল আল্লা! মেয়েরা বেশিরভাগই উলু দিল | কেউ গিয়ে বটগাছের গোড়ার সেই রক্ত দিয়ে কপালে তিলক কাটলো | হরেন ঠাকুরের বিধবা মানোদা ঠাকুরানী বাড়ি থেকে ধূপ নিয়ে এসে জ্বেলে দিল বট গাছের গোড়ায় | গলায় আঁচল জড়িয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো |


 সামসুদ্দিন মাস্টার ছিল ত্রাণ শিবিরের দায়িত্বে | খবর পেয়ে ছুটে এলো | বললো, এসব কি হচ্ছে? চাচিকে গাছ থেকে নামাও | বাতাসের ধাক্কায় উড়ে গিয়ে বটগাছে বিঁধে আছে কোনো ডালের সঙ্গে | সনাতন মোহন্ত বললো, হ্যাঁ, ম্যাস্টর আমি নিজের চোখে দেখেছি | বেগম বাতাসে উড়ছিল | মাস্টার বললো, তবে শুনলেন তো! এর মধ্যে অন্য কিছু নেই | অমনি মোহন্ত বললো, নিশ্চয় আছে | বেগম দুই হাত দিয়ে, নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেছে এই বটগাছকে | যেখানে সব গাছ ভেঙ্গে গেছে সেখানে বটগাছের একটা ডাল ও ভাঙলো না কেন?


অন্য সকলে একযোগে বলতে শুরু করলো, তুমি থামো মাস্টার | দু’কলম পড়ে তুমি মস্ত তালেবর হয়েছো? এ আল্লার কারসাজি | শামসুদ্দিন মাস্টার বুঝলো, এইসব লোকজনকে থামানো যাবেনা | বোঝানো ও যাবেনা | তাই নিজেই উঠে পড়ল বটগাছে | মাস্টারকে উঠতে দেখে ঘনশ্যাম ও উঠলো | তারপর অনেক কষ্টে দুজনে ধরাধরি করে নূরজাহান বেগমকে নামিয়ে আনলো | মাস্টারের কথাই সত্যি, একটা ভাঙা ডাল গেঁথে গিয়েছিল বেগমের বুকে | তাই ঐভাবে আটকে ছিল | বুকের রক্ত গড়িয়ে নেমেছে বটগাছের গোড়ায় |


সামসুদ্দিন মাস্টারের কোনো যুক্তিপূর্ণ কথাই শুনতে রাজি নয় পারগা গ্রাম | রমজান মোল্লা, সনাতন মোহন্ত সকলের একই বক্তব্য এ হরির কেরামতি, এ আল্লার আজব খেল | সামসুদ্দিন মাস্টার থানায় খবর দিয়ে নিজের ভাঙা ঘরের দাওয়ায় গুম হয়ে বসে থাকলো | নিজের অক্ষমতার কাছে বড় অসহায় মাস্টার | একবিংশ শতাব্দীতেও যদি এরা বাস্তবকে অস্বীকার করে!


উঠে দাঁড়ালো মাস্টার | বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে থেকে উদ্ধার করলো কাঁচ ভাঙা ছবিটাকে | কাঁধের গামছা দিয়ে পরম মমতায় মুছে নিল ছবিটা | স্বামী বিবেকানন্দের ছবিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়ালো | তারপর চললো ত্রাণ শিবিরের দিকে | অনেক কাজ সেখানে | আমফান ঝড়ে সব হারানো মানুষগুলোর মুখে এই করোনাকালের লকডাউনে অন্তত একমুঠো খাবার তুলে দিতেই হবে | 


নূরজাহান চাচির ঘর ভেঙ্গে গেছে | তার তলায় চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে জাহাঙ্গীর চাচা | কোনরকমে ঘেঁসটে ঘেঁসটে বেরিয়ে এসেছিল গোঙাতে গোঙাতে | কথা বলতে পারেনা চাচা | জন্ম থেকেই গোঙা | কিন্তু খাটতে পারতো খুব | বছর দশেক আগে ভটভটি গাড়ি উলটে খাদে পড়ে চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে | তারপর থেকে চাচি হাঁস মুরগীর ডিম বিক্রি করে, গরুর দুধ যোগান দিয়ে কোনরকমে চালাচ্ছিল | চাচি সেইজন্যেই সামসুদ্দিন মাস্টার বারবার বলা সত্বেও প্রাইমারি স্কুলের ত্রাণশিবিরে যায়নি | চাচা ফ্যাল ফ্যাল করে চারিদিকে তাকিয়ে চাচিকে খুঁজলো | তাই দেখে রমজান মোল্লার ছোট নাতনি বললো, নানা কাকে খোঁজো? তোমার বেগম আর এই ভাঙা কুঁড়েঘরে আসবে না | নানি তো বেহেস্তে | গোঁ গোঁ করে জাহাঙ্গীর মিঞা কি যেন বললো | আর জোরে জোরে মাথা নাড়ালো | তাই দেখে দশ বছরের সাবিনা বেশ মজা পেল |


সাবিনার বন্ধু ফিরোজাও ফিরছিল বটগাছ দেখে | সেও দাঁড়িয়ে পড়ল মজা দেখতে | সাবিনা বললো, শোনো নবাব, তোমার বেগম এখন জান্নাতে সোনা রুপো দিয়ে তৈরী বাড়িতে থাকবে, দুধের নদীতে গোসল করবে, ভালো ভালো খাবার খাবে | তোমার এই বাড়িতে নানি আর ফিরে আসবে না | এসব শুনে জাহাঙ্গীর মিঞা হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা লাঠি নিয়ে ইঁ ইঁ করে তাড়া করলো ওদের | ওরা চলে যেতে বোবাকান্নায় ভেঙ্গে পড়ল জাহাঙ্গীর | সবটা না বুঝতে পারলেও এটা বুঝেছিল বিবির ইন্তেকাল হয়েছে | বিবি আর ফিরবে না |


জাহাঙ্গীর মিঞা আর নুরজাহান বেগম ছিল পারগা গ্রামে চর্চার বিষয় | কেউ কেউ বলতো পাঁচশো বছর আগের সেই নবাব আর বেগম ফিরে এসেছে আমাদের গ্রামে | এমনই ছিল ওদের প্রেম | তাই বেগমকে হারিয়ে গোঙা মানুষটা আছাড়ি পিছাড়ি খেতে লাগলো | পুলিশ এসে বেগমকে নিয়ে গেল | বেগমকে শেষ দেখাটুকুও দেখতে পেল না বর্তমানের নিঃস্ব সম্রাট জাহাঙ্গীর |


ঝড়ের পরে কেটে গেছে পনেরো দিন | এখনো পারগা গ্রামের বেশিরভাগ লোক রাত কাটাচ্ছে নীল অথবা কালো ত্রিপলের নীচে | অসহায় মানুষগুলো জানেনা সত্যি সত্যি যদি নিসর্গ ঝড় হানা দেয় এই গ্রামে, তবে নূরজাহান বেগমের মতই কি বটগাছে ঝুলবে ওদের দেহ? এসব কিছু না জেনেও বটগাছের গোড়ায় বাঁশ আর কঞ্চি দিয়ে তৈরী করেছে ছোট্ট ঘর | তাতে নূরজাহান বেগমের একটা ছবি রেখেছে ছোট্ট বেদীতে | এই একটাই ছবি ছিল নবাব আর বেগমের যৌবনের সুখস্মৃতি হয়ে | মোল্লা আর মোহন্ত মিলে ছবিটা মাঝখান দিয়ে কেটে নবাবের ছবিটা ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে | একটা পুরনো গুড়ের টিন কেটে তাতে আলকাতরা দিয়ে লিখে দিয়েছে “বেগম সাহেবার থান” | কাঁতার দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে মুখ কাটা নারকেল তেলের কৌটো |


এ গ্রাম ও গ্রাম থেকে বেগম সাহেবার থানে আসছে মহিলারা | তারপর মানত করে ইঁটের টুকরো লাল সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বটগাছে | যাবার সময় ঝনাত্ করে বেজে উঠছে নারকেল তেলের কৌটো |


সামসুদ্দিন মাস্টার ও রোজ আসে থানে | বটগাছে ঝোলানো ইঁটের টুকরোগুলো গোনে | এক—দুই—তিন—তিরিশ---ষাট---একশো কুড়ি--- তারপর খেই হারিয়ে ফেলে | আবার প্রথম থেকে গুনতে শুরু করে সামসুদ্দিন মাস্টার |



Rate this content
Log in