STORYMIRROR

Sucheta Banerjee

Inspirational

2  

Sucheta Banerjee

Inspirational

দাদা

দাদা

4 mins
1.2K


গাড়িতে স্টার্ট দিতে যাবে, এমন সময় রিয়ার ভিউ মিররে নকুলের চোখে পড়ল ফোনটা, পেছনের সীটের এককোণে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে।

হাত বাড়িয়ে ও তুলে নিল জিনিসটা। নোকিয়া ফোন, বহু পুরনো মডেল। একসময় নিশ্চয়ই ঝকঝকে রঙিন ছিল বহুব্যবহারে ধাতব শরীরের অনেকটাই ঘষে, ক্ষয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে।

নির্ঘাৎ ঐ ছেলেমেয়েদুটোর একজনের হবে। এইমাত্র নেমে গেল হাজরার মোড়ে। মনে মনে বিরক্ত হল নকুল। প্রেমের আবেশে এমনই মশগুল যে, ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতেরও খেয়াল নেই। নব্বইয়ের ওপর দশটাকা যেচে টিপস দিয়ে গেল, কারণ খুচরো ফেরত দিতে ওর একটু দেরি হচ্ছিল।


যাকগে, মরুকগে। ফোনটা সিটের পাশে রেখে গাড়ি চালিয়ে দিল নকুল। ওর কী আসে যায়! যার হারিয়েছে,সে নিজের গরজেই ফোন করবে।

রবীন্দ্রসদনের সামনে জ্যামে আটকে আছে, ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। কলটা নিলো নকুল, হ্যালো!

-- হ্যালো...আমি,..মানে, যে ফোনটা আপনি...

--জানি।ফোনটা আপনি আমার ট্যাক্সিতেই ফেলে গেছেন। এটা আমার কাছেই থাকবে, নিশ্চিন্ত থাকুন।

-- বাঁচালেন মশাই। আমি এখন হাজরায় আছি। ওটা কীভাবে কোথায় পাব যদি একটু বলেন! 

--এখন তো হবে না। এখন আমি প্যাসেঞ্জার নিয়ে হাওড়া শিবপুর যাচ্ছি। আপনি বরং রাত দশটা নাগাদ পার্ক সার্কাস ট্যাক্সি ডিপোতে চলে আসুন। আমার ট্যাক্সি ওখানকার। আমি যদি না-ও থাকি, ডিপোর মালিক ইসমাইল আখতারের খোঁজ করবেন। ওর কাছে ফোন রেখে যাব।

--অসংখ্য ধন্যবাদ! আপনার নামটা?

--নকুল দাস। গাড়ির নাম্বারটা নোট করে নিন, WB04....

তারপর ওর নাম ঠিকানা টুকে নিল নকুল। আখতারকে বলে রাখতে হবে।


আজ নকুলের কপালটা ভাল বলতে হবে। শিবপুর থেকে একটা শাঁসালো পার্টি পেয়ে গেল। সোজা বারুইপুর, লম্বা পথ।

বিদ্যাসাগর সেতুর কাছালাছি আবার বেজে উঠল ফোনটা। এঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। খুব উচিত ছিল ওটা অফ করে রাখা। আসল মালিকের সঙ্গেই যখন কথা হয়ে গেছে, ওটা খুলে রাখার কোন মানেই হয় না আর।

বেজে বেজে থেমে গেল একসময়।

গাড়ি যখন ব্রীজের মাঝামাঝি, আবার ফোন এল। সেতু থেকে নামতে নামতে চারটে মিসড কল। বন্ধই করে দিচ্ছিল, প্যাসেঞ্জার বললেন, ধরছেন না কেন ফোনটা? অন্ততঃ ব্যস্ত আছি, ড্রাইভ করছি, এইটুকু তো বলা যায়?

নকুল ওঁকে সংক্ষেপে বলল ঘটনাটা। ভদ্রলোক চুকচুক করে আক্ষেপের শব্দ করলেন, সো কেয়ারলেস ফেলো!

নকুল ভাবল, ফোনটা সুইচ অফ করে দেয়। আবার কী মনে হতে ফোনটা নেড়েচেড়ে কললিস্ট সার্চ করল। চারটে মিসড কলই এসেছে একটাই নম্বর থেকে--বোনটি।

কোন বিপদ-আপদ নয় তো!

আচ্ছা ঝামেলা তো! তেমন কিছু যদি হয়ও, নকুল এখন ওর দাদাকে কোন গর্ত থেকে টেনে তুলবে?

বিরক্ত হলেও কে জানে কেন, ও ফোন করল ঐ ফোনটা থেকে। স্পীকার অন করে রাখল, হাতে স্টিয়ারিং, হাজার হোক! 

অপরপ্রান্ত থেকে একটা কাতর ক্ণ্ঠস্বর ভেসে এল, দাদা! দাদা রে!

--হ্যাঁ, দেখুন বোনটি, আমি...

-- দাদা, মা চলে যাচ্ছে! মা! তোর

মা, আমার মা, চিরজীবনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে দাদা! তুই আসবি না? এখনও মুখ ফিরিয়ে থাকবি? দাদা রে, আমি যে চোখে অন্ধকার দেখছি!

--কী হয়েছে মায়ের?

 জবাবে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল বোনটি, মৌলালির কাছে, রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় ছিটকে গেছে রে দাদা! মাথায় চোট। ডাক্তার বলছে, বাঁচা কঠিন। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। বাঁচাতে হলে অনেক রক্ত চাই, অনেক।

-- কিন্তু...আমি...

-- মাথাটা ফেটে চৌচির। অনেক রক্ত চাই। দাদা, অভিমানের সময় এ নয় দাদা! ফিরে আয়! শেষ দেখা দেখবি না? মা যে অজ্ঞানেও বাবলু বাবলু করছিল রে!

নকুল নিজের অজান্তেই গাড়িটা সাইড করেছে। কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল, কোন হসপিটালে আছে মা?

--এন আর এস। তুই আসছিস তো দাদা?

-- আমি...আমি...মানে আমি তো...

নকুলের হাত থেকে এক ঝটকায় ফোনটা কেড়ে নিলেন প্যাসেঞ্জার ধীরাজবাবু, কত রক্ত লাগবে? কী গ্রুপ?

-- ছ' বোতল রেডি রাখতে বলেছে, এ নেগেটিভ, কিন্তু... আমার দাদা...আপনি...

গম্ভীরস্বরে বললেন ধীরাজবাবু, হ্যালো বোনটি, কোন চিন্তা কোরো না। তোমার দাদা যাচ্ছে, এবং রক্ত নিয়েই যাচ্ছে।

তারপর নকুলের উদ্দেশ্যে বললেন, হাঁ করে দেখছেন কি? চলুন এন আর এস। পার্ক সার্কাস ওভারব্রীজ ধরুন।

-- কিন্তু ওর দাদা? তাকে কোথায় পাব?

-- নিকুচি করেছে দাদার। চলুন আপনি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। 

-- ছ' বোতল রক্ত?

-- রাখে হরি মারে কে?


রবিবারের কলকাতা।চোখের নিমেষে পার্ক সার্কাস পৌঁছে গেল ওরা। শিয়ালদার দিকে যাচ্ছে, বাধা এল, উঁহু, ওদিকে নয়, ডানদিকে চলুন।

--কিন্তু, এন আর এস তো...

--রক্ত নিতে হবে না?


-- বোনটি! এই যে...আমি এসে গেছি।

বোনটি তো হতভম্ব। এমন দুজন অজ্ঞাতকুলশীল দাদা তো সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।

-- দা-দা? আমার দাদা?

নরম হেসে বললেন ধীরাজবাবু, মায়ের অপারেশন চলছে তো?

--অ্যাঁ! হ্যাঁ, চলছে। এই তো ভেতরে ঢোকালো। কিন্তু... আপনারা? আমার দাদা কই?

-- সে এক লম্বা কাহিনী। এই নাও রক্ত। এ নেগেটিভ। বহুকষ্টে যোগাড় করেছি বোন। শিগগির ভেতরে খবর পাঠাও।...আরে হাঁ করে দেখছ কী?....সিস্টার! এই সিস্টার! ব্লাড এনেছি, এ নেগেটিভ। এঁনার পেশেন্ট, অ্যাক্সিডেন্ট কেস...।

--দাদা!! 

কথা ফুটল বোনটির হতভম্ব মুখে।

--বলব, সব বলব। এখন আগে মা-কে বাঁচাতে হবে তো, নাকি!

-- এক বোতল কম আছে যে?

চওড়া হাসলেন ধীরাজবাবু, না। কম নেই। পুরোই আছে।

-- না, মানে, ওরা তো ছয় বলেছিল। 

-- বাকি এক বোতল তোমার সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে আছে বোনটি!

--দাদা!!

ডুকরে কেঁদে উঠল বোনটি।

পরম স্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ধীরাজবাবু, আমিও এ নেগেটিভ।সিস্টারকে বলে রেখেছি। সময় হলেই আমায় ডাকবে। তোকে কথা দিচ্ছি বোন। মা-কে না নিয়ে আমরা ভাইবোন আজ কিছুতেই ফিরব না এখান থেকে...!


Rate this content
Log in

More bengali story from Sucheta Banerjee

Similar bengali story from Inspirational