Partha Pratim Guha Neogy

Romance Tragedy

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Tragedy

বসন্ত এসে গেছে

বসন্ত এসে গেছে

6 mins
562


শীত চলেই গেছে বলতে গেলে। এখনকার বিশ্বায়নের নানা উন্নয়নের সাথে উষ্ণয়ানের মাত্রাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর হাত থেকে গ্রাম বাংলাও রেহাই পায়নি। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তামাটে বর্ণের মসৃণ কপালে। আজ বেশ দেরি হয়ে গেল। মেলা আজকের মত শেষের পথে, হয়ত খরিদ্দার এক-দু’জন এখনও আসবে বসে থাকলে। আর ইচ্ছে করছে না। কয়েকটা মোটে হার আর দুল পড়ে আছে। এবার পাততাড়ি গোটানো যাক। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে।


গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যা হয়ে যায় খুবই তাড়াতাড়ি আর ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনিতে সন্ধ্যা সূচিত হওয়ার সাথে সাথেই ভিড় ঠাসাঠাসি শুরু হয় গয়নার হাটে। সারাদিন খাটার পরে একটু অবসর বিনোদন।

বর্ধমান জেলার অন্তর্বর্তী ছোট্ট এক গ্রামাঞ্চল— পুষ্পপুর। আজ শনিবার। সপ্তাহের এই দিনটাই কেবল গয়নার হাটের দিন হিসাবে বরাদ্দ । দুপুর গড়াতে না-গড়াতেই যে-যার পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে বসে পড়ে ময়না , টগর, মঞ্জুরারা । 


সেই কোন ছোটোবেলা থেকে মায়ের কাছে কড়ি, পুঁতি, ঝুটো পাথরের গয়না গড়তে শিখেছে ময়না । নিকটবর্তী আলোকোজ্জ্বল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এলাকাগুলিতে থেকে বাবু-বিবিরা আসেন গয়না কিনতে। ময়নার রুচিশীল ও সুনিপুণ কাজের গুণে ওর চারপাশ সবসময় পরিপূর্ণ থাকে খরিদ্দারের ভিড়ে।সকলের ফরমাস পূরণ করতে করতে ময়না ক্লান্ত হয়ে পড়ে। 


সন্ধ্যার এই হাটের সময়টুকু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটে। নিজের সৃষ্টি অন্যের হাতে তুলে দিয়ে, কড়ায়-গণ্ডায় হিসাবটুকু বুঝে নিয়ে প্রাপ্ত মূল্য পাশে রাখা কাপড়ের ছোট্ট থলিতে রেখে দেয় পুষ্প। তা না-করে কী আর উপায় আছে? একেই পেটের দায়, তার ওপর আবার কুসুমকে ভালোভাবে বড়ো করবার মস্ত স্বপ্ন।পয়সা নিলেও যখন ওর বানানো গয়নার চাহিদা বেশী থাকে - তখন ওর মনটা গর্বে ভরে যায় শিল্প সৃষ্টির আনন্দে। আসলে পয়সার সাথে এটাই তো তার উপরি পাওনা। 


“কী গো? চিনতে পারছো আমাকে?”— অচেনা কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকাল ময়না । আরে? এ যে সেই শহরের দিদিমণি! আগের বছর শহরে শিল্পমেলায় দেখা হয়েছিল। এর মুখ খুব ভালোভাবেই মনে আছে। অবর্ণনীয় রূপ—যেন সুদক্ষ কোনও চিত্রকরের জাদুতুলি দিয়ে অঙ্কিত মুখাবয়ব, অদ্ভুত এক মায়াময় ঔজ্জ্বল্য। প্রথমবার দেখার পর ময়না শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। এমন রূপ তো মন্দিরের দেবীমূর্তির হয়! স্পষ্ট মনে পড়ল সব। সবুজ শাড়িতে সেদিন যেন আরও বেশি মনোমুগ্ধকর দেখাচ্ছিল সেই দীপ্তকান্তিময়ী তরুণীকে। তবে সেদিন সে একা ছিল না। সাথে এক সুদর্শন যুবকও তো ছিল। আহা! বড়ো মানানসই যুগলবন্দী!! ময়নার থেকে কড়ির গয়না কিনে নিজে হাতে তরুণীর গলায় পরিয়ে দিচ্ছিল যুবক। 


গয়না কিনে চলে যাওয়ার আগে ময়নার নাম-ধাম সব জিজ্ঞাসা করেছিল এই দীপ্তকান্তিময়ী। বেশ কয়েক মুহূর্ত চলেছিল পরিশীলিত শহুরে আর রুক্ষ গ্রাম্য ভাষার বাক্যবিনিময়। ময়না যদিও তরুণীর নাম জানতে চায় না। ও তো তার কাছে দেবী!! দেবীরাই তো এমন হয়। 


দু’জনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেদিন মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠেছিল ওর - ও তাকিয়েছিল ওদের গতি পথের দিকে যতক্ষন পর্যন্ত দৃষ্টির আড়াল না হয় । ওই চরম ব্যস্ততার মধ্যেও বার বার দূরে বসে থাকা রামুর দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। রামুও তখন মহা ব্যস্ত— সুতলি দড়ির পাপোশ আর ব্যাগের বিক্রিবাটা নিয়ে। 


চরম শীত পড়েছিল তখন। ওই দু’জনকে দেখার পর থেকে কাজে মন বসাতেই পারছিল না ময়না । শীত বড়ো নিষ্ঠুর... মনকে বড্ড আদর-কাঙাল করে তোলে যেন! উন্মত্তের মতো সেদিন রামুর পুরুষালি স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছিল খুব। 


“কী গো? কী এত ভাবছ?”... তরুণীর ডাকে সম্বিত ফিরল ময়নার ।চমকে উঠে আবার বাস্তবে ফিরে এলো আর বলল, “কিস্সু না গো দিদিমুনি, তুমি আমারে মনে রাইখস?”

“মনে রাখবো না কেন? কিন্তু,এবারের শিল্পমেলায় তো দেখলাম না তোমাকে?”

“এবারে যাই নাই গো... তা তুমি এখেনে?” 

“এখানে আমার দিদার বাড়ি। আজ গয়নার হাট বসে শুনে এলাম।”

“দাদাবাবু কুথায়? আসেন নাই?”

  

প্রশ্ন শুনে ম্লান হয়ে গেল দেবীর মুখ।—

“আমি একলাই গো!! আমার কোনও দোসর নেই আর। ওই লাল রঙের মালাটার দাম কত? দাও তো দেখি?” 


তরুণীকে মালা এগিয়ে দিয়ে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ময়না ।—

“আমরা সবাই একলা গো দিদিমুনি!” স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাগুলো। 


হাটশেষে আজ আর টগরদের সঙ্গে ভ্যানে না-ফিরে ময়না হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ ওই দিদিমনিকে দেখে মনটায় ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হল, পুরানো স্মৃতিগুলো সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে - এখন একটু নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। খুব মনে পড়ছে আগের বছরের শিল্পমেলার কথা।...


শহরের মেলায় বসবার জায়গার ব্যবস্থা রামু করেছিল। দশদিন ওর সাথে একসঙ্গে থাকা— ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয়, অদ্ভূত এক শিরশিরানি!

ময়না অনুমতি চাইবার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠান্ডা গলায় বলেছিল গঙ্গা — “রামুরে কইবি, আশপাশের মন্দিরে গিয়া তুর কপালে যেন সিন্দুর লেইপ্যা দেয়।”


তার মা গঙ্গা বরাবরই এমন... আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম। মা-কে কোনোদিন রাগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ প্রকাশ করতে দেখেনি সে। কথাও বলে মেপে, নির্লিপ্ত স্বরে। কিন্তু দূরদর্শিতার অভাব নেই গঙ্গার মধ্যে। ময়না নিজের বাপকে কোনওদিন চোখে দেখেনি। তার অভিভাবক বলতে গঙ্গাই। 


হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিল রামু — “বিয়ার দিন কি পলায়ে যাইব? অহন ইদিকে কারবারে মন দে।”

প্রতিদিন মেলা শেষে রামুর কোনও এক বন্ধুর ফাঁকা ডেরায় গিয়ে উঠত ওরা দু’জন। দশদিনের অস্থায়ী সংসার ময়না সাজিয়ে তুলেছিল। তার আর রামুর সংসার। 


স্নান করে শরীর থেকে সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে স্টোভ জ্বালিয়ে ভাত বসাত ময়না । গরম ভাতের গন্ধে খিদে আরও চনমন করে উঠত দু’জনের। খাওয়া শেষে হ্যারিকেন নিভিয়ে শীতরাতে আদর-জড়ানো উষ্ণতা খুঁজে নিত ওরা— পরস্পরের শরীরে শরীর মিশিয়ে। রামু সারাদিনের পরিশ্রম আর শহুরে ধুলোমেশানো বিরক্তিটুকু ময়নার নরম শরীরের মধ্যে উজাড় করে দিয়ে তবে শান্ত হতো; আর রামুর ওই উগ্র অশিষ্ট আদরকে সোহাগরূপে বরণ করে নিত ময়না । দূর থেকে ভেসে আসা ব্যস্ত শহরের ট্রাফিকের আওয়াজ আস্তে আস্তে স্তব্ধ হয়ে মিলিয়ে যেত রাতের গভীরতার অন্ধকারে। ময়না - রামু পরম তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করত।

  

শিল্পমেলায় বিক্রিবাটা মন্দ হয়নি ওদের। ময়না গঙ্গার জন্যে চুড়িদারের পিস আর কাঁচের চুড়ি কিনে নিয়ে গে’ছিল। অতদিন পর মেয়েকে দেখে গঙ্গা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছিল। তারপর তার হাতটা ধরে টানতে টানতে ঠাকুরের ছোট্ট কুলুঙ্গি থেকে সিঁদুর নিয়ে ময়নার মাথায় লাগিয়ে বলেছিল—

“কেউ জিগাইলে কইবি, শহরে গিয়া তুদের বিয়া হইসে।”...

  

দু’-তিনদিন পরেই রামু গ্রামছাড়া হয়। ময়নাকে জানায়, কলকাতা শহরে দোকান খুলবে না-কি সে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করেছে। সব পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে গেলে ময়নাকে এসে নিয়ে যাবে... চিরতরে জীবনসঙ্গিনী করে। 


যাবার দিন কপালে চুমু দিয়ে যায় রামু । ওর চলে যাওয়ার রাস্তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ময়না । বিকেল গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে চোখে।

তারপর আর কথা হয়নি রামুর সাথে। রামুর মোবাইল নম্বরটারও আর অস্তিত্ব নেই। কয়েকদিনের মধ্যে শীত পেরিয়ে বসন্ত আসে। গোটা গ্রামজুড়ে কৃষ্ণচূড়া ও পলাশের লাল আভার ছড়াছড়ি। সবার অলক্ষ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠে কপোতবিহীন কপোতী। দুরু দুরু বুকে গঙ্গাকে এসে একদিন জানায় ময়না ,

“মা গো! হয় নাই, এমাসে হয় নাই গো!”

  

গঙ্গা একঝলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মায়ের দু’চোখের কোণে সেদিন সে দু’ফোঁটা জল দেখতে পেয়েছিল যেন!!

গ্রামের অনেকের কলকাতায় যাতায়াত আছে। রামুর সাথে তাদের মাঝেমধ্যেই সাক্ষাৎ ঘটে। ময়না খবর পায়— বেশ ভালোই আছে রামু । বছর ঘুরে আবার শীত আসে, শীত পেরিয়ে বসন্ত— আবার...

আজ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মধ্যে ফের সেই দীপ্তকান্তিময়ীকে দেখতে পেল ময়না । পরনে তার পলাশরঙা শাড়ি। হাতে, গলায় পলাশফুলের মালা। আহা! কী অপূর্ব দেখাচ্ছে। তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল সেই দেবী। ময়না এগিয়ে চলল তার হাতটা ধরে। আজ সে নিজেও পলাশের গয়নায় সুসজ্জিতা। লম্বা, ফাঁকা রাস্তা। হেঁটে চলেছে তারা দু’জন। চারিদিকে আর কেউ কোথাও নেই!...

  

চকিতে ঘুমটা ভেঙে গেল। ভোরের নরম আলো এসে পড়ছে চোখে-মুখে। পাশে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করছে চার মাসের সোনা । ওকে কোলে তুলে নিয়ে তাদের মাটির ঘরের সামনের জলাশয়টার কাছে এসে দাঁড়াল ময়না । সোনাকে আঁকড়ে ধরে গালে গাল ঘষল সে। ছোট্ট তুলতুলে শরীরের গরমটুকু নিজের মধ্যে মিশিয়ে নিল। অগণিত শালুকফুলে ভরে ওঠা জলাশয়ের কিনারে খেলে বেড়াচ্ছে এক সাদা ধবধবে বক ও তার ছোট্ট ছানা। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সোনা । নৈসর্গিক প্রকৃতি প্রতিবারই জানান দেয় পৃথকভাবে, পৃথকরূপে— বসন্ত এসে গেছে। ময়নাও সব দুশ্চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে বসন্তের আগমনের প্রতীক্ষায় রইলো তার ছোট্ট সোনার সঙ্গে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance