বৃষ্টির উত্তর
বৃষ্টির উত্তর
বাইরে মেঘলা আকাশ। সারাদিনই মেঘলা থাকার দরুন, আর বৃষ্টি বাদলার অভাবে আবহাওয়া ভারি ভ্যাপসা। আমি এই ভ্যাপসা দুপুরবেলা বসে সিগারেটে টান দিতে দিতে মেহেদী হাসান-এর গান শুনছি। এরই মধ্যে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। চেনা নাম ভেসে উঠলো ফোনের স্ক্রিনে।
- "হ্যাঁ বল।"
মজার স্বরে - "রু, একটা খবর আছে।"
- "তাই নাকি! কি?"
- "বাড়িতে মেনে গেছে। আমার বিয়ে ফিক্সড। "
কিচ্ছুক্ষণ স্তব্ধ সব। অস্বস্তিকর নীরবতা।
- "হাঃ হাঃ হাঃ" পাগলের মতো অট্টহাস্য করে "বাহ! হেব্বি ব্যাপার তো। কবে?"
উৎসাহী ভাবে - "সামনের বছরের ডিসেম্বরে। এত কিছু করে, এত কিছু সামলে শেষমেশ সবাই রাজি। অনিন্দ্য দা এসেছিল বাড়িতে কথাবার্তা বলতে। প্রথমে দৃঢ় অমত থাকলেও পরে বাবা নিজেই মত বদল করে ফেলে। রাজি হয়ে যায়। অনিন্দ্য দা'র বাড়ির লোকেদের আসতে বলে। আজ এসেছিল। ওঘরে কথা হচ্ছে আর এঘরে তো আমার অবস্থা টাইট। অ্যাঙসাইটি আর নার্ভাসনেস বুকে হাতুড়ি মেরেই চলেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই হাসিঠাট্টা কথাবার্তার মাঝে এরা হঠাৎ তারিখ ঠিক করে ফেলল। নার্ভাসনেস টা আরো বেড়ে গেলো, তবে এবার চাপা আনন্দের সাথে। এই কিছুক্ষণ হলো ওরা গেছে। প্রথমেই তোকে ফোন করলাম।"
- "হুম। খুব ভালো হয়েছে। এবারে নিশ্চিন্ত তো?"
- "বাল! চিন্তা তো বেড়ে গেলো। কতকিছু কিনতে হবে। কতজনকে জানাতে হবে। মদ খেতে হবে।"
- "সব করিস। এখন আপাতত ব্যাপারটা অনুভব কর পুরোপুরিভাবে। ভেতরে শুষতে দে ব্যাপারটা।
- "সব আমি করব কি! তোকে করতে হবে। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার বিয়ের প্রধান দায়িত্ব তো তোর।"
মৃদু হেসে - "না রে। তোর বিয়েতে আমি যেতে পারব না।"
- "বাল, ইয়ার্কি হচ্ছে!"
- "না রে। ইয়ার্কি নয়। সত্যি বলছি। তোর বিয়েতে আমি থাকব না।"
ফোনের দুইপ্রান্ত চুপ।
আমি বলে চললাম - "দ্যাখ। আমি যতটা সহজে বোঝানো সম্ভব, তোকে বোঝাতে চেষ্টা করছি। আমার একমাত্র এত কাছের একজন সঙ্গী, এত প্রিয় বন্ধুকে আমি অন্য কারও সম্পূর্ণ একমাত্র সঙ্গী, অন্য কারও প্রিয়তম বন্ধু হয়ে যেতে দেখতে পারব না। এটা প্রেম নয় রে। এটা অন্য এক রকম ভালোবাসা। আমিও জানিনা কেমন। যে বন্ধু একসময় মদ খেয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে, আমার জামা ভিজিয়ে বমি করেছিল, আমার কাঁধে ভর করে চারতলা বেয়ে উঠে খাটে আমার জায়গায় শুয়ে পড়েছিল, পরদিন সকালে আবার সেই কাঁধেই মাথা রেখে বাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাড়া রাস্তা এসে অফিস পৌঁছেছিল, সে সারাজীবনের
জন্য অন্য কারও কাঁধে মাথা রেখে দেবে একান্ত অন্তরঙ্গ ও দূর্বল মুহূর্তে, এটা আমার মনকে মানাতে পারব না। যদিও আমি এই খবরটা শুনে তোর জন্য খুশিই হয়েছি, তবে আমি আমার মনকে খুশি রাখতে পারব না। ভীড় থেকে পালিয়ে বেড়ানো ছেলেটা যার জন্য অচেনাদের ভীরে পাড়ি দিলো সুদূর হিমালয়ে, সে ছেলে কখনোই তার মনকে মানাতে পারবে না যে তার সে বন্ধু আজ একেবারেই সব ভীড়ের মধ্যে একজন অন্যতম মানুষ পেয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। যার জন্য সে এক আনকোরা নতুন সম্ভাবনাকে ছেড়ে দিয়েছিল, একমাত্র তাকে বন্ধু হিসেবে হারাতে চায়নি বলে, সে আজ হারিয়ে যাচ্ছে নতুন জীবনের সম্ভাবনায়, এটা সে তার মনকে বোঝাতে পারবে না কখনোই। তাই, তোর বিয়েতে আমি থাকব না রে। তোর কষ্ট হবে, দুঃখ পাবি, সব মানছি, তবে এইবারে আমি তোর এই দুঃখ কষ্ট দূর করতে পারব না। তুই যেই বললি যে, তোর বিয়ের তারিখ পাকা হয়ে গেছে তখনই মনটা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল। মুখ দিয়ে যদিও হাসির শব্দ বেরলো। তখনই ফোনটা কেটে দিতে চাইছিলাম, কিন্তু কেটে দিলে সত্যি কেঁদে ফেলতাম। হয়ত এখনো ফোনটা রাখলে কেঁদেই ফেলব। তাই কথা বলে যাচ্ছি। সত্যি বলছি রে, তোর বিয়ের খবর পেয়ে আমি আনন্দ পেয়েছি, যন্ত্রণা খালি বন্ধুর আগে প্রিয় কথাটা মুছে যাওয়ার। প্রেমের পরিশোধ না হওয়ার বা প্রেমের বিরহ যন্ত্রণাটা আলাদা রকমের। বেশ পরিচিত সেটা। কিন্তু প্রিয় বন্ধুর বন্ধুত্ব বিরহের যন্ত্রণা আমার কাছে নতুন। আমার মনের অতটা সামর্থ্য হয়ে ওঠেনি এখনো। "
আবার নিশ্বাস ফেলে অল্প আনন্দের স্বরে - "বিয়ের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।"
কিছুক্ষণের জন্য ফোনের লাইনটা খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। দুদিকেই কোনো শব্দ নেই। নীরবতা ভাঙল বাইরে আচমকা আঁচড়ে পড়া বজ্রপাতের আওয়াজ। প্রথমের একবার, তারপর একাধিকবার।
মৃদু কাঁপা গলায়, নাক টানের শব্দের সাথে, কথার আওয়াজ এলো ওপার থেকে - "এতদিন.. এর আগে.. কেন?....... আজ কেন?"
আমি ঠিক শুনতে পেলাম না স্পষ্ট ভাবে - "কি বললি? "
স্পষ্ট উত্তর এসেছিল ঠিক বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই। পরিবেশের গুমোট ভাব কাটিয়ে দিয়েছিল সে বৃষ্টির মুষল ধার। মনের ভ্যাপসা গুমোট ভাব কি কাটাতে পেরেছিল সে উত্তর? কনো উপসংহার কি ছিল সেই উত্তরে, নাকি ছিল কনো নতুন সম্ভাবনার প্রস্তাবনা?
আমি সেটা জানিনা। গল্পটাই তো কাল্পনিক। আসল জীবনের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা। তাই, এই শেষটা আমি চাইছি আপনারা বা তোমরা নিজেদের মতো করে কল্পনা করে নাও। হয়ত কিছু নিজের ব্যাপারে বুঝে যাবেন বা যাবে।