বৃষ্টিধারা
বৃষ্টিধারা




সামনে বেশ জ্যাম। টোটো গাড়িটা এগোতে পারে না। রোদটাও বেশ ঝাঁঝালো। সজনী ক্রমশ বিরক্ত। ঠিক এই সময় চোখজোড়া আটকে যায়। আরণ্যক না? বুকে বাচ্চাকে চেপে হেঁটে আসছে ফুটপাথ ধরে। টোটো থেকে সে নেমেপড়ে। ছোকরা টোটোওলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, নেমে পড়লেন যে?
একটু দরকার ভাই।
ব্যাগ থেকে পার্স বের করে হিসেবটা চুকিয়ে দিয়ে ফুটপাথে এসে ওঠে সজনী। মুখোমুখি দাঁড়ায়। আরণ্যক চমকে ওঠে, তুমি!
ছেলেকে তো দেখলাম না, আজ একটু দেখতে দেবে? হাঁপাতে হাঁপাতে সে স্থির হয়।
বড্ড ঠাণ্ডা লেগেছে ছেলেটার। একটু জ্বরও। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলুম।
সজনী বাচ্চাটার মুখের উপর আকাশ হয়, বড় সুন্দর হয়েছে গো তোমার ছেলে। কোথাও একটু বসবে? কতদিন দেখা হয় না।
বেশ, তবে বেশিক্ষণ না, আমার কাজ আছে।
কাছাকাছি নদী। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সেদিকে যায়। অশ্বত্থ গাছের বেদিতে বসে ওরা।
সজনী উথালপাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকায়, এখনও একইরকম অভিমানী রয়ে গেছ।
আরণ্যক অতীতকে এড়াতে চায়, আজ কি তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হল?
হল। বলেই ছেলেটাকে আরণ্যকের কাছ থেকে আলতো নেয়। মুগ্ধ আবেশে দেখে। সদ্য ফোটা ফুল। এমন ছেলেকে ফেলে কেমন করে অন্য ছেলের হাত ধরে চলে যায় মা!
আরণ্যকের দিকে তাকায় সজনী। নাগাল ছাড়িয়ে দূর বহুদূর নদীর ওপারের আবছা ছায়াতে হারিয়ে গেছে। এই অন্যমনস্কতায় ছোঁয়া দিতে ইচ্ছে করে না। অনেকদিন আগের সেই তরতাজা তরুণটার কথা মনে পড়ে। যেসব দিনে আরণ্যক মেঠো হাওয়ায়, সোঁদাগন্ধে মিশে থাকত গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়। লেখাপড়া চুলোয় দিয়ে পায়রা ওড়ানোর নেশায় মেতে থাকত। যেবার জোড়ের থেকে একটা মাদি পরপুরুষের সঙ্গে উড়ান দিয়েছিল, বাচ্চা পায়রাটাকে বুকে চেপে মনমরা আরণ্যক বলেছিল, ডিম ফোটার পর কিছুতেই বাচ্চাটার কাছে কাউকে ঘেঁসতে দিত না ওর মা, খোপাতে আসত। যেই বড় হল, যেই উড়ুক্কে হল বাচ্চাটা, ওর মা পালাল। পশু-পাখি এমন।
সজনী ছেলেটার কপালে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবে, মানুষ কী কদর্য! এতটুকু দায়বদ্ধতা নেই।
আরণ্যক।
মুখ ফেরায় আরণ্যক। তখনও দু'চোখে দিগন্ত।
ছেলেটাকে তো মানুষ করবে, ওর মাকে ডিভোর্স দিয়েছ?
ক্ষীণ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে ম্লান হাসি, তুমি তো জানো আমি অনেককিছু পারি না। আইন, কোর্ট, উকিল...
স্তব্ধ সজনী অপরাধীর মতো বসে থাকে। অনেক বলা না-বলা থেকে যায়। তবু গুমরোতে গুমরোতে বলে, ক্লাসে কত ভাল ছাত্র ছিলে, একটা চাকরির চেষ্টা করলে না...
হঠাৎ খেঁকিয়ে ওঠে আরণ্যক, তুমিই তো আমাকে নষ্ট করলে। বলেই ছেলেটাকে ছিনিয়ে নেয় নিষ্ঠুরের মতো, এসব শোনাবে বলে কি ডাকলে?
অজস্র ব্যথায় টলটলে চেয়ে থাকে সজনী। আরণ্যক উঠে দাঁড়ায়। বাচ্চাটা কোলছাড়া হয়ে কাঁদে। সজনীর দিকে হাত-পা ছোঁড়ে। ভিতরের আগুনটাকে ঠাণ্ডা করতে করতে বসে আরণ্যক। ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে, হয়তো মা ভেবেছে।
কান্না থামিয়ে বাচ্চাটা সজনীর বুকে মুখ গুঁজছে। ছলছল আরণ্যক বলে, মায়ের দুধ তো, খুঁজছে।
সামান্য কথায় কী যে ছিল, ভিতরটা পাগল হাওয়ায় দাপিয়ে উঠল। আরণ্যকের দিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ চোখে। বুকের গুমোট যন্ত্রণাকে নিবৃত্ত করতে বাচ্চাটাকে চেপে ধরে সজনী। প্রাণপনে।
আমাকে দেবে?
আরণ্যক ওর মুখের দিকে তাকায়, আমি ওকে মাটির স্পর্শে রাখতে চাই, ও যেন দুঃসময়ে টের পায় চারদিকে ছায়া, শিকড় চালানোর সহজ উপায়।
একটা কাক কা-কা ডেকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। উঠে দাঁড়ায় আরণ্যক। কাছেই একটা মেঠো পথ আছে। এ-পথ দিয়ে সহজে সে চলে যেতে পারে। দু'হাত বাড়িয়ে বলে, আর সময় নেই, বাগান আছে, দাও। এই পথে বরং তাড়াতাড়ি ফিরি।
বাচ্চাটাকে দিয়ে সজনী চেয়ে থাকে। জনবিরল পথটা বিধবা মেয়ের সিঁথির মতো। ঢলে যাওয়া সূর্যের আলোয় কেমন বিষণ্ণ, করুণ হয়ে একাকী এগিয়েছে আরণ্যক। তাকেও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। প্রেশারটা বেড়েছে, সেই সঙ্গে মেয়েলি অসুখ। মাথা ঘুরে মাঝে-মধ্যে পড়ে যায় আজকাল। অনেক অ্যালাপ্যাথি করেও সারেনি। এখানে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দেখাচ্ছে সে। নইলে আরণ্যকের পাশে একটু হাঁটতে পারত। ওর ছেলেকে বুকে নিয়ে। ভুল করে অচেনা-অজানা কেউ তো ভাবত বউ-ছেলেকে নিয়ে এই তেতো রোদে আনাড়ির মতো এগিয়ে চলেছে একটা ঢ্যাঁঙা-লম্বা লোক।
বুকটা তার ছটফট করে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কোনও মায়া নেই আরণ্যকের। চলে যাওয়ার সময় ভুলেও জানতে চাইল না, কেন এসেছে এখানে। এতটা পরের চোখে দ্যাখে। ডাক্তারখানার দিকে সে পা ফেরায়।
বাড়ি ফিরে দ্যাখে উঠানের লেবু গাছটাকে দাদা কুঠার দিয়ে কাটছে। মা দাঁড়িয়ে কাছাকাছি। সজনী সইতে পারে না। বাড়ি ফিরলে কত বেনেবউ পাখিকে দ্যাখে গাছের ডালে। তাদের লাল ঠোঁট, হলুদ পালকে ঝরঝরিয়ে উঠত এ-গাছ!
মা'কে মৃদু ছুঁয়ে সে বলে, গাছটা কাটছ কেন?
কী হবে! চার-পাঁচ বছর তো শুধু ফুল ফুটছে,আর ঝরছে। একটাও লেবু নেই।
শ্রান্ত সজনী ঘরে ঢোকে। ব্যাগটা রেখে কাপড় বদলাতে থাকে। ফল না-হলে ফুলের কোনও দাম নেই। কিশোরী সজনী ফুল হওয়ার কালেই উছল হয়ে উঠেছিল একদিন। আরণ্যক ওকে ভালবেসেছিল তখন। সজনী পাগল হয়েছিল সে-ভালবাসায়। মেঘমেদুর এক বিকেলে আরণ্যকের ঘরটা নিবিড়। তিনকুলে কেউ ছিল না ওর। বুড়ি ঠাকমা ওর সতেরো বছরে মারা গেল। রেখে গেল খড়ের চালের ঘর, উঠানময় আম, লেবু, সবেদা, পেয়ারার গাছ। আর রেখেছিল বিঘে পাঁচেক জমি। সেখানে ফুল চাষ হয়। তাতেই চলে সংসার। সেই ঠাকমা মারা গেলে কিশোরী সজনী আরণ্যকের সব জ্বালা মুছে দিতে পাগল হয়েছিল।
নিবিড় ঘর। বাইরে থেকে আসছিল ঠাণ্ডা হাওয়া, বৃষ্টির ছাঁট। গাছগাছালির পারস্পরিক ঘর্ষণে বোঝা যাচ্ছিল মাতাল ঝড়ের দাপট। হঠাৎ দরজার পাল্লাটা ভেজিয়ে দিয়ে মুখের কাছে মুখ এনেছিল আরণ্যক। আলতো স্পর্শ লেগে গিয়েছে ঠোঁটে। ঝিমঝিম বৃষ্টি আর হাওয়ার দাপটে দরজার পাল্লাদুটো কাঁপছিল ঠকঠক। কী হল সজনীর! কাঁপতে কাঁপতে আরণ্যকের উপর টলে পড়ল। তিতিরের মতো কী যেন বলল অস্ফুটে!
আরণ্যকের কী হল হঠাৎ। বলল, আমরা নাবালক নই সজনী, লোভকে সামলে চলতে হবে। সামান্য ভুলে কত রটনা, কত বদনাম...
লাল হয়েছিল সজনী, এখন কেউ নেই।
জোর করে সরিয়ে দিল আরণ্যক। সজনী শুনল না। ঝাঁপাল।
অপমান কোরো না।
দেওয়ালে মা মেরির নগ্ন স্তন। বৃন্তে শিশু যীশু। সেদিকে তাকিয়ে আরণ্যক বলল, যেখানে প্রাণের জন্ম সেটা ছেলেখেলার নয়, যদি বাচ্চা আসে নষ্ট করতে হবে। অপেক্ষা করো সজনী। আমি তোমার গর্ভকে কবরখানা বানাতে পারব না।
রক্তচক্ষে বিড়বিড় করল সজনী, এত জ্ঞান, এত অহঙ্কার তোমার!
আরণ্যক ওকে টানল। কপালে ঠাণ্ডা হাত ছুঁয়ে সমস্ত উত্তেজনা মুছতে চাইল, ভালবাসি, আমাকে লোভী কোরো না, প্লিজ!
সজনী কিছুই বোঝার চেষ্টা করেনি। নগ্ন করেছিল বুকের আবরণ। স্থির পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল আরণ্যক। নগ্নতার নিষ্ঠুরতায় রাঙিয়ে উঠেছিল চোখের তারা। ঘেন্নায় রি-রি করেছিল সর্বাঙ্গ। ঠাস করে চড় মেরেছিল সজনীর গালে।
ভিজতে ভিজতে সে বেরিয়ে এসেছিল। মাতাল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে।
তারপর বিয়ে হল। মধ্যবিত্ত ঘরের ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে। গরিবের মেয়ে হলেও সজনী তো কম সুন্দরী ছিল না।
স্কুল থেকে ফিরে ডেলি ডেলি কী ভাবিস বিছানায় শুয়ে? ধরম মা গো, দিনে দিনে আর কত দেখব রগড়!
উঠে দাঁড়ায় সজনী। কেউ তাকে সহ্য করতে পারে না আজকাল।
একটু ঘোরাফেরা কর, জুবুথুবু হয়ে শুয়ে থাকলে সকাল-সকাল যখন বাতে ধরবে, কে দেখবে? স্বামীর ঘর থেকে তো ডিভোর্স নিয়ে এলে, একটু মানাতে পারলে না, এখানে এসেও কীর্তির বাকি রাখছ না।
চমকে ওঠে সে। আরণ্যকের সঙ্গে দেখা হওয়ার খবর কি মায়ের কানে পৌঁছে গেছে? রাগে-দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে সে বেরিয়ে আসে। মাঝে-মাঝে মনে হয় বিষ খেয়ে মরে। কিন্তু পারে না। হারলে তো সব শেষ। তাহলে দেখা করেছিল কেন ওই মেঠো ছেলেটার সঙ্গে?
নেমে আসা সন্ধ্যায় নির্জন পুকুরপাড়ে একটা ডুমুর গাছের কাছে দাঁড়ায় সজনী। চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়ে। কেন সে বিয়ে করেছিল? কেনই বা ফিরে এল? অনিমেষদের তো দোষ ছিল না। বাড়ির বউয়ের কাছ থেকে একটা সময় স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি বংশের প্রদীপ চায়। সেই চাওয়াতেই সে তিন-তিনবার বাচ্চা নিয়েছিল। কিন্তু কেউ পৃথিবীর মুখ দেখল না। পেটে ফুটেই পেটের মধ্যে মারা গেল। বারবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল সজনী, কোনও সুরাহা হয়নি। একদিন অনিমেষ মদ খেয়ে এসে তার পেটে লাথি মারল, গর্ভের দোষ! বিয়োতে পারবে না কোনওদিন।
সজনী কাঁপছিল। যে-সংসারে ঠাঁই পেতে চেয়েছিল, সেখানে এভাবে মার খেতে হয়! ডিভোর্স নিয়ে ফিরে এল সে।
অন্ধকার নামছে চারপাশে। পাখিরা ফিরছে। কোনওদিন আর কোনও বেনেবউ তাদের উঠানে তাকাবে না। শাঁখের আওয়াজের সঙ্গে কুকুরের সুরেলা কান্নাটা অমঙ্গলের কায়া হয়ে গাছপালার ফাঁক বেয়ে বাতাসে বাতাসে বয়ে যায়।
উঠানে পা দিতেই সজনী টের পায় লেবু পাতার গন্ধ। বেড়ার ধারে পড়ে আছে গাছটা। দাওয়ায় পড়তে বসে ভাইপো আর ভাইঝি খুনসুটি করছিল, সজনী দুটোকে সরিয়ে দিল। বউদি শাঁখের মুখ ধুয়ে তেড়ে এল। দুমদাম কষিয়ে দিল দু'জনের পিঠে, যত বড় হচ্ছে বদের পাণ্ডা হচ্ছে সব।
ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে ছেলেটা। আবারও মারতে যায় বউদি। সজনী টেনে নেয়, আঃ বউদি ছেলেমানুষ ওরা। মজা পায়।
মুহূর্তে আক্রমণটা তার উপর নেমে আসে, ছেলেমানুষ! মজা! বুড়ো মেয়ে হয়ে তুমিও কি কম মজা করছ? বর ছেড়ে এসে আবার পুরানো মানুষের সঙ্গে পিরিত করছ...
রান্নাঘরে ঢুকে যায় বউদি। শ্মশানের স্তব্ধতা। ঘরে ঢুকে নিজের তক্তাপোশে থম মেরে বসে পড়ে সজনী। বুকের ভিতর যে-প্রাণটুকু লতিয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিল, সব মৃত।
সজনী কী করবে এবার? কয়েকটা রাত নিথর কেটে যায়। ঘুম নেই, স্বপ্ন নেই। শুধু বুকের উপর হাত রাখলে ঝিমিয়ে পড়া প্রাণের দ্রিমি-দ্রিমি শব্দ। বিষ কিংবা দড়ি যে-কোনও কিছু সে জোগাড় করে নিতে পারে। কিন্তু এইভাবে? কোনও প্রতিবাদ না রেখে?
সে প্রতীক্ষায় ছিল। আরণ্যক হয়তো খবর নেবে। সজনী তো স্কুল হয়ে ওই পথে ফেরে। অথচ কেন যে মানুষটাকে দেখা যায় না। বুকের সমস্ত কষ্ট নিংড়ে একদিন যায় সে। যার বউ থাকে না তার আবার কীসের অহঙ্কার!
দখিনা হাওয়ায় মৃদু মৃদু দুলছিল ঠাকমার হাতে লাগানো গাছগুলো। কলমে গাছ। টুসটুসে বাতাবি লেবু। পাতাগুলো কাঁপছে তিরতির করে। সজনীর বুকজোড়া একদিন তিরতির কাঁপত এখানে। দাওয়া থেকে বাচ্চাটার কান্না ভেসে আসে। একটা বছর আটের ছেলে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে।
না না কাঁদে না। ভাই আমার, সোনা আমার...
তাড়াতাড়ি কাছে যায় সজনী। ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়।
ওর বাবা কোথায়?
বাগানে। ক'দিন ভাইয়ের জ্বর ছিল, ঠিকমতো যেতে পারেনি।
তোমার কাছে রেখে গেল?
হ্যাঁ।
সজনী বাচ্চাটাকে কোলে নিল। কান্না বন্ধ। ছেলেটা আনন্দে হঠাৎ নেচে ওঠে, বদমাশ! আমার মাকে দেখে ওভাবে কান্না গেলে।
ছেলেটা লাফাতে লাফাতে দাওয়া থেকে নেমে উঠান পেরনোর আগে চেঁচাল, তুমি তালে দ্যাখো, আমি খেলতে চললুম।
অস্বস্তিতে পড়ে সজনী। কতদিন পরে আসা। পাড়ার কোনও বউ-বুড়ি টের পায় যদি, কী বলবে ও! বাচ্চাটার জ্বলজ্বলে চোখদুটো দেখে লোভ সামলাতে পারে না। মুখে ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে। বড় তোলপাড় লাগে সজনীর। ছেলেটা হঠাৎ কাঁদে। ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক চেয়ে কোথাও দুধের পাত্র পায় না। একটা খালি বোতল। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায়। যদি কোথাও কড়াই বা গামলায় কিছু একটা ঢাকা দেওয়া থাকে।
কোথাও পেল না সজনী। একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় গাছপালা কেঁপে ওঠে। উঠানের ধুলো চক্কর মারতে মারতে দাওয়ায়। ছেলেটা চিৎকার তোলে। কচি শরীরের দামালপনায় সজনীর ভরাট শরীরদুটো বেসামাল হয়ে যায়।
কী করবে ও ? কেমন করে পেতোবে? মাথাটা ওলট-পালট লাগে। বাচ্চাটা মায়ের শরীর খুঁজছে। অনেকদিন পর ফিরে পাওয়া শরীরে ঢুঁ মারছে। অস্বস্তিতে পড়ে সজনী। পড়শিরা যদি এসে পড়ে। দুর্বার আবেগে সে এক অসাধারণ কাণ্ড করে বসে। ব্লাউজের একটা দিক তুলে ফেলে। বাচ্চার মুখে গুঁজে দেয় একটা বৃন্ত। মায়াবী শিহরণে নিজের চোখজোড়া বোজে।
বাইরে কুলকুলিয়ে বৃষ্টি নামে। বাচ্চাটার টানে ভেসে যাচ্চে সজনী। দু'চোখের কোণ বেয়ে টপটপ জল পড়ে। সজনীর কোনও হুঁশ থাকে না। হঠাৎ অস্থির শব্দে চমকে যায়। আরণ্যক! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল। সজনী কোনওক্রমে নিজেকে সামলে তার কাছে এসে দাঁড়ায়, কিছুই খাওয়াতে পারিনি ওকে।
আরণ্যক চেয়ে থাকে। মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো বৃষ্টির জলে মুক্তার দানা। গা বেয়ে টপটপ ঝরছে। স্থিমিত চোখে বলে, খোকন কোথায়? ওকে তো বলে গেছি চৌকির নীচে দুধ ঢাকা।
সজনী বোকার মতো চেয়ে থাকে। আরণ্যকের দু'চোখে অস্বস্তি, কেউ দ্যাখেনি তো?
সজনী বোবার মতো চেয়ে থাকে। আরণ্যক কী বলবে বুঝতে না পেরে লাজুক হাসে। আস্তে করে বলে, ওইভাবে কি বাচ্চাকে পেতোনো যায়?
সজনীকে হঠাৎ উত্তেজিত দেখায়, নষ্ট হব বলে একদিন আমাকে তাড়ালে, অথচ কোনও পাপ তো করিনি, তাহলে কেন আমার গর্ভ কবরখানা? তবে কেন আমার শরীরের দুধ কোনও সন্তান পাবে না?
বাইরে দামাল হাওয়া। সবেদা গাছের একটা ডাল ভেঙে গেল মড়াৎ করে। কাহিল আরণ্যক কোনও জবাব খুঁজে না পেয়ে তড়িঘড়ি দুধের বোতল এনে বাচ্চার মুখে দেয়।
সজনী দু'চোখের জল মুছে ওর দিকে তাকায়। ভিতরে বৃষ্টির তোড়কে সামলে বলে, তুমি তো সারাক্ষণ বাগান নিয়ে থাকো, আমি ওকে নিয়ে যাই, আলাদা কোনও জায়গায়?
উঠানে ঝড়ের দমকে কাঁপছে কলমে গাছগুলো, তাদের ডালে আশ্রয় নিয়েছে যে-পাখিগুলো, তারাও। সেদিকে চোখ রেখে আরণ্যক বলে, পারবে! এই জল-হাওয়ার দেশে একটু সুন্দর মাটি পেলে, একটু শিকড় গাড়লে ওর কোনও ভয় নেই। তুমি কি পারবে সেই মাটি হতে?
কী হল সজনীর, পাগলের মতো বাচ্চাটাকে বুকে চাপে। পরক্ষণে বুকের সামনে ঝুলিয়ে দ্যাখে। তার ঝাপসা হওয়া স্বপ্নগুলো তারার মতো ফুটতে থাকে। বাচ্চার নরম পা দুটো তার তলপেট ছুঁয়ে। এই ছোঁয়ায় তিন-তিনটে হারিয়ে যাওয়া প্রাণ যেন দাপিয়ে উঠছে। বড় আনন্দে সজনী জাপটে ধরে আরণ্যককে। বৃষ্টি-ঝরা ব্যর্থ সেই দিনটার কথা আর সে মানে না। বাইরের তুখোড় বৃষ্টির মতো তার দু'চোখ ভাসতে থাকে। যে-বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে একদিন বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই বৃষ্টিই যেন তাকে ফিরিয়ে দিল সব। নতুন করে।