বংশ প্রদীপ
বংশ প্রদীপ
ছোট্ট সদ্যোজাত মেয়েটাকে নিয়ে হসপিটালের বেডে বসে চোখের জল ফেলছে রিমা । এই নিয়ে তার তিন তিনটে মেয়ে হলো । প্রতিবার ছেলের আশায় থাকে কিন্তু হয় মেয়ে । তিন তিনটে মেয়ের জন্ম দিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে রিমা । প্রতিবার ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যাতে ছেলে হয় ।
একজন সাধারণ গৃহবধূ রিমা । স্বামী আর শাশুড়িকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী অজয় একজন প্রোমোটার , বিশাল পয়সা কিন্তু মনে কোনো সুখ নেই কারণ তাদের ঘরে একটাও ছেলে নেই , পরপর তিনটে মেয়ে হয়েছে । এবার যখন মেয়ে কোলে নিয়ে মুখ কালো করে বাড়ি ফেরে রিমা তখন তার শাশুড়ি মা হেমালি দেবী তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন - বৌমা , মেয়েরা হলো ঘরের লক্ষ্মী । মেয়ে হয়েছে বলে মন খারাপ কেনো করছো ?
রিমা - মা , এই নিয়ে আমার তিন তিনটে মেয়ে হলো । আমার ছেলের সাধ কি কখনো পূরণ হবে না ?? আর মেয়ে মানেই তো ঝামেলা । একটু বড় হলেই ওদের বিয়ের চিন্তা করতে হবে । এটা কি কম বড়ো দায়ভার ??
রিমার স্বামী অজয় - মা , রিমা তো ঠিকই বলেছে। ছেলের আশায় এই নিয়ে পরপর তিন তিনটে মেয়ে হলো । এবার ছেলে না হলে আমার বংশ রক্ষা কে করবে ?? আমার এতো সম্পত্তি , তার ভার কে নেবে ?? মেয়েরা তো পরের বাড়ি চলে যাবে , তাদের তো সম্পত্তির ভাগ দেওয়া না দেওয়া সমান
হেমালী দেবী - খোকা , ঘরে যদি মেয়েই না থাকে তাহলে সে ঘর তো শ্রী হীন । আর ভুলে যাস না , মেয়েরা জন্ম নেয় বলেই তোদের মতো পুরুষরা জন্মাতে পারে । আর বৌমা , তুমি যে মেয়ে হয়েছে বলে এতো হা হুতাশ করছো , তা মা তুমিও তো একজন মেয়ে ? একটা মেয়ে হয়ে মেয়েদের সম্পর্কে যে কি করে এই কথা গুলো বলছো , আমি বুঝতে পারিনা বাপু ?? হুঁ!
এই বলে হেমালী দেবী ঘরে চলে গেলেন
রিমা অজয় কে বলে - শোনো , মা তার নাতনীদের খুবই ভালবাসে জানি কিন্তু আমার ছেলে চাইই চাই । আমি মা দুর্গার কাছে মানত করবো যাতে আমার যাতে ছেলে হয় । মা যদি আমার কথা শোনে তাহলে মাকে একটা নথ গড়িয়ে দেবো।
অজয় - হম ঠিক আছে
তারপর রিমা মা দুর্গার কাছে মানত করে ছেলের জন্য।
তারপর বছর ঘুরতেই রিমার কোল আলো করে আসে তাদের ছেলে । অজয় রিমা সাধ করে নাম রাখে অরুণাভ.....তাদের প্রথম ও একমাত্র ছেলে তাই আদর টাও একদম আকাশ ছোঁয়া । রিমা তার কথা অনুযায়ী মা দুর্গাকে সোনার নথ গড়িয়ে দেয় । রিমার কোনো হুসই নেই যে তার আরও তিন কন্যাসন্তান আছে।
১৩বছর বয়সী বড়ো মেয়ে রিমলি প্রথম প্রথম মায়ের এই ব্যবহারে আঘাত পেলেও পরে তা সামলে ওঠে । ও দেখে যে ওর মা বাবা শুধু ওর ভাইয়েরই দেখাশোনা করে । ঠাম্মার বয়স হয়েছে কিন্তু তাঁর দায়িত্বও তার মা বাবা এড়িয়ে যায় । তাদের জগৎ জুড়ে শুধুই তাদের ছেলে এমনকি অর্ধেক দিন তাদের স্কুলের টিফিন পর্যন্ত pack করে দেয় না ; বাড়ির servants দেরও তাদের ছেলের ফাই ফরমাসে নিযুক্ত করেছে , তাই তারাও গুছিয়ে দিতে পারেনা । তাই রিমলি মনে মনে ঠিক করে নেয় যে তার ঠাম্মা আর বোনেদের দায়িত্ব এখন থেকে তার ।
মাত্র ১৩বছর বয়সী মেয়েটা তারপর থেকে ভোর ভোর উঠে পড়াশোনা শেষ করে রান্না করে নিজের এবং বোনেদের টিফিন pack করে ঠাম্মার breakfast দিয়ে স্নানে যায় । স্নান করে বেরিয়ে বোনেদের ready করে স্কুলে পাঠায় ।
এরপর কেটে গেছে ১০বছর । অরুণাভ এখন শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের আদরে আদরে বাঁদর টি তৈরি হয়েছে। যখন যেটা চাই সেটা তখুনি দিতে হবে নয়তো চিল চিৎকার সঙ্গে কান্না । আর বাবা মাও তখন ছেলের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত । হেমালি দেবী গত হয়েছেন দু বছর হলো । রিমলীর বিয়েও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তার বোন টিকলি আর তিতলি পড়াশোনা করছে । ভাইকে যতই ভালোবাসুক ভাইয়ের এই অহেতুক ব্যবহারে তারাও যথেষ্ট বিরক্ত । কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। এই তো সেদিন রিমা আর অজয় অরুণাভ কে plate ভর্তি পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে দিয়েছিলো । ছেলেটা সেটা নষ্ট করছে দেখেও কিচ্ছু বলেনি । বরং টিকলি আর তিতলি যখন বললো যে মা , ভাই খাবার গুলো নষ্ট করছে তখন উল্টে রিমা ওদের ধমক দিয়ে বললো - ওই টুকু ভাই , তাকে বড়ো দিদি হয়ে তোরা হিংসে করিস !! ছিঃ !!
এরকম রোজই চলে , রিমা আর অজয় ছেলেকে plate ভর্তি করে পঞ্চব্যাঞ্জন খেতে দেয় আর অরুণাভ দু হাত দিয়ে সেই খাবার সারা ঘরে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ফেলে , বড়ো বড়ো দুই দিদিকে ধরে ধরে মারে কিন্তু রিমা আর অজয় ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসায় ছেলেকে কিছুই বলে না ।
আসতে আসতে অরুণাভ বড়ো হয় ; এখন আর সে কিশোর নেই , সে এখন যুবকে পরিণত হয়েছে। ততদিনে তার দুই দিদিরও বিয়ে হয়ে গেছে রিমলির দুই দেওরের সাথে । রিমা অজয়ের ও বয়স হয়েছে । অরুণাভ এখন প্রচন্ড রুক্ষ হয়ে উঠেছে , বাবা মা কাউকেই পাত্তা দেয় না ।
এরমই একদিন অরুণাভ তার বাবা মাকে বলে - পাপা , দেখো আমি বিয়ে করতে চাই
অজয় - নিশ্চয় বাবা , তুমি বিয়ে করবে তো , কিন্তু তার জন্য তো পাত্রী দেখতে হবে
অরুণাভ - হম ৭ দিনের মধ্যে দেখো
রিমা - বেশ তাই হবে বাবা
কয়েকদিনের মধ্যে একটা ভালো পাত্রী পেয়েও যায় , মেয়েটার নাম নন্দিনী ।
এরপর একটা শুভ দিন দেখে আর অরুণাভ আর নন্দিনীর বিয়ে হয়ে যায় । বিয়ের পর কদিন খুব ভালো কাটে । আসতে আসতে অজয় বাবুরও বয়স বাড়ছে । তাই সে একদিন সমস্ত সম্পত্তি অরুণাভর নামে লিখে দিলেন আর তার মেয়েরা অত্যন্ত ভালো তাই সম্পত্তির ভাগ তারা আর চাইলো না । কিছুদিন পর অজয় বাবু তার স্ত্রী কে রেখে চোখ বুঝলেন । এক বছর খুব সুন্দর কেটে গেলো কিন্তু তারপরেই শুরু হলো অশান্তি । নন্দিনীর সঙ্গে তার শাশুড়ীর বনিবনা হচ্ছে না। ননদরা আগে যাওবা আসতো এখন আসেও না । অরুণাভ ও এখন কেমন বদলে গেছে । Office থেকে ফিরে মা এর সাথে দেখা করার সময়টুকুও হয় না তার । মা যদি কিছু বলে তাহলে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় ।
একদিন সকালে ,
নন্দিনী - মা , আজ আমি পার্লারে যাবো । তাই রান্না গুলো করে রাখবেন
রিমা - বৌমা , আজকে আমার বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে । আজ যদি একটু তুমি করে নাও...
নন্দিনী - impossible !! আমি পারবো না
রিমা - দেখো বৌমা , রোজের রান্না তো আমিই করি আজ নয় তুমিই করলে
নন্দিনী - কি বললেন আপনি ?? আমি একদিনও রান্না করিনা ??? সংসারের সমস্ত কাজ বুঝি আপনি একা করেন ? আজ আসুক আপনার ছেলে , দাড়ান !!
বলে ও চলে যায় । আর রিমা বাতের ব্যাথা নিয়েও রান্না ঘরে প্রবেশ করে ।
সন্ধেবেলা অরুণাভ ফিরলে , নন্দিনী ওকে ইনিয়ে বিনিয়ে মায়ের নামে বলে । আর অরুণাভ এমনিতেই খুব রুক্ষ , মা কে এখন তেমন আর পছন্দ করেনা তার ওপর স্ত্রী এর এই নালিশে ওর প্রচন্ড মাথা গরম হয়ে যায় । সেদিন রাতে প্রচন্ড অশান্তি হয় আর তার ফলস্বরূপ অরুণাভ মাকে টানতে টানতে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় । রিমা অবাক হয়ে যায় ছেলের এই ব্যবহারে । তিনি আলুথালু পোশাকে মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকে , লক্ষ করে না সামনে থেকে একটা গাড়ি আসছে । আর ওদিকে রিমলি , টিকলি আর তিতলি তাদের স্বামীদের সাথে সিনেমা দেখে ফিরছিলো , তারা মাঝে মাঝেই সিনেমা দেখতে যায় ; বরেদের সাথে তো যায়ই আবার মাঝে মাঝে শাশুড়ি ননদ দের সাথেও যায় । কিন্তু তারা রিমা কে এভাবে দুর থেকে দেখে চিনতে পারেনা । ওরা ভাবে যে কোনো বয়স্ক ভদ্রমহিলা রাস্তা দিয়ে এভাবে দিগ্বিদিক জ্ঞ্যানশূন্য হয়ে হাঁটছে ।
টিকলি রিমাকে পিছন থেকে ডেকে ওঠে - মাসিমা , সরে যান , গাড়ি আসছে । আরে ও মাসিমা , সরে যান
রিমার কানে কোনো কথা যায় না । তাই দেখে ওরা ৬জন ছুটে এসে রিমাকে টেনে ফুটপাথের দিকে নিয়ে আসে ।
তিতলি - কি করছিলেন কি আপনি ?? এক্ষুনি কতো বড়ো....
রিমলি - মা , তুমি !!!!!
টিকলি - মা , তোমার এই অবস্থা কি করে ? কি হয়েছে ??
রিমা ডুকরে কেঁদে ওঠে
এই দেখে টিকলির বর , অর্ক বলে - মা , আপনি কাদছেন কেনো ? কাদবেন না please , শান্ত হোন
তিতলি - মা কি হয়েছে আমাদের বলো ??
রিমা কাদতে কাদতে ওদের সমস্ত কিছু বলে , তার সঙ্গে এও বলে যে আমার যদি ছেলে না হয়ে আরেকটা মেয়ে হতো তাহলেই বোধ হয় ভালো হতো । আমার যে তখন কি মতিভ্রম হয়েছিলো যে ঈশ্বরের কাছে পুত্রসন্তান চেয়েছিলাম , কে জানে
রিমলির স্বামী , আদিত্য বলে - শালাবাবু , এটা কি করলো ?
রিমা - খোকা এখন পুরো অন্যরকম হয়ে গেছে !!! কিন্তু আমি এখন কোথায় যাবো ?
তিতলির স্বামী অভ্র - কেনো আপনার এতো গুলো ছেলেমেয়ে থাকতে আপনার থাকার জায়গার অভাব নাকি ? আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন
রিমা - না না তা হয় না , আমি তোমাদের বাড়ি.....
তিতলি - কেনো হবে না মা , তুমি এখন আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি যাবে । মা বাবাও তোমার কথা বলছিলেন
সবাই - তাহলে রাজি
রিমা হেসে ফেলে , বলে - রাজি !
গাড়িতে যেতে যেতে ,
রিমা - মা রে ছোট্ট থেকে তোদের এতো অবহেলা করেছি , কখনো কাছে টেনে নিইনি , সব সময় ভালোটা খোকাকে দিয়েছি আর আজ তোরা আমার কথা ভাবছিস !!
রিমলি - থাক না মা , এখন আবার এসব কথা কেনো ? Past is past , ভুলে যাও ওসব
টিকলি আর তিতলি - হ্যা মা বড়দি ঠিকই বলেছে , ভুলে যাও ওসব
ওরা বাড়ি যেতেই , রিমলি , টিকলি আর তিতলির শাশুড়ি , হেমলতা বলে - আরে দিদি তুমি ?? আমার কি সৌভাগ্য , কতদিন পর এলে দিদি , আমাদের বাড়ির রাস্তা তো প্রায় ভুলতেই বসে ছিলে
ওরা সবাই পুরো ঘটনাটা খুলে বলে শশুর শাশুড়িকে আর এও বলে যে আজ থেকে রিমা ওদের সাথেই থাকবে । সব শুনে ,
অজিতেশ ( শশুর মশাই ) - বাঃ এতো খুব ভালো কথা । তোমরা বেরিয়ে গেলে আমাদের বুড়ো বুড়িকে আড্ডা দিতে হয় , এবার নাহয় আমরা তিন জন মিলে আড্ডা দেবো।
হেমলতা - আর দিদি , কাল আমি টিকলি আর অর্ককে পাঠিয়ে তোমার সব জিনিস এবাড়িতে নিয়ে আসবো ।
রিমা - আচ্ছা বেশ
ছেলে মানেই বংশ প্রদীপ নয় । পৃথিবীতে ছেলেদের যেমন দরকার তেমন দরকার মেয়েদেরও । একটা মেয়ের বাবা মায়ের প্রতি যতটা টান , ছেলেদের ক্ষেত্রে সেই টান অনেকাংশে কম ( কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ) । তাই ছেলেরা কিন্তু আজীবন নাও দেখতে পারে কিন্তু একটা মেয়ে আজীবন বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে পারে লাইফে কম্প্রোমাইজ করে । কিন্তু পৃথিবীতে চালিয়ে উভয়কেই দরকার । তাই একজন বাবা মা এবং একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে ছেলে মেয়ে বা নারী পুরুষ উভয়কেই সমান চোখে দেখাই কাম্য।
