ভোঁ কাট্টা
ভোঁ কাট্টা


ছাদে ভীষণ হইচই হচ্ছে । আজ ওদের ম্যাচ । ওই ফ্ল্যাটের দত্তদের সাথে এবাড়ির মিত্তিরদের । দুজনদের দলই সমান । এ একটু ঢিল দেয় তো ওরা টান মারে আবার ওদল সুতো ছাড়ে তো এদল সুতো গোটায় । বুড়িকে ওরা খেলায় নেয়নি । ওদের মতানুযায়ী ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায় মেয়েরা থাকলে অসুবিধা । বুড়ি তাই একা ছাদের এক কোণে বসে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । মাঝে মাঝে নিজের মনেই বলে উঠছে ,"আরে ওরা ঢিল দিচ্ছে টানো টানো " । ওর কথা যদিও কেউ শুনছে না তবুও উত্তেজনার বশে বলেই চলেছে । প্রতিযোগিতায় নেয়নি তো কি হয়েছে দাদাদের হয়ে চিয়ারআপ তো করাই যায় । সব ভক্ত কি আর ভগবানের দেখা পায় তবুও তো ডাকে ।
বড়িগুলো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রোদে শুকোতে দেবার জন্য ছাদে উঠলেন মিত্তির বাড়ির কর্ত্রী বিমলাদেবী , বুড়ির ঠাকুমা । বুড়িকে একা থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন " তুই একা ওখানে কি করছিস আয় এখানে " । বুড়ি একটু বিরক্ত হয়েই উঠে এলো ।
- "তুই একা কি করছিস ? খেলিসনি কেন ওদের সাথে ?"
- " মেয়ে থাকলে খেলায় অসুবিধা তাই নেয়নি "।
বিমলাদেবী হাসলেন । " মেয়ে থাকলে অসুবিধা এমন কথা বাপের জন্মে শুনিনি "।
"ওরা তাই তো বললো"।
বিমলাদেবী একবার আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ির দিকে তাকালেন । মনে পড়ে গেল শৈশবের কথা। বিমলাদেবী তার দুইভাইকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়েছিলেন । মাঞ্জা তৈরি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু । তখনকার দিনে সে তল্লাটে বিমলাদেবীর ঘুড়ি ওড়ানোর প্রশংসা সর্বত্র । বিয়ে হয়ে যাবার পরও সেই নেশা যায়নি কিন্তু সংসারের চাপ সবকিছু ভুলিয়ে দেয় । আজকে নিজের নাতীরা বলে কি মেয়ে থাকলে ঘুড়ি ওড়ানোয় অসুবিধা !!
বিমলাদেবী বুড়িকে জিজ্ঞাসা করলো " তুই লাটাই ধরতে পারিস ?" ।বুড়ি মাথা নাড়লো । বিমলাদেবীর মনে হলো তিনি যেন আবার সেই শৈশবে ফিরে এসেছেন । কোমরে শাড়ির আঁচলটা গুজে তিনি বললেন যা ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে আয় । বুড়ি কিছুখন হাঁ করে দাঁড়িয়ে নিজের ঠাকুমাকে দেখছিলো । বিমলাদেবী গলা খাঁকিয়ে বললো " যা নিয়ে আয় ওদের আজকে দেখিয়ে দেব মেয়েরা কি জিনিস "। আর কিছু না বলে বুড়ি একটা ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে এলো । বিমলাদেবী ততক্ষণে বড়ি গুলো রোদে দিয়ে হাওয়া পরীক্ষা করছিলেন । বহুদিন আগে চাপা পরে যাওয়া আগুন আবার জ্বলে উঠেছে অগ্নুৎপাত আটকায় কে ...
আকাশে ঘুড়ি উড়লো । নীল রঙের এক ডিব্বা ঘুড়ি । বুড়ি লাটাই হাতে দাঁড়িয়ে রইলো । বিমলাদেবী কয়েকবার সুতোটা টেনে দেখে নিলেন । পুরোনো অভিজ্ঞতা । বিমলাদেবীর মনে হলো আবার সেই আগের মতো শক্তি ফিরে এসেছে । কয়েকমিনিট পেরোতেই এবাড়ির মিত্তিরদের পেল্লায় লাল ঘুড়িটা কেটে গেল । ছেলেগুলো হাঁ করে দেখছে তাদের ঠাকুমা ঘুড়ির সুতোয় নিখুঁত টান দিচ্ছেন আবার কখনো ঢিল আর বুড়ি ধরে আছে লাটাই । হটাৎ একটা চিৎকার এলো দত্তদের ওদিক থেকে । সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো নীল ঘুড়িটা কেটে গেছে আর দত্তদের ছেলেরা চিৎকার করছে " ভোঁ কাট্টা ..."।
বিমলাদেবী চোখ বুঝলেন । আর সে শক্তি নেই ইচ্ছা থাকলেই সব কিছু হয়না বয়সের ভার সুতোর ওপর পড়লে সে তো আপনাআপনি ছিঁড়ে যাবে সে ঘুড়ি হোক কিংবা সম্পর্ক । বুড়ির ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে দেখেন নাতীরা দাঁড়িয়ে । হাতে একটা পেল্লাই ঘুড়ি । নাতীরা এগিয়ে এসে সেটা বুড়িকে দিয়ে বলল " ওরা আর ঠাকমা তুমি লাটাই ধরো আমরা চিয়ার-আপ করছি "। একটা সুখের হাসি ফুটে উঠলো বিমলাদেবীর শিরা বেরিয়ে আসা মুখে ।
আবার ঘুড়ি আকাশে উড়লো ।
নাতীরা চিৎকার করছে " থ্রি চিয়ার্স ফর ঠাকুমা , হিপ হিপ হুররে .."। বেশকিছুখন লড়াই হলো । দত্তদের মাঞ্জাটা বেশ উঁচু দরের । হটাৎ দড়িতে ঢিল পড়লো । দেখতে দেখতে মিত্তির বাড়ির পেল্লাই ঘুড়ি নিচের দিকে নামতে নামতে আচমকা শোঁ করে ওপরে উঠে গেল । যা হবার তাই হলো । বিমলাদেবীর অভিজ্ঞ হাত এক নিমেষে কেটে দিলো দত্তদের ধারালো মাঞ্জা । বুড়ি চিৎকার করে উঠলো " ভোঁ কাট্টা ..." । নাতীরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে বিমলাদেবী ফিরে পেলেন বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া এক অকৃত্তিম আনন্দ । ঘুড়ির সুতো ভোঁ কাট্টা হয়ে গেলেও জীবনের সুতো এখনও জুড়ে আছে শৈশব কৈশোর সংসার ও বার্ধক্য । জীবনের সুতো ভোঁ কাট্টা হয়ে গেলে দুঃখের শেষ থাকে না । আকাশের কোনো এক কোনায় উড়তে থাকে হারিয়ে যাওয়া ঘুড়ি আলগা সুতো পড়ে থাকে হাতের মুঠোয় ....।।