বেড়াল রানী
বেড়াল রানী
রানী আর বনি দুই বোন।খুব ছোটবেলায় রেখাদের বাড়ীর সামনে কে যেন ফেলে দিয়ে গিয়েছিল দুই বোনকে। তারপর রেখাই তুলে এনে ওদের মানুষ করেছে। আদর করেছে,ভালবেসেছে।তাই রেখাকেই মা বলে জানে ওরা।মা আর দুই মেয়ের এক আলাদা জগৎ।শুধু ভালবাসা আর স্নেহ।
একদিন বাড়িতে খুব হই-হুল্লোড় শুরু হল। কত লোকজন,খাওয়া দাওয়া, কত মজা আর কি।আনন্দে মেতে উঠলো দুই বোন রানী আর বনি। ভাবল নতুন কিছু হতে চলেছে কারণ নতুন সাজে সেজে উঠেছে তাদের মা রেখা।কি আনন্দ, কি মজা। কিন্তু ভবিষ্যতের পরিনতি কি আর জানত তারা? তারা তো আর জানত না যে তাদের একা ফেলে চিরদিনের মত চলে যাবে তাদের মা। রেখা শশুরবাড়ি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই রানী আর বনির দুর্ভোগ শুরু হল।রেখার বদল সম্বন্ধ হয়েছিল তাই রেখার বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই রেখার ননদ মালবিকার সাথে রেখার দাদা মাধব এর বিয়ে হয়ে গেল।মালবিকা একদম বিড়াল দেখতে পারে না। তাই এসেই আগে রানী আর বনি কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করল।
এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় দুই বোন। পেটের দায়ে খাওয়ার চুরি করতে গিয়ে জোটে ঠেঙ্গানি আর লাথি।
রানী'টা চালাক হলেও বনি'টা ছিল একদম বোকা। একদিন সাহা বাড়ীর বৌ ওদের খুব ডেকে ডেকে মাছ খেতে দিতে গেল।রানীর সন্দেহ হল কারন এই মহিলা তো ওদের সবসময় ঠেঙ্গায় তাহলে আজ কেন খেতে দিচ্ছে? তাই ও গেল না। কিন্তু বনি'টা ছিল বোকা তাই খাওয়ারের লোভ সামলাতে না পেরে এগিয়ে গেল।ব্যাস আর কি? সাহা গিন্নি ঝপ করে ওকে তুলে নিয়ে করে দিল বস্তার ভিতরে চালান ।তারপর কোথাও গিয়ে পারও করে দিয়ে আসল।
এবার রানী হয়ে গেল সম্পূর্ণ একা আর নি:সঙ্গ।খেলার কেউ নেই কথা বলারও কেউ নেই।একদিন মা ও চলে গেল আর তারপর বোনও।নিজের চোখের জল নিজেই মোছে আর তারপর পেটের দায়ে চোর বদনাম মাথায় নিয়ে খাওয়ার খুঁজে বেড়ায় বেড়াল রানী।
একদিন বোধহয় ভগবান মুখ তুলে চাইলেন রানীর উপর। দস্তিদার বাগান বাড়ীর পিছনে একটা ডোবা ছিল, ওদিকটা কেউ যেত না।একদিন একাকিনী ঘুরতে ঘুরতে ওই ডোবাটাই খুঁজে পেল রানী।আহারে, ডোবা ভর্তি ব্যাঙ!ভাগ্যিস এই ডোবাটার কথা কেউ জানেনা, নাহলে বাকী সবাই মিলে এই ব্যাংগুলোকে খেয়ে খেয়ে শেষ করে দিত।এই ডোবাটা খুঁজে পাওয়া লটারি পাওয়ার মত ব্যাপার ছিল রানীর কাছে।আহারে বনিটা যদি আজ কাছে থাকত! কি জানি কেমন আছে বোনটা; আদৌ খেতে পাচ্ছে কি না।
এরপর পাকাপাকিভাবে এই ডোবাটাতেই আস্তানা গড়ে নিল রানী।বাইরে আর যেতনা।পাশেই একটা গাছের কোটরে ঘুমোত আর ডোবার ব্যাঙ ধরে খেত।
এর কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ করে রানীর নাকে এল সুন্দর এক গন্ধ। সেই তার মা রেখার বিয়ের দিনের গন্ধের মত গন্ধ। মুখার্জী বাড়ীর ছেলের বিয়ে। গন্ধে পাগল হয়ে সেখানে উপিস্থিত হল রানী। পেট ভরে মাছের কাঁটা আর মাংসের হাড় খেল।তারপর একটু রাতের দিকে ঢুলতে ঢুলতে ফিরছিল তার বাড়ীতে। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে অনুভব করলো ঘাড়ে এক কামড়। ছকা মস্তান!এ অঞ্চলের একমাত্র মস্তান হুলো বেড়াল ছকা। "এত সুন্দরী মেয়ে আমার চোখের আড়ালে এতদিন ছিল কি করে?"বিড়ালের ভাষায় বলে উঠলো ছকা।তারপর রানীর ঘাড় কামড়ে ধরে ওকে শুইয়ে দিল মাটিতে।তারপর পূর্ণমাত্রায় যৌন সঙ্গম করে আবার নিজের পথে ফিরে গেল ছকা।
এসবের মানে রানী জানেনা কারণ, কেউ তাকে কোনওদিন বলেই নি।কিন্তু সেদিন সে খুব আনন্দ পেয়েছিল ছকার এই আচরনে।
দিন যেতে লাগলো৷৷পুচু,বিলু,নিতু,....সবই রানীর দেওয়া নাম।কারণ ওই তো ওদের মা তাই না? পেটে অসহ্য যন্ত্রনা দিয়ে একদিন বেড়িয়ে এল ওরা।কি মিষ্টি, কি সুন্দর! একসাথে সবকটা স্তন্যপান করে।রানী চেটে চেটে আদর করে দেয় ওদের।আজ রানীর মনে আর কোন দু:খ নেই কারণ সে আর একা নেই।ওদের দুধ খাওয়ায় আর নিজে ডোবা থেকে ব্যাঙ ধরে খায়।ভালই কাটছিল দিনগুলো। এরপর আবার একদিন নাকে এল সেই সুন্দর বিয়েবাড়িরর গন্ধ।গন্ধের রাস্তা ধরে আবার রানী হাজির হলো সেখানে।আসার সময় বাচ্চাদের বলে গেল কোটরের বাইরে না আসতে।আর এও বলে গেল যে আসার সময় সে ভাল ভাল খাওয়ার নিয়ে আসবে।
পেট পুরে খেয়ে দেয়ে মুখে একটা মাংসের হাড় বাচ্চাদের জন্য নিয়ে ঘরে ফিরলো রানী। কিন্তু একী! এসে যা দেখল তাতে মুখ থেকে খাওয়ারটাই মাটিতেই পড়ে গেল রানীর।চোখ খুবলানো অবস্থায় পড়ে আছে তার বাচ্চাদের দেহ।রানী বারবার বারণ করা সত্বেও বাচ্চাগুলো বাইরে এসেছিল আর তখনই কাকে ঠুকরে তাদের চোখগুলো খুবলে নিয়ে তাদের মেরে ফেলেছে।আসলে রানীও মাঝে মাঝে ব্যাঙ ছাড়াও কাকের বাচ্চা খেত তাই তার অনুপস্থিতিতে কাকগুলো প্রতিশোধ নিয়েছে।
হাহাকার করে উঠল রানী। চারিদিক অন্ধকার দেখতে লাগলো সে। "ওয়াও,ওয়াও,ওয়াও".... মায়ের মড়াকান্না। মাথা আর কাজ করছে না। এদিক ওদিক তার সন্তানদের খুঁজে বেড়াতে লাগলো রানী যদি কোথাও তারা থাকে।"আয় না, আয় না, কোথায় আছিস তোরা?দেখ না তোদের মা কাঁদছে"। চৌধুরী বাড়ীর বুড়ি ঠানদি বলে," রাইত দুপুরে ওই হারামজাদী বিড়ালটা 'কু' ডাকতেসে।কোনো অমঙ্গল হবে বৈকি। মার হতচ্ছাড়িকে।"....ছুঁড়ে মারলো একটা ইঁট,এসে লাগলো রানীর পায়ে।লেঙ্গরী রানী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে আর খুঁজে বেড়ায় তার সন্তানদের।
লেঙ্গড়াতে লেঙ্গড়াতে কোনরকমে নিজের কোটরে এসে পৌঁছল রানী। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেল। কতদিন না খেয়ে না দেয়ে পড়েছিল সেটা ওরই মনে নেই। নি:সঙ্গ একাকীনি রানী চোখের জল ফেলে নি:শব্দে। এল শীতকাল। ভীষন ঠান্ডা। রানীর মনে পড়ে মা রেখার কথা। মনে মনে বলে," ও মা তুমি তো খুব ভালবাসতে আমায় আর বোনকে।লেপের তলায় নিয়ে শুতে।তোমার কোলে ঘুমোতাম আমরা।গলা দিয়ে ঘড়ঘড় করতাম। তুমি কোথায় চলে গেলে মা?আমার খুব শীত করছে আর খুব খিদেও পেয়েছে৷ তুমি কি ফিরে আসবে মা? আবার আমায় কোলে নেবে?"
রান্না করতে করতে বিষম খায় রেখা। দোলনা থেকে কেঁদে ওঠে খুকী। দৌড়ে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে স্তন্যপান করানো শুরু করে সে।চোখে ওর জল। মনে পড়ে রানী আর বনির কথা। জন্ম নাই বা দিল, মাতো মা'ই।
বিয়ের ১ মাস পর বাপের বাড়ী তে বেড়াতে এসে রানী আর বনিকে দেখতে না পেয়ে বৌদির সাথে একচোট হয়ে গেছিল রেখার।কিন্ত তাতে লাভের বদলে ক্ষতি ই হয়েছে। সবার সামনেই তার স্বামী তাকে মেরেছিল কষিয়ে এক থাপ্পড় কারণ, সে তার বোনকে খুবই ভালবাসত।অন্তত বৌ এর থেকে অনেক বেশী।রেখার দাদা আবার একটু কাপুরুষ টাইপের ছিল তাই এর কোন প্রতিবাদই করতে পারেনি সে। মেয়ের জন্ম দেওয়ার কারণে আজ শ্বশুরবাড়ীতে নানা কথা শোনে রেখা।তাই হাজার কষ্ট পেলেও আর রানী আর বনির খোঁজ সে নিতে পারেনি।
শীত গিয়ে এল বসন্ত।কোকিল ডেকে উঠল কুহুতান। আবার সেই সুন্দর গন্ধ।পেট জ্বালা করে উঠলো খিদেতে।না: এবার বিয়ে নয় গৃহপ্রবেশ। পুলিশের ডি.সি.পি সুখেন বোস আর ওনার স্ত্রী অতসী পাড়ায় সবচেয়ে বড় বাড়ী করে এসেছেন।দূর দূরান্ত থেকে নিমন্ত্রিত হয়েছে লোকজন।সেদিন ই রানী প্রথম দেখেছিল তার হৃত্বিক রোশন কে।হ্যাঁ মানুষ হলে হৃত্বিক রোশনের সাথে তুলনা করাটাই বোধহয় উচিত হবে। বোসগিন্নি অতসীদেবীর কোলে অবস্থানরত সেই সুপুরুষ ২২ হাজার টাকা দামের অরিজিনাল সাদা ধবধবে পার্সিয়ান ক্যাট মিস্টার প্রিন্স। সময়ের সাথে সাথে রানীর জীবনে নেমে এল বসন্ত। শুধু রানী কেন সমস্ত মেয়ে বিড়াল গুলোই খাওয়া ফেলে হাঁ করে দেখতে থাকল প্রিন্সকে। অপর মেয়ে বিড়াল চিনি তো বলেই উঠলো,"উফফ! হিরো তো হিরো!এর সন্তানের মা যদি হতে পারতাম তো জীবন বদলে যেত।কিন্তু আমাদের মত খেঁদি পেঁচী দের কি আর পাত্তা দেবে?।" রানীর মুখে কোন কথা নেই।সে এক দৃষ্টে দেখছে প্রিন্স কে।
এমন সময় হঠাৎ এসে হাজির হল মস্তান হুলো ছকা। সমস্ত ছেলে বিড়ালকে সে মেরে পাড়া ছাড়া করেছে। প্রিন্স কে দেখে গা পিত্তি জ্বলে গেল ওর,প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে গড়্গড় করতে লাগলো সে।,"ওই শুয়োরের বাচ্চা।এই মেয়েছেলেগুলো সব আমার।এদিকে একদম হাত বাড়াবি না।"প্রিন্স ও অতসী দেবীর কোলের মধ্যে থেকেই উলটো গড়্গড় করে উঠলো।,"যা ভাগ এখান থেকে গেঁয়ো ভুত কোথাকার।"
অপমান টা সহ্য হল না ছকার, এবার বেশ জোরেই গড়্গড় করে উঠল সে,"শালা মানুষের কোলে থেকে রঙ দেখাচ্ছিস?মরদের বাচ্চা হলে মানুষের কোল থেকে নেমে এসে আমার সাথে মুকাবিলা কর।হিজড়ে কোথাকার"
হিজড়ে বলাতে আবার প্রিন্সের ও গায়ে লেগে গেল ।,"দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা",এই বলে ছটফট করে অতসীদেবীর কোল থেকে নেমে আসার চেষ্টা করতে লাগলো প্রিন্স।
নিজের পোষা বিড়াল আর বাইরের হুলো বিড়ালটার মধ্যে সম্ভাব্য লড়াই এর আঁচ পেয়ে অতসী দেবী তার ছেলে বাবান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,"বাবান! লাঠি দিয়ে ওই নোংরা বিড়ালটাকে তাড়া তো।'' বাবান লাঠি নিয়ে তেড়ে যেতেই ছকা সহ রানী, চিনি সকলেই পালিয়ে গেল।পালাবার আগে দূর থেকেই প্রিন্স কে হুমকী দিয়ে গেল ছকা।"একদিন তোকে দেখে নেব শালা।"
বাড়ী ফিরে এল রানী।চোখে তার ঘুম নেই। রোজ রাতে একাকিনী কাদঁতো সে।আজ একাকিনী হাসছে। মন মেতে উঠেছে নতুন আনন্দে।, "হার মানা হার পরাবো তোমার গলে..."... মন গেয়ে উঠলো এই গান।
পরদিন সকাল ১১ টা। বড় চারতলা বোস বাড়ীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে রানী, উদ্দেশ্য মাছ চুরি করা নয় প্রিন্সের দেখা পাওয়া।
দু ঘন্টা ধরে খুঁজছে দেখতে পাচ্ছে না।অবশেষে দোতলার উপর একটা ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ভিতরে দেখতে পেল প্রিন্সকে।উফফ্ কি দারুন সুপুরুষ। কি যৌবন।খেলে বেড়াচ্ছে প্রিন্স তার খেলনা ইঁদুরের সাথে আর মাঝে মাঝে সাদা বাটিটা থেকে ক্যাট পেডিগ্রি না কি বলে ওসব খাচ্ছে। রানী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলো ওর কান্ড কারখানা। খেলতে খেলতে হঠাৎ প্রিন্সের চোখ পড়লো রানীর দিকে। লজ্জা পেয়ে রানী জানালার পাশে লুকোতে গেল কিন্তু ততক্ষনে প্রিন্স ওকে দেখে ফেলেছে। ও এগিয়ে এল জানালার পাশে। আমন্ত্রন করলো রানীকে,"এস ভেতরে এস। তুমি আমার অতিথি।নাও খাওয়ার খাও"।বলে পেডিগ্রির বাটিটা কে দেখিয়ে দিল প্রিন্স।
এর আগে কোন বিড়াল বন্ধুর থেকে এমন ব্যবহার পায় নি রানী এমন কি নিজের বোন বনির থেকেও নয়।
ভাই, বোন, বন্ধু যাই হোক না কেন খাওয়ার সময় সবাই সবার শত্রু তে পরিনত হয়।তাই প্রিন্সের এমন অমায়িক ব্যবহার মুগ্ধ করল রানীকে।সলজ্জ মুখে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো রানী। খাওয়ারের বাটিতে মুখ দিল আর দিয়েই আনন্দে নেচে উঠল রানী।এত সুন্দর টেষ্টি খাওয়ার সে আগে কোনদিনও পায়নি। গপগপ করে খেয়ে চলল রানী। প্রিন্স ওর দিকে তাকিয়ে ওর খাওয়া দেখতে লাগলো গভীর ভাবে।
খাওয়া শেষ করে মুখ, থাবা চেটে তারপর কথা শুরু করল রানী," অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর খাওয়ার খাওয়ানোর জন্য। প্রিন্স হেসে বলল, "ওয়েলকাম"। রানী ও এবার অনেকদিন বাদে মৃদু হাসলো। কথা নেই ওর মুখে। কথাটা প্রিন্স ই শুরু করল।
"তোমার নাম কি?"বলল প্রিন্স।
রানী বলল,"রানী।আমার মায়ের দেওয়া নাম।জানো তো তোমার মায়ের মত আমার ও মানুষ মা ছিল। মানুষদের মধ্যে ওই বিয়ে না কি হয় না, সেই সব হওয়ার পরে মা চলে গেল আর আমি একা হয়ে গেলাম।"....
প্রিন্স বলল,"হ্যাঁ গো ঠিক বলেছ।আমার ও না মানুষদের মত খুব বিয়ে করার ইচ্ছা কিন্তু কেউ রাজী হয় না জানো তো।আগে আমি যেখানে থাকতাম সেখানে আমার দুটো গার্লফ্রেন্ড ছিল ওদের কত করে বললাম বিয়ে করার জন্য কিন্তু ওরা কেউ রাজি হল না।অন্য পুরুষের সাথে চলে গেল।"
প্রিন্সের কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলো না রানী।ও বলল,"গার্লফেন্ড আবার কি গো?আর বিয়ে
টাই বা ঠিক কি, তাও আমি পরিষ্কার ভাবে জানিনা।এটুকু জানি যে বিয়ে হলে মেয়েরা অন্য জায়গায় চলে যায়৷"
এবার হা হা করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো প্রিন্স। তারপর বলল," আচ্ছা তোমার তো অনেক বয়েস হয়েছে দেখছি তা মা হয়েছো এর আগে কোনদিন?"
মা হওয়ার কথা বলাতে সন্তানের ভয়াবহ মৃত্যুর স্মৃতি ফিরে আসায় বিমর্ষ হয়ে গেল রানী।," হ্যাঁ! কিন্তু সন্তানরা কেউ আর বেচেঁ নেই।"বলল রানী।
প্রিন্স বলল," সরি।তোমায় দু:খ দিলাম। কিন্ত এবার তুমি আমায় বল কিভাবে মা হয়েছিলে তুমি?
রানী বলল," ওই তো! কাল তোমার যার সাথে ঝগড়া হচ্ছিল ছকা, ও একদিন রাতে আমার সাথে কি সব যেন করল আর তারপরেই আমি মা হয়ে গেলাম।"
প্রিন্স বলল,"হ্যাঁ।এবার ছকা তো তোমার সাথে জোর করে ওসব করেছিল তুমি তো আর ইচ্ছা করে কিছু কর নি তাই না?"মাথা নাড়ল রানী।
প্রিন্স বলল, " যখন একজন ছেলে আর একজন মেয়ে এই দুজনের ইচ্ছাতে ওসব হয় তখন তাকে বলা হয় প্রেম। আর প্রেম হলে ছেলেটিকে বলে বয়ফ্রেন্ড আর মেয়েটিকে গার্লফ্রেন্ড। আর যখন ওই ছেলেটির জীবনে শুধু ওই মেয়েটি ই থাকে আর ওই মেয়েটির জীবনে শুধু ওই ছেলেটিই থাকে আর দুজন একসাথে সন্তান লালন পালন করে তখন তাকে বলা হয় বিয়ে। আর বিয়ে হলে ওই ছেলেটিকে ওই সন্তান গুলোর বাবা বলা হয়ে থাকে।"কথা গুলো হাঁ করে শুনলো রানী।বোঝার চেষ্টা করল।কিছু বুঝলো আর কিছু বুঝলোও না কিন্তু এটা ভাবল যে কত কিছু জানে প্রিন্স।প্রিন্সের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় ভরে উঠলো রানীর মন। প্রেম তার মনে নাড়া দিয়েছে কিন্তু এখন অবধি প্রেমের মানে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে নি সে।
বোকার মত হেসে চলেছে রানী। আবার কথা শুরু করলো প্রিন্স,"আচ্ছা রানী তুমিও একা আমি ও একা।তোমার কোন বন্ধু নেই আর আমার ও কোন বন্ধু নেই, তা আমরা দুজন তাহলে বন্ধু হই না কেন?'' হাসি মুখে মাথা নাড়লো রানী।
এবার ওরা খেলে বেড়াতে লাগলো ঘরময়।কখনো খেলনা ইঁদুর নিয়ে আর কখনো নিজেরাই উল্টে পাল্টে কামড়া কামড়ি করে। ঘরের জানালা দিয়ে দুজনে বাইরে বেরিয়ে গেল। ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে লাগলো দুই মার্জার মিথুন।প্রিন্সের সাদা লোম ধুলোয় মেখে ধূসর হয়ে গেল।
সায়াহ্নে ডুবে গেল সূর্য। ওদিকে প্রিন্সকে বাড়ীতে না দেখতে পেয়ে অতসী দেবী তো মড়াকান্না জুড়ে দিয়েছেন। তিনবার স্বামীকে ফোন করা হয়ে গেছে। দুবার ১০০ নম্বরে ডায়াল করতে গেছিলেন। ছেলে বাবান অনেক কষ্টে আটকেছে।
সন্ধে নাগাদ ধুলো মেখে ঘরে ঢুকলো প্রিন্স। ওকে দেখেই তো হাঁউমাউ করে উঠলেন অতসী দেবী।প্রিন্স কে নিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলেন বাথরুমে আর তারপর বাথ টাবে বসিয়ে ১ ঘন্টা ধরে সাবান দিয়ে স্নান করালেন৷ আর তারপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে প্রিন্সের লোমগুলো শুকোনোর পর, আর ফোলানোর পর শান্তি পেলেন।
পরদিন থেকে পায়ে শিকল লাগলো প্রিন্সের।দুপুর টা ফাঁকাই থাকে বোসবাড়ি।সুখেনবাবু থানায়, ছেলে বাবান কলেজে আর অতসীদেবী জিমে। এই সময়টাই প্রিন্সের সাথে রানীর দেখা করতে আসার সময়।এখন তো আর প্রিন্স বেরোতে পারে না।পায়ে শিকল দেওয়া থাকে ওর। তাই রানীই ঢোকে ওর ঘরে। তবে এখন প্রিন্সের উপর অতসীদেবী খুব খুশি থাকেন কারণ আগে প্রিন্স খাওয়ার নষ্ট করত আর এখন সব খাওয়ারটাই খেয়ে শেষ করে দেয়।উনি তো আর জানেন না যে এখন খাওয়ারে ভাগ বসেছে। হাড়গোড় বার করা রানী, ক্যাট পেডিগ্রী খেয়ে ধিরে ধিরে সুন্দরী হয়ে উঠতে লাগল। সে আবিষ্কার করল যে কাবুলি বিড়ালের সমস্ত রকম বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে আছে। ঝাড়ালো লেজ,লম্বা লোম,ধীরে ধীরে প্রিন্সের রানী হয়ে উঠেছে সে। পুকুরের জলে নিজের রূপ দেখে নিজে চিনতে পারেনা রানী। মনে নতুন আনন্দ আর শরীরে নতুন যৌবন। বুকের হাল্কা ধুকপুকুনি বুঝিয়ে দেয় প্রেমকে। অ্যানড্রয়েড মোবাইলের টকিং টম আর টকিং অ্যাঞ্জেল আজ বাস্তবের প্রিন্স আর রানী।
"Every night in my dreams
I see you, I feel you
That is how I know you, go on
Far across the distance
And spaces between us
You have come to show you, go on"...
প্রিন্সের সমস্ত ভালবাসা গায়ে মেখে একদিন রাতে ফেরার পথে আবার ছকার সাথে মুখোমুখি হল রানী।"ওই হিরোটার সাথে আজকাল খুব চুলকাচ্ছিস তাই না শালী"বলল ছকা।
রানী বলল,"রাস্তা ছাড়ো বাড়ী যাব৷"..
ছকা:-(এক থাপ্পড় মেরে)"এখানে আমি ছাড়া আর কোন মরদ থাকে না সেটা তুই জানিস না?"
রানী:-"তুমি আমার রাস্তা ছাড়ো।"
ছকা:-"ওই শালী আমার সাথে পাঙ্গা নিবি না বলে দিচ্ছি।"
এই বলে রানীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছকা।একসময় রানী ছকার সন্তানের মা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আজ প্রিন্সের গায়ে মাখা ভালবাসাকে কোনভাবেই ছকার হাতে নষ্ট হতে দিতে চাইছিল না সে।প্রবল ভাবে বাধা দিয়ে উঠল রানী।
এই সময় একটু দূরে একটা কুকুর ঘুমোচ্ছিল।আচমকা বিড়ালের চেঁচামিচি শুনে তার জন্মগত স্বভাববশতঃ বিড়াল তাড়া করার উদ্দেশ্যে ছুটে এল এদিকে। কুকুর দেখে ছকা আর রানী পরস্পর বিপরীত দিকে ছুটে পালাল।
"আজ এই শালা কুকুর টার জন্য ছাড়া পেয়ে গেলি শালী। কিন্তু আমার হাত থেকে বাঁচবি না মনে রাখিস"এই বলে ছুটে পালাল ছকা।
কিছুদিন পরে আবার রানীর কোলে এল সেই বুলু, টুলুরা। ওরা প্রিন্সের সন্তান।এবার ওদের গাছের কোটরে রাখেনি রানী পাছে কাক আবার মেরে ফেলে।রেখেছে কাছেই একটা পোড়ো ভাঙ্গা বাড়ীর ভেতর।বাড়ীটা ভুতের বাড়ী বলে বিখ্যাত তাই কেউ এদিকে আসে না।বাচ্চাগুলো বেশ নিরাপদেই আছে এখানে।
তিনদিন বাদে একটু সুস্থ হতেই প্রিন্সের কাছে গিয়ে খবরটা দিল রানী।"জানো তো তোমার সন্তানের মা হয়েছি"বলল রানী। তিনদিন ধরে রানী না আসাতে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল প্রিন্স। এবার রানীকে পেয়ে খুব খুশি সে। "আমার মা তো পায়ে শিকল দিয়ে রেখেছে তাই দেখতে যেতে পারছি না।একটু বড় হলে তুমি সঙ্গে নিয়ে এস কেমন?"বলল প্রিন্স।
সারাদিন গল্প শেষে আবার ঘরে ফিরে এল রানী।কিন্তু একী!আবার সেই দৃশ্য। তার সন্তানদের মুন্ডহীন দেহ পড়ে আছে পাশে। আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ছকা মস্তান," হা, হ, হা,শালী আমার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছিলিস তাই না?কি ভেবেছিলি? আমি তোর আস্তানা খুঁজে পাব না? এ অঞ্চলে আমার সন্তান ছাড়া আর কারোর সন্তান জন্মায় না বুঝলি?দ্যাখ তাকিয়ে দেখ।তোর সন্তানদের আস্ত গিলে ফেলেছি আমি।"বলে উঠল হিংস্র ছকা। এবার সন্তানহারা রানী পাগলের মত হয়ে গেল।ভয়ংকরী রূপে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছকার উপর।"শয়তান! আজ তোকে শেষ করে দেব আমি"বলল রানী।
এক ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল ছকা।
আগেরবার রানীর কাছে কাঁধে মাথা রাখার মত কেউ ছিল না কিন্তু এবার তার কাছে প্রিন্স আছে।তাই ছুটে গেল সে প্রিন্সের কাছে। চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে সব কথা বলতে লাগলো সে। রাগে গা জ্বলে গেল প্রিন্সের। ও শুধু একটা কথাই বলল, " বাইরে অপেক্ষা কর রানী। আমি একটু বাদে আসছি।"
দুপুরে অতসীদেবী যখন প্রিন্স কে স্নান করানোর জন্য শিকলটা খুলতে গেলেন ঠিক তখনই শিকল খোলার সাথে সাথেই একলাফে জানালা দিয়ে পালালো প্রিন্স।বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল রানী।প্রিন্স বলল,"তাড়াতাড়ি চল রানী,আর সময় নেই।ছকাকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে আমায় বল।"
রানী বলল," এই সময় তো কালুর মুরগীর দোকানের সামনেই থাকে",
"চল তবে সেখানেই যাই"৷এই বলে ছুটে ছুটে এগিয়ে যেতে থাকল রানী আর প্রিন্স।পিছনে পিছনে উন্মাদিনীর মত হাহাকার করতে করতে ছুটে আসতে লাগলেন অতসী দেবী। তার পিছনে ছেলে বাবান আর স্বামী সুখেন বাবু। তারও পিছনে কাজের মাসী আর রান্নার মাসি সুখলতা আর কমলা আর তারও পিছনে মজা দেখার উদ্দেশ্যে কিছু পাড়া পড়শি আর ছেলে ছোকরার দল।সব মিলে গোটা ২৫ জন মানুষ ধাওয়া করল প্রিন্স আর রানীকে।
কালুর মুরগীর দোকানের সামনেই বসে ছিল ছকা।প্রিন্স কে দেখে মুখ দিয়ে গড়গড় আওয়াজ শুরু করল সে।,"শালা হিজড়া,এতগুলো মানুষ সাথে করে নিয়ে এসেছিস আমায় মারতে? মরদের বাচ্চা হলে একা লড়ে দেখা শালা" বলল ছকা।
"একা লড়বি তো? তাহলে চল ওই কার্নিশের উপরে যেখানে মানুষ নাগাল পাবে না।"এই কথা বলে প্রিন্স সোজা লাফিয়ে উঠলো এক দোতলা বাড়ীর কার্নিশে।অপর দিক দিয়ে ছকাও ওই একই কার্নিশে গিয়ে উঠলো। দুজনে মুখোমুখি,শুরু হল লড়াই।
নিচে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন অতসী দেবী,"বাঁচাও বাঁচাও,ওই শয়তান বেড়ালটা আমার ছেলেটা কে মেরে ফেলল রে"...
এই দৃশ্য দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো ছেলে ছোকরারা।সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করতে লাগলো।কিন্তু ওই যে বলে 'কারোর পৌষ মাস তো কারোর সর্বনাশ' সবাই মজা নিচ্ছে আর অতসীদেবীর দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।তার আদরের সন্তান টিকে যে ওই শয়তান হুলোটা মেরে ফেলবে।কিন্ত কেউ ওটা বুঝছে না।
ওদিকে রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।ঘ্যাঁও ঘ্যাঁও,গড় গড় শব্দ আর তার সাথে আকাশ বাতাশ ভরে উঠেছে বিড়ালের সাদা সাদা লোমে। ওদিকে অতসীদেবী হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছেন। আশেপাশের সবার কাছে আর নিজের স্বামীর কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করে চলেছেন তিনি। "কেউ বাঁচাও আমার ছেলেকে প্লীজ, দয়া করে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দাও কেউ।প্লীজজজ"....
অবশেষে লড়াই থামলো।ক্যাট পেডিগ্রী খাওয়া প্রিন্সের কাছে খুবই নগন্য হয়ে গেল হাড়গোড় খাওয়া ছকার শক্তি। লড়াই শেষে কার্নিশ থেকে নিচে পড়ে গেল ছকা। একটা ঠ্যাঙ ভাঙ্গলো,সারা গা ক্ষত বিক্ষত,রক্ত বেরচ্ছে।ল্যাঙড়াতে ল্যাঙরাতে গা ঢাকা দিল ছকা।
বিজয়ী প্রিন্স বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কার্নিশে।নিচ থেকে এবার রানী লাফিয়ে উঠলো কার্নিশে।দুজনে খুব আদর আর চাটাচাটি করল। প্রিন্স কার্নিশ থেকে নামতেই অতসীদেবী নিয়ে চলে গেলেন ওকে।বাড়ী গিয়ে তো এলাহি কান্ড। আবার স্নান করানো, মলম লাগানো এসব আর কি।
এর পর থেকে আবার রোজকার মত শুরু হল প্রিন্স আর রানীর দুপুরে লুকিয়ে দেখা করা।
আবার সন্তান এল রানীর গর্ভে।এবার প্রিন্স বলল, "তুমি এবার আমার ঘরেই সন্তান প্রসব করবে।" রানী বলল,"সে কী! তোমার মা তো দেখলে রেগে যাবেন।"
"কিচ্ছু হবে না তুমি দেখ না মজা টা" বলল প্রিন্স।
অতসীদেবী ঘরে ঢুকে সন্তানসহ রানী কে দেখে প্রথমে ভিরমি খেলেও তারপর সন্তানগুলোর দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন।অবিকল ছোট প্রিন্স।রানীও মূলত কাবুলি বিড়াল হওয়াতে বাচ্চাগুলোকে সম্পূর্ণ পার্সিয়ান ক্যাটের মতই দেখতে হয়েছিল।
চোখে জল অতসীদেবীর।"ওরে কে কোথায় আছিস আমার প্রিন্স বাবা হয়েছে।আমি ঠাকুমা হয়েছি তোরা দেখে যা,"বললেন অতসীদেবী। তারপর বাচ্চাগুলোকে হাত দিয়ে আদর করতে লাগলেন।
প্রিন্সের সন্তানের মা হওয়ার সুবাদে রানী পাকাপাকিভাবে বোসবাড়ীতে স্থান পেয়ে গেল।মানে অতসীদেবী ওকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিলেন।তবে এই শাশুড়ি বউতে ভারি ভাব।
বিড়াল দম্পতি হিসেবে সারাজীবন কাটালো আর বহু সন্তানের জন্ম দিল প্রিন্স আর রানী।
৮ বছর পর ৫ দিনের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করল প্রিন্স আর রানী।আগে প্রিন্স আর তার ৫ দিন বাদে না খেয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করল রানী।অতসীদেবীর হাহাকারে সেদিন কেঁপে উঠেছিল আকাশ বাতাস।
বাড়ীর বাগানে পাশাপাশি কবর দেওয়া হল দুই দম্পতিকে আর তার উপর ক্রশ ও বসিয়ে দেওয়া হল।
আজও বিড়াল জগতের ইতিহাসে মুমতাজ -শাহজাহানের মত বিখ্যাত হয়ে আছে প্রিন্স আর রানীর প্রেম কাহিনী।