STORYMIRROR

Suparna Bose

Romance

2  

Suparna Bose

Romance

অলক্ষ্মী

অলক্ষ্মী

6 mins
132


ভোরবেলা ঘুম ভেঙে অজিত দেখল বাণী বিছানায় নেই। ছেলে বাবুসোনা উল্টো দিকে ফিরে পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।বাণী হয়তো টয়লেটে গেছে ভেবে অজিত আবার ঘুমের আঠায় জড়িয়ে গেল।কিছুক্ষণ পরে ঘুম কিছু ফিকে হলে সে ভাবল,কই বাণী এখনো এলো না তো?এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার মেয়ে নয় বাণী।রাত জেগে কিসব ছাইপাঁশ লিখে বেলা দশটা পর্যন্ত পড়েপড়ে ঘুমোয়।সাক্ষাৎ অলক্ষ্মী একটা।বাবুসোনাকে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে স্কুলে দিয়ে আসা প্রায় নিত‍্যদিন অজিতেরই ডিউটি ।এই ভোর রাত্তিরে বাণী গেল কোথায়! এই এক বউ জুটেছে তার।না গেলা যায় না ফেলা যায়।ছেলেটা না থাকলে কবেই ডিভোর্স করে পাপ চুকিয়ে ফেলত অজিত।কিন্তু দশবছরের ছেলের তো মাকে চাই।এই অলক্ষ্মীকে বিদেয় করলে অজিত না হয় বউ পেয়ে যেতেই পারে কিন্তু বাবুসোনা তো মা পাবেনা।সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে অজিত।বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে বাণী মেঝেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।মাথার নিচে কুশন। খোলা চুল মেঝেতে ছড়ানো। চোখে চশমা।বুকের ওপর কালো কভারের একটা ডাইরি উপুড় করে রাখা।জলপাইরঙের নাইটি হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে।সেদিকে তাকিয়ে আজ অনেকদিন পরে একটু যেন আদরের ইচ্ছে জাগল অজিতের।বাণীর চোখ থেকে চশমাটা আলতো হাতে সরিয়ে নিতেই চটকা ভেঙে তাকালো।অজিত দেখলো বাণীর চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল।অজিত অবাক হয়ে বললো,কি হয়েছে?তারপরেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। মনে মনে বললো, ' নির্ঘাৎ আবার প্রেম ভেঙেছে।লজ্জা ঘেন্না বলে বস্তু নেই এই মেয়েমানুষের।


গতবছর এই সময় সেকি কেলেঙ্কারি। অরবিন্দ না অরিন্দম কি যেন নাম লোকটার! কবি না লেখক না ধম্মের ষাড়।তার বউ কোথা থেকে অজিতের ফোননম্বর জোগাড় করে কি অপমানটাইনা করলে অজিতকে।ভাগ‍্যিস তার আদ‍্যিকালের বোতাম টেপা মোবাইল তা নয়তো বাণীর কিসব নগ্ন ছবি টবি পাঠানোর কথা বলছিল মহিলা।ছিঃ ছিঃ। ভাবলে পেটঘুলিয়ে বমি উঠে আসে। কোন কুক্ষণে এই মেয়ের রূপ দেখে মজে বিয়ে করেছিল অজিত।পাগল একটা মেয়েকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।এই শান্ত হয়ে রয়েছে তো পর মুহুর্তেই অগ্নিশর্মা।পান থেকে চুন খসলেই জিনিসপত্র ছুঁড়ছে ভাঙছে।দেখ না দেখ হাত কাটতে যাচ্ছে নিজের।বিয়ে করে বারো বছরে জীবন হিল্লে হয়ে গেল অজিতের।আবার কি যে ছাইপাঁশ কবিতা লেখে।প্রথম প্রথম ধৈর্য ধরে শোনার চেষ্টা করত অজিত।মাথামুন্ডু না বুঝেও বলতো,বাহ বেশ ভালো লিখেছ তো! তাতেই লাই পেয়ে ঘরের কড়ি নষ্ট করে ফি ব্ছর একখানা করে কবিতার বই বার করা চাই।তার ওপর আজ এখানে কাল ওখানে কবিতার অনুষ্ঠানের নামে নেচে বেড়ানো।কোবতে কচ্চেন উনি। তাও যদি না সুকান্তর মত লিখতে পারতো,পূর্নিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।আসলে কবিতা ফবিতা কিচ্চু নয়।নাং খুঁজতে বেরোয়।কথায় আছে নেড়া তিনবার বেলতলায় যায়না।আর এনাকে দেখো।গতবারের অপমানেও চেতনা হয়নি নির্ঘাৎ আবার কিছু করেছে।কবিদেরও বলিহারি।পরকীয়া ছাড়া যেন কবিতা হয়না।সকাল সকাল মনটা তেঁতো হয়ে যায় অজিতের।সে ডাইনিং হলে গিয়ে টিভিটা চালিয়ে দেয়।

বাণী মেঝে থেকে উঠে বসে খোলা চুল হাতখোঁপায় জড়িয়ে নেয়।খোলা দরজা দিয়ে দেখে অজিত তার দিকে পিছন ফিরে বসে টিভি দেখছে।বাণীর খুব ইচ্ছে করে অজিতের কোলে মুখ গুঁজে খুব একচোট কাঁদে।সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে মনে করার চেষ্টা করে গত রাতে মণিরুলের টেক্সট মেসেজগুলো।মণিরুল তাকে বলেছিল,প্রতিবার স্ত্রী খাদিজার শরীরে উপগত হবার সময় সে মনেমনে বাণীর শরীর কল্পনা করে।যে শরীর সে হোটেলের বন্ধ ঘরে বার কয়েক দেখেছে। গতকাল সকালবেলায় খাদিজা একটি ফুটফুটে কন‍্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে।মণিরুল তার নাম রেখেছে রাধা।সেই সদ‍্যজাত রাধার চোখদুটো যেন অবিকল বাণীর মতোই।ঈষৎ পিঙ্গলবর্ণ,ঘনপল্লবে ছাওয়া। মণিরুল চায় এখন থেকে এক আদর্শ বাবা হয়ে উঠতে।আর যেটা মণিরুল বলেনি সেটা বাণী বোঝে।মণিরুল ঠিক একইভাবে হয়ে উঠতে চায় খাদিজার পয়গম্বরের মত আদর্শ স্বামী।বাণীর মাথার মধ‍্যে তাকে নিয়ে লেখা মণিরুলের অজস্র কবিতা ঝমঝম করতে থাকে।বাণীর মনে পড়ে হলদিবাড়ি কবিতা উৎসবের নিবিড় আনন্দের দিনগুলো।ভিনাস,অ‍্যাফ্রোদিতি,সরস্বতী।কত নামেই না ডাকতো তাকে মণিরুল।আদরে আদরে বিবস করে ফেলতো।এমন আদর সে কখনো পায়নি অজিতের কাছে।তার তো ধরো তক্তা মারো পেরেক স্বভাব।বাণীর স্ট্রবেরির মত গোলাপি ঠোঁট গ্রাস করে নিতে নিতে মণিরুল বলেছিল,বাণীই নাকি তার কবিতার প্রেরণা।এখন থেকে কি তবে মণিরুল আর কবিতা লিখবে না! নাকি কন‍্যার চোখের দিকে তাকিয়েই সে কবিতা লেখার প্রেরণা পাবে! এখুনি এই মুহুর্তে মণিরুলকে দেখতে ইচ্ছে করছে বাণীর।কি করবে সে? এখুণি একবার ফোন করে বলবে,হোয়াটসআপে এসো।আমি দেখব তোমায়।এখুনি একবার তোমায় না দেখলে আমি ছাতি ফেটে মরে যাব?কি বলবে সে! ফোনের রংটোনে ঘুম ভাঙিয়ে মণিরুলকে বলবে,এখুনি বাথরুমে যাও জামা খোলো।আমি তোমার বুকের পশমে মুখ ঘষবো।আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে মণি।আমায় একবার জড়িয়ে ধরো তোমার বুকের মধ‍্যে।আরো একটিবার ঠোঁটে ঠোঁট রাখো।এই শেষবার।আর কখনো বলবো না তোমায়।বাণী হোয়াটসআপে মণিরুলের ছবির দিকে চেয়ে থাকে।মণিরুলের চোখের তারায় সেই নক্ষত্রের ঝিকিমিকি।একমাথা কালো চুলে দু একটি রুপোলি তার।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।সাদা পাঞ্জাবির বুকের ওপর কালো রঙে বাংলা বর্ণমালা লেখা।এই পাঞ্জাবি মণিরুলকে বাণীই উপহার দিয়েছিল।ঠোঁট টিপে হাসছে মণিরুল। বাণী জানে ওর ঠোঁটের স্বাদ নোনতা।বাণী জানে মণিরুলের শরীরের কোথায় তিল।কতক্ষণ সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে বাণীর ভিতর।মণিরুলও কি জানে না,কোথায় স্পর্শ করলে বাণী আর স্থির থাকতে পারেনা।সব প্রতিরোধ ভেঙে সে ভেসে যায়।সুনামির ঢেউয়ের মত কান্না বাণীর চোখের উপকূলে আঁছড়ে পড়ছে কান্নার দমকে সারা শরীর ফুলে ফুলে উঠছে।বাণী সেটিংসে গিয়ে মণিরুলকে রিপোর্ট অ‍্যান্ড ব্লক করলো।মুহুর্তের মধ‍্যে পরস্পরের দিবারাত্রির অজস্র অনুভূতিমালা মুছে গিয়ে ফাঁকা স্লেটের মতো হাল্কা সবুজ স্ক্রিন।বাণী ফেসবুকে গিয়ে মণিরুলের অ‍্যাকাউন্টে গিয়ে সেখানেও ব্লক করলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাণীর চোখের সামনে থেকে মণিরুল বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। বাণীর পোস্ট এ তার দেওয়া লাইক কমেন্টসগুলিও উধাও হয়ে গেল। যেন মণিরুল বলে কেউ বাণীর জীবনে ছিলই না কখনো।এবার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বাণী।সেই শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অজিত।তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ।উঠে এসে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, সকাল সকাল আবার এসব কি ন‍্যাকামো জুড়লে শুনি।আবার কনো নাগর ধোঁকা দিয়েচে বুজি? বাণী উত্তর দেয় না।কিছু লিখবে বলে ডাইরিটা টেনে নেয়।সেই কিশোরীবেলা থেকে এটাই তার অভ‍্যেস।যে অনুভূতি সে কারোর কাছে প্রকাশ করতে পারে না তাই সে লিখে রাখে ডাইরির পাতায়।


বাণী দুটো পংক্তি লিখলো ডায়রির পাতায়, এ জীবন মরুর প্রদেশ/ মরিচীকার মত তোমার দুচোখে স্বপ্নের আদেশ...পরের পংক্তি লেখার আগেই ডায়রিটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করল অজিত।এই ডাইরিটাই তার চক্ষুশূল।বাণী বুকের কাছে চেপে রাখল ডায়রিটা। অজিত আরেকটু জ্বলে গিয়ে বললো। _'তোমার কি জীবনে শিক্ষা হবেনা? এতো চুলকুনিটা কিসের তোমার?' বাণী এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে ডাইরিটা পাশে নামিয়ে রেখে ফণাধরা সাপের মত অজিতের মুখোমুখি দাঁড়ালো।_' জানো না চুলকুনিটা কিসের? নিজের মুরোদটা জানো তো? নাকি সেটাও বলে দিতে হবে? নিজের অক্ষমতা ঢাকতে ছেলের দোহাই দাও।দশ বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে শোও।আর ন‍্যাকামো করে বলো, ছেলেকে ছাড়া ঘুমোতে পারো না।কাকে বোকা বানাচ্ছ?' বাণী হিসহিস করে কথাগুলো বলে হাঁফাতে থাকে। অজিত এক মুহূর্ত থমকে গিয়েই আবার একপর্দা গলা চড়িয়ে বলে,_' বিষ নেই তার কুলোপানা চক্কর।সংসারের কোনো কাজে মন নেই।এদিকে কোবতে হচ্চে।পরকীয়া না করলে আর ওনাদের কোবতে হয়না।কবিতা উৎসব তো নয় রাসলীলা করতে যায় সব।কি অভাব রেখেছি আমি তোমার? শাড়ি গয়না গাড়ি বাড়ি।তাও আর মন পাওয়া যায়না ।হতো অন‍্য কনো ছেলে ঠ‍্যাং ভেঙে বাড়িতে বসিয়ে রাখতো।'


বাণী আর স্থির থাকতে না পেরে হাতের কুশনটা ছুঁড়ে দিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,_তুমি এখুনি ঘর থেকে বেরোও নয়তো আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।' অজিত মুখ ভেঙিয়ে ওঠে, _কোথায় যাবে? কে ঘরে তুলবে? দুদিন ফূর্তি করে ফেলে দেবে।' বাণী থমকে যায়। তার চোখের সামনে মণিরুলেরমুখখানা ফুটে উঠে। মণিরুল কি তাহলে ভালবাসার নামে তার সাথে ফূর্তিই করেছে?এই যে কবিতা প্রতি-কবিতায় ক্রমশ কাছে আসা।মিলেমিশে যাওয়া সেকি শুধুই ফুর্তিলোটার জন‍্যে ! বাণী হঠাৎ খুব শান্ত হয়ে যায়। অজিত গজগজ করতে করতে জামা প‍্যান্ট গলায়। _'কোথায় সকালবেলায় এককাপ চা দেবে তা নয় সকাল থেকে উঠই অশান্তি। অলক্ষী একটা বউ জুটেছে আমার '।অজিত বাইকের চাবি,গোলার চাবি হাতে নিয়ে সশব্দে দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায়।কিছু দূরে মেইনরোডের ওপর তার সিমেন্ট বালির গোলা।সেখান থেকেই একটু একটু করে প্রমোটরি কারবার জমিয়ে তুলেছে সে।বাজারের ভেতর এখন যে প্রজেক্টটা চলছে সেখানেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা দুশো স্কোয়ারফিটের দোকানঘর সে বাণীকে দিতে চাইছে বিউটিপারলারের কারবার করার জন‍্যে।কিন্তু বাণীর মাথায় ওই কি এক পাগলামো কবিতা লেখার।কবিতার বই আজকালকার দিনে কেউ কেনেও না।পড়েও না।বেকার পয়সা নষ্ট তার ওপরে হাজার রকম উৎপাত।আজ এই কবি তো কাল ওই কবির সঙ্গে প্রেম।এতো প্রেম এদের আসে কোথা থেকে কে জানে! অজিত অফিসঘরের তালা খুলতে খুলতে দেখে পুরনো কর্মচারী চন্ডী ঢুকছে।সে হাঁক দিয়ে বলে _দেখতো,ঝনাদার দোকানে কচুরী ভাজছে কিনা? তাইলে এক প্লেট কচুরী আর এক কাপ চা নিয়ে আয়।' অজিত ফরাসের ওপর গা এলিয়ে দেয়। সকাল থেকে যা গেল।অশান্তির একশেষ।

কিছুক্ষণ পরে চন্ডী কচুরীর প্লেট এনে দেয়।অজিত গরম কচুরীর এক টুকরো মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে ভাবে, ' কিজানি অলক্ষ্মীটা কিছু খেলো কিনা'



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance