ANKIT ROY

Romance Fantasy Inspirational

4.5  

ANKIT ROY

Romance Fantasy Inspirational

অক্ষরবৃত্তের জ্যা

অক্ষরবৃত্তের জ্যা

7 mins
608


কলকাতা শহরের অপেক্ষাকৃত নির্জন একটি পার্কে বসে আছে আহেরী। মানুষের জীবনে হঠাৎ করেই সবকিছু কিরকম ডামাডোল হয়ে যায়। কি নিরবচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলে সময় অথচ পরমূহুর্তে যে কি হতে চলেছে তা কাউকে কোনো উপায়ে বুঝতে দেয় না। সময়যন্ত্রের সামনে মানুষের এই অসহায়তাকে গত কয়েক দিন ধরে কিছুতেই মানতে পারছে না আহেরী। অথচ না মেনে কারোরই করার কিছু থাকে না। নিজের মনকে ও ক্রমাগত বুঝিয়ে চলেছে এই অসহায়তাও চিরস্থায়ী নয়; ক্ষত সারানোর জন্য সময়ের চেয়ে ভালো প্রলেপ আর কিছু নেই পৃথিবীতে। তবু ওর মন শান্ত হচ্ছে না। থেকে থেকে চোখের সামনে ভেসে আসছে একটার পর একটা স্মৃতি। সমুদ্রের ঢেউ যেমন নিঃশব্দে সৈকতের বালিদের ভিজিয়ে ফিরে চলে যায় তারপর আবার আছড়ে পড়ে ভিজে ভিজে বালিদের ওপর তেমনই মনকেমনের স্মৃতিরা বারবার ফিরে আসছে আহেরীর মনে। বাবার সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত্তের কত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতি। এতদিন এদের কোনোটাকেই কিছুমাত্র দরকারি বলে মনে হয় নি ওর। কিন্তু গত শুক্রবার রাতের পর থেকে এগুলোই ওর বেঁচে থাকার অবলম্বন। পাঁচ মিনিটে পরপর দুটো হার্ট অ্যাটাক-হাত বাড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্স ডাকার সুযোগটাও দিল না বাবা। শুধু শেষ নিঃশ্বাসটা ছাড়বার আগে আহেরীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল একটা হলদে কাগজে লেখা চিরকুট: "এবারে আর ফিরতে পারব না রে মনা, ঠিক করে থাকিস.."। 


ছোট থেকেই বাবার কাছে মানুষ আহেরী। ওকে জন্ম দিয়েই ওর মা মারা যান নার্সিং হোমের বেডে। তারপর থেকে ওর বাবা একা হাতে বড় করেছিলেন দুধের মেয়েটাকে। পাড়া-পড়শি, আত্মীয় স্বজন সবাই বলেছিল আবার বিয়ে করতে কিন্তু আহেরীর বাবা শোনেন নি। এই প্রসঙ্গে কেউ কিছু অতিরিক্ত সহানুভূতি দিতে আসলে তিনি তাদের বলতেন: "আমার মেয়ে আমার সাথে অফিস করতে করতে বড় হবে। ও নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না।" 


আহেরীর আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত ওর বাবাকে অবশ্য বাড়িতে আয়া রাখতে হয়েছিল। অতটুকু মেয়েকে তো আর অফিসে নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু তিন বছর থেকে ও বাবার সাইকেলে চেপে চলে যেত অফিসের ক্রেশে। অফিসে মালতী মাসি, বুবাই কাকুদের সঙ্গে খেলে ও যখন স্কুলে পড়ার বয়সী হল তখন থেকে ওর আর বাবার সাথে অফিস যাওয়া হল না। এতে কিছুদিন একটু মুষড়ে পড়েছিল ও। কিন্তু ওর বাবা আদরের মেয়ের মন ভোলাতে শুরু করলেন আরেক মজার খেলা। সকালে উঠে দু'জনে একসাথে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে টিফিন গুছিয়ে দিতেন আহেরীর বাবা। তারপর স্কুল যাবার আগে মেয়ের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জামার হাতে চিটিয়ে দিতেন ছোট্ট চিরকুট। তাতে কোনোদিন লেখা থাকত-"আজ পরোটা আছে, সব খেয়ে নেবে" কিংবা কোনোদিন-"আমি আজ টিফিনে স্কুলে যাব"। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল চারটে নাগাদ বাড়িওয়ালা দাদুর সাথে আহেরী স্কুল থেকে ফিরলে সোফায় দেখত কোনোদিন আটকানো আছে-"তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে একটুখানি, আমি ছ'টার মধ্যে চলে আসব।" অথবা কোনোদিন-"আজ কিন্তু নো ঘুমু। চারটে অঙ্ক আর দু'পাতা হ্যাণ্ড রাইটিং করে রাখবে কেমন? আমরা সন্ধেবেলা একসঙ্গে ঘুরতে যাব।" যে বয়সে আর পাঁচটা বাচ্চা চব্বিশ ঘণ্টা খেলে, এর ওর আদর খেয়ে সময় কাটায়, সেই বয়সে আহেরীর সময় কাটত বাবার সাথে চিরকুটে গল্প করে করে। তাই বড় হওয়ার অনেকদিন পর পর্যন্তও বাপ বেটির এই খেলা চলত অনর্গল। এইসমস্ত কথা এখন স্মৃতি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতেই আর একবার দু'চোখের পাতা ভিজে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল আহেরীর গালে। বাড়ি ফিরতে ওর ইচ্ছে করছে না। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে আজই অফিস জয়েন করেছিল ও। ভেবেছিল অফিসে কাজকর্মের চাপে কিছুটা ভুলে থাকবে। কিন্তু অফিস ফিরতি পথে বিকেলে আবার যখন দুঃখের সেই ভারী বোঝাগুলো মনের মধ্যে পসার জমাতে শুরু করল তখন ও ঠিক করল অফিস থেকে আর বাড়ি যাবে না। বাইরে কোথাও ঘুরে বেড়াবে আরো কিছুক্ষণ সময়। রাত বাড়লে বাড়ি যখন ফিরতেই হবে, তখন কিছু একটা খেয়ে বাড়ি গিয়েই শুয়ে পড়বে। তাই এই পার্কে নির্জন একটি বেঞ্চ বেছে ও বসে আছে বড়ো পুকুরটার সামনে। 


এইভাবে বসে থেকে ঘড়িতে কতক্ষণ পেরলো ওর সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎই একমুঠো দমকা হাওয়া কোথা থেকে এসে ওর চুলগুলো মুখের ওপরে ফেলে দিতেই হঁশ ফিরল আহেরীর। এপাশ ঘুরে তাকিয়ে দেখল বসার বেঞ্চটা থেকে খানিক দূরে একটা ঝাড় মাথা বেঁকানো নারকেল গাছের নিচে বসে এক ওর বয়সেরই যুবক। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, চাহনি আহেরীরই দিকে। ছেলেটার গলা বেয়ে ছোট ছোট সাদা হেডফোনের কান দুটো সাপের মতো ঝুলছে, কোলে একটা খাতায় কি যেন খচখচ করছে পেন্সিল দিয়ে। তার দৃষ্টি কিন্তু এখনো আহেরীর দিকেই। মন এমনিতেই ভালো নেই ওর। তার ওপর উটকো ছেলেটার এইরকম তাকিয়ে থাকা আহেরীর একেবারেই ভালো লাগল না। অফিস ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছোঁড়ার সামনে গিয়ে ও শুধালো:

"কি দেখছিলে হাঁ করে? মেয়ে দ্যাখো নি নাকি? তোমাদের মতো বাউণ্ডুলে ছেলেপিলেদের জন্যই মেয়েরা বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পায়। এখন উঠে পড়ে বলবে কি দেখছিলে না লোক ডাকব?"

একনাগাড়ে আহেরীর বলে যাওয়া এই কথাগুলো ছেলেটা বুঝি এক বর্ণও শুনতে পায় নি। যতক্ষণ আহেরী বলে যাচ্ছিল ততক্ষণ ওর মুখ নামানো ছিল নিচে। যদিও হাত চলছিল নিজের তালে। এবার সে ঘাড় তুলে একটা বড়ো এ ফোর সাইজের পাতা ধরিয়ে দিল আহেরীর হাতে।

পাতাটা হাতে নিয়ে থম মেরে গেল আহেরী। কেউ যেন ওর হাতে আয়না ধরিয়ে দিয়েছে। বড়ো সাদা পাতায় পেন-পেন্সিল-চারকোল মিশিয়ে আঁকা ওর স্কেচ। ও তো নিজেও এইভাবে দেখতে পায় নি কখনও নিজেকে। মনের প্রতিটা কথা যেন ছবিতে আঁকা মুখটা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে। কি চমৎকার সুনিপুণ আঁকার হাত ছেলেটার। যখন স্মৃতির গহীনে ডুবেছিল আহেরী তখন ও ছেলেটার সাবজেক্ট ছিল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আহেরী তার আগে ছেলেটা আর একফালি কাগজ ধরাল ওর হাতে যাতে লেখা:

"অ্যায়াম ডাম বাই বার্থ। তাই আপনার একটা প্রশ্নেরও উত্তর নেই আমার কাছে। তবে আমি খারাপ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে দেখছিলাম না। বাজে ছেলেদের মতো আমি নই। আসলে ভিতরের শৈল্পিক মনটা যখন ইচ্ছে নিজের মতন বাইরে আসতে চায়। তাই কিছু মনে করে থাকলে ছবি ছিঁড়ে ফেলে দিন।"


লাজতঃ চোখে মাথা নাড়িয়ে আহেরী বলল:

"অ্যায়াম এক্সট্রিমলি সরি। ওভাবে বলা উচিৎ হয় নি তাহলে আমার। যাই হোক আমিও যে কারো পড়াশোনার সাবজেক্ট হতে পারি আপনি এই কাজটা না করলে জানতেও পারতাম না। আর এমন নিখুঁত ছবি ছিঁড়ে ফেলা যায়? আপনি রাখুন ওটা, এক্সিবিশনে দেবেন। ওকে, প্লিজ এক্সকিউজ মি। আমার একটু কাজ আছে আজ। আপনাকে আর কিছু হেল্প করতে পারি?"

সরল শিশুর মতো মাথা নাড়িয়ে ছেলেটি খুব তাড়াতাড়ি লিখে আহেরীর হাতে ধরিয়ে দিল আরেকটি চিরকুট:

"নো থ্যাংকস। আমিও উঠব এবার। কিছু মনে না করলে পার্কের গেট অবধি একসাথে হেঁটে যেতে পারি আমরা। আই হ্যাভ আ স্ট্রং অবজার্ভেশনাল ফিল আপনি একটা অদৃশ্য কাঁচের বৃত্তে নিজের সাথে নিজেই যুঝছেন অথচ সেই বৃত্ত থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছেন না। যদি আপত্তি না থাকে, বলে দেখতে পারেন। মাঝে মাঝে হুঠ করেই সমাধান বেরিয়ে আসে।"


কি সাংঘাতিক অবজার্ভেশন ছেলেটার। পাখির চোখে দেখেছে আহেরীকে। মনে মনে অন্তত একবার অ্যাডমায়ার না করে পারল না ও। মুখে বলল:

"আসলে যে বৃত্তের মধ্যে আমি এখন আটকা পড়ে তার কোনো দিশা সময় ছাড়া আপাতত কারোর কাছেই নেই। তবু গেট অবধি হেঁটে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। চলুন ওঠা যাক।"


পার্কের এইদিকটা অনেকটাই ভিতরে। তাই গেট অবধি হেঁটে যেতে খানিকক্ষণ সময় তো লাগবেই দু'জনের। ছেলেটার কাঁধে বিশ্বভারতী মার্কা ঝোলা ব্যাগ, হাতে পুরোনো মডেলের সাইকেল। এতক্ষণ এই বোবা পেন্টারের সাথে চিরকুট চালাচালি করতে করতে আহেরীর সেই ছোটবেলায় বাবার সাথে চিরকুট খেলার কথা আবারও মনে পড়ে গেছে। মনটা আবার নিস্তেজ ও ভারী হয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেটার দিকে তাকাতেই সে আরেকটা চিরকুট ধরিয়ে দিল আহেরীর হাতে:

"মাঝে মাঝে সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে হয় মন থেকে। তা নাহলে মনখারাপেরা দিস্তা দিস্তা জড়ো হতে থাকে অলিন্দে। ছোট ছোট স্মৃতিগুলো একা একা থাকলে কয়েদখানা। কারো সাথে শেয়ার করলে উন্মুক্ত।"

-"শুনুন তাহলে-"

এতদিনের স্মৃতিগুলো এবার বাবা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম মুখ ফুটে কাউকে বলতে শুরু করল আহেরী। 

স্মৃতিচারণ যখন শেষ হল আহেরীর, ও দেখল পার্কের মেন গেট ছাড়িয়ে ওরা দু'জনে পৌঁছে গেছে বড় রাস্তার ক্রসিংয়ে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওর ছবি আঁকিয়ে সঙ্গীটি আহেরীর হাতে ধরাল আরো একটা চিরকুট। কথা বলার ফাঁকে কখন যে লিখেছে আহেরী খেয়াল করে নি। এবারেরটায় লেখা:

"চলুন একটা খেলা খেলি। মজার এই খেলা খেলবার পর কাল থেকে আপনি নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করবেন। গ্যারান্টি।"

এই বলে প্রায় টানতে টানতে ওকে নিয়ে সামনের একটা খাতাপেনের দোকানে নিয়ে গিয়ে হাতের ইশারায় একটা স্টিকি নোট প্যাড আর ডট পেন কিনে প্রথম নোটটা দোকানদারকেই লিখে দিল: "থ্যাঙ্ক ইউ"। 

এরপরের নোটটা ঝটপট লিখে আহেরীর জামার হাতায় সাঁটিয়ে দিল ছেলেটা:

"এটাই খেলা। সামনে দেখতে পাওয়া যে কোনো মানুষকে দেখে যা মনে আসছে তাই লিখে হাতে ধরিয়ে দিতে হবে চিরকুট। এভাবেই চলবে খেলা। এবার আপনার পালা।"

এক মূহুর্ত্তের জন্য আহেরী যেন কিছুক্ষণের আলাপ হওয়া ছেলেটার মধ্যে নিজের মরে যাওয়া বাবাকে দেখতে পেল। বিগত দিনগুলোর পর এই প্রথম মন থেকে হাসল ও। একটা নোট লিখে ছেলেটার বুক পকেটে লাগিয়ে দিল হলুদ কাগজ যাতে লেখা:

"তুমি একটা পাগল"।


এইভাবে ওরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, সন্ধেবেলার চায়ের দোকানে, অফিস ফিরতি ভিড়ে, বাসস্টপের লাইনে হেঁটে চলে বেড়ানো মানুষের হাতে ধরিয়ে দিতে লাগল হলদে চিরকুট। মাঝে মাঝে ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ থামা মানুষদের প্রত্যুত্তরও পেল বেশ খানিক। এক মূহুর্তেই শহরটা কিরকম হাল্কা হয়ে গেছে। রাশি রাশি অনুভূতি যেন শব্দ হয়ে ঝরে পড়ছে আহেরীর মুখে, চোখে, হৃদয়ে। তার চেয়েও বেশি হাল্কা হয়ে গেছে আহেরীর মন। ওর বাবা এখন এই শহরের স্পন্দনে মিশে গেছে, পথ চলতি মানুষগুলোর ঠোঁটে যে হাসি লেগে আছে সেটা ওর বাবা, অথবা ফুটপাথের ধারে বসে থাকা মায়ের মমতায় মিশে গেছে ছোট্ট আহেরীকে ডাকা ওর বাবার ডাক। যে অক্ষরবৃত্তের জ্যা ওর মনে একবার টেনে দিয়েছিলেন ওর বাবা তারই অন্য প্রান্তটা যেন আজ পূর্ণ হল ছেলেটার হাত ধরে। নিজের অজান্তেই বোবা ছেলেটার আঙুলে আঙুল ধরে ফেলল আহেরী। ছবি আঁকা হাতের স্পর্শে যেন বাবার মতো আদর খুঁজে পেল ও। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance