কেয়া রায়

Inspirational

3  

কেয়া রায়

Inspirational

অগ্নিসাক্ষী

অগ্নিসাক্ষী

5 mins
514


প্রথম পর্ব


কোলকাতার মধ্যস্থিত এক নামী নার্সিংহোমের বার্ণ ইউনিটের বেডে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে আছে চারু। আগুনে সম্পূর্ণ ঝলসে যাওয়ায় শরীরের জ্বালাটা যেন রাত বাড়তে না বাড়তেই ক্রমে বেড়েই চলেছে। চারুর মত সহনশীল মেয়ের কাছেও যেন তা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মুখ বুজে সহ্য করতে চাইলেও চোখের জল যে বাধা মানছে না কিছুতেই। ভগবানের কাছে চারু প্রার্থনা করেই চলেছে যাতে ওকে আর এভাবে সকলকে কষ্ট দিয়ে বেঁচে না থাকতে হয়। এসব ছাই-পাঁশ ভাবতে ভাবতেই কখন যেন চারুর চোখদুটো বুজে এল। নার্স কেবিনের আলো নিভিয়ে দিয়ে পাশেই একটি চেয়ারে বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। এমন সময় শুভ্র ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করল, শুধুমাত্র নিজের স্ত্রীকে একটু চোখের দেখা দেখবে বলে। বেডের পাশেই রাখা একটি টুলে বসে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চারুর দিকেই তাকিয়েছিল আর মনে মনে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে চলছিল এক নাগাড়ে। পুরনো স্মৃতির পাতা একের পর এক পাল্টে যাচ্ছিল শুভ্রর মনের মধ্যে।


        আজ থেকে বছর চার আগের কথা। শুভ্রর ছোট্টবেলার বন্ধু উপলের বিয়েতেই চারুর সাথে পরিচয় পর্ব ঘটে। উপলের মাসতুতো বোন হল চারু আর বেস্ট ফ্রেণ্ড হল শুভ্র। ফলে সেই সূত্র ধরেই ভাগ্যের খেলায় ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে পরিচয় থেকে প্রেমের নিবিড় বন্ধন তৈরী হয়। অবশেষে সেক্টর ফাইভের টাটা কন্সালটেন্সি সার্ভিসের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে একখান মস্ত বড় চাকুরী জুটিয়ে শুভ্র চারুকে সঙ্গী করে বিয়ের পিড়িতে বসে। হ্যাঁ, ওদের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়েছিল সেদিন। দুজন দুজনের মাঝে ছোট ছোট মূহুর্তের সাথেই ওদের সংসার গড়ে উঠছিল। বিয়ের ছ'মাস পর শুভ্র আর চারু প্রথম হানিমুনে গেল হিমাচল প্রদেশ। সত্যি কি সুন্দর ছিল সেসব কাটানো দিনগুলো। কিন্তু এত ভালো যে কপালে সয় না সকলের, তাই হয়তো আচমকা ভগবান বিরূপ হলেন ওদের ওপর। একদিন সন্ধ্যেবেলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে চারুর গায়ে জড়ানো হাউসকোট থেকে পুরো শরীরে আগুন ধরে যায়। ঘরে তখন শুভ্রও ছিল না, ফলে চারু আর নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। যখন প্রতিবেশীরা টের পেল তখন চারুর শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছে। তারপর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে শুভ্র এসে নিজস্ব তৎপরতায় অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে এসে নার্সিংহোমে ভর্তি করায় স্ত্রীকে। এভাবেই হাতে গোনা প্রহর কাটতে থাকে।।


              দ্বিতীয় পর্ব


।। আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল চারু একইভাবে নার্সিংহোমের বেডে শায়িত অবস্থায় রয়েছে চারু। এরই মধ্যে পরপর দুবার প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে ওর। স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ হতেও সময় লাগবে। আগের মতো সেই ছেলেমানুষি আজ আর নেই। শুভ্র সবটাই বুঝতে পারে, কিন্তু ও এর কোনও উপায় খুঁজে পায় না। শুধু চুপ করে থাকে ; একটা কষ্ট হতে থাকে বুকের ভেতর। দিন দশেক পর ডিসচার্জ পেয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল চারুকে। এখন থেকে সমস্ত দায়িত্ব শুভ্র নিজের কাঁধেই নিয়েছে। কিন্তু দিনে দু'বার ড্রেসিং করাতে আসে দুজন নার্স আর তখনই যেন চারুর ব্যথার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। শুভ্রর তখন মনে হয় এক ছুটে গিয়ে ওর চারুকে কাছে টেনে নেয়। এভাবেই চলতে থাকে ওদের দিন। প্রতি সপ্তাহে একদিন করে রুটিন চেক-আপ করানোর থাকে। সেসময়ই চারুর ডক্টর শুভ্রকে ডেকে জানায় যে, "দেখুন আপনার স্ত্রীর যে কনডিশন হয়ে আছে তাতে করে হয়তো আপনারা কখনোই মা-বাবা হতে পারবেন না। আর মনটাকে শক্ত করুন এখন থেকেই, নইলে আপনার স্ত্রী কিন্তু ভেতর থেকে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।" এসব আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল চারু। ফলে একদিন তো অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ও শুভ্রকে বলে ফেলে, "আমাকে ছেড়ে তুমি অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করে নাও। আমি তো তোমাকে কখনোই সুখ দিতে পারলাম না। তাই আমার কাছ থেকে তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত আর......", কথাটি শেষ হতে দিল না শুভ্র। হাত দিয়ে স্ত্রীর মুখটা আলতো করে চাপা দিয়ে শুভ্র শুধু বলল, "তুমি আজ যেমন পরিস্থিতির শিকারই হও না কেন, আমি তোমার হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু হাতদুটো ধরি নি।" দূরে অস্পষ্ট আঁখিপল্লবের সীমারেখা ছাড়িয়ে পরিস্ফূট জ্যোৎস্নার আলো ওদের ভালোবাসাকে ক্রমশ উজ্জ্বল করে তুলছে। 

 

       অত্যন্ত ধীরে ধীরে চারুর শরীর সুস্থ হচ্ছে। ডক্টর বলেছেন যে, চারুর শরীরে নাকি অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে যার ফলেই এত লেট রিকভারি। তাই বলে শুভ্র কিন্তু হাল ছাড়েনি। ইতিমধ্যেই ওর জমানো টাকা সব স্ত্রীর চিকিৎসাতেই খরচ করে ফেলেছে। নিজেদের ভবিষ্যতের কথাও আজ আর মাথাতে নেই। এরই মধ্যে কোম্পানি থেকে শুভ্রর জার্মানি যাওয়ার অফার এসেছে একটা প্রজেক্টের কাজে। কি করবে এখন শুভ্র? দো'টানায় পড়ে অফারটি ফিরিয়ে দিল সেবারের মতো। কিন্তু ছয় মাস যেতে না যেতেই আবার আরও ভালো এক অফার পায় কোম্পানির কাছ থেকে, ফ্রান্সে যাওয়ার। পরিবারের সকলের মতামত নিয়ে এবারে শুভ্র আর দেরি না করে অফারটি অ্যাক্সেপ্ট করে নেয়। আসলে ওর মনে তো অন্যরকম প্ল্যানিং চলছে তখন, বিদেশে গিয়ে কি করে চারুকে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা যায় !!


              তৃতীয় পর্ব


।। ভিসা, পাসপোর্ট করাতে করাতে আরও চার-পাঁচ মাস দেখতে দেখতে কেটে গেল যেন। এই ঝামেলার জন্য শুভ্র পুরোপুরি খেয়াল রাখতে পারছিল না চারুর। তাই শুভ্রর মা ছায়াদেবী এলেন ঘর আর বউমাকে সামলাতে। চারু তো একরকম আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। অনেক রকমের কানাঘুঁসোরও সম্মুখীন হতে হয়েছে ওদের দুজনকেই। ভাঙবে তবু মচকায়নি কিন্তু ওদের সম্পর্কটা। এভাবেই অনেক বাধা পেরোতে পেরোতে ওরা একসময় নিজেদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীও অতিক্রম করল চুপিসারে। অবশেষে সমস্ত রকমের মায়ার বাঁধন কাটিয়ে কলকাতার স্মৃতিকে সঙ্গী করে শুভ্র আর চারু ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, হয়তো দীর্ঘকালের জন্য। পথের ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে এক অজানা প্রান্তে আজ ওরা নবরূপে সংসার পাতল - চোখে হাজারো স্বপ্ন আর আশার ডালি নিয়ে। স্থায়িত্ব আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগল বটে। তবে শুভ্র খেয়াল করল যে, এখানে আসার পর থেকেই চারুর শরীরে পোড়ার জ্বালাটা বুঝি ক্ষীণ হয়ে আসছে। মাসখানেক পর থেকে চারুকে নিয়ে ফ্রান্সের সবচেয়ে নামী ডক্টরের কাছে নিয়মিত চেক-আপ করানো শুরু করল শুভ্র। কোলকাতায় থাকাকালীন তো সেখানকার ডক্টর জানিয়ে দিয়েছিল যে, চারুর এই অবস্থার জন্য কখনো ও বাচ্চা কন্সিভ করতেই নাকি পারবে না। চারু হতাশ হলেও শুভ্র কিন্তু হয়নি। বরং ধীর-স্থির মনের মধ্যে যত্ন করে লালিত করে রেখেছিল এতদিনের আশাটুকু।


     সাত বছর পরের কথা। কোলকাতায় এখন ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘরে ছুঁইছুঁই করছে। হঠাৎ ছায়াদেবীর ঘরের টেলিফোনটিতে রিং বেজে উঠল। 

- "হ্যালো, কে বলছেন?"

- "মা, আমি তোমাদের শুভ্র বলছি।"

- "ওমা, তুই এইসময় যে?? সব ঠিক আছে তো রে বাবু? আর আমাদের বউমা ঠিক আছে তো নাকি?"

- "আরে, মা, এত চিন্তা কোরো না তুমি। সব ঠিক আছে। আমি একটা গুড নিউজ দিতে চাই তোমাদের। বাবা কোথায় আগে বলো?"

- "এই তো এখানেই। দাঁড়া ফোনটা তোর বাবাকে দিচ্ছি।"

- "হুম দাও। আমি তোমাদের দুজনকে একসাথেই খবরটা দিতে চাই।"

- "হ্যাঁ রে বাবু বল", ফোনের ওপারে অপেক্ষারত বছর সত্তরের সমরেশবাবু।

- " বাবা, তুমি আর মা দুজনের ঠাকুরদা আর ঠাকুমা হতে চলেছ। তোমাদের আশা পূরণ হতে চলেছ যে অবশেষে।"

- "কি বলছিস রে, সত্যিই !! আহা আজ আমাদের যে কত আনন্দের দিন, বলে বোঝাতে পারব না রে বাবু। খুব ভালো থাক রে তোরা। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করি তোদের।"...ফোন রাখার পর দুপাশের প্রান্তেই যেন এক স্বস্তির নি:শ্বাস পড়ল।


      অপেক্ষার প্রহর গোনার পালা বুঝি শেষ হল শুভ্র আর চারুর। ওদের গাঁটছড়াকে আরও শক্ত করতে নয় মাস পর চারুর কোল আলো করে এল ছোট্ট রাজকন্যা। ভগবান বুঝি এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন ওদের দিকে। প্রথম সন্তানকে চোখের দেখা দেখে দুজনেই আর থাকতে পারল না, শুভ্র আর চারু দুজনের গাল বেয়ে ক'ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational