STORYMIRROR

POET MD HEDAETUL ISLAM

Inspirational Others

3  

POET MD HEDAETUL ISLAM

Inspirational Others

অদম্য বারির বাবা

অদম্য বারির বাবা

5 mins
198

মোঃ হেদায়েতুল ইসলামঃ সেই ছোট্টবেলার বারির কথা। বারিদের বাড়ি ছিলো যমুনা নদীর কুল ঘেঁষা। তাদের পালের গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ও পুকুরে মাছ ছিলো প্রচুর।শাকসবজি ও প্রচুর হতো বারিদের নদী তীরের জমি গুলোতে। বারি একদম ছোট, তার ছোট্ট বোন লিলি এসেছে কয়দিন হল দুনিয়ায়। সব ভালই চলছিল। বারির বাবা কোনো কাজকে ছোট মনে করতেন না। ছোট মনে করতেন ওটাই যে নিজের সামর্থ্য থাকার পরও কাজ না করে অন্যের কাছ থেকে চেয়ে খাওয়া। তার বাবা ছিলেন চরম অতিথি পরায়ন একজন মানুষ। তাদের বাড়িতে কোন অতিথি এলে না খেয়ে যেতে দিতেন না কখনই। সহজ, সরল ও নীতিবান লোক ছিলেন বারির বাবা। জমির কাজের মধ্যেও তার বাবা মা কে অনেক সাহায্য করতো। যেহেতু বারি আর তার ছোট বোন লিলি পাশাপাশি, তাই তার মা একা পারতেন না। বারির ও লিলির জামাকাপড় ধোয়া, খাওয়ানো ও খেলা করার জন্য তার বাবা প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন তার মায়ের। হঠাৎ একদিন বর্ষণ শুরু হলো। একটানা চারদিন ছিল। এরইমধ্যে সর্বগ্রাসী নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে আর ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়ে সব গ্রাস করে নিচ্ছিলো। প্রবল বর্ষণে বন্যা আর নদী ভাঙ্গনে সব নদীতে তলিয়ে যাচ্ছিলো। তার বাবা কোনোমতে জান নিয়ে বারিকে আর তার বোনটিকে একটি ঝাকার মধ্যে করে মাথায় নিয়ে আর তার মা একটি ছোট্ট টিনের সুটকেস নিয়ে গ্রাম ছাড়ে।

পুরো গ্রাম ই নদীগর্ভে চলে যায়। নিরাপদ বাস ও জীবিকার তাগিদে বারিকে নিয়ে তার বাবা অজানা অচেনা শহরে চলে আসে। কিন্তু কোথায় থাকবে নেই কোনো চেনা বাসস্থান এবং চেনা লোক। বড় বড় ইট পাথরের বাড়ি আর রাস্তায় গাড়ির যানজট। রেল গাড়ি করে আসার পথে এক বয়স্ক লোকের সাথে পরিচয় হয় বারির বাবার। তিনি ইট ভাঙ্গার কাজ করতেন। বয়স্ক লোকটি ষ্টেশনের পাশের বস্তিতে একাই থাকতেন। রেলগাড়ি থেকে নেমে লোকটি লোকটির মত আর বারির বাবা তার মতো চলতে থাকে । দুই রাত বারিদের ষ্টেশনে কাটে। কারণ তার বাবা হন্যে হয়ে খুঁজেও কোনো থাকার বা কাজের ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না। তৃতীয় দিন হঠাৎ সেই বয়স্ক লোকের যাকে তার বাবা চাচা বলে সম্বোধন করেন তার দেখা মেলে। সে সব কথা শুনে বারিদের একটি থাকার ব্যবস্থা করে দিলো বস্তিতে। এরপরের ৩/৪ দিন ও কাজের কোনো ব্যবস্থা হলো না বারির বাবার। না খেয়েই কাটাতে হলো সেই কটা দিন বারিদের। তারপর সেই চাচাই ইট ভাঙ্গার কাজ যোগাড় করে দিলেন তার বাবাকে। তাই দিয়েই কোনোমতে বারিদের দু-বেলা খাবার জুটতো। তার বাবাকে খেয়ে না খেয়েই কাজ করতে হতো। তার বাবা দিনে ইট ভাঙ্গার কাজ করতো আর রাতে রিক্সা চালাতেন। বারিরা এতটাই সহায় সম্বলহীন ছিলেন যে কোনো আসবাবপত্র তো দূরের কথা, একটা চৌকি ও ছিলো না। তাই নিচে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাতে হতো ইঁদুরের সাথে। তারপর বারির বাবা দিন রাত পরিশ্রম করে আস্তে আস্তে বসবাস উপযোগী কিছু আসবাবপত্র কিনলেন আর তার মাকে কিনে দিলেন সেলাই মেশিন, যাতে করে তার মাও কিছু উপার্জন করতে পারে। এরপর বারি বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেন, সাথে তার বোন লিলি ও।

বারির বাবা রিক্সা চালাতে গিয়ে এক বিদেশি সাহেবকে প্রতিনিয়ত আনা নেওয়া করতেন। হঠাৎ ওই ভদ্রলোক তার বাবার আচরনে মুগ্ধ হয়ে বারির বাবাকে একটি বেসরকারি দাতব্য সংস্থার চাকুরিতে যোগদানের প্রস্তাব করেন। তার বাবা ভদ্রলোকটির প্রস্তাবে রাজি হয়ে আগের সব কাজ ছেড়ে ঐ কাজে যোগদান করেন। তার বাবা খুব দক্ষতার সাথে কাজ করতেন বলে চাকুরিতে অল্পদিনেই পুরো আস্থাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন। দুটো শুকনো রুটি ভাজা বারির বাবা অফিসে নিয়ে যেতেন, যার একটি সকালে আর অন্যটি দুপুরে খেতেন। অফিসে তার বাবাকে দুপুরের খাবার দেওয়া হতো। কিন্তু বাবা সেই খাবার না খেয়ে বাড়ি বয়ে নিয়ে আসতেন সবাই একসাথে খাবে বলে। শুধু তাই নয়, তার বাবা নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন। ছুটির দিনে তার বাবা সারাদিন বারিদের নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতেন: কাপড় ধুয়ে দিতেন, তার মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করতেন, বারিদের বিদ্যালয়ের পড়া দেখিয়ে দিতেন আরও কত কি। বারিদের জন্য সাধের ঘোড়াটা বাবাই হতেন — কথাগুলো বলছিলেন বারির মা বারিকে। তখনও বারি সপ্তম শ্রেণীতে আর তার ছোট বোন লিলি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তার মা সেলাই করার জন্য সুতা কিনতে বাজার গেল। ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় বারির মা তার দুটো পা ই হারান। ডাক্তারের কাছ থেকে এই খবর পাওয়ার পর বারিরা সকলেই খুব ভেঙ্গে পড়ে । যখনই চোখের সামনে দেখলো যে তার মায়ের দুই পা নেই, তার মা আর হাটতে পারবে না তখনই হাউমাউ করে কান্না আসতো বারির। ডাক্তার তার বাবাকে আরও বললো যে তার মা বুকে এবং মাথায় ও প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। বারির বাবা তখন আরও ভেঙ্গে পরলো। কিন্তু মনোবল হারাননি। একসাথে হাসপাতালে বারির মায়ের দেখাশুনা, লিলি বারিকে দেখাশুনা ও তার বাবা নিজের অফিস চালাতেন। যখন বারি লিলি কান্নায় ভেঙে পড়ত তখনই তার বাবা বুকে আগলে নিয়ে শান্তনা দিতেন আর নিঃশব্দে নিজের চোখের পানি ঝরাতেন। তার বাবা সবসময় বলতো পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেন কখনও মনোবল হারাবে না। প্রায় ২০ দিন পর তার মাকে ঘরে নিয়ে আনা হলো। বারির মাকে ঘরে আনার পরও তার মায়ের সব সেবা বারির বাবাই করে; কাপড় ধোয়া, তার মাকে গোসল করানো, রান্না করা, ঘর আর অফিস বারির বাবা সমানতালে সামলাতেন। তার মা কে যখন কাঁদতে দেখতো তখন তার বাবা বলতো এই যে দেখ আমি কিন্তু এখনও মরে যাইনি, তোমার আর ছেলেমেয়েদের জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। একদিন বারিরা ভাইবোন বিদ্যালয় থেকে ফিরে দেখে তার মা হুইল চেয়ার থেকে নিচে পড়ে আছে। আশেপাশের মানুষজন ডাক্তার ডাকলো আর তার মাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কিন্তু আর বারির মার কোনো সাড়া শব্দ ছিলো না। ডাক্তার এসে তার মাকে দেখে বললেন তার মা আর নেই, বারির মা স্ট্রোক করে ইহলোক ত্যাগ করেন। বারির বাবা বাসায় আসার পর তার বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। তার মায়ের মৃত্যুতে যথারীতি বারিদের পরিবারে আকাশ ভেঙে পরলো । কিন্তু তার বাবা সাহস যোগাতেন বরাবরের মতই আর বলতেন: “আপনটিরে জ্বালিয়ে দিয়ে জ্বালাবি সবার প্রদীপটিরে, দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিরে।” শুরু হলো বারির বাবার নতুন সংগ্রাম। যদিও তার বাবা আগে থেকে সংসারের সব কাজ করে অভ্যস্ত তাও এখন সম্পূর্ণ সংসারটা তার মাথায়। তার বাবা বারিদের সকল আবদার বলবো না, তবে অনেক আবদার ই পূর্ন করতেন।

তারা দুই ভাইবোন পড়ালেখায় বরাবরই ভালো ছিলেন । তাই বারির বাবাও তাদের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। তার বাবাকে অনেকেই বলেছে আবার বিয়ে করতে, কিন্তু বারির বাবা করেনি বারি লিলির কথা ভেবে। যদি নতুন মাবারিদের আপন করে নিতে না পারে সেই ভয়ে। তার বাবার হাতের রান্না ছিলো অসাধারন। তার বাবার হাতে টাকা হলেই তার বাবা তাদের পাশের এক এতিমখানায় নিজে রান্না করে খাবার পাঠাতেন। খাবার বেলায় সবসময় বড় আর ভালো খাবারগুলো বারি আর লিলিকে খেতে দিতেন। আর বারির বাবা ছোট টুকরোগুলো খেতেন। কিছু কেনার সময়ও তার বাবা কিনতেন কমদামি জিনিস আর বারিদের দিতেন অপেক্ষাকৃত দামী গুলো। বারিরা কেউ বাবার কাজে সাহায্য করতে গেলেই তার বাবা রেগে বারিদের পড়তে পাঠিয়ে দিতেন। তার বাবা বলতেন বারিদের লেখাপড়াই হলো তোদের একমাত্র কাজ। বড় হয়ে মানুষের সেবা করাই হবে তোদের প্রধান কাজ। দেখতে দেখতে লিলির ডাক্তারী পড়া শেষ করলো। তার কিছুদিন পরেই লিলির বিয়ে হয়ে বিদেশ পাড়ি জমালো।বারি এখন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী যখন যেভাবে পারে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করে। তার বাবা এতিমখানার ছেলেমেয়েদের সেবায় আছেন এখনও। বারির বাবা বলে আমি যতদিন বেঁচে আছি ততোদিন আমি ওদের যতটুকু পারি সাহায্য করে যাবো। বারির বাবা লিলিকেও বলে দিয়েছে যে সে যখন‌ই দেশে আসবে তখনই যেন এইসব অনাথ, গরীব, অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তার বাবা লিলিকে ডাক্তারী পড়ান। বারি জানান অসহায়, গরীব, পথশিশুদের জন্য দান করেন কাজ করেন অবিরাম। বারি তাই জানান, এই বৃদ্ধ বয়সেও যখন এইসব কাজের জন্য বাবার কন্ঠ সোচ্চার হয়, তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি এই আমার অদম্য বাবা।

"শত বাধায় দমে যান না যারা, উচিৎ তাদের নিয়ে ভাবা। কাজের মানুষদের একজন যে বারির অদম্য বাবা"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational