আত্মরক্ষা
আত্মরক্ষা
“না মামণি আমি ওই পাগল মাষ্টার মশাই এর কাছে কিছুতেই পড়বো না”। ছোট্ট তৃষার কথা শুনে তার মা তো অবাক। “কেন কি হয়েছে? কেন পড়বেনা তুমি ওর কাছে? তুমি কিন্তু খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ এবার। পাশের ঘরে রয়েছেন, উনি শুনে কি মনে করবেন বলোতো। এভাবে বলতে আছে নাকি”। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটির সেই এক কথা, “না মামণি আমি নিজে পড়বো তবু ওই লোকটার কাছে কিছুতেই পড়বো না”। মা আর কি করবেন তখনকার মতো ওকে শান্ত করে মাষ্টার মশাই কে বলে দিলেন, “ওর আজ পড়তে ভালো লাগছেনা, আবার আগামী কাল এসো”।
রাতে তৃষার বাবা ফিরলে তাকে সব ঘটনা বলা হলো। শুনে তো তিনি অগ্নিশর্মা। “এ আবার কি অসভ্যতা! মেয়ে যা বলবে তাই শুনতে হবে? পাড়ার ছেলে অল্প মাহিনায় পড়াচ্ছে ওর কাছে পড়তে অসুবিধা কোথায় ওর? এই তো প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করে কটা টাকাই বা রোজকার করি যে আবার অন্য মাষ্টার খুঁজবো?”। তৃষার মা এবার ভয়ে ভয়ে বলেন, “ও বলছিল যদি একজন দিদিমণি রাখা হয় ওই ওর মুনমুনদিদির মতো তাহলে ও খুব খুশী হবে”। ব্যাস আর যায় কোথায় এবার তো তৃষার বাবা আরো রেগে গিয়ে বলে ওঠেন, “দেখলে তো তোমার আদরের মেয়ের ওটাই আসল কথা তাই ওই মাষ্টার মশাই পাগল। আমার তো একটা ছেলে রয়েছে, তার ভবিষ্যৎ তো ভাবতেই হবে আমায়, তোমার আহ্লাদীকে বলো ওর কাছে পড়তে পারে পড়ুক না হলে থাক মুর্খ হয়ে। মেয়ে তো পরের ঘরে যেতেই হবে, ঘরের কাজ কর্ম শিখুক ভালো করে”।
পাশের ঘর থেকে সব কথাই তৃষার কানে গেছে, বাবা কি বলে শোনার জন্যই ও জেগে বসেছিল। প্রথমটা খুব কষ্ট হলো - এই বিচার হলো বাবার? ভাই ই সব ও কিছু নয়? কিন্তু ওই শয়তানটার কাছে কিছুতেই পড়তে পারবেনা ও। মামণি কে তো সব কথা ও জানাতেই পারেনি, বলবেই বা কি করে। এইসব বাজে বাজে কথা যে কেউ বলতে পারে সে তো ভাবতেই পারে না। তার স্কুল বাসের দিদিদের নিয়ে তো অনেক বিশ্রী বিশ্রী মিথ্যা কথা বলেইছে, উল্টে ওকে শুদ্ধু কীস
ব বলে, কেন বলে ওর মাথাতেই ঢোকেনা। শুধু ওর শিশু মনে এইটুকু বোঝে এসব ঠিক নয়। অনেক ভেবে একদিন এক বন্ধু কে বললো সব কথা। কিন্তু সেও তো বাচ্চা মেয়ে কতো আর বুদ্ধি তার। কিন্তু রাতের পর রাত তৃষা ঘুমোতে পারেনা, পড়ায় মন বসাতে পারে না শুধু এক চিন্তা কি করে ওই মাষ্টার কে তাড়াবে। তার মামণি তাকে অনেক বোঝায়। শেষে একদিন বলে লক্ষী মেয়ে যদি ওর কাছে পড়ো হারমোনিয়াম কিনে দেব। কিন্তু সে নাচার। সত্যিতো ও ভয় পাচ্ছে ওই মাষ্টারের কাছে পড়তে, মনে মনে মামণির ওপর রাগ হচ্ছে। কই কেউ তো ওকে বুঝতে চাইছে না, রোজ রাতে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ে ও জেগে কাঁদতে থাকে কেউ তো জানতেও পারেনা।
একদিন ওর বাবা খুব বকাবকি করে অফিস বেরিয়ে গেছেন বলেছেন যদি ও ওই মাষ্টার এর কাছে না পড়ে তাহলে ওর কাল থেকে স্কুল যাওয়া বন্ধ। সারা দিন ও শুধু ভেবেছে কি করবে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে কিন্তু কোথায় যাবে, যেখানেই যাক বাবা ঠিক ধরে আনবে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা মাষ্টার মশাই এলে তৃষা তাকে বললো, “আমি আপনার কাছে আর পড়তে চাই না, আপনি বাবাকে বলুন আর পড়াতে পারবেন না, নাহলে আমি সকল কে সত্যি কথা বলে দেব”। মাষ্টার মশাই বলে, “কেউ বিশ্বাস ই করবেনা তোমার কথা”। তৃষা বলল, “এই কথা ঠিক আছে তবে আমি নদী তে ঝাঁপ দেব আর লিখে রেখে যাব আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আপনি”।
তৃষার কথার মধ্যে এমন একটি আত্মবিশ্বাস ছিল আর যাই হোক সেটা যে মিথ্যা ভয় দেখানো নয় এ বুঝতে পেরে মাষ্টার মশাই ওর মা কে ডেকে বললো, “বৌদি আমি চাকরী পেয়ে গেছি আর পড়াতে পারবোনা”। তৃষা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মুক্তির আনন্দে মনটা ভরে গেল ওর, একইসঙ্গে বুঝতে পারলো নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে, শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই। শয়তান যতো বড়ই হোক, সঠিক পথে এগোলে জয় অনিবার্য। ঠিক মা দূর্গা যেমন অশুভ শক্তি কে পরাস্ত করে শুভ শক্তির সূচনা করেছিলেন। মেয়েরা মহামায়ার জাত কেন পারবে না?