বিসর্জন
বিসর্জন


৯০ এর দুর্গাপুজোর নবমীর দিনে জন্মেছিলাম বলে
মা আমার নাম রেখেছিল গায়ত্রী ।
আমার জন্মের পর নাকি আমার বাড়ি থেকে
আমার বাবাকে পর্যন্ত কেউ আসতে দেয়নি ...
কি জানি হয়তো নিজেই আসতে চায়নি।
বড় হওয়ার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারতাম একমাত্র মা ছাড়া
আমাকে যেন বাড়ির সবাই কেমন একটা অভিশাপ হিসাবে মনে করত ।
আমার অবস্থা ছিল ঠিক অনেকটা রাস্তার ধারে বসে থাকা
সাথিহারা শালিকটার মতো , যে আজ অবদি জানলো না তার দোষটা কোথায় ?
বাড়িতে খুব অশান্তি করে মা একটা ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়েছিল বলে
দুদিন আমাদের ভাগ্যে জুটেছিল সবার উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার ।
থাক আজ আর এসব পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে কাজ নেই ।
আজ দুর্গাষ্টমী , বাঙ্গালীর সবচেয়ে প্রিয় এবং পবিত্র দিন ।
আমার বন্ধুদের কতো দেখেছি অষ্টমীর দিনে নতুন শাড়ীতে
মণ্ডপাভিমুখে কোনো অচেনা রাগের টানে ছুটতে ।
কিন্তু আমি আজ অবদি কাউকে বলতে পারলাম না
কেন এই অষ্টমী শব্দটা আমার অন্তরে সর্বদা এক ভয়ার্ত অনুভূতি জাগ্রত করে ।
তখন আমি সবে ক্লাস ১২ এর এক ছাত্রী,
আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোতে পুষ্পাঞ্জলির জন্য প্রস্তুত হয়ে ,
নতুন শাড়িতে দৌড়াচ্ছিলাম আমাদের থাকুরদালানের দিকে ।
হঠাৎ এক বলিষ্ঠ হাত জাপটে ধরে আমার ঠোঁটের উপর ,
দুহাতে কোলে তুলে নিয়ে যখন আমায় ছুঁড়ে ফেলে তিনতলার ঘরের বিছানায়,
তখন চেয়ে দেখি সামনে ক্ষুধার্ত সারমেয়র মত তাকিয়ে আছে
দশাসই চেহারা নিয়ে আমার ৪২ বছরের পিসেমশায় ,
মুহূর্তের মধ্যে মায়ের দেওয়া নতুন শাড়ি উড়ে গিয়ে পড়ল আলমারির কোণায় ।
পুষ্পাঞ্জলির পুন্যলগ্নে আমার সদ্য যৌবনে পরিপূর্ণ কোমল শরীরটাকে
হিংস্র পশুর মতো চিবিয়ে খেল আমার পিসেমশায় ।
আমার গলাফাটা চিৎকার সেদিন হার মেনে গেল
ঘণ্টা ,কাঁসর , ঢাক আর কোলাহলের কাছে ।
কেউ শুনতে পেলেও কিছু হোতো বলে মনে হয় না ।
মন্ডপে খুঁজে না পেয়ে
অবশেষে মা আমায় আবিষ্কার করল এক বীভৎস নগ্ন চেহারায় ।
তারপর বাবার থেকে পাওয়া উত্তরটা আমায় আরও হাসিয়েছিল ।
বাবা সব শুনে আমার মাকে বলেছিল --
“ ওকে এসব কাউকে বলতে বারণ করো,ওসব কিছু না, যা হয়েছে ভুলে যেতে বোলো । ”
হঠাৎ মনে হয়েছিল এতো বাবা নয় , আমার পিসেমশায়ের অন্য এক রূপ ।
বাবা যদি সেদিন কিছু অন্তত বলত তাহলে আর এদিনটা আমায় দেখতে হত না ।
সেই দশমীরই দুপুরে যখন আমি ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম ,
হঠাৎ শুনলাম মায়ের আর্তনাদ ,
একছুটে যখন ছাঁদে গিয়ে দাঁড়ালাম ...... তখন দেখি
পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিল মা ।
পিছনে দাঁড়িয়ে আমার সেই প্রিয় পিসেমশায় ।
বুঝতে বাকি রইল না আমার আর কিছু ।
পাশে পরে থাকা ধারালো দা সজোরে বসিয়েদিলাম ওনার গলায় ।
ওই পাপের রক্তে ভিজে যখন আমি ছাদের দেওয়াল ধরে নিচের দিকে তাকাই
দেখলাম রাস্তার সমস্ত লোক ঘিরে আছে আমার মায়ের থেঁতলে যাওয়া দেহটা ।
মুহূর্তে মুখটা ঘুরিয়ে বসে পড়লাম ছাদের উপর ।
এঘটনাটা শুধুই আমার কাছে সত্য , সবার কাছে সত্যগল্প হল
“আমি মাকে ঠেলেদিয়েছিলাম আর সেটার সাক্ষী পিসেমশায় ছিল বলে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল আমাদের পরিবারে মহান মানুষটিকে ।”
তাই হাসিমুখে দুটো খুনের সাজা বরণ করে
আমি আজ ৪৩ নং সেলের ৭৮৯৬ নং আবাসিক।
কিন্তু এটা আমার কাছে ঘরের থেকেও ভালো ,
রোজ খেতে দেয় এরা , গল্প করার কত লোক ,
এখানে থেকে পরেই আমি এবছর পিএইছডি পেতে চলেছি ।
ওই বাড়িতে থাকলে এতদিনে হয়তো খেলনা হয়ে
অন্য কোনো খাঁচায় বিক্রি হতাম সিঁদুরদানের চুক্তিতে।
মাঝে মাঝে মনে হয় মা কি এই জন্যেই নিজের জীবনটা বিসর্জন করে দিল
আমাকে একটু সুখ দেবে বলে ?