তিনতলা
তিনতলা


(১)
-"ধুর্ আর ভালোলাগে না। এই ঝক্কি কি আর পোষায়?"
-"আহাহা এই দেখো না তোমার প্রিয় আম পাপড় এনেছি গো। কাল সময় পেলে খেও।"
-"এখনো কি আমাদের লুকিয়ে দেখা করার বয়স আছে? যত্তসব!"
-"কাল তেঁতুলের চাটনি নিয়ে আসবো খন। আজ তেঁতুলগুলো রোদে দিয়েছিলাম।"
-"দূর বাবা আমি মরছি আমার জ্বালায় আর ইনি তেঁতুল পাপড় এসব নিয়ে পড়ে আছেন!"
-"এসব বলে কি লাভ বলোতো? জানোই তো এ কখনো ঠিক হবার নয়। তার চেয়ে এই বেশ ভালো।"
-"কি ভালো অ্যাঁ? কি ভালো? এইভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে মাঝরাতে দেখা করতে তোমার ভাললাগে?"
-"হ্যাঁ ভালোই তো। কত টান বেড়েছে বলো আমার-তোমার মধ্যে।"
-"হুম টান বেড়েছে! ছাতার মাথা বেড়েছে! চল্লিশ বছর একসাথে সংসার করার পরও এই লেখা ছিলো আমাদের কপালে! ছ্যা।"
-"রাগ করেনা। চল অনেক্ক্ষণ হয়ে গেল। বিতু পুতুরা উঠে ভয় পেলে কেলেংকারী হবে।"
-"হ্যাঁ এই বয়সেও ভয় পেয়েই কাটাই। সারাজীবন ভয় পেয়েই যাব।" বলে উঠে গেলেন কমলেশ বাবু ও ফাল্গুন দেবী।
(২)
কমলেশ মজুমদার ও ফাল্গুন দেবী বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। তারপর সাত বছরের মধ্যেই হয়ে গেলেন তিন সন্তানের বাবা-মা। তিনটেই ছেলে। দুজনেরই মেয়ের সখ থাকলেও ভগবান সহায় হন না। এখন দুজনেই ষাটোর্ধ। বড় ছেলে প্রানাশীষ বিয়ে করেছে বছর নয় আগে। ছেলের বয়স এখন আট। মেজো ছেলে দেবাশীষের বিয়ে হয়েছে সাত বছর আগে। ছেলের বয়স ছয়। আর ছোটোজন শুভাশিষ, এখনও অবিবাহিত।
ছেলেদের বিয়ের পরপর কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা তৈরী হল যখন দেবাশীষের ছেলের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। এ বাড়িতে সকল বাচ্চাই পাঁচ বছর হয়ে গেলে মা-বাবার সাথে আর শোয়না। কমলেশবাবুর পুত্রদের ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছিল। দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার বছর দুইয়ের মধ্যেই ওপর তলাটা বানিয়ে নিয়েছিলেন কমলেশবাবু যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়। বাড়িতে এখন ঘর পাঁচটি। নীচে দুটো আর ওপরে তিনটি। একটায় কমলেশবাবুরা আর বাকি তিনটেয় তিন ছেলে তাদের বউ নিয়ে, আর ঘর রইল দুটি। তা কমলেশবাবুর দুই ছেলেই তুতো ভাইদের একসাথে রাখতে রাজী নয়। তো তারা সমাধান বের করল যে বড়জনের ছেলের সাথে থাকবে কমলেশবাবু আর ছোটোটির সাথে ফাল্গুনী দেবী।
এও ঠিক ছিল কিন্তু আরও বড় সমস্যা হল এই যে প্রানাশীষ দেবাশীষদের হেঁসেলও আলাদা। প্রানাশীষদের হেঁসেল নিচের তলায় আর দেবাশীষদের ওপর। মা-বাবাকেও তারা সেইমতন ভাগ করে নিয়েছে। মা খায় ছোটো ছেলের কাছে আর বাবা বড় ছেলের কাছে। সারাদিন নাতিপুতিদের নিয়েই ব্যাস্ত দুই বুড়োবুড়ি আর আলাপ করবার সুযোগ পায়না। কথা হয়তো বলতে পারে কিন্তু একান্তভাবে আর হয়ে ওঠে না। তাই একান্ত সময় কাটাতে রাতে তারা চলে যান ছাদে। এই সময়টুকুর জন্যই সারাদিন অপেক্ষা করে থাকা দুজনের। কমলেশবাবুও আজকাল মাঝে মাঝে আপশোষ করেন কেনো যে বাড়িতে আর একটা ঘর নেই! হায়!!
(৩)
পরের দিন রাত তিনটেয়। ছাদের ঘরে-
-"আজ বাজারে গিয়ে অরবিন্দ বাবুর সাথে দেখা হয়েছিল। উনি একটা পরামর্শ দিলেন জানোতো।" বললেন কমলেশবাবু।
-"কি পরামর্শ গো?" জিজ্ঞেস করলেন ফাল্গুনী দেবী।
-"ওনার শ্বশুরবাড়ির ওখানে নাকি নতুন এক বৃদ্ধাশ্রম খুলেছে। খরচও নাকি খুব বেশি নয়। যাবে নাকি ওখানে?"
-"তোমার কি মাথা খারাপ? নিজের বাড়ি থাকতে বৃদ্ধাশ্রমে যাবো কেন?"
ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ-"নিজের বাড়ি? কোনটা নিজের বাড়ি হ্যাঁ? যেই বাড়িতে স্বামি স্ত্রীকে চোরের মতো দেখা করতে হয় সেটাকে তুমি নিজের বাড়ি বলছো?"
-"আসতে আসতে! উফ! এত জোরে কেউ চিৎকার করে? ওগো এটা আমার নিজেরই তো বাড়ি। নিজের হাতে তৈরী করেছি আমরা এটাকে। এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও মরেও আমি শান্তি পাবোনা।"
-"কেন বারবার মরার কথা বলো বলোতো গিন্নী? জানো ওই একটা জিনিসকেই ভয় পাই আমি। অমন কথা আর মুখেও আনবে না বলে দিলাম। যেতে না চাইলে যেওনা তাই বলে ওই কথা বলবে তুমি? যাও কাল দেখাই করতে আসবোনা।"
-"ওমা! বাবুর গোঁসা হয়েছে?"
-'জানিনা যাও। বুতুটা ঘুমের মধ্যে এমন লাথি মারে যে ব্যাথা হয়ে গেছে।"
-"হে হে ঠিক হয়েছে। আমাকে বলতে না যে আমার নাক ডাকার শব্দে তোমার ঘুম হয়না। দেখো এবার কেমন লাগে। হি হি।"
-"হুম তা তো লাগবেই। তুমি তো কোনোদিনই আমাকে ভালোবাসলে না তাই আমার কষ্টই তো তোমার ভালো লাগবে!"
-"আজ মেজোদের ঘরে ভেটকিমাছের ফ্রাই হয়েছিলো জানোতো? রান্না করার সময় তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। কি খেতে ভালোই না বাসতে তুমি!"
-"আবার আজকে তুমি রান্না করেছো? কেন? আজ তো রানী এসেছিল দেখলাম।"
-"হ্যাঁ তা তো এসেইছিল। কিন্ত বউমা বলল যে মা আপনি এত ভালো ভেটকিমাছ রাঁধেন যে অন্য কারোরটা আর মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনা"
-"অ বেগারটা ভালোই খাটিয়ে নিল অ্যাঁ? তা তুমি খেয়েছো?"
-"তোমাকে না দিয়ে আমি কি করে খাই বলোতো। আমারটা রানিকে দিয়ে দিয়েছি। বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে খাবে খন।"
-"গিন্নি তুমি কি একটুও বদলাবে না?" বলে জড়িয়ে ধরলেন কমলেশ বাবু নিজের প্রাণের মানুষটিকে।
-"বদলে কি লাভ এইতো বেশ আছি।"
এঁর ফাকে যে দুজনেই নিজেদের চোখের জল আড়াল করে নিল সেটা বুঝি স্বয়ং ঈশ্বরও দেখতে পেলেন না।
(৪)
শুভাশিস আজ বিয়ে করেছে। রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে করে বউ নিয়ে ঘরে এসেছে। ঘরের আবহাওয়া আজ অন্যরকম। সবার মুখ থমথমে। শেষে বড় বউ গলা দিলেন-"মানসম্মান আর কিছু বাকি রাখলেনা গো। ছিঃ ছিঃ!"
-"বিয়ে করেছি বউদি। খুন করে আসিনি কারোর।"
-"চুপ হতভাগা একদম চুপ আবার মুখ চালাচ্ছে। মারব টেনে এক থাপ্পর। কুলাংগার ছেলে।" বলে চুপ করলেন দেবাশীষ।
-"দ্যাখ দাদা তোদের সাথে ঝগড়া করার একটুও ইচ্ছে আমার নেই। আমার বউ রিনিতা এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবে। তোদের রান্না করার সমস্যা থাকলে বলে দে আমরা দুজন মিলে রান্না করে নেবো। মাসবাবদ আমার খরচের থেকেই একটু বেশি টাকাই তুলেদি তোর হাতে। তাই আশা করি অসুবিধে নেই।" বলে রিনিতার হাত ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছিল শুভাশিস। তারপর হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে বলল-"আর একটা কথা আমি একটা কথা ভেবেছি। ওপরের তলায় আমি একটা পাশে দুটো ঘর বানাবো বলে ঠিক করেছি। আর একটা পাশ ফাঁকা থাকবে। তোরা টাকা দিলে তোরাও এখন বানিয়ে নিতে পারিস।" বলে চলে গেলো নিজের ঘরের দিকে।
-"দেখলে মা তোমার ছোটো ছেলেকে দেখলে? আমাদের পরিবারে এ ঘটনা কখনো ঘটেছে? আত্মীয় স্বজনকে কি বলবো বলতো এবার?" এতক্ষণে মুখ খুললো প্রানাশীষ।
-"আমাদের বাড়িতে এরূপ ঘটলে বাবা তাকে বাড়িতেই আর রাখা হতোনা। কি কান্ড অ্যাঁ? জীবনটাকে ফিলিম বানিয়ে ছাড়লে একেবারে!" বলল বড়বউ।
-"অনেক ঘটনাই তো নতুন ঘটে বউমা। সাতজন্ম একসাথে থাকার কথা যাদের তাদের শেষ বয়সে আলাদা থাকার ঘটনাও তো নতুনই। তা দেখেও যখন সবাই মুখ বন্ধ করে আছে তখন এ দেখেও কেউ কিছু বলবেনা" বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন কমলেশবাবু।
-"দেখলে তোমার বাবাকে দেখলে? শেষ বয়সে ভিমরতি। আপনাদের জন্য যতই করি আপনাদের আর মন পাওয়া যাবেনা। আমি আর আপনার মেজো ছেলে সারাদিন অফিস করি তা কি নিজেদের জন্য! এই বয়সে নাতির সাথে থাকতে এত আপত্তি কিসের শুনি? আর ভালোলাগে না। এই চলো ওপরে চলো। আপনিও আসুন পুতু এখনও কিছু খায়নি।" বলে ঝড়ের গতিতে ওপরে উঠে গেলো মেজোবউ।
সবাই ঢুকে গেলো নিজের ঘরে। থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ফাল্গুনী। আপন পরের হিসেবটা বড্ড গোলমেলে।
(৫)
-"কেন আমরা কেন স্যাক্রিফাইস করতে যাবো? বাবা-মাকে তো আর রাস্তায় ফেলে দিইনি! এখন ওনাদের জন্য আমদের ভাগে কম কেন পড়বে হ্যাঁ? এই বয়সেও এতো পিরিত কিসের?" বলল মেজোবউ।
-"ঠিকই তো। মেজো তো ঠিকই বলেছে। দেখো তুমি শুভর সাথে কথা বল। এইটুকুনি ঘরে আমাদের হবেনা। তার চেয়ে ওই আরেকটা ঘর না বানালে কত বড়বড় ঘর হবে। প্রান খুলে শ্বাস নিতে পারবো।" বলল বড়বউ।
-"হ্যাঁ দাদা ওপরে ঘর তিনটেই হোক। আমাদেরটাকে আমি সুন্দর করে গেস্ট রুম বানাবো। ছোটো হলে মানসম্মান থাকে বল? বাড়িতে এক্সট্রা ঘর নেই তাই ক্লাইন্টদের ডাকতেও পারিনা। ওসব হবেনা দাদা তুই কথা বল একবার।" বলল দেবাশীষ।
-"হুম দাঁড়া।" বলে ডাক দিলেন-"শুভ এই শুভ একবার আয়তো আমাদের ঘরে। "
কিছুক্ষন পরেই এলো শুভ আর সাথে রিনিতা। রিনিতার সাথে একমাত্র শ্বশুর-শাশুরি ছাড়া আর বাড়ির কারোরই ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। রিনিতা অবশ্য চেষ্টা করেছিলো কিন্তু এরা কেউই তা চায়নি। তাই রিনিতাকে দেখে আজকেও কেউ সন্তুষ্ট হলো না। কেউ অবশ্য মুখেও কিছু বললোনা। বড়ছেলে মুখ খুললো-"বস্। কিছু কথা আছে।"
-"না এভাবেই ঠিক আছে। বল।" বললো শুভাশিস।
-"সোজাসুজি বলাটাই ভালো। শোন তুই যে ওপরে ঘর বানাচ্ছিস তা নিয়ে কিছু কথা আছে।"
-"হুম তো বলনা। এত কিন্তু কিন্তু করিসনা বলে ফ্যাল।"
-"আমরা সবাই চাইছি যে ওপরে চারটে নয় তিনটে ঘর হোক। তাহলে ঘরগুলো একটু বড়সড় হয় আরকি। আরে মাবাবা তো আর খারাপ নেই। নাতি ছাড়া ওনাদেরও আর ভালো লাগবে না দেখিস!"
-"এটা কি তোকে মা বা বাবা কেউ বলেছে?"
-"না তোমার মা বা বাবা আজকাল আমাদের কিছুই বলেনা গো। শোনো ওপরে তিনভাইয়ের তিনটে ঘর হবে এতে এতো কিন্তু কিন্তু করার কি আছে? আমরা কি আর অন্যায় আবদার করছি?" বললেন মেজোবউ।
-"আমিও তো আর কিছু অন্যায় আবদার করছিনা বউদি। তোমাদের সবার ভাগে তিনটে করে ঘর হয়ে যাবে আর আমার ভাগে পড়ে থাকবে দুটো ঘর। আমি শুধু আমারটা করে নিচ্ছি। সেটায় আমি মা-বাবাকে একসাথে থাকতে দিচ্ছি সেটা তো আমার ব্যাপার। অন্যায়টা কি দেখলে শুনি?"
সবাই একেবারে থম মেরে গেল। সবাই চুপ দেখে রিনিতা মুখ খুললো -"একটা কথা যেটা তোমাদের ভাই তোমাদের বলেনি। বাবা-মা রাতের বেলা লুকিয়ে ছাদে দেখা করতে যায়। কারন একই বাড়িতে থেকে তোমাদের জন্য তারা সেটা সারাদিন করতে পারেনা। ওরা কি তোমাদের বাচ্চা সামলানোর মেশিন?"
-"কি কি বললে? ভাসুরের সামনে দাঁড়িয়ে গলা তুলে কথা? আমাদের বাড়িতে এরকম কখনো হয়নি। ছি ছি কাকে বিয়ে করে আনলে অ্যাঁ?" বললেন বড়বউ।
-"আমাদের বাড়িতে বাবা-মার সামনেও আমরা গলা তুলে কথা বলিনা বড়দি। এখানে তো সেটাও হয়।"
-"যাই হোক ছাড়ো। আমি ওপরে আমার জন্য দুটো ঘরই বানাবো। তোরা তোদেরটা না বানাতে চাইলে বলে দিস মিস্ত্রীকে সেইভাবে বলতে হবে। এসো।" বলে বেরিয়ে গেলো শুভ আর রিনিতা।
(৬)
ঘটনার ছয়মাস পরে। মজুমদার বাড়িতে এখন নটা ঘর। শুভ-রিনিতার কথা মতো কমলেশ-ফাল্গুনীও একটা ঘর পেয়েছে। যদিও ঘরগুলো ছোটো ছোটো কিন্তু তাতে আফসোস নেই তাদের। হেঁসেলও এখন এবাড়িতে তিনটে। মা-বাবা ছোটো ছেলের কাছে খায়, যদিও দুটো কাজের লোক রাখা আছে। এখনও ওনারা ছাদে যায় যদিও তা মাঝরাতে লুকিয়ে নয়। এখন একসাথে সূর্য ডোবার সাক্ষী হয় এই দুই প্রৌঢ়। বেঁচে থাকার ইচ্ছে এখন আরো গভীর, আরো প্রশস্ত।