জীবনের রং
জীবনের রং
কতই না সুন্দর ছিল, চিন্তা মুক্ত জীবন, সেই ছোটবেলা। ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গিয়েছিল সে তার অতীতের সমুদ্রে। পড়াশুনা করলেই যে সুন্দর একটা চাকরি পাওয়া যায়, সেই ভ্রান্তি নিয়ে জীবনের চব্বিশ টা বছর আজ অতিক্রম করেছে সে। কোথায় চাকরি! সবই মায়া।
এই মায়া কেটে গেল যখন তার ছোটবেলার বন্ধু পিছন থেকে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, কি রে বিবেক কাল ইন্টারভিউ কেমন হলো? অনেক দিন পরে দেখা তাদের, কিন্তু প্রায়ই কথা হতো ফোনে। বিবেক বলল, না রে ভাই , এখন কি আর শুধু ইন্টারভিউ দিলেই চাকরি পাওয়া যায়! পাওয়া গেলেও তা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।
যাই হোক, তুই আজ এদিকে হঠাৎ কি মনে করে?
সুমন এসেছিল তার বিয়ের ইনভিটিশন দিতে , তার বাড়িই যাচ্ছিল , কিন্তু চায়ের দোকানেই তাকে পেয়ে গেলো। আজ সুমন প্রতিষ্ঠিত , বিবেকের সঙ্গেই পড়ত , কিন্তু মাধ্যমিকের পরেই পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে তার বাবার ব্যাবসায় মনোযোগ দিয়েছিল। সে এখন আর বাড়িতে থাকে না, ব্যাবসায়ের কাজে অনেক বড়ো বড়ো মানুষের সঙ্গে তার ওঠা বসা ।সবই ভাগ্য!
বিবেক বলল, ঠিক আছে, আমি নিশ্চয়ই যাবো তোর বিয়েতে। কিছুক্ষণ চা খেতে খেতে গল্পঃ করার পর, সুমন চলে গেল সেখান থেকে। সে বুঝতে পেরেছিল বিবেকের মনটা এখন ভালো নেই।
দিন শেষে বাড়ি ফিরল বিবেক, বাড়ির অবস্থা তেমন খারাপ নয়। দুবেলা খাওয়া টুকু হয়ে যেত, নিম্ন মধ্যবিত্ত যাকে বলে। বাড়িতে কাজের মানুষ বলতে তার বাবা, কিন্তু তাঁরও তো বয়স হয়েছে! আর কতদিনই বা রক্তজল করা পরিশ্রম করবেন?
সমস্ত চিন্তা যেন বিবেকের রক্তে ক্যান্সার এর মত ছড়িয়ে পড়েছিল। যার প্রতিকার খুঁজতে খুঁজতে কেটে গেল আরও দুই বছর। সবই আগের মত, এখনও সবকিছু অন্ধকার। যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি।
মাথার উপর অনেক ঋণ আছে তাদের, বাড়ি তৈরি করতে অনেক টাকা নিয়েছল ঋণ অফিস থেকে। এর আগে তাদের বাড়ি ছিল বেরা দিয়ে তৈরি , মাথার উপর ছিল খোলার চাল। কখনো কখনো মনে পড়ে যেত, বর্ষাকালে ভোররাতে মুখের উপর চুঁইয়ে পড়া সেই জলের ফোঁটার কথা। সারারাত চলত যুদ্ধ।
তবে রাতের অবসান হয়ে দিনের আলোর মত এলো একটা চিঠি । বিবেকের মুখের কানায় একটু হাঁসি ফুটলো। একটা চাকরি পেয়েছে সে!
- তবে কথায় আছে যে " অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়া যায়" , ঠিক তেমনি হলো। চাকরি পেয়েছে , কিন্তু জয়েন করতে গেলে নাকি কুড়ি হাজার টাকা দিতে হবে। এতো টাকা কোথায় পাবে সে? তাই চিঠি টার কোনো দাম রইলো না, সেটা এখন শুধুই একটা কাগজের টুকরো মাত্র।
সব ছেড়ে বিবেক এখন একটা কারখানায় হিসেবের কাজ করে। মাসের শেষে হাতে পায় মাত্র আট ছয় হাজার টাকা। তবে তাদের কাছে এটা অনেক। সমস্ত ইচ্ছা শুধু স্বপ্নই রয়ে গেল।
একদিন ছুটির দিন সকালে বাজারে যাওয়ার পথে দেখা হলো, বন্ধ সুমনের সাথে । পিছন থেকে অনেকবার ডাকলেও সে কোনো কথা না শুনেই চলে গেল। তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল , চায়ের দোকানে। নানান চিন্তায় আর ফোন ও করেনি বিবেক। এমন সময়ে তার মনে পড়লো , সুমনের বিয়ের ইনভিটিশন এর কথা । মনের অশান্তিতে সে ভুলেই গিয়েছিল তার বিয়েতে যাওয়ার কথা। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো সে, ভাবতে লাগলো কত বড়ো ভুল হয়ে গেছে তার। এই কারণেই হয়তো , সুমন তার ডাকে সাড়া দেয়নি। জীবন যেনো তার সাথে খেলা করছে , একটা সমস্যা দুর হতেই , আরেকটা সমস্যা।
বাবা, মা ও পরিবারের পরে বন্ধুরাই হয় সব থেকে আপন। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কিছু মুহূর্ত। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য, পড়তে যাওয়ার সময় একসাথে সাইকেল এ করে সোজা রাস্তায় না গিয়ে, অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাওয়ার সেইসব কথা, ছুঁচ এর মত তার বুকে ফুটছে।
বিবেক সিদ্ধান্ত নিল, আজ বিকালে সে সুমনের বাড়িতে যাবে, এবং তার কাছে ক্ষমা চাইবে। সে ক্ষমা না করলে , তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে।
বাজার করে বাড়ি ফিরলো বিবেক। বাড়ি ফিরে দেখল তার বাবার বুকে প্রচন্ড বেথা করছে। এখনি হসপিটাল এ নিয়ে যেতে হবে। বিবেক একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে, তার বাবাকে নিয়ে গেলো হসপিটাল এ। এবং বাবাকে হসপিটালে অ্যাডমিট করলো। সারারাত বিবেক ক্লান্ত চোখে জেগে বসেছিল বাইরের বেঞ্চে, যাতে পেশেন্ট সিরিয়াস হলে কেউ উপস্থিত থাকতে পারে। পরের দিন দুপুরে তারা বাড়ি ফিরলো।
কেটে গেল আরও কিছু দিন, বিবেকের বয়স এখন সাতাশ। তার ছোটবেলা টা নষ্ট হয়েছে ভবিষ্যতের চিন্তায়, আর এখন সে তার অন্তরে পুড়ছে সংসারের চিন্তায়। তাই বিবেক ঠিক করেছে, আর কোনো চিন্তাই করবে না সে। নদীর স্রোতের মতো জীবনটাকেও সে ভাসিয়ে দিয়েছে, যেদিকে গড়াবে সেদিকেই যাবে সে।
To Be Continued.........