গল্পের শুরু ...
গল্পের শুরু ...
মেয়েটি তখনো আড়চোখে তাকাচ্ছিল আমার দিকে । নীল ড্রেস-আপ করা মায়াবী একটা মেয়ে । দুধে আলতা মুখের মধ্যে ঘনকালো টানা টানা চোখ দুটি, যেনো মোহনীয়তায় ছেয়ে আছে । সে মোহনীয় চোখ দুটি আমার দিকেই এগিয়ে আসছে ।
(গতকাল সন্ধায়,রাজা-ম্যানশনে বইপত্র লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম । 'আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী' বইটি কিনব বলে ।দারুণ একটি বই । অনেকদিন ধরে সময় এবং অর্থের অভাবে কেনা হচ্ছিল না । যখন সময় থাকে তখন অর্থ থাকে না, আর যখন অর্থ থাকে তখন সময় । পুঁজিবাদ সমাজের কিছু মানুষকে ঊন্নয়নের গাড়িতে তুলে দূর্বার বেগে দৌড়াচ্ছে, আর অধিকাংশকে সেই গাড়িতে পিষ্ট করতেছে ।পিষ্ট হওয়া সেই অধিকাংশ লোকদের মধ্যে আমিও একজন । যে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে সত্য এবং সুন্দরের, স্বপ্ন দেখে শান্তির শুভযাত্রার ।কিন্তু যা ব্যর্থ হয় দানবের হুঙ্কারে ভেঙ্গে যায় স্বপ্ন মাঝ রাস্তায় । স্বপ্ন এবং বাস্তবে পুঁজিবাদ যেনো এক নিষ্ঠুর দানবের নাম । যার পিঠে যে চড়ে সেই রাজা,বাকী সব আহার । স্বার্থ এবং অর্থই হল পুঁজিপতি সেই রাজাদের একমাত্র আরাধ্য । মানুষ, দেশ, মানবতা -এগুলো মুখস্থ কথা । যেগুলো প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তাদের মুখে উচ্চারিত হয় । এখনো উচ্চারিত হচ্ছে........ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে)
" আপনি জয়, তাই না ? "
"হ্যা । আপনি ? "
"আমি নীলা । গত বিজ্ঞান উৎসবে গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম । আমি আপনার জুনিয়র "
" তো ! "
" আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করতে পারেন "
" তো, তুমি কোন ক্লাসে পড় ? "
" ক্লাস টেনে । সামনে SSC পরীক্ষা । "
" প্রস্তুতি কেমন ? "
"মোটামুটি ভালোই । বই কিনতে এসেছেন না কি ? "
" হ্যা, এইতো একটা বই কিনলাম । তুমি ? "
" আমিও বই কিনতে । চারটে বই কিনব । দুইটা শরৎচন্দ্রের, একটা ...... "
"এতো বই পড়বে কখন ? সামনে তো পরীক্ষা । "
"ইচ্ছা থাকলে পড়া যায় । আপনি-তো বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ সিলেট শাখার সংগঠক, তাই না ? "
" হ্যা....... "
" আমাদের জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা কবে হবে ?
আমাদেরকে তো বলা হয়েছিল........."
" আগামী জানুয়ারি মাসে হওয়ার সম্ভাবনা আছে । পরিবেশ বিধ্বংসী রামপাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতেছি, যার জন্য জাতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান উৎসব তোমাদেরকে দেওয়া সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হয়নি "
" রামপাল প্রকল্প, অর্থাৎ সুন্দরবনের পাশে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সেটাই তো ? "
" হ্যা । যে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রাকৃতিক রক্ষাপ্রাচীর ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সহ পরিবেশের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে "
"কিন্তু, টিভিতে তো দেখলাম এই প্রকল্পে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং এটি লাভজনক ।"
" টিভিতে তো অনেক কিছুই বলা হচ্ছে । যেমন : সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল - রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দিকে কোনো বাতাস-ই নাকি প্রবাহিত হয় না, আর বাতাস প্রবাহিত না হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিও হবে না । কিন্তু আমরা জানি যে, শীতকালে বছরে চারমাস বাতাস রামপাল থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয় । এছাড়া ঝড়-বৃষ্টির কারণে বছরের অন্যসময়েও অনিয়মিতভাবে সুন্দরবনের দিকে বাতাস প্রবাহিত হয়। "
" কিন্তু, রামপাল প্রকল্পেতো আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে । যার ফলে দূষণের মাত্রা অনেকগুণ কমে যাবে।"
" হ্যা,দূষণের মাত্রা কিছু কমবে, কিন্তু দূষণ হবেই ।আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি দ্বারা মাত্র ১০শতাংশ দূষণ কমানো সম্ভব । তাছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিক পাশেই পশুর নদী যা সুন্দরবনের ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয় । বায়ুদূষণ কমানো হলেও, তাতে পানিদূষণ বেড়ে যায়, কারণ বাতাস থেকে সংগৃহীত রাসায়নিক পানিতে মিশিয়ে নদী /জলাভূমিতে ফেলা হয় ।তাছাড়া যেখানে প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকা বুড়িগঙ্গা নদীকেই দূষণমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে সুন্দরবনে ব্যবহৃত হবে ব্যয়বহুল আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি, যা অনেকটা শিশুরহাতে চাদ তুলে দেওয়ার মতো লোভ দেখানো ! "
" ক্ষতি যদি হবে, তাহলে কেন করা হচ্ছে এই প্রকল্প ? "
" স্বার্থ রক্ষার জন্য । এখানে সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত । কেন, এর আগেও তো এরকম অনেক চুক্তি হয়েছিল । যেমন : ফুলবাড়ির কয়লা-খনিকে সরকার বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চুক্তি করেছিল, যেখানে বিদেশিদের মালিকানা ৯৪ভাগ আর আমাদের ৬ভাগ । বিদেশি কোম্পানির সাথে গ্যাস তোলার চুক্তি করেছিল এই শর্তে, আমাদের গ্যাস তবে আমরা পাব ২১ ভাগ ওরা ৭৯ ভাগ । তাছাড়া ১৯৮ বছরের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন কোম্পানির কাছে লিজ দেয়ার চক্রান্ত...."
" হ্যা - হ্যা,, মনে পড়েছে । আর আপনারা তখন প্রচার, আলোচনা সভা, আন্দোলন, সমাবেশ, লংমার্চ ইত্যাদি করেছিলেন । যার ফলে আপনারা ওই সর্বনাশা চুক্তিগুলো ঠেকিয়েছিলেন । এবারও তাই করতে হবে... "
"আমরা আন্দোলন করব আর তুমি কি দাড়িয়ে দেখবে ?"
"কিন্তু আমি ত মেয়ে..."
"মুক্তিযুদ্ধে কি শুধু ছেলেরা একা লড়াই করেছিল ? নাকি সেখানে ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ, ছাত্র শ্রমিক সবাই অংশগ্রহণ করেছিল..."
"আমিও অংশ নেব সুন্দরবন রক্ষার এই আন্দোলনে । এবং আমার পরিচিত সবাইকেও বলব সুন্দরবন রক্ষার এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য...।"
"আগামী ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকায় সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। তুমি কি আমাদের সাথে যেতে পারবে । আমরা ২৫ নভেম্বর সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করব ।"
"বাসায় গিয়ে মা বাবার অনুমতি নিয়ে আপনাকে জানাব । যদি আপনার ফোন নাম্বার টা দিতেন...? "
"01........................."
"এটা আমার নাম্বার"
"আমি কি যেতে পারি ?" পাশে দাড়িয়ে থাকা অপরিচিত একজন বললেন । যাকে আমরা এতক্ষণ ততটা খেয়াল করিনি ।
"অবশ্যই । আপনাকেও আমন্ত্রণ । সুন্দরবন তো সবার, কারো একার নয় । "
" বিদ্যুৎ আমিও চাই, কিন্তু সুন্দরবন ধ্বংস করে নয় । বিদ্যুতের অনেক বিকল্প আছে, কিন্তু সুন্দরবন একটাই ।"
" আগামী ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকায় আপনাকেও আমন্ত্রণ "
{ যে এতক্ষণ গল্পটি পড়লেন }
[ বিঃদ্রঃ -
এরপর...
ফোনে কথা ।
বাসে দেখা ।
ঢাকায় একসাথে মিছিলে পথ চলা ।
এরপর...
গল্পের শুরু ]