Karima Khatun

Inspirational Others

3  

Karima Khatun

Inspirational Others

গল্প হলেও সত‍্যি

গল্প হলেও সত‍্যি

6 mins
72


অনুপ্রেরণা: মেঘাচ্ছন্ন কোনো এক দুপুরে ঘরের জানালা দিয়ে একফালি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় আমার মনে পড়লো আমার সেই বন্ধুর কথা যে আমাকে আবদার করে বলেছিলো, 'তুই যেদিন নিজে উপার্জন করবি সেদিন আমাকে একটা ঘড়ি উপহার দিস।' এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এই গল্প লেখা।


সকাল থেকেই আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন তবে ঝড়ের কোনো সম্ভবনা নেই, অনতিবিলম্বে বৃষ্টি নামবার আশঙ্কাটাই ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা এবার নামবেই, চাষিরা হয়তো সেই আশায় স্বপ্ন বুনছে ঘরের দাওয়ায় বসে। আর আমি মনোযোগ সহকারে একটা গল্প পড়ছি। আজকাল গল্প পড়াটা যেন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে! যাইহোক এমন সময় বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। বাইরের দিকটা ঠিক দেখা যাচ্ছেনা, সাদা বৃষ্টি যেন সবকিছুকে গ্রাস করে রেখেছে। আমার মনে পড়তে লাগলো 'সোনার তরী' কবিতার সেই দুটি লাইন -

     গগনে গরজে মেঘ ঘন বর্ষা

      কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।

কবিতাটা আপন মনে আবৃত্তি করে উঠতেই মনে পড়লো বিনয়ের কথা। একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় বিপ্র এসে হাজির। ওকে দেখে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিলো। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই ও কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, 'কখনো কখনো রক্তের সম্পর্কের চেয়েও যে আত্মার সম্পর্ক বড়ো হয়ে উঠে তা আজ বুঝলাম।' একথা বলেই বিপ্র হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। অনেকেটা প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর বিনয় বললো,'রক্ত কখনো বেইমানি করেনা রে কিন্তু যার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক হয় সে সবটুকু শুষে নিয়ে দূরে ঠেলে দেয়।' ও যে কথাগুলো আবেগের বশে বলে উঠেছে সেটা বোধ হয় বিপ্র বুঝতে পেরেই কোনো তর্কে যায়নি।

    বিনয় অনেকটা চাপা স্বভাবের, ভিতরে ভিতরে জীর্ণ হয়ে গেলেও সে তার কষ্ট সহজে কারোর কাছে প্রকাশ করতো না। আর করলেই বা কী বড়োজোর একটু শান্তনা বাক‍্য শোনাবে তারপর যে যার কাজে ব‍্যস্ত হয়ে পড়বে। মা চলে যাওয়ার পর নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলো বিনয়। মায়ের মৃত্যুর জন‍্য বৌদি যে অনেকটা দায়ী সে কথা কখনোই ভোলেনি বিনয় তাই সিদ্ধান্ত নিলো একা পথ চলার। যে পথে সঙ্গ দেয়নি বাবাও, সঙ্গ দিয়েছিলো কেবল এক অশরীরি মূর্তি। যার সঙ্গে চলতো গভীর রাতে কথোপকথন। যদিও কিছুদিনের জন্য সঙ্গ দিয়েছিলো এক শরীরি মূর্তি তবে সে সব আজ অতীত।

    প্রত‍্যেক রবিবার আমরা গঙ্গার ঘাটে বসে আড্ডা দিতাম কিন্তু সেদিন বিনয় আসেনি, ফোনও করেনি। রাত্রি বারোটার সময় হঠাৎ ফোন এলো। ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করতেই বিনয় ভয়ার্ত গলায় অস্ফুটে বলে উঠলো, 'বিভাস আমার খুব ভয় করছে!' আর কোনো কথা বলতে পারেনি। লাইনটা না কাটায় বুঝতে পারলাম ওর জ্বর এসেছে, জ্বর কে খুব ভয় পেতো বিনয়। ছোটোবেলায় মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো, 'মা আমার খুব ভয় করছে,আমি মরে যাবো না তো। এখনো যে আমার জগতটাই ভালো করে দেখা হলো না!' মা বলতো, 'পাগল ছেলে জ্বর হলে কেউ মরে যায় নাকি! আর আমি তো আছি ভয় কিসের?' কাঁপা কাঁপা গলায় বিনয় বলে উঠতো, 'এইভাবে সারাজীবন তুমি আমায় আগলে রাখবে তো মা?' মা একটু গম্ভীর হয়ে বলতো, 'আমার বিনয় বাবু কি পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচবার পরিকল্পনা করছে? তাহলে তো আমার কষ্ট করাই বৃথা!' বিনয় অতোশতো বোঝেনা তাই আবার বলে, 'বলোনা মা আমায় আগলে রাখবে কিনা?' মা একটু হেসে বলে, 'সারাজীবন কি কেউ বাঁচে বাবা!' যাইহোক ফোনটা ধরে আমি ভাবছি কী করবো এমন সময় বিনয় চেঁচিয়ে উঠে বললো,'মা তুমি এসেছো! আমার যে খুব শীত করছে আর মাথা যন্ত্রণা করছে। তুমি তোমার কোমল হাতখানি দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও!' আমি বুঝলাম সে ঘোর প্রলাপ বকে চলেছে। আমি আর বিপ্র ওর বাড়িতে গিয়ে কাকুর কাছ থেকে জানতে পারি কাল রাতে বৃষ্টির মধ‍্যে ভিজে একাকার হয়ে বাড়ি ফিরেছে তারপর এই অবস্থা।

    শনিবার রাত্রি বারোটার দিকে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো, ফোনটা রিসিভ করতেই একটা চিরপরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলো বিনয়, 'আগামীকাল সকাল দশটায় কলেজস্ট্রিট মোড়ে চলে আসিস।' বিনয় ভাবতে থাকলো পাঁচবছর পরে ফোন করলো আর এটুকু বলেই রেখে দিলো! আর রাখবেই না কেন! কিন্তু হঠাৎ কালকেই যেতে বললো কেন? তবে কি...ওসব কথা আবার কেন ভাবছি? পুরানো স্মৃতিগুলো আজো জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিপটে কিছুতেই ভুলতে পারছেনা বিনয়। মায়ের পরে আপন বলতে তো তাকেই জেনেছিলো তবে কেন এমন হলো? আপনজনরা কি কেবলই কষ্ট দেয়? এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বিনয় তা সে নিজেও জানে না।

       সকাল দশটার আগে বিনয় পৌঁছে গেলেও সৃজনী আসেনি তবে কি কাল রাতে ভুল করে ফোন করেছিলো। ভাবতে ভাবতে বিনয় পাশের চায়ের দোকান থেকে এককাপ চা নিয়ে সবেমাত্র একটা চুমুক দিয়েছে এমন সময় একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। দুধে আলতা রঙের শাড়ি আর অক্সিডাইসের হালকা গহনা পরিহিত কোনো পরী যেন নামলো গাড়ি থেকে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা বিনয়, একি দিবাস্বপ্ন নাকি কোনো প্রহেলিকাময় রাতের স্বপ্ন! নিজের অজান্তেই কখন যে সে দাঁড়িয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারেনি। তার চমক ভাঙলো সেই স্বপ্নোন্থিত পরীর কন্ঠস্বর শুনে-'দুঃখিত রে! রাস্তায় প্রচুর ভিড় ছিলো তাই আসতে দেরি হয়ে গেলো।' বিনয় মনে মনে ভাবতে লাগলো সৃজনী আজ তাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে তবে কি...তার এই ভাবনায় ব‍্যাঘাত ঘটলো পাশের থেকে চায়ের দোকানদার যখন বললো,'ম‍্যাডাম আপনি কি চা খাবেন?' সৃজনী বললো, 'না শিবু আজকে আর চা খাবো না।' কী ব‍্যাপার এতো জরুরি তলব কেন? বিনয় এই প্রথম কথা বললো সৃজনীর সঙ্গে। সৃজনী বললো, 'ইচ্ছে হলো বইপাড়া ঘোরার তাই তোকে আসতে বললাম। বিনয়ের অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। ঘুরতে ঘুরতে যখন 'কথা ও কাহিনীর' সামনে এলো তখন একজন মধ‍্যবয়স্ক ব‍্যক্তি বলে উঠলো,'ম‍্যাম আপনার আসবার কি দরকার ছিলো,ফোনে বললেই পাঠিয়ে দিতাম।' আজকাল সবাই ওকে ম‍্যাম বলে ডাকে। ও যে এখন আর ছাত্রী সৃজনী নয় নাম করা ইউনিভার্সিটির নাম করা অধ‍্যাপিকা। সৃজনী সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটা ফুচকার দোকানের সামনে। মিন্টুদার স্পেশাল ফুচকা। একসময় তারা যে কতো ফুচকা খেয়েছে এখান থেকে তার কোনো হিসাব নেই। সৃজনী বললো, 'মিন্টুদা জমিয়ে ফুচকা বানাও দেখি, অনেকদিন তোমার হাতের ফুচকা খাইনি।'

-'একটু দাঁড়ান ম‍্যাডাম! এখুনি বানিয়ে দিচ্ছি।'

- 'আবার শুরু করলে তুমি!' খানিকটা অনুযোগের সহিত বললো সৃজনী।

-'আরে বিনয় যে, কতোদিন পরে তোমাকে দেখলাম!' বলেই জড়িয়ে ধরলো।

- 'এদিকে যে আর আসোই না তোমরা...।'

    ব‍্যাগ থেকে ফোনটা বের করে সৃজনী বললো, 'হরেন গাড়ি নিয়ে এসো।'

- 'আবার কোথায় যাবি?'

- 'দেখ কোথায় নিয়ে যাই!'

      এক ঘন্টা গাড়িতে থাকার পর একটা অচেনা জায়গায় এসে দাঁড়ালো গাড়িটা। একটা সুন্দর ঝিল যার চারপাশে ফুটে আছে রকমারি বাহারি ফুল। যাদের ছায়া পড়েছে ঝিলের স্বচ্ছ জলে। ঝিলের জলে ফুটে আছে রঙবেরঙের পদ্মফুল আর তার অনতিদূরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু রাজহাঁস সঙ্গে রয়েছে তাদের ছানারাও।

    অনেকদিন পরে আজ সৃজনীও বিনয় পাশাপাশি বসে আছে কোনো এক নির্জন স্থানে কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। নিরবতা ভেঙে সৃজনী বললো,'হাতটা দে।' 

-'বল কী বলবি শুনছি।'

মাথাটা নিচু করে ভাবতে থাকলো বিনয় তবে কি সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার আগের মতো হয়ে যাবো আমরা। সৃজনী কতোবার বিনয় কে ঘড়ি পরার কথা বলেছে কিন্তু সে পরেনি। মৃদু হেসে বলতো, 'তুই যখন নিজে উপার্জন করবি তখন একটা ঘড়ি কিনে আমায় পরিয়ে দিবি! আর আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবো শুধু তোর দিকে!' সৃজনী হেসে বলতো, 'আর আমায় কি দিবি?' বিনয় একটু গম্ভীর হয়ে বলতো, 'আমার জীবনের সবচেয়ে মূল‍্যবান জিনিসটা তোকে দেবো কথা দিলাম।'


    সৃজনী আজ তার জন‍্য কিনে এনেছে অনেক দামী একটা ঘড়ি, পরিয়েও দিয়েছে কিন্তু বিনয় তার দিকে একবারও তাকায়নি, তাকিয়েছিলো ব‍্যাগে থাকা বিয়ের কার্ডটার দিকে। যার উপর বড়ো বড়ো করে লেখা আছে অনিল ও সৃজনীর শুভ পরিণয়। হঠাৎ করে একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে ওলট পালট করে দিলো সমস্ত কিছু। সৃজনীর খোলা চুলগুলো যেন তাকে উপহাস করতে লাগলো। ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছিলো বিনয়। সৃজনী তার সমস্ত শরীর দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো বিনয়কে কিন্তু বিনয় তাকে একবারের জন‍্যও স্পর্শ করেনি তার হাত দিয়ে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো বিনয়ের কিন্তু সে কাঁদেনি। কে সেই মুহূর্তে সে অনুভব করলো কোনো এক অশরীরি মূর্তির উপস্থিতি। যে অলক্ষ‍্যে দাঁড়িয়ে বলছে, 'বিনয় তোকে যে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে,তুই কি ভুলে গেছিস সে কথা!' অত‍্যন্ত দৃঢ়কন্ঠে বিনয় বললো, 'সরে দাঁড়া সৃজনী।'

- 'তুই যে ভয় পাচ্ছিস!' অস্ফুটে বললো সৃজনী।


-'আমি ভয় পাচ্ছিনা' বলে এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিলো বিনয়।

     হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বিনয় প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললো, 'আমি তো এমন উপহার চাইনি! কেন দিচ্ছিস আমায় এমন উপহার?' ঘড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো তার পায়ের কাছে। সৃজনী কম্পিত স্বরে বলে উঠলো,'কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?'

- 'বুঝতে পারছিস না!' বলে ঝড় বৃষ্টির মধ‍্যেই বিনয় নেমে পড়লো পথে, হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে গেলো পথের বাঁকে। একরাশ অভিমান নিয়ে যখন সৃজনী ঘড়িটা ব‍্যাগে রাখতে গেলো তখন সহকর্মীর দেওয়া বিয়ের কার্ডটা চোখে পড়তে নিমেষেই সব বুঝতে পারলো, বুঝতে পারলো পাঁচবছর আগে ঘটে যাওয়া সেই নেপথ্য কাহিনীর আসল রহস্যটা।

                    


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational