গাঁয়ের বধূ
গাঁয়ের বধূ


গোধূলিতে কলসী কাঁখে জল তুলতে যাওয়া দৈনন্দিন অভ্যাস রাই আর তার মতো কিছু গ্রাম্য-বউদের। যখন সূর্য ডুবু ডুবু হয়,ওরা নদীতে যায়। যেখানে জঙ্গল শুরু হয়েছে ,ঠিক তার কাছটাতে। খেলায় ব্যস্ত রাজহংসীদের মতো ওদের জল ছিটানো দেখে কলকল করে হেসে ওঠে নদী। সূর্যও ওদের দেখতে দেখতে কেমন যেন শ্লথ হয়ে যায়। সন্ধ্যা ওদিকে তাড়া দেয়। পাখিরা চিৎকার করে। শেয়াল ডেকে ওঠে জঙ্গলে একপাল। বউরা হাসতে হাসতে ঘরে ফেরে। ওদের সারাদিনের কাজকর্মের ক্লান্তপ্রকৃতির অবারিত দ্বারে বসন্ত সবে উঁকি মেরেছে এমন এক দিনে ওরা লক্ষ্য করে, জঙ্গলে ঢোকার মুখে এক কুঁড়েঘর রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। ওরা কৌতূহলী হয়। কোনো এক শিল্পী তার অসামান্য প্রতিভায় স্বল্প সময়ে কুটির বানিয়ে ফেলেছে। গতকালও যার অস্তিত্ব ছিল না। ওরা একটু এগিয়ে যায়। সন্ধে নামছে। ওদের তখনও কলসী ভরতে বাকি । উসখুশ করতে থাকে রাই আর বউগুলো কুঁড়ের ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে। ফিরে যাবে ভাবছে ওরা এমন সময়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে খুব সরু পায়ে চলা পথ ধরে এক পুরুষ বেরিয়ে আসে। মাথায় কাঠের বোঝা। আবছা আলোয় ঠিকমতো দেখা যায় না মুখ। তবে বোঝা যায় পুরুষটি বলিষ্ঠ দেহের। কাঠ নামিয়ে হাসে লোকটা। বলে, “তোমরা বসো এখানে, আমি নদী থেকে রাইয়েরা এবারে লক্ষ্য করে,ঘরের পেছনদিকে ঘাটে নৌকা বাঁধা একটা। ওরা ইতস্তত করতে থাকে। এদিক ওদিক তাকায়। দেখে লোকটার ঘরের ভেতরে তেমন কোনো আসবাব নেই। দু’টো মাটির হাঁড়ি, একটা লমফ, আর একটা পুঁটলি। ওদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, “এই ক’টা জিনিস মাত্র? মাদুর অবধি নাই। কলসী নেই। আনাজপাতি কই? খাবে কী? শোবে কোথাযআরেকজন বলে, “সেসব চিন্তা তোকে করতে হবেনা।… এ লোক এল কোত্থেকে? জঙ্গলের ধারে ঘর বানিয়েছে। ভয়ডর নাই লোকটার?“অনেক দূর থেকে এসেছি গো। ঘুরে ঘুরে বেড়াই। যে জায়গা মনে ধরে সেখানে বাসা বানিয়ে ফেলি। কিছুদিন পরে যখন মনে হয় আবার বেরিয়ে পড়ি। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ দেখি।” ওরা খেয়াল করেনি কখন লোকটা ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটা আবার বলে, “আজ সংস্থান নাই কিছু। সন্ধে হয়েছে। তোমরা ঘরে যাও নিজেদের। কাল বেলা থাকতে এসো গে। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে নদীতে যায়। অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে। এখন জল নিয়ে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যাবে। ওরা তাড়াহুড়ো করে। রাই খালি পেছন ফিরে দেখে। কুঁড়েঘরে একটা হলুদ আভা দেখা যায়। লোকটা বোধহয় লমফতে আগুনপরের দিন নদীর ঘাটে পৌঁছে ওদের একজন বলে, “কীরে? যাবি লোকটার কাছে?”
“আমার কেমন যেন সুবিধে ঠেকছে না।”
“ডাকাত নয় তো?”“চল না, এতোজন মানুষ আছি। ও একা। কী করে নেবে?”
“এক রাতে ঘর তৈরি করে ফেলছে। অলৌকিক পুরুষ হতে পারে। যাওয়া ঠিক হবে না।”নানজনে নানাকথা বলে। রাই চুপ করে শোনে। বেশি কথা কোনদিনই বলে না ও। ওর ঠিক ভয় করছিল না। অল্প কৌতূহল হচ্ছিল লোকটাকে নিয়ে। কিন্তু লোকটার কাছে যেতেও ইচ্ছে করছিল না। ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। চিন্তাভাবনা সব পথ হারিয়ে ফেলছিল।
শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে ঠিক হল―সন্ধে হতে ঢের বাকি। ওরা আজ একটু আগেভাগেই বেরিয়েছিল লোকটার সাথে আলাপচারিতার জন্য। তাহলে এখন আবার এত জটিলতার আছে কী! একবার গেলেই হয়সেইমতো কলসী ঘাটে রেখে ওরা ধীরপায়ে এগোয়। লোকটা আজ বসেছিল কুটিরের পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। ওদের জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছ“বসো বসো তোমরা। তোমাদের আপ্যায়ন করি। তারপর কথা বলব।” বলে লোকটা ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়ওরা বসল সমতল ঘাসবিছানো জমিতে। লোকটা রঙবেরঙের ফল হাতে করে বেরিয়ে আসে।“তোমার নাম কী গো?” ওদের মধ্যে একজন জানতে চায়।
“কানাই গো। মা নাম রেখেছিল। মা যেদিন মরে গেল আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।” লোকটার কথার মধ্যে কিন্তু কোনো পুরানো বেদনার প্রলেপ লাগানো ছিল না। কতো সহজে বলল কথাটা! ওরা অবাক হয়ে চেয়ে থকানাই আবার বলে,“তা তোমাদের কথা বলো কিছু। আমি তো ঘরদোর-ছাড়া যাযাবর মানুষ। আমার তো কেউ নেই যাকে নিয়ে তোমাদের কাছে গল্প করব।ওদের মধ্যে একজন বলল, “আমরা তো গাঁয়ের বউ সব। সারাদিন ঘরের কাজ করি। সন্ধ্যায় জল নিতে আসি। বাড়ি ফিরে বরের সেবা করি। আমাদের ও জীবনে বেশি কথা নেই“তুমি বুঝি নৌকা করে এসেছো?” কেউ একজন জানতে চায়।“হ্যাঁ গো। ওটা আমার ই নৌকা। তোমরা চাইলে ওতে চাপতে পারো। আমি ভালো মাঝি। ভয় নেই তোমাদের।”
কথা বলতে থাকে ওরা। বসন্তের বাতাসে আশেপাশের ফুলগাছগুলো থেকে টুপটুপ করে ফুল ঝরে পড়ে। রাই কথা বলে না। চুপ করে বসে থাকে নদীর দিকে তাকিয়ে। কানাই আজ বিকেল শেষের হলদে আলোয় দৃশ্যমান সম্পূর্ণভাবে। গায়ের রঙটা একটু চাপা, কালোর দিকেই বেশিরভাগটা। চমৎকার দেহের গড়ন―পুরুষালি কাঠিন্য এবং কমনীয়তার মিশেলে তৈরি। মাথার চুল কোঁকড়ানো,কাঁধ পর্যন্ত ব্যাপ্তি। পোশাকে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। গাঁয়ের মানুষদের মতোই গামছার ওপরে কোমরে সরু করে আরেকটা গামছা বাঁধা। রাইর উদাস দৃষ্টি কানাইয়ের চোখ এড়িয়ে যায় না। কানাই বলে ওঠে, ”তা তোমাদের এই বন্ধুটির এত দুঃখ কীসের? ও তো মুখ ই খুলছে না। আমাদের কথাবার্তায় এতটুকুএতক্ষণে বউয়েরা সহজ স্বাভাবিক হয়েছে অনেকটা। ওরা বলে ওঠে, “আরে ওর বর দূরে কাজ করে ,মাসে মাসে দু’দিনের জন্য ঘরে ফেরে। কতোদিন আর শুধু শাশুড়ি বুড়ির সাথে সংসার করা যায় এই বয়সে!তাই ও মনমরা সারাদিন। ” হেসে ওঠে সএবারে রাই মুখ খোলে। প্রতিবাদ করে ওঠে। “না না, মোটেই তা নয়। আমি সূর্য দেখছিলাম। সূর্যের অস্ত যাওয়া প্রতিদিন দেখেও আশ মেটে না।“সে বাপু তুই যাই বল। আমরা কী আর জানিনা। বসন্তের সময় ,বর বাড়িতে থাকে না। এসময়ে মনখারাপ হওয়া স্বাভাবি“চল এবারে, সন্ধে হয়ে এসেছে। শাশুড়ি বকবে আবার কালকের মতো।” রাই উঠে পড়বাকিরাও উঠে পড়ে একে একে। বিদায় চায় কানাইয়ের কাছে। কানাই বলে, “তোমরা ভালোমানুষ। আবার এসো গরিবের ঘরওরা মাথা নেড়ে বিদায় নেযকয়েকটা দিন কেটে যায় এভাবে। ওরা মাঝেমধ্যে কানাইয়ের কাছে যায়। কথা হয়। কানাই বলেছিল বটে,যাযাবর মানুষ ও,বলার মতো কিছু নেই,কিন্তু দেখা যায়, কানাই ই বেশিরভাগ কথা বলছে। রাইয়েরা শ্রোতামাত্র। কানাই যাই বলুক না কেন তাতে ওরা আকর্ষণ অনুভব করে । মন ভালো হয়ে যায় ওদের। ইচ্ছে করে ওর কথা শুনতে ,ওর কাছে বসেকখনও মৃদু প্রগলভ কানাই। একদিন রাইকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে কানাই বলেছিল, “আমি তোমার বর নই, কিন্তু আমিও পারি তোমার মনকে রাস্তা দেখাতে।” চমকে উঠেছিল রাই। এরপর কানাই চোখ টিপে বলেছিল, “বরের কাছে সুখ না পেলে আমার কাছে আসতে পারো।” বাকি সকলে হেসে উঠেছিল। কিন্তু রাই হাসতে পারেনি।
ও পরের দিন থেকে জল আনতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন কানাই একটা অশ্বত্থ পাতায় নখ দিয়ে লিখে বাকি বউদের হাতে রাইকে পাঠিয়েছিল― “যদি ক্ষমা করতে পারো তবে কাল এসো, নৌকায় ঘোররাই সে পাতা ছিঁড়ে ফেলেছিল। বাকি বউদের ওপর ওর কেমন একটা রাগ হচ্ছিল। ওদের জন্যই কানাই এমন কথা বলার সাহস পেল। রাই কেমন যেন গুটিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে ধীরে ধীরে। ওর সঙ্গীরা কিছুতেই ওর মনের নাগাল পাচ্ছিল না। আগের মতো রাই মেলামেশা করে না ওদের সাথে। জল আনতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রাইয়ের শাশুড়ি বাধ্য হয়ে বাকিদের সাথে যেত নদীতে।
দোল উৎসবের আর পাঁচদিন বাকি। প্রতি বছর গ্রামে দোল উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। দিনভর হুল্লোড় ,রঙ মাখামাখি। দুপুরে গ্রামেরই কারো বাড়িতে সুখাদ্যের আয়োজন। তারপর সন্ধ্যায় ভাঙ খেয়ে জোড়ায় জোড়ায় হারিয়ে যাওয়া। তখন প্রেমের সময়। প্রেম উদযাপনের সময়। বাড়ি থেকে বহুদূরে কর্মরত পুরুষেরা,প্রেমিকেরাও ফিরে আসে। গতবারে রাইয়ের স্বামী অয়নও ফিরে এসেছিল। বিয়ের পরে সেই প্রথম ওদের প্রেমের সুযোগ। পূর্ণিমার গোল চাঁদ যখন ঠিক মাথার ওপরে ,পুরো হলুদ হয়ে মানুষের বসন্ত উদযাপন দেখছে তখন রাই-অয়ন মিলিত হয়েছিল ওদের নিজস্ব কুটিরে। রাইয়ের বুড়ি শাশুড়ি উৎসব দেখতে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাই পরিতৃপ্ত হয়নি। অয়ন ছিল অকর্মণ্য। সেদিনের রাত কেটেছিল দুর্বিষহ। তার পর থেকে অয়ন খুব কম আসে বাড়িতে। এবারের পূর্ণিমাতেও আসবে না অয়ন। রাই জানে না কীভাবে অতিবাহিত হবে এবারের উৎসব!সম্পূর্ণ গৃহবন্দি রাই অনুভব করে তার অস্তিত্ব যেন একটু একটু করে ছোট হয়ে আসছে। কীসের জন্য যে এত আকূলতা,এত দহন জ্বালা! মনের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে আসলে কার বিরুদ্ধে ? কে দায়ী আসলে? সখীরা দায়ী? অয়ন? কানাই? নাকি ও নিজেই!
রাইয়ের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত পথে চলতে থাকে। কর্তব্য স্থির করতে না পেরে ও ঠিক করে,পরের দিন জল আনতে যাবে।
সেইমতো পরের দিন যখন নদীর ঘাটে কলসী ডোবায় রাই, ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন হঠাৎ করে জেগে ওঠে। ও শুনতে পায় বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে কানাইয়ের কুটির থেকে। রাইর হাত থেকে কলসী ছেড়ে যায়। ও সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে কানাইয়ের কুটিরের দিকে। কলসী নদীর স্রোতে ভেসে চলে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রাই ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলে সুরের উৎসের দিকে। বাঁশির টানে আবিষ্ট সাপিনীর মতো ধেয়ে চলে কানাইয়ের দিকে। একসময়ে পৌঁছে যায় কুটিরের সামনে। কৃষ্ণচূড়ায় ঠেস দিয়ে বসে কানাই যেন ঝড় তুলেছে। অথচ সে-ঝড় এলোমেলো নয়। তার মধ্যে একটা লয় আছে,নিয়ম আছে, ভালো লাগে সে ঝড়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। রাইয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণই আর থাকে না নিজের ওপর। কবাকি বউয়েরা জল নিতে এসে দেখে এ দৃশ্য। বাঁশি থেমে যায় কানাইয়ের। চমক ভাঙে রাইয়ের। উঠে পড়ে দৌড়তে থাকে বাড়ির পরের দিন মনের সাথে অবিরাম যুদ্ধ করেও শেষ অবধি পরাজিত হয় রাই। প্রতিটি শিরায় রক্তের জায়গায় যেন কোনো দূষিত তরল বইছে ওর। জ্বলতে থাকে সর্বাঙ্গ। বিকেল হতেই ও ছুটে যায় নদীর দিকে। আবার সেই সুরের মূর্ছনা । আবার হারিয়ে যাওয়া। আজ কানাই বাঁশি থামায় সন্ধের অনেক আগেই। বলে, “নৌকাযবিহ্বল রাই বলে, “চলো, যাব আমি।”
জলে নৌকা নামায় কানাই। দক্ষ হাতে চালায় নৌকা। রাই কানাইয়ের দিকে চেয়ে থাকে। বৈঠা টানার সময়ে কানাইয়ের বাহুর পেশী ফুলে ফুলে ওঠে। রোদ ঠিকরে ঠিকরে পড়ে কানাইয়ের গা থেকে। কানাই মজা করে বলে, “আজ সূর্য দেখরাই বলে, “তোমাকে দেখব আজ।”
―“মনের কাছে হেরে গেলে, রাই?”
―“হতে পারে। কিন্তু হেরে গিয়েও আমি পরিষ্কার আজ নিজের কাছে।”―“তুমি নিজেই জানো না, কী চাও তুমি!”
―“এখন জানি। আগে জানতাম না। আমি এরকমই ভেসে বেড়াতে চাই। এরকম করেই সবকিছু পেতে চাই।”―”এত সহজে কি পেতে আছে সবকিছু? সময়কে গড়িয়ে যেতে দাও আরও খানিকটা। তারপরে তুমি যা বলবে তাই হবে।”
ভাসতে থাকে ওরা। দিন শেষ হয়ে আসে। গাংচিলের চিৎকার শোনা যায় আশেপাশে। একঝাঁক মৌমাছি উড়ে যায় সদ্য আবিষ্কৃত ফুলের সন্ধা
দোলের আর দু’দিন বাকি। কিন্তু সকাল থেকে আকাশ কালো। বিকেলে প্রবল বেগে ঝড়-জল আসে। উৎকন্ঠিত হয় রাই। ওকে যে যেতেই হবে কানাইয়ের কাছে। বুড়ি শাশুড়ি ওর আকূলতা টের পায়। বলে, “এত উসখুশ করিস কেন? বৃষ্টিতে বেরোবি নরাই বলে, “হ্যাঁ মা,বেরোতেই হবে।”
―”কেন গো? কোন নাগর তোমার জন্য বসে থাকবে!”
―”সে আছে কেউ। অলৌকিক পুরুষ এক।”
―”কী বলছিস বউ! কিছু বুঝতে পারছি না।” অবাক হয় বুড়ি“কিছু না মা,তুমি কাজ করো।” বলে রাই। বারবার আকাশের দিকে তাকায়। অপেক্ষা করতে থাকে বৃষ্টি শেষ হওয়ার। কিন্তু সন্ধ্যা পেরোয় । বৃষ্টি থামার নাম নেই। রাইয়য়ের পক্ষে অসহ্য হয়ে ওঠে বন্দীদশা। কানাইয়ের নেশা এখন ওর প্রতিটি স্নায়ুতে। মন বশ মানে না। ও মাথায় গামছা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারে। বুড়ি পেছনে চিৎকার করতে থাকে। বৃষ্টির শব্দে সে চিৎকার রাই পর্যন্ত পৌঁছায় না। বুড়ি অবাক হয়ে আকাশপাএদিকে রাই দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে অন্ধকারে পিচ্ছিল পথ ধরে ছুটতে থাকে। রাস্তার আশেপাশে ফোঁস ফোঁস করতে থাকতে থাকে ক্ৰোধী বিষধরেরা। ওদের গর্তে জল ঢুকে গেছে। রাই কোনো কিছুকে পরোয়া করে না। পড়ে যায় হড়কে। তাড়াহুড়ো করে ওঠে। আবার পড়ে। অবশেষে পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাপিয়েও ওর কানে আসে বাঁশআজ রাই কানাইয়ের বাহুতে নিজেকে সঁপে দেয়। কানাই বলে, “এটা আবেগ মাত্র। ভালোবাসা নয়। এটা আকর্ষণ মাত্র, মোহ। প্রেম নয়। তুমি নিজেকে আরো সময় দাও রাই। তোমার মনে এখনও ঠাঁই পায় অতীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে রাই। রাগে ফুঁসতে থাকে। বলে, “আমি থাকব না এখানে আর। কেমন করে তোমার কাছে এসেছি তার সামান্যতম ধারণা যদি থাকত তোমার,একথা বলতে পারতে না।” কানাইয়ের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে আলগা করে কুটির থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেকানাই ওর আঁচল টেনে ধরে। ওকে তুলে নেয় দুই হাতে। রাই গলা জড়িয়ে ধরে কানাইয়কানাইয়ের কুটিরে রাত কাটে রাইয়ের। সকালে চকচকে আকাশে সূর্য ওঠে। রাই ঘরে ফেরে। দেখে,দাওয়ায় বসে আছে,ওর বুড়ি শাশুড়ি। হঠাৎ করে নিজেকে অপরাধী মন“মা,আমাকে বাঁচাও।” কেঁদেকেটে বুড়ির পায়ের কাছে পড়ে রাই। বুড়ি মন দিয়ে সবটা শোনে। রাইয়ের গালে হাত রেখে বলে, “ঘরে আয়। খেয়ে নে কিছু। তারপর দোল এসে যায়। সেজে ওঠে জনপদ। প্রকৃতির আপন রঙবাহারের সাথে মানুষও মিশে যেতে চায় তাদের নিজেদের বানানো রঙ মেখে। রাইয়ের বুড়ি শাশুড়ি নিজের হাতে সুখাদ্য তৈরি করে। রাইকে যত্ন করে খাওয়ায়। সখীরা রাইকে রঙ লাগাতে এলে বলে, “তোদের আর লাগাতে হবেনা রঙ। ওর প্রেমিকের হাতে রঙ মাখবে ও । তোরসন্ধে হয়ে আসে একসময়। বুড়ি চোখের জলে বিদায় করে রাইকে। কপালে চুমু খেয়ে বলে,”নিজের পছন্দের পুরুষের সাথে ভালো থাকিস মা।” রাই শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে বুকানাইয়ের কুটিরে পৌঁছায় রাই। বলে, “আজ আমাকে কৃষ্ণচূড়ার মতো রাঙাওকানাই হেসে ফেলে। বলে “এমনিতেই টুকটুকে ফর্সা তুমি। তোমার গায়ের রঙ সমস্ত ফুলের চেয়েও ভালো।রাইয়ের আজ হঠাৎ গাল লাল হয়ে যায় লজ্জায়। মুখ নিচু করে থাকে ও। কানাই দুই আঙুলে রঙ নিয়ে গালে মাখায় ওর। তারপর কপালে,হাতে,পিঠে,কোমরে ,সারা গায়ে। রাইয়ের শরীরে শিহরণ খেলে যায়। কানাইয়ের প্রতিটি স্পর্শে রাই চমকে চমকে ওঠে। কানাই বলে, “এবারে তোমরাইয়ের মনে হয় পূর্ণিমার চাঁদ হাসছে আজ । কানাই আর রাই জড়াজড়ি করে বসে থাকে গাছতলায়। রাত গভীর হয়। ওরা একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যায়। ভালোবাসার পূর্ণতা খোঁজে ওদের মন। শরীরে শরীর মিশতে থাকে। রাই এতদিনে পরিতৃপ্ত হয়। নিজেকে সুখী নারী মনে হতে থাকে ওর। আজ সবই আছে ওর। একটু পরেই ও কানাইয়ের সাথে বেরিয়ে পড়বে অজানার উদ্দেশ্যে। কানাইয়ের সাথে দেশে দেশে কানাই বলে, “কী ভাবছো?”
“কখন বেরোব আমরা?” বলে রাই।
―”তুমি নিশ্চিত তো?”
―”আমি পরিতৃপ্ত। তোমার সাথেই থাকব।”
“চোখের দিকে চেয়ে বলো আমার।” বলে কানাই।রাই এবারে তাকায় কানাইয়ের দিকে। কিন্তু এ কী? চমকে লাফিয়ে ওঠে রাই। এ কার মুখ দেখছে? ওর কি মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে অতিরিক্ত সুখভোগে। এ যে অয়ন বসে আছে গাছতলায়। মুচকি মুচকি হাসছে। বলে ওঠে, “ বলেছিলাম তো, তোমার মনে অয়ন থাকে। প্রমাণিত হল আজ।”
রাই পিছু হঠতে থাকে। নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস হয় না ওর। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে থাকে বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরে দেখে দাওয়ায় উদ্বিগ্ন চেহারায় বসে আছে অয়ন। পাশে চুপচাপ বসে বুড়ি শাশুড়ি মাটির দিকে চেয়ে।