একালে সেকালেনীল দেওয়ালের ঘর
একালে সেকালেনীল দেওয়ালের ঘর
কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত "কসবার ঐ নীল দেওয়ালের ঘর" বলতে আমি বর্ধমানের কসবার কথা ভাবতাম। এমন তো কতবারই হয় আমরা আসলটা না জেনে, ভুলটা মেনেই একটা গান, একটা মানুষ, একটা জায়গা, এমনকি একটা আস্ত অস্তিত্বকে ভালোবেসে ফেলি। এমনভাবে ভাবে ভালোবাসি, যেখানে সত্যির চেয়ে ঠুনকো বোধহয় আর কিছু নেই, অথচ মিথ্যের বুদবুদগুলো দিব্যি ড্যান্ডেলিয়নদের মাথার মত দুলতে দুলতে আমাদের দূর দূরান্তে, কখনও রোমানিয়া কিংবা কখনো ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোয় নিয়ে চলে যায়।
তখন ক্লাস নাইন। বড়পিসিমনি-দের বাড়ি যাচ্ছি। না, বাস, ট্রেন নয়, বাইকে করে। আমি, মা, বাবা, ভাই, দুখানা ব্যাগ, একটা বাইক। এখনকার কথা না হয় বাদই দিলাম, এমনকি তখনও যদি কেউ শুনত একটা মোটরসাইকেলে চারজন চেপে আসছে, চোখ কপালে উঠিয়ে "বাবা তোরা পারিসও বটে" গোছের বক্তব্য ছুঁড়ে দিত। স্বভাবতই এখন যারা এই লেখাটা পড়ছে তাদের মনে হতেই পারে যে আমরা কেন যেতাম এরকমভাবে! প্রথমত, আমরা যেতাম গ্রামের পথ ধরে, যেখানে মাঝ রাস্তায় এসে নদী পেরোনোর জন্যে খেয়ায় চাপতে হত, এতে করে পিসিমনিদের বাড়ি পৌঁছতে সময় লাগত অনেক কম। আর দ্বিতীয়ত, উৎসাহ; আমার আর ভাইয়ের নৌকা বা খেয়ায় চড়তে এত ভালো লাগতো, আমরা ইচ্ছা করেই বায়না ধরতাম ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার জন্যে। শেষ এবং সবচেয়ে কার্যকরী কারন, বাসে চাপলেই ভাইয়ের বমি হত।
বছরের ঠিক কোন মাস মনে নেই, তবে মনসা পুজো ছিল সেই সময়টায়। বাংলার যে সকল জায়গায় মনসা পুজোর রমরমা বেশী তারমধ্যে সবার প্রথমে পড়ে রাঢ় বাংলা আর নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয়। আমরা যাচ্ছিলাম নদীর পাশের পথটা ধরেই। গ্রামের পথ, লোকজন কম, বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। তখন সবেমাত্র কসবার মনসা মন্দির পেরিয়েছি, বেশ বড় মেলা বসেছিল, মন্দির চত্বরটায়, অথচ লোক নেই। আমার চোখ যদিও মেলার অন্যতম আকর্ষণ নাগরদোলা-টার দিকে যায়নি। আমি খালি দেখেছিলাম ঐ ছোট্ট ভাঙা শানের মন্দিরটা। মন্দির না বলে পুরোনো আমলের এক কুটুরির ঘর বলাই শ্রেয়, আর একারনেই আমার মাথার মধ্যে প্রশ্ন জেগেছিল "অঞ্জন দত্ত কি এখানেই বেলার সাথে থাকার প্ল্যান করেছিলেন?" অবশ্য বয়েস বাড়ার সাথে আমার মনে হয়েছে এই নীল ঘরের সন্ধান হয়তো দত্ত বাবু কোনোদিন জানতেনই না। কিন্তু আমার এখনও মনে হয় দত্ত বাবু আর বেলার সংসারটা "সাদা-কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে" না হয়ে এখানে হলে, ওনারা অন্তত নির্ঝঞ্ঝাটে বাঁচতে পারতেন।
মন্দির পেরোনোর পর খেয়ায় উঠে তখন আমি দামোদর আর বাংলার আকাশের এক হয়ে যাওয়া দেখছি। বাবা হঠাৎই বললেন, "জানিস আমরা চাঁদ সওদাগরের বংশধর? আগে আমাদের বনিক সমাজে কেউ মনসার পুজো করতেন না, পরে বেহুলার আগ্রহে চাঁদ সওদাগর বাধ্য হন মনসার পুজো করতে। যদিও শিবভক্ত থাকায় তিনি মনসাকে ডান হাতে পুজো দেননি, বরং নামমাত্র পিছন ফিরে বাঁ হাতে পুজো সেরেছিলেন"। লোক মতে মনসামঙ্গলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ চরিত্র চাঁদ সওদাগর নাকি দামোদর নদের পথেই ব্যাবসা বানিজ্য করতেন। যার মধ্যে কসবা ছিল অন্যতম। আজ সেই কসবাতেই মনসা পুজো উপলক্ষে রীতিমতো বড় মেলা বসে। চাঁদ, মনসার পুজো করবেন না ভেবেই বেহুলা-লখিন্দরের জন্য এক অতি সুরক্ষিত বাসর ঘর বানিয়েছিলেন, যাতে মনসার কোপ তাঁর কনিষ্ঠতম পুত্রটির ওপর না পড়ে। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি, ঘরের একটি ছোট্ট ক্ষুদ্র দিয়ে সাপ ঢুকে লখিন্দরকে কামড়ায়, সর্পদংশনে প্রাণ যায় লখিন্দরের, ঠিক তাঁর দাদাদের মত। তারপর তো কত কাহিনী! মৃতদেহ নিয়ে বেহুলার নদীপথ যাত্রা। স্বর্গে গমন, এবং লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পাওয়ার পর মর্ত্যে মনসার পুজো শুরু।
এসব গল্প শুনতে শুনতে পিসিমনিদের বাড়ি পৌঁছে গেছি সন্ধ্যে নামার আগেই। মিষ্টি, চা এসব খেতে খেতেই সন্ধ্যে ঘনালো বেশ গাঢ় করে, অমাবস্যা থাকায়, আকাশ যেন আলকাতরার পিচের চেয়েও কালো। গ্রামের সন্ধ্যে এইসময় এক উপভোগ করার বস্তু। চারদিকে অন্ধকার, লোডশেডিংটাও ঠিক সেই সময়েই হল। আমরা ভাই, বোন, দিদিরা উপরের ঘর থেকে নীচে এলাম। দেখি, মাটির ঘরের চাতালের উপর পিসেমশাই, বাবা, পিসেমশাইয়ের মা (সুবর্ণ ঠাম্মা), মেজজ্যেঠু (পিসেমশাইয়ের বড় ভাই) বসে আমতেল মাখানো শুকনো চালভাজা চিবোতে চিবোতে এন্তার আড্ডা দিচ্ছেন। মা আর পিসিমনি তখন হেঁসেলে, চা, তেলেভাজা বানাচ্ছেন। আমিও সেই দলে যোগ দিলাম। মা, পিসিমনিও এলেন, আড্ডাটা যেন আরও জমল।
চারিদিকে নিকষ অন্ধকার; আর পিসিমনিদের চাতালটুকু জুড়ে হ্যারিকেনের আলো। ছোটো ছোটো খুপরির ভেতর রাখা মোমবাতির আলোয় সবার মুখগুলোর রঙ প্রদীপের শিখার মত নরম হলদেটে হয়ে আছে। পিসিমনিদের বাড়িতে তার পরের দিন মনসা পুজো উপলক্ষে "রান্না পুজো", সেই নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্যেই আমাদের যাওয়া। বাঙালির রান্নায় মাছ থাকবেনা তা তো হয়না তাই আমাদের সেইদিনের আড্ডাতেও মাছ নিয়ে বিস্তর চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছিল। সেখান থেকেই আমি জেনেছিলাম, আমরা গন্ধবনিক বা যে কোনো বনিক সম্প্রদায়ের মানুষ বোয়াল মাছ খান না। "কেন খান না?" প্রশ্নটা প্রায় অজান্তেই করে ফেলেছিলাম। উত্তর হিসেবে এখানেও ঘুরে ফিরে সেই বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী। পিসিমনির কাছ থেকে যতটা শুনেছিলাম তার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, বেহুলা, লখিন্দরের কঙ্কাল নিয়ে ভেলায় ভাসার সময় নদীর জলের তোড়ে লখিন্দরের হাঁটুর মালাইচাকি খুলে পড়ে যায় জলে, তখন এক রাঘব বোয়াল হাঁটুর সেই অংশ গিলে ফেলে। এই অসম্পূর্ণ কঙ্কাল নিয়ে বেহুলা অনেক কষ্টে স্বর্গে পৌঁছালেও লখিন্দরের প্রাণ সঞ্চারে ব্যর্থ হন। যার ফলে পুনরায় বেহুলাকে নদী পথে যাত্রা করতে হয় অবশেষে মনসা দেবীর কৃপায় বেহুলা হাঁটুর সেই অংশ খুঁজে পেলেও ক্রোধে তিনি রাঘব বোয়ালকে অভিশাপ দেন, রাঘব বোয়ালের বংশধররা কখনো জলের উপরের স্তরে চলাফেরা করতে পারবে না এবং মৎসকূলের সম্মানের ও যথোপযোগী হবেনা। পরে বেহুলার মান রক্ষার্থে বনিক সম্প্রদায় বোয়াল মাছ ভক্ষণ করেননা, সেই পরম্পরা নাকি আজও চলে আসছে।
গল্প শেষ হতে হতেই প্রায় রাত দশটা বেজে গেল, এরই মধ্যে বিজলি বাতি জ্বলেও গেছে আবার। তাই দেরী না করে খেয়ে দেয়ে আমরা ঘুমোতে গেলাম। রাত হয়ে গেছে অনেকটাই তবু আমার চোখে ঘুম নেই, আমার মাথায় তখন অঞ্জন দত্ত, বেলা বোস, লখিন্দর, বেহুলা মিলে মিশে একাকার।
এমনকি আজও বেলা বোসের গান শুনলে আমার মনে কসবার ঐ ভাঙা শানের নীল চুনকাম করা মন্দিরটাই চোখের সামনে ভাসে, যেন একটা পুরো অস্তিত্ব একাল থেকে সেকালে আসা যাওয়া করছে, যেন এতযুগ পরে এই একটা গানই কেবল বেঁধে রেখেছে আমাকে, দত্ত বাবুকে, বেহুলাকে, বেলা-কে, লখিন্দরকে, আর চেনা-অচেনা, নামি-অনামি মানুষের গল্পগুলোকে। যারা সত্যি-মিথ্যা, মনগড়া বা যুক্তিযুক্ত কথা আর গানের অনেক উর্দ্ধে, যাদের সম্বল করে যখন খুশি স্মৃতি মেদুরতায় হারিয়ে যাওয়া যায়, একাল থেকে সেকালে। যেখানে একটা রাস্তা আছে চলার, আর আছে অনেক কথা বলার...

