Sucharita Das

Drama

4.5  

Sucharita Das

Drama

এক পশলা বৃষ্টিতে,চেরাপুঞ্জীতে

এক পশলা বৃষ্টিতে,চেরাপুঞ্জীতে

6 mins
3.9K



আজকাল একটা ব্যাপার খুব ঘটছে, বিশেষ করে যখন তুমুল বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। তিন সময়ের তিনটি স্মৃতি আমাকে সেই সময়ের সুখ, দুঃখ আর অপার্থিব অনুভূতির কাছে নিয়ে যায়। তিন সময়ের তিন রকমের বৃষ্টির সৃতির মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়, একটা বৃষ্টি স্বপ্ন পুরনের, একটা বৃষ্টি দুঃস্বপ্নের আর একটা বৃষ্টি অপার্থিব সুখের, কল্পনার চেয়েও বেশী বাস্তবে ধয়া দেয়ার।

 

আজকাল টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলেই আমি শিলং এর চূড়ায় চলে যাই যেন! যেদিন শেষ বিকেল আর সন্ধ্যাটা আমার কাছে ছিল অনেক দিনের লালিত স্বপ্নের হাতে ধরা দেয়ার মত। বেশ আগে থেকেই, বিশেষ করে যখন থেকে পাহাড়ে যাওয়া শুরু করেছি, তখন থেকে এই স্বপ্নটা চুপিচুপি বহুবার দেখেছি, একদিন শেষ বিকেলে কোন এক পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে থাকবো, পুরো পাহাড় জুড়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরবে, পাতায় পাতায়, পাহাড়ে পাহাড়ে, গাছে গাছে তার টুপটাপ শব্দ একটা মূর্ছনা ছড়িয়ে দেবে।

 

একটা পাতলা জ্যাকেট গায়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে দাড়িয়ে থাকবো বৃষ্টি ভেজা আর বৃষ্টি ঝরা পাহাড়ের চূড়ায়, কোন কোন পাহাড়ের গায়ে গায়ে ভেসে বেড়াবে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা, কোন কোন পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঠাই নেবে সন্ধ্যাকালের ধোঁয়া ধোঁয়া ঘন কুয়াসা, আর যেখানে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে দূরের কোন পাহাড়ে সেখানে একত্রে আলিঙ্গনাবদ্ধ হবে মেঘ-কুয়াসা আর শেষ বৃষ্টির ছোঁয়া। সবকিছু মিলে একাকার হয়ে যাবে। সবুজ, স্নিগ্ধ, ভেজা ভেজা, বিশুদ্ধ পার্থিব পৃথিবী হয়ে উঠবে অপার্থিবতায় ভরা।

 

ঠিক তেমনই এক অপার্থিব শেষ বিকেলের সেই বৃষ্টিস্নাত পাহাড় চূড়ায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখবো মেঘ-পাহাড়-কুয়াসা আর গাছের লতায় পাতায়, জানালায়, গ্রিলে ঝুলে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা, হাতে থাকবে গরম ধোঁয়া ওঠা কফির মগ, তেমন অপার্থিব মুহূর্তে ধোঁয়া ওঠা কফির মগের সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলবো পুরনো স্বপ্ন সত্য হবার আনন্দে, আকুলতায় আর অজানা সুখে।

 

ঠিক ঠিক আর ঠিক এমন স্বপ্নের মত করেই, এমন ভাবনা আর কল্পনার মত করেই পেয়েছিলাম শিলং এর পাহাড় চূড়ায় এক বৃষ্টি ভেজা, কুয়াসা ঘেরা, মেঘে ভেসে বেড়াবো আর ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ কফির মগ হাতে নেয়া একটা বিকেল। এক স্বপ্ন সত্য হওয়া শেষ বিকেল। এক অপার্থিব জগতের পার্থিবতায় ধরা পরে যাওয়া সন্ধ্যা।   

 

এরপর যখনই ঝিরঝিরে বৃষ্টির ধারা গুলো বড় বড় ফোঁটা হয়ে, মুষলধারে ঝরতে শুরু করে, ভীষণ ভীষণ বেগে বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়, আকাশের ঘন কালো অন্ধাকার মেঘে মেঘে ঘর্ষণে যখন বিদ্যুৎ চমকায় তখন একটা অজানা আনন্দের সাথে একটা দুঃসহ সৃতি চোখের সামনে এসে পরে। শরীরের সমস্ত রোমকুপ গুলো ভয়ে, রোমাঞ্চে আর নিজেকে নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারার আনন্দে আত্মহারা করে দেয়।

 

দিন সাতেক ছিলাম শিলংয়ে, পাহাড় বরাবর পছন্দের আর তাই একটা অবিরল ভালোলাগার স্রোত বইছিলো শরীর বেয়ে । শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছে, গাছ গুলো চনমনে হয়ে আছে। আচ্ছা অসময়ে চান করলে গাছেদের সর্দি লাগার ভয় নেই না? কোনো মা গাছ কি তার ছানা গাছ কে বলে 'এক দিনে দু বার তিন বার ভিজছিস, বর্ষার জল জ্বর আসবে। যা মাথা মুছে নে শিগগির।' ছানা গাছ কি তখন বলে 'মা এক কাপ রোদ দাও না, সকালের রোদের ফ্লেভার দেওয়া'? এই সব হাবি জাবি ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি। চারদিকে পাখিদের বর্ষার ক্লাস চলছে। কিচমিচ কিচমিচ করে বাচ্ছা পাখি গুলো কুচুর কুচুর করে একটু উড়ছে, আমি ক্যামেরা তাগ করছি তারা ফের কিচ কিচ করে দুয়ো দিয়ে অন্য জায়গায় উড়ে পালাচ্ছে। ভোঁ ভোঁ করে ভোমরা উড়ছে, ভেজা মাটি গাছ সব মিলিয়ে চমৎকার একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা জায়গাটায়। এক জায়গায় বসে বসে পাখির ডাক রেকর্ড করতে গেলাম, হতভাগা পাখিটা কি বদ রে ভাই, যেই আমি রেকর্ড অন করছি ব্যাটা টের পাচ্ছে বোধহয় লম্বা একটা পজ দিচ্ছে তারপর আমি পজ করছি ও ব্যাটা ডেকে উঠছে। হলুদ হলুদ ফুল ফুটেছে এক জায়গায়, ছবি তুলতে গেলাম কিরম বিচ্ছিরি এলো!!

 

অনেক অনেকক্ষণ পাহাড়ি জঙ্গল কোনো কথা বলল না আমায়। পাখি নিজের মনে ডাকতে থাকলো, জঙ্গলে পাতা কোনো পাইপ থেকে ছিড়িক ছিড়িক জল ছিটকে পড়ার আওয়াজ আসতে লাগলো, পোকার আওয়াজ হতে থাকলো। চুপ করে পাহাড়ি জঙ্গল কি বলতে চায় শুনতে গিয়ে বুঝলাম আসলে এ সমবেত শব্দ শোনাতে চায় আমায় সে, আমার জ্যাকেটের পকেটে মুঠো ভরে দিয়ে দিতে চায় পাথেয় যাতে অনেক অনেক দিন আমার মন খারাপ না করে অকারণ। সেই যে সেবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ফ্রেন্ডলি আম গাছটার সাথে মোলাকাত হয়েছিলো, ওইই নিশ্চয়ই খবর পাঠিয়ে দিয়েছে বিষণ্ণতা ব্যাধির খপ্পরে পড়ে যাই আমি খালি খালি, অকারণ মন খারাপ সারারে আমার পথ্যি দরকার। প্রকৃতি আমাদের শেষ আশ্রয় আমরা সবাই জানি তবু তা ধ্বংস করার সে কি আশ্চর্য নেশা আমাদের। অদ্ভুত! স্যাডিস্ট না বোকচন্দর বোঝা মুশকিল। চলে যাওয়ার আগে সব্বাইকে থ্যাংকু বলতে ইচ্ছে করছে খুব, মন ভালো হয়ে গেছে আমার, কোনো অভাববোধ কোনো না পাওয়া কোনো রেস আমায় উত্তেজিত করছে না। গাছেরা যে আমাদের থেকে ঢের উন্নতপ্রাণ তা ফের টের পেলাম আরো খানিক পর। আমার আরো খানিকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিলো।।কিন্তু পারমিট একদিন এরই এনেছি আর বন্ধু শেরপাও একদিনের রসদ দিয়েই পাঠিয়েছে। মোবাইলে যোগাযোগ করা যাবে না টাওয়ার নেই। বাংলোয় যাবার আগে ইচ্ছেটা পড়ে ফেলেছিলো বোধহয়।

 

শিলং টা বেশ ঘুরছিলাম, তারপর সেই প্রকৃতির দান, যেটা না হলে পাহাড়ি জায়গায় যাওয়ার মজাই নেই, মানে বৃষ্টি। বৃষ্টি ফোঁটার টুপটাপ শব্দে মনটা ভরে যাচ্ছিলো। গুনগুন করে গাইছিলাম- এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন । কিছুদূর এগোতেই একটা চায়ের দোকান দেখলাম, 20 টাকার একটা বোরো ভাঁড়ে চা নিয়ে যেই চুমুক দিতে যাবো, পেছন থেকে একটা গলার স্বর - বাঙালি? পেছন ঘুরে দেখি ডেনিম জ্যাকেট পরা মাথায় কালো টুপি, মোটামুটি ৫'৯' হাইট হবে একটা ছেলে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। সম্ভবত গান শুনেই আন্দাজ করেছে । আমি বললাম - হ্যাঁ, বুঝলাম টুরিস্ট তাই জিজ্ঞেস করলাম - চেরাপুঞ্জী দেখে এলেন নাকি? ছেলেটি বললো না, তবে এইবার রওনা দেব, আপনি যাবেন? তাহলে একটা গাড়ি তেই শেয়ার এ যাওয়া যেত । একবার ভাবলাম অচেনা লোক, যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তারপর ভাবলাম একে তো বাঙালী আর দেখেও ভালো মনে হচ্ছে, ঘুরে আসা যেতেই পারে ।

অনেক আলাপ আলোচনার পর একটা গাড়ি ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম, রাস্তায় আরো ভাব জমে গেল ওর সাথে । ও হ্যাঁ ওর নাম টা এখনো বলিনি, ওর নাম মেঘ, বয়স 25 । যাই হোক, মেঘের সাথে কথা বলতে বলতে বেশ কিছুটা চলে এল গাড়িটা, রাস্তায় নেমে কয়েকটা ছবিও তুললাম কারণ ওটাই আমার নেশা আর ঘুরতে আসার প্রধান কারণ বটে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে আর পাহাড়ি সবুজ গাছ গুলো যেন হাত নেড়ে ডাকছে ।

 

আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো বেশ, নিজেদের ব্যাপারে অনেককিছু শেয়ার করলাম, ততক্ষনে চেরাপুঞ্জীর প্রায় কাছাকাছি। গাড়ি থেকে নামার সময় ড্রাইভার বাহাদুর কে বলে গেলাম - তোমার কিছু খাওয়ার হলে খেয়ে নিও, আমরা একে ঘন্টা পর আসছি । বাহাদুর এর হাবভাব ঠিক ভালো ঠেকল না, কেমন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আর আধ ভাঙা বাংলায় বললো- ম্যাডাম, জলদি আসবেন, বেশি দূর যাবেন না । প্রথম টাতে অবাক লাগলেও, পরে ভাবলাম মেঘ কালো করে এসেছে আর পাহাড়ি রাস্তা তাই হয়ত ভয় পেয়ে বলছে । আমি আর মেঘ কিছুটা এগিয়ে পাহাড়ের ধারে গিয়ে বসলাম, প্রকৃতি টা কেমন অদ্ভুত সুন্দর ছিল সেদিন । মেঘ কে বললাম দাড়াও তো তোমার কয়েকটা ছবি তুলি, ও কিছুতেই রাজি হলো না, তারপর বললো আমি তোমার ছবি তুলে দি । আমি ক্যামেরা টা ওর হাতে দিলাম ।

তারপর বেশ কিছুক্ষন পর মেঘকে বললাম এখানে তো মোমো খুব ফেমাস , চলো খেয়ে আসি, তাতেও রাজি হলো না । অনেক্ষন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, ছেলেটার কোনো কিছুতেই যেন ইচ্ছেই নেই, শুধু আমার ক্যামেরা টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি যেন দেখে চলেছে । বেশ অনেক্ষন আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম । ছেলেটা নিরুত্তাপ। হঠাৎ দেখলাম বাহাদুর এর গাড়ি র কাছে খুব ভিড় , আমি দৌড়ে গেলাম জানার জন্য , গিয়ে দেখি বাহাদুর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পরে আছে, একটি লোক মুখে জল দিচ্ছে, আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, পাশে একজন বয়স্ক লোক হাতে একটা লোকাল পেপার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আধো বাংলায় বললো, - জানেন দিদি, আমি এই গাড়ির পাশে পাথর এর ওপর বসে পেপার পড়ছিলাম, বাহাদুর ভাই কে আমি অনেকদিন চিনি, এখানে যাতায়াত আছে, একটা খবর পরে শোনাতেই ও কেমন যেন করতে লাগলো, পেপার টা ছিনিয়ে নিয়ে দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেল । ততক্ষনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিছু কি তাহলে অবিশাস্য ঘটে গেছে? পেপার টা চাইলাম ওনাকে । প্রথম পেজের দ্বিতীয় খবর- গতকাল কলকাতার একজন টুরিস্ট, শিলং থেকে চেরাপুঞ্জী যাওয়ার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট এ জীবন হারিয়েছেন । ছেলেটি পরনে ছিল ডেনিম জ্যাকেট, মাথায় কালো টুপি, বয়স ২৫, ৫'৯' হাইট । মৃতদেহ র পাশ থেকে একটি ক্যামেরা উদ্ধার করেছে লোকাল পুলিশ, সম্ভবত ছবি তুলতে ভীষণ ভালোবাসত সে ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama