দুই পৃথিবী
দুই পৃথিবী
বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির উন্মাদনায় প্রকৃতি আজ দুরন্ত!!! এই অঝোর বৃষ্টিস্নাত সন্ধায়, জানালার পাশে বসে অবাক চোখে, বৃষ্টি দেখছে রঞ্জন ...... বাইরের বৃষ্টির, উন্মাদনা দেখতে দেখতে, কখন যে মনের কোণে জমে থাকা মেঘ নিজের অজান্তেই রঞ্জনের চোখে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করেছে, নিজেও তা খেয়াল করেনি.......... হঠাৎ, ফোনের শব্দে চমকে ওঠে রঞ্জন..... অপরিচিত একটি নাম্বার.... ধরলো না রঞ্জন। ভালো লাগছে না কথা বলতে তার.... কোন কোম্পানির ফোন হবে নিশ্চয়ই। বাজুক... বাজতে বাজতে একসময়ে নিজেই বন্ধ হবে। ভুলতে চাইলেও সে আর ভুলতে পারে না কয়েক বছর আগের স্মৃতি। অঝোরে বৃষ্টির ধারা যেন আরও বেশী করে ..... উফ্ফ্ .....আবার আবার ফোনের আওয়াজ। বেজেই চলেছে ... বেজেই চলেছে। বিরক্তি নিয়ে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে . একি!! এতো একই নাম্বার .... প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্বেও, কলটা রিসিভ করে সে
'হ্যালো অনীক ....হ্যালো ... প্লীজ ফোনটা রেখো না
'ধুর.... আপনি কাকে ফোন করেছেন? যত্ত সব রঙ নাম্বার!
ফোনটা কেটে দেয় রঞ্জন। বিরক্ত মনেও একবার মনে হল ও প্রান্তে একজন অপরিচিত মহিলার আকুতি যেন শুনতে পেয়েছে
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার মোবাইলটা বেজে উঠল
নিতান্তই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাইল-এর কল টা রিসিভ করে
'হ্যালো কে আপনি? আমি অনীক নই, রঞ্জন. রঞ্জন মজুমদার। হ্যালো.....শুনছেন? কে আপনি?' ওপাশে হঠাৎ যেন এক রাশ নিরবতা একটু পরে হঠাৎ যেন কানে এল কাঁপা অস্ফুট এক শব্দ
'রঞ্জন?'
চমকে ওঠে রঞ্জন, এতো রিনার গলা এতবছর পরেও সে ভোলেনি রিনার গলার সেই মিষ্টি আওয়াজ ভুলবেই বা কি করে। সে যে এখনও পাগলের মত রিনাকে
মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই কলেজ ছুটির দিনটা
হ্যাঁ রঞ্জন রিনা পাশাপাশি ছিল কলেজ ক্যান্টিনে অপেক্ষায় ছিল আর এক বন্ধুর.... অনীকের জন্যে। বাইরে আজকের মতোই তুমুল বৃষ্টি.... রঞ্জন রিনা ও অনীকের খুব ভালো বন্ধু ছিল। ওরাও তাই। কলেজে রঞ্জনা-রিনা-অনীক এর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব অনেকেরই ঈর্ষার কারণ ছিল। কিন্তু রঞ্জনের মনে এক আলাদা ভালোবাসার জায়গা জুড়ে ছিল রিনা। মনের কথা মনেই থেকে গিয়েছিল রঞ্জনের, মুখ ফুটে বলতেও পারে নি। ক্যান্টিনেও রঞ্জন বলতে গিয়ে রিনার মুখে এক অন্য ছটফটানি , ভালোবাসার আকুতি দেখতে পায়, বারবার অনীকের কথা বলে। ওদের একসঙ্গে সিনেমায় যাওয়ার কথা ছিল। অনীক আসছে না দেখে একসময় রিনা বারবার ফোনে ধরার চেষ্টা করে অনীককে.... লাইন না পেয়ে হতাশ রিনাকে দেখে রঞ্জনের মনে হল কত কাছাকাছি থেকেও কত দূরে আছে রিনা.... রিনার মনের নাগালের অনেক বাইরে তখন রঞ্জন। সেদিন আর আসে নি অনীক।
জানলার বাইরে বৃষ্টিস্নাত রাস্তা দেখতে দেখতে আজও আবার নতুন করে রঞ্জন অনুভব করল সে কত একা .... হ্যাঁ, আজও রিনা আসে নি .... রঞ্জনের মনের কাছে। এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে.... রঞ্জন এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত বর্তমানে। অনেক দিন অনীকেরও খোঁজ পায় নি সে.... একবার শুনেছিল অনীক লেখালেখি করত.... কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বই সংগ্রহের নেশা ছিল ওর.... কবিতার বই। তারপর আর ওর খোঁজ পায় নি।
এতদিন বাদে রিনা অনীককে উত্তেজিত হয়ে খোঁজ করছে কেন....এ প্রশ্নের উত্তর আজ জানতেই হবে রঞ্জনকে। ফেসবুক ঘেঁটে উদ্ধার করে অনীকের হদিশ। এ কি চেহারা হয়েছে অনীকের!! ফোন নাম্বার ও পেয়ে যায় অনীকের। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা করেই ফেলে রঞ্জন। ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে তারা দুই বন্ধুতে একটা কফিশপে মিট করল। সব খুলে বলল অনীক। অনীক রঞ্জনকে অবাক করে দিয়ে বলে যে সে জানত রঞ্জন কতটা ভালোবাসতো রিনাকে। তাই রিনার খুব ভালো বন্ধু হয়েও মন থেকে ভালোবাসতে পারে নি অনীক রিনাকে। রঞ্জনকে ঠকাতে চায় নি সে। অনেকবার রিনা কে বোঝানোরও চেষ্টা করেছে অনীক রঞ্জনের ব্যাপারে। কিন্তু তাতে রিনার জেদ আরও বেড়ে যায়। রিনা তাদের বাড়িতে অনীক কে নিয়ে বাবা মার সঙ্গে আলাপ করাতেও এক সময় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অনীক কর্ণপাত করে নি। অনীকের কবিতা লেখাতেই মন ছিল বেশি.... না হলে যে উপায় নেই অনীকের।
এক সময় রিনা অনীকের কবিতা লেখা নিয়েও প্রশ্ন তোলে.... কবিতা না রিনা... কোনটা চায় সে? অনীকের মনে আঘাত দিয়ে কিছু কথাও বলে বসে অনীককে। রঞ্জনের কথা ভেবে অনীক মনে কষ্ট পেয়েও কিছু বলে নি রিনা কে। কিন্তু অনীক রিনার ভালোবাসা বুঝেও মুখে কিছু না বলে একদিন হঠাৎ রিনাকে ছেড়ে চলে যায় তার পুরনো গ্রামের বাড়িতে। ভুলে থাকার জন্য কবিতা লিখে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিত। একসময় বেশ নাম হল অনীকের ভালো লেখার সুবাদে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনীকের কবিতা বেরোতে লাগল। পরে অনীক শহরে এসে এক ভাড়া বাড়িতে এসে ওঠে। কিন্তু অনীক এখনও রিনাকে ভুলতে পারে নি।
রঞ্জন সব শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। আজ যেন তার সবকিছুই গুলিয়ে যাচ্ছে..... এতদিন বৃথাই রিনার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে থেকেছিল যে নাকি অনীককেই একমাত্র ভালোবেসেছিল.... রঞ্জনকে নয়? আবার রঞ্জনের এত সুন্দর বন্ধুত্ব প্রীতি ও সততাও রঞ্জনকে ভীষণ মুগ্ধ করলো। বুঝতে পারছে না রঞ্জন কি করবে এখন সে.... রঞ্জন যে রিনাকে খুব ভালোবাসতো এটা অনেক আগে থেকে জেনেছিল অনীক এবং সেজন্য বেস্ট ফ্রেন্ড এর ভালোবাসার মানুষকে অনীক আর মন থেকে ভালোবাসতেও পারে নি রঞ্জন কষ্ট পাচ্ছে এই উপলব্ধি করে..... কতটা বন্ধুত্বের সততার প্রতি দায়বদ্ধ থাকলে এরকম হওয়া যায়। রঞ্জন মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞ হল অনীকের কাছে। তখনই ঠিক করল অনীকের মত এত সুন্দর একজন বেস্ট ফ্রেন্ডের ভালোবাসার মর্যাদা রাখবে..... নাই বা পেল রিনার ভালোবাসা.... সবাই তো সবকিছু পায় না জীবনে। কিন্তু এত নির্ভেজাল সৎ বেস্ট ফ্রেন্ড কজন পায় জীবনে? এখন বুঝতে পারল কেন ফোনে রিনা বারবার অনীক কে চাইছিল কথা বলার জন্য....হয়ত অনুতপ্ত এখন.... ক্ষমাপ্রার্থী অনীকের কাছে এতদিন পর। রঞ্জন বুঝতে দিল না তার মনের অবস্থা অনীক কে। রঞ্জন অনীককে বলে রিনার সঙ্গে কথা বলতে..... একবার কথা বলে দেখুক রিনা কি বলতে চাইছে.... রিনার অনীকের প্রতি ভালোবাসা নিশ্চয়ই মরে যায় নি। অনীক অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও রঞ্জনের কথা ফেলতে পারল না।
অনীক ফোন করে রিনা কে ফোনে অনীকের গলা শুনে রিনা ভীষণ আনন্দে লাফিয়ে ওঠে... কাঁপা কাঁপা গলায় অনীককে বলতে থাকে ...
'প্লীজ আমাকে ক্ষমা কর অনীক....আমি অনেক ভুল করেছি...একবার সুযোগ দাও....আমাকে ফিরিয়ে দিও না' ।
অনীক রিনাকে আশ্বস্ত করে তার ভাড়া বাড়িতে আসতে বলে। রঞ্জন অনীককে বলে ওরা নিজেরা একান্তে কথা বলে নিক। রঞ্জন পাশের ঘরে চলে যায়। একটু পরে রিনা আসে। অনেক দিন বাদে তার আগের অনীককে দেখে চমকে যায় রিনা। একি চেহারা হয়েছে অনীকের। অনীকের হাতে নিজের হাতটি রাখতে রাখতে কান্নায় ভেঙে পড়ে রিনা। অনীক একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়েও রিনার মাথায় হাত রাখে।
'আমি ভুল বুঝতে পেরেছি অনীক। তোমাকে দুঃখ দিয়ে গেছি দিনের পর দিন পরে যখন বুঝতে পারি রঞ্জন আমাকেই ভালোবাসতো তখন আমি মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলাম। কিন্ত তখন তো অনেক দেরী হয়ে গেছে কিন্তু আমি যে তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম অনীক তুমি বুঝেও সাড়া দাও নি আমার মনের কাছাকাছি তোমায় পাচ্ছিলাম না কিছুতেই..... তাই মাঝে আমি দিশেহারা হয়ে মনের দোটানায় অন্যরকম হয়ে যাই অনীক....হয়ত তোমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি অনেক....তারপর তুমি যখন চলে গেলে আমায় ছেড়ে.... যোগাযোগ রাখছো না দেখে আমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম..... শেষপর্যন্ত দুকুল হারালাম আমি!!! না রঞ্জন না অনীক!! তাই তোমার সঙ্গে আবার কথা বলতে গিয়ে অবচেতন মনে রঞ্জনের মোবাইলে ভুল করে ফোন করে ফেলি। ওর গলা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারি নি অনীক.... কাঁদছিলাম এক অপরাধ বোধে....জানি না অনীক কি করব আমি...তুমি কি আমায় তোমার মনে একটু জায়গা দেবে না অনীক? বলো অনীক বলো.....'
'হ্যাঁ রিনা... অনীক তোমারই ছিল... তোমারই থাকবে.... নিশ্চিত থেকো'.....
মূহুর্তে রিনা চমকে ওঠে.... কার গলা শুনতে পেল.... রঞ্জন!!!!' পাশের ঘর থেকে রঞ্জনকে আসতে দেখে রিনার চোখে তখন এক অদ্ভুত চমক।
'হ্যাঁ রিনা... এ রঞ্জন ... আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। যে রঞ্জন তোমায় খুব ভালোবাসতো.... কিন্তু তোমার মনের হদিস করতে পারে নি বেচারা।'
'আমায় ক্ষমা কর রঞ্জন.... আমি যে মনে মনে.....' 'থাক আর বলতে হবে না রিনা'
রঞ্জন বলতে শুরু করে....
'ওরে অনীক ভালোবাসা সবাই পায় না রে.... তুই অনেক ভাগ্যবান...এমন ভালোবাসা কে দূরে ঠেলে দিস না বন্ধু আমার... আমিও ভাগ্যবান তোর মতো একজন সুন্দর মনের বন্ধু কে পেয়েছি যে আমার ভালবাসার মর্যাদা মনে মনে এতকাল দিয়ে এসেছে.... আমি এতেই খুশি থাকব রে অনীক.... রিনার খুশি কেড়ে নিয়ে যে আমি ভালো থাকতে পারব না.... আমি যে রিনা কে .... আমি যে
গলা ধরে আসে রঞ্জনের.... রিনার বুঝতে অসুবিধা হয় না .... রিনার ঠোঁটে কাঁপা কাঁপা উচ্চারণ.... 'রঞ্জন'..... রঞ্জনের চোখ তখন ঝাপসা...জলে ভরা চোখে একটু যেন রোদের ঝিলিক...এত বছর পর রিনার ঠোঁটে নিজের নাম শুনতে পেল.... সেই একটা কাঁপা কাঁপা উচ্চারণের 'রঞ্জন' ডাক....এই ভালোলাগা নিয়েই সে কাটিয়ে দিতে পারবে জীবনের বাকি দিনগুলো.... তার মনে গেঁথে থাকবে রিনার মনের আকুতি ... রিনার কাছাকাছি থাকার এই মূহুর্তগুলো সযত্নে সাজিয়ে রাখবে রঞ্জন। আজকে ক্যালেন্ডারের ভ্যালেন্টাইন ডে না হলেও তার মনের গভীরে এই সুখানুভুতিটাই ভ্যালেন্টাইন গিফট হিসেবে ভেবে নিয়েছে রঞ্জন। অনীক বুকে জড়িয়ে ধরে রঞ্জনকে.....
'তোর মতো এত ভালো বন্ধু আর একটিও হয়না রঞ্জন.... রিনার খুশির জন্য তুই যা করলি তার একটাই মানে রঞ্জন.... ভালোবাসার জয় তার অধিকারে নয়..... ভালোবাসার মানুষের খুশিতে, আনন্দে থাকাতেই তার মধুর জয়।'
রিনার সামনে তখন ভালোবাসার দুই পৃথিবী
অনীক ও ..... রঞ্জন।

