Shampa Banerjee

Romance

3  

Shampa Banerjee

Romance

ডায়েরী

ডায়েরী

5 mins
866


আজ আবার শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার বিকেলের গাড়ী টা বেশ লেট করছে,পাপড়ি আজ একটু বেশী ই ক্লান্ত! আজ স্পোর্টস ডে ছিলো স্কুলে।সারাদিন ছাত্রী দের নিয়ে রোদে তাই আজকে আর শরীর দিচ্ছে না।

অবশেষে ট্রেন টা এলো,কোনোরকমে একটা জায়গা ও পেয়ে গেলো পাপড়ি, ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে দীর্ঘক্ষন,চাকদহ র পরে পাপড়ি র ঘুম টা ভাঙলো।আর বেশীক্ষণ নেই,শীত মাখা কুয়াশা ঘন রাত গুলো যেন ট্রেন চলার সাথে সাথে মিশে যেতে থাকে জীবনের অবসন্ন বৈচিত্র‍্যের নানান প্রচ্ছদে।


কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামার আগে হঠাৎ পাপড়ির চোখে পড়লো পাশে একটা কালো রঙের ডায়েরী হয়তো আগে থেকেই ছিলো পাপড়ি খেয়াল করে নি!কার না কার ডায়েরী হাত দেওয়া টা কি উচিত হবে?কিন্তু এক অমোঘ আকর্ষণ, দোলাচল....শুধুই তো একটা ডায়েরী, ফেরত দিয়ে দেবে ডায়েরী র মালিক কে এই মনে ভেবেই ডায়েরী টা নিয়েই পাপড়ি ট্রেন থেকে নেমে পড়ে।


বাড়ী ফিরে ডিনারের পর নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে ডায়েরী টা বার করলো পাপড়ি , প্রথম পাতা!! একি! কার নাম দেখছে সে!? আর স্থির থাকতে পারলো না পাপড়ি , দুরন্ত গতি তে সে পাতা গুলো!! শত তরঙ্গের ঢেউ আছড়ে পড়লো তার হৃদয়ে! প্রতি টা পাতায় তার ছবি আঁকা বা তাকে নিয়ে কবিতা লেখা, সেই সোনালি দিন গুলির নিখুঁত প্রতিচ্ছবি রয়েছে এই ডায়েরী র প্রতি টি ছত্রে! প্রেমিক হাতের নিপুণ আলপনা যেন এই ডায়েরী টি....


সেই সোনাঝুরী, তাদের সেই ছোট্ট সাজানো সুন্দর বাড়ী টা....শতদলের সাথে লুকিয়ে পৌষ মেলার দিন প্রেম করতে যাওয়া!! বিয়ে টা তখন.... নাহ! আর কিছু ভাবতে পারছে না পাপড়ি।

এতো বছর পরেও পাপড়ি কে আজ ও তুমি!!! তাহলে সেদিন তুমি কেনো! আমাকে আমার পরিবার কে ঠেলে দিয়েছিলে এক করাল তমসাচ্ছন্ন রাতে!!


অতীত সমুদ্রের এক করুণ হাতছানি...সেদিন ছিলো শুভ ফাল্গুনের শুভ স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সেই দিন টি,চার হাতের,চার চোখের চিরকালীন হৃদয় বন্ধনে র রঙিন সেই দিন টি!সকাল থেকেই হৃদ যমুনার ফল্গু নদী টি মন মাতাল করা প্রেমের অঞ্জলী নিবেদনে নিবেদিত ছিলো,আনন্দে,উত্তেজনায় এক পাগলপারা অবস্থা পাপড়ির!!

গোধুলী লগনে চার হাত এক হবে সাজো সাজো রব,লাল বেনারসী,সাথে রাঙা চেলী তে মিষ্টি পাপড়ি র থেকে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছিলো না।পাপড়ি সপ্ত সুরের প্রেমের মূর্ছনায় শতদলের ই অপেক্ষায়!!

গোধুলী লগ্ন পেরিয়ে সাঁঝবেলা,সাঁঝবেলা পেরিয়ে রাতের প্রথম প্রহর!দ্বিতীয়! তৃতীয় ! চতুর্থ প্রহর... নাহ... নাহ....শতদল সেদিন আসে নি।

পাপড়ি র বাবা সেদিন অপমানিত, লজ্জিত সমাজ সংসারের কাছে! আর পাপড়ি !তার চোখের জলের লোনা সমুদ্রে মুখ লুকিয়েছে! সেদিন যদি রিনি ঠিক সময়ে এসে না পড়তো তাহলে হয়তো আজ আর পাপড়ি র কোনো..... যাক সে কথা।

তবে জানো পরী! উফফ এই দেখো, এই নাম টাই আজ, তোমার হয়তো আজ ভালো নাও লাগতে পারে,আমার ভালো লাগা?যাক কি বলবে বলো শতদল!ক্ষনিক মুহুর্ত!আজ ও আদরের সেই পরী নাম টা!!চোখে তীব্র অভিমান !! বলো কি বলবে....আমাকে ফিরতে হবে।

তোমার সাথে জীবনে কখনো দেখা হবে ই আমার, সেটা আমিও খুব ভাবতাম,সেদিন বিবাহ লগ্নে আমি তোমার কাছে....আজ .থাক না এসব শতদল, দহনে প্রলেপ আর নাই বা দিলে!প্রলেপ নয় পাপড়ি সত্যি টা বলার একটা সুযোগ ও কি আমি পাবো না এ জীবনে!? শুনছি....

এ চরম অন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই পরী সে আমি জানি।আমি তখন এক রাজনৈতিক পার্টি র সাথে যুক্ত ছিলাম হয়তো তোমার মনে থাকবে।সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলাই ছিলো আমাদের উদ্দেশ্য।

সেদিন সকালে আমাদের গোপন ডেরায় পুলিশ হানা দেয়,দু রাউন্ড গুলি চলে আমাদের কিছু পার্টি সদস্য আহত,এবং নিহত হন।

আমাদের মাষ্টার মাইন্ড তুমি চিনতে বিভাষ দা সকালে আমায় জানায় এবং বলেন আমাদের কিছু মানুষ কে রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পুর্ণ আমার, তখুনি আমাকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে চলে যেতে হবে অতি গোপনে নিরাপত্তা র দুর্ভেদ্য বেড়াজাল ডিঙিয়ে।তাই এমত অবস্থায় সার্থপরের মতো সেদিন!!উপায় ও ছিলো না,যোগাযোগ মাধ্যম তখন এতো উন্নত ছিলো না যে....বাড়ী তেও কাউকেই কিছু না বলে আমি বেরিয়ে যাই , চরম গোপনীয়তা তখন বাঞ্ছনীয়।

জানি পরী, হয়তো তোমার মনে হচ্ছে আমি দায়িত্ব জ্ঞানহীন বা এটা আমার অজুহাত, কিন্তু বিশ্বাস করো পরী এটাই সেদিন সত্যি ছিলো।

একমাস পরে ফিরে এসে সোনাঝুরী তে তোমাদের বাড়ী গিয়েছিলাম,দেখলাম দরজায় বড় তালা, প্রতিবেশী বললেন ওই ঘটনার পরদিন ই তোমরা চলে গেছো, কোথায় গেছো কেউ ই বলতে পারলেন না।এও শুনলাম সেই রাতে তুমি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলে,যদি না ঠিক সময় তোমার একজন বান্ধবী সেই মুহুর্তে না দেখতো নাহলে হয়তো!!!

তারপর বিশ টা বছর অতিক্রান্ত... বিশ্বাস করো পাপড়ি কতো খুঁজেছি তোমায়,রোজ প্রতি টা মুহুর্তে এ চোখের আরশী তে ওই ডায়েরী তে তোমায় এঁকেছি, তোমায় নিয়ে লিখেছি আমাদের স্বপ্নের কথা।স্বপ্ন,কল্পনা,ইচ্ছে গুলো কে সাজিয়ে মালা গেঁথে চলেছি বিশ টা বছর ধরে।

বাবা, মাও গত হয়েছেন বহুদিন এখন এখানেই আমার ছন্নছাড়া জীবন ।

গতকাল ওই ডায়েরী টাও হারালাম কষ্ট হচ্ছিলো খুব! নৈহাটিতে একটা কবি সম্মেলনে...শতদল তুমি এখনো!?ওই আর কি,কবিতা নিয়ে থাকা মানে তোমায় নিয়ে থাকা,তোমায়ভেবে লেখা,

আসলে ডায়েরী টা সবসময় আমার কাছেই থাকে,ফেরার সময় ট্রেন চলার সাথে সাথে মাঠ , ঘাট, প্রান্তরে যেন তোমায় দেখছিলাম,তোমারি ছবি আঁকছিলাম।কখন ডায়েরী টা পাশে রেখেছি ভীড় ভাট্টায় নামার সময়......কি ভাগ্যিস!! পাপড়ি তোমার হাতে....

কিছু বলো পরী, সত্যি শতদল কখনো ভাবতে পারি নি এ জীবনে আর তোমার সাথে....

সেই ঘটনার পর আমরা কৃষ্ণনগর চলে আসি, তারপর বাবা আর বেশী দিন বাঁচেন নি।কোনোরকম একটা মাথা গোঁজার আশ্রয়ে মা আর আমি থাকি।কোলকাতায় একটা স্কুলে পড়াই,এই আমার জীবন কড়চা। এবার চলি তাহলে! ডায়েরী টা ফেরত দিতে এসেছিলাম, তবু এই ডায়েরী টার জন্যে পরী তোমাকে....চশমা পড়ে তোমায় বেশ লাগছে,দাঁড়াও একটা স্কেচ নিয়ে নি,পরী তোমার মনে পড়ে এই পরী নাম টা শুধু...... কতো স্বপ্ন, কবিতা শুধু এই নাম টা ঘিরে........অনেকটা দূর ফিরবো শতদল সত্যি ই এবার আমায় বেরোতেই হবে।পরী , আমি না হয় তোমায়....চিন্তা করো না।

পাপড়ি উঠে দাঁড়িয়েছে শতদল হাত টা টেনে মাঝে না হয় বিশ টা বছর .... আমি না হয় মধ্য পঞ্চাশ, তুমিও পরিণত, খুব কি দেরী হয়ে গেছে পাপড়ি?এবার আর কোনো ভুল হবে না দেখো?


,একটু থমকে পাপড়ি ... চোখ সিক্ত হয়ে আসে পাপড়ির,এতো বছর ধরে তোমার হৃদয় শতদলে পাপড়ি মেলেই তো ছিলাম,আছিই আজ ও।

পাপড়ি গাইবে সেই গান টা তুমি অপূর্ব গাইতে"তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে"।

শতদল আজ যে তোমাকেও গাইতে হবে,তুমি তো শুরু করো আমি না হয় গলা মেলাবো।দুজনেই আজ সুরে সুরে গেয়ে উঠলো "আমি ডুবতে রাজী আছি,আমি ডুবতে রাজী আছি".....শতদল আজ বহুদিন পরে খোলা গলায় গাইছে আজ এই মুহুর্তেও আমি তোমাতে ডুবতে রাজী আছি"।

উফফফ!!!হাতের ডায়েরী টা পড়ে গেলো যে শত.....ওই ডায়েরী টাই কিন্তু!!! দুষ্টু কোথাকার!!!আজ যে তুমি আমার জীবনে পরী..... !!


Rate this content
Log in

More bengali story from Shampa Banerjee

Similar bengali story from Romance