Pratiti Choudhuri

Inspirational

3  

Pratiti Choudhuri

Inspirational

দায়িত্বের ঘাত প্রতিঘাতে

দায়িত্বের ঘাত প্রতিঘাতে

15 mins
9.5K


"বলছি অভ্রের স্কুলে টিউসডে মিটিং আছে, তুমি এবারটা এ্যাটেন্ড করতে পারবে?" কর্ণফ্লেক্সের বোলটা টেবিলে নামাতে নামাতে জিজ্ঞাসা করলো অনিন্দিতা।

স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই সুদীপ্ত উত্তর দিল, "আমার কি করে হবে অনু! তুমি তো জানো ওই একটা দিনই আমার অফ ডে, তিন দিন আগে থেকে আইনক্সে যাওয়ার প্রোগ্রাম ফিক্সড হয়ে আছে৷কতো দিন পর এই গেট টুগেদারটা..."

-"না মানে বলছিলাম অন্য একটা দিন যদি অফিসে লিভ ম্যানেজ করতে পারতে!"

-"সেটা কি করে সম্ভব! রাকেশ তো টিউসডে রাতের ফ্লাইটেই সিঙ্গাপুর চলে যাবে। ইনফ্যাক্ট ওকে ড্রপ করেই আমরা ফিরব।"

সুদীপ্তর কলেজ ফ্রেন্ড রাকেশ সিঙ্গাপুরে অফিস জয়েন করার পর ফার্স্ট টাইম ইন্ডিয়া এসেছে, তাই গেট টুগেদারটা মেইনলি ওকে নিয়েই। তাছাড়া সুশোভনদা, সৌরভদা, অরুণদা, মানে সুদীপ্তর ফ্রেন্ড গ্রুপের সব ফ্রেন্ডরাই থাকবে। সব কিছুই অনু জানে। তবুও যদি কোনো ভাবে কয়েক আওয়ারসের জন্য ম্যানেজ করে অভ্রের প্যারেন্ট মিটিংটা এ্যাটেন্ড করে আসতে পারতো সেই ভেবে বলা।

যদিও অভ্রের স্কুলে বেশির ভাগ গার্জেন মিটিং গুলো অনু একাই যায়, কিন্তু এই বারটা ভীষণ চাপে পড়ে গেছে ও। কারন অনুর নিজের স্কুল নবজীবনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একটা তিন দিনের ট্রেনিং এ যেতে হচ্ছে। ট্রেনিংটা 'অনলি ফর ফিমেল টিচার', স্পেশালি প্রি-প্রাইমারি সেকশনের বাচ্চাদের সাইকোলজিক্যালি বুঝতে পারা নিয়ে ট্রেনিং। আর অনুর স্কুলে এখন ওই একমাত্র ফিমেল স্টাফ, কাজেই ট্রেনিং টা নেওয়া ছাড়া ওর কিছু উপায়ও থাকেনি।

অভ্র হবার পর সুদীপ্ত অবশ্য অনুর এই চাকুরী করা নিয়ে অনেকবার আপত্তি করেছে। কিন্তু অনু কিছুতেই ওর শিক্ষকতার জীবন থেকে সরে আসতে পারেনি। সুদীপ্তর বারবার বোঝানো শর্তেও অনু একটাই উত্তর দিয়েছে যে অভ্রর সাথে ওর টানটা মাত্র কয়েক বছরের, সেখানে নবজীবনপুর বিদ্যালয়ের সাথে ওর অচ্ছেদ্য বন্ধনটা আজ বারো বছরেরও বেশি। আর অনু শুধুমাত্র কিছু টাকার জন্য কাজটা করেনা, ওর জীবনের সাথে এই স্কুল, টিচিং, সম্মান সব কিছু খুব বেশি জড়িয়ে আছে।

ট্রেনিং থেকে টিফিন টাইমে ডিপারেচার দিয়ে কোনো রকমে বেরিয়ে হাত ঘড়িটাই দেখল অনু দুটো বাজতে দশ। তাড়াতাড়ি বাস ধরে অভ্রের স্কুলে না পৌঁছতে পারলে স্কুলের সিকিউরিটি গার্ড হয়তো আর ভিতরে ঢুকতে এ্যালাও নাও করতে পারে।

অনুর বেশ অবাক লাগে একই শ্রেণি পঠনপাঠনের জন্য স্কুল অথচ, কতো ডিফারেন্স ওর নিজের স্কুলের সাথে অভ্রের এই স্কুলের। অনু প্রথম দিকে চেয়েছিল অভ্র ওর স্কুলেই পড়বে, কিন্তু অনুর স্কুলের এ্যাডমিশন এজ যেখানে ফাইভ প্লাস, সেখানে এই স্কুলে টু এন্ড হাফেই এ্যাডমিশন৷তাই এই প্রায়ো-ইয়ারস'গুলো অভ্রকে বাড়িতে বসিয়ে রেখে নষ্ট করতে চায়নি। তাছাড়া সুদীপ্ত তো কোনো ভাবেই রাজী হতো না ওর ছেলেকে কোনো বাংলা সরকারী প্রাইমারী স্কুলে পড়াতে! তাই এই জোসেফ পাবলিক স্কুলে অভ্রের এ্যাডমিশন৷অভ্র এখন ফাইইউ.কে.জি তে পড়ে।আর এখনই ইংলিশ স্পিকিং, গ্রামার, ম্যাথামেটিক্স, জিওমেট্রি, ক্যারিওগ্রাফি, আর্ট, স্পোর্টস, মিউজিক, কি নেই! আর অনুর স্কুলে ওই 'এজে' শুধু এ,বি,সি,ডি... একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ স্লেটে লিখে দাগা বুলোনো পর্যন্তই সিলেবাস।

সিকিউরিটির রেজিস্টারে সাইন করে অভ্রর স্কুলে ঢুকতে অনুর প্রায় তিনটে বেজে গেছে। প্রতি মাসের সেকেন্ড আর ফোর্থ স্যাটারডে মেইনলি সেকেন্ড আওয়ার্সে একটা করে টিচার গার্জেন ফেস টু ফেস মিটিং অভ্রর স্কুলে থাকেই। এইবারটা এ্যানুয়াল স্পোর্টস নিয়ে। স্নিগ্ধা ম্যাম স্পেশালি অনুকে বোঝাচ্ছিল অভ্রর ঘাটতিগুলো ঠিক কোথায়! আর্ট বা স্টাডিতে হাই পারফর্ম করলেও খেলার মাঠে ও কেমন একটা মুষড়ে থাকে।

আগেরবার অনু অভ্রদের এ্যানুয়াল স্পোর্টসে যেতে পারেনি। তিনটে ইভেন্টে নাম ছিল ওর। বিস্কুট রেস, ফ্রগ রেস আর এগ এন্ড স্পুন রেস। কিন্তু খেলার কোনো ইভেন্টেই স্টার্টিং লাইনে দাঁড়াতে চায়নি। ম্যামরা একটু জোর করতেই কান্নাকাটি শুরু করে। শেষে ওনারা বাধ্য হয়ে গার্জেন কল করে৷দুপুরের পর সুদীপ্ত এসে অভ্রকে নিয়ে যায়।

অনু বোঝে আউটডোর এক্টিভিটিসগুলো এই বয়সে অভ্রর কতটা জরুরী। বিকেল দিকে প্রায়ই অনু পার্কে বা কাছের প্লে-গ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়ে অভ্রকে প্র‍্যাক্টিসও করায়।

স্নিগ্ধা ম্যাম অনুকে বলল এবারও এ্যানুয়াল স্পোর্টসের জন্য ওরা স্কুলের সবাইকে প্রিপেয়ার করেছে। আর এবার যেন অনু অবশ্যই ওইদিন গ্রাউন্ডে যায়। আগের বার অনুর খেলার মাঠে না থাকা নিয়ে সুদীপ্ত বেশ রাগারাগি করেছিল। সুদীপ্তর ধারনা অনু থাকলে সেদিন অভ্র মোটেও ওরকম আচরন করতোনা। অভ্রের অন্যান্য ফ্রেন্ডসদের পেরেন্টদের সাথে অনুকে না দেখতে পেয়েই অভ্র কোনো ইভেন্টে পার্টিসিপেট করতে চায়নি।। বেশ কিছুদিন তো অভ্রের মনে একটা ট্রমা টাইপ তৈরি হয়েছিল। ও আর প্লে-গ্রাউন্ডে যেতেই চাইছিল না। তারপর অনু কয়েক মাস ধরে রোজ নিজে বিকেলে গ্রাউন্ডে নিয়ে যেয়ে প্র‍্যাক্টিস করিয়ে অভ্রের মধ্যকার ট্রমা টা দূর করেছে।

অনুর মাঝে মাঝে বেশ হাসি পায়। এই সব পাবলিক স্কুল-একাডেমি গুলোতে কতো রকমের মজাদার সব আউটডোর ইভেন্ট। কোনো ইভেন্টে হাত বাঁধা অবস্থায় ছুটে গিয়ে বসে আটার থালা থেকে মুখে করে লজেন্স বার করা, কোথাও কোমরে বেলুন বেঁধে দেবে, সেটা হাতে ছাড়া অন্য ভাবে ফাটিয়ে ছুটে যেতে হবে ফিনিশিং লাইনে, আবার কোনো ইভেন্টে দড়িতে বাঁধা ঝুলন্ত বিস্কুট থেকে এক টুকরো কামড়ে মুখের মধ্যে নিয়ে ছুটতে হবে শেষ পর্যন্ত।

প্রায় কয়েক ডজন খেলা। যাতে প্রতিটা গার্জেন বেশ গর্বিত চিত্তে বলতে পারে আমার ছেলে বা মেয়ে দুটোতে ফার্স্ট, তিনটে সেকেন্ড ইত্যাদি, ইত্যাদি।

আগেরবার অন্যান্য পেরেন্টসদের কাছে সুদীপ্ত বেশ অপ্রস্তুতে পড়েছিল। বিশেষ করে সবাই যখন বলছিল "অভ্রর তো স্টার্টিং লাইনে দাঁড়াতেই ভয় করছিল। ছুটবে কোথা থেকে!" বা "সে কি, অভ্র পার্টিসিপেটই করলো না! আমাদের অংশুমান তো দুটোতে ফার্স্ট আর একটাতে একটুর জন্য সেকেন্ড হয়ে গেল।" অনুর যদিও এই ধরনের মন্তব্যে হাসিই বেশি পায়। মনে হয় রেসটা ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠে কম, বাবা মায়ের আলোচনায় বেশি। এমন ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা নিয়ে অনুর খুব একটা মাথাব্যথা নেই, তবে অভ্রর স্টার্টিং লাইনে একেবারেই না দাঁড়াতে চাওয়াটা ওকে ভাবিয়েছিল।

অনুদের সরকারী স্কুলগুলোই একদম অন্যরকম। কয়েক শো ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র আট দশ জনই পুরস্কার জিতে আনে। অনুদের মতো প্রায় কুড়ি-বাইশটা স্কুলের খেলা একসাথে হয় একটা গ্রাউন্ডে। তাও ওই টিচারদের থেকে চাঁদা তুলে। তাতে ইভেন্ট বলতে ১০০ মিটার দৌড়, ২০০ মিটার দৌড়, উচ্চ লম্ফ, দীর্ঘ লম্ফ, এই সব। ওই আটা লজেন্স, পাজেল সলভ, স্পুন এন্ড এগের মতো সফিস্টিকেটেড গেমস নয়। আর অভ্রদের একাডেমির মতো স্পেশাল ইউনিফর্ম, খেলার সক্স, কেডস এই সবেরও বালাই নেই। ছেঁড়া গেঞ্জি, খালি পায়ে সব যা ছোটে মাঠ কেঁপে যায়। অনু মাঝে মাঝে ভাবে এদের দু একটা যদি ভুল করে এই সব পাবলিক স্কুল বা একাডেমিতে ঢুকে পড়তো, তাহলে ওই 'আমার অংশুমান দুটোতে ফার্স্ট', 'আমার অভিলেখা তিনটেতে সেকেন্ড' দের কি অবস্থাটাই হতো!

নভেম্বরের প্রথম থেকেই এবার শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। ১১ই ডিসেম্বর অভ্রর স্কুলে স্পোর্টসের ডেট ঠিক হয়েছে। অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলে সুদীপ্তও অভ্রকে নিয়ে সামনের গ্রাউন্ডে প্র‍্যাক্টিসে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগে কেনা কেডসগুলো একটু হার্ড টাইপ হওয়ায় সুদীপ্ত আবার এক জোড়া সফট কেডস দিল্লী থেকে অর্ডার করে অভ্রর জন্য আনিয়েছে।

যেদিন সুদীপ্ত যেতে পারেনা, অনু নিয়ে যায় অভ্রকে গ্রাউন্ডে। অনেকবার অনু অভ্রকে বুঝিয়েছে নার্ভাস হওয়ার কিচ্ছু নেই। ফার্স্ট হতে হবে এরকমও কোনো ব্যাপার নেই। সবার সাথে ছুটবে, সব বন্ধুদের সাথে পারফর্ম করবে, তাহলেই হবে। যদিও অনু জানে অভ্রর কাছ থেকে সুদীপ্তর এক্সপেক্টেশন অনেক বেশি, তাও অনু সেটা অভ্রকে বুঝতে দিতে চায়না।

অফিসের একটা কাজে ডিসেম্বরের ফার্স্ট উইকেই সুদীপ্তকে পাটনা যেতে হবে, ফিরবে প্রায় দিন দশেক পর। তাই অভ্রকে নিয়ে টেনশনটা ওর খুব বেশি। এবারও যদি স্টার্টিং লাইনে দাঁড়িয়ে ছুটতে না চায়, কান্নাকাটি শুরু করে! অনু যদিও সুদীপ্তকে বলেছে এরকম কিছু হবেনা এবার। তাছাড়া যখন অনু নিজে প্রেজেন্ট থাকবে ওখানে, সমস্যার কিছু নেই।

অনুর স্কুল থেকে এবার বড়ো দল বালিকা বিভাগে একটা মেয়ে ১০০ মিটার আর ২০০ মিটার দুটো ইভেন্টেই ফার্স্ট হয়েছে। ওদের সরকারী প্রাইমারী স্কুলগুলোতে যেমন অতো সব ইভেন্টও নেই, তেমনি একজন দুটোর বেশি ইভেন্টে নামও দিতে পারেনা। মারাত্মক ছোটে মেয়েটা। আগের বার যখন টু'তে পড়তো তখনই দুটো ইভেন্টে ফার্স্ট হয়ে সার্কেল থেকেও প্রাইজ নিয়ে এসেছিল৷ কিন্তু পায়ে খুব জোর চোট লাগার জন্য আর সাব ডিভিশনে খেলতে যেতে পারেনি। এবার অনুদের স্কুলের সবার আশা সুপর্ণা হেমব্রম ওদের স্কুলের নাম ডিস্ট্রিক্ট লেভেল পর্যন্ত ঠিক নিয়ে যাবে।

অনুদের স্কুলের সাবডিভিশনের খেলাও ১১ই ডিসেম্বর। অনু আগের থেকেই ছুটি নিয়ে রেখেছে ওই দিন যেতে পারবেনা বলে। তবে বারবার সুপর্ণাকে বলেছে সাবধানে রেগুলার প্র‍্যাক্টিস করার জন্য, আগের বারের মতো হাতে পায়ে চোট লাগালে এই বারের সুযোগটাও মিস হয়ে যাবে।

অনু জানে এই সুপর্ণার মতো ছেলে-মেয়ে গুলোর বাড়িতে জানেও না কতো কি প্রতিভা লুকিয়ে আছে এদের মধ্যে। সরকারী স্কুলে গুটি কতক ভালো পড়াশুনো করা ছেলেমেয়ের ভিড়ে হারিয়ে যায় লাস্ট বেঞ্চে বসা সুপর্ণার মতো মেয়েদের নাম। আগের বার সার্কেল থেকে দুটো প্রাইজ নিয়ে আসার পর সুপর্ণার সাথে কথা বলে অনু জেনেছে ওরা পাঁচ বোন, এক ভাই। সুপর্ণার পরেও ছোটো দুটো ভাই বোন। বাবা-মা, বড়ো দুই দিদি ইঁটভাটায় কাজ করতে গেলে, ঘরের দিদি রান্না চাপালে ওকেই নাকি দেখতে হয় ছোটো ছোটো ভাই বোন দুটোকে। অনু যখন সুপর্ণাকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করেছিল ওর বাবা মা সার্কেল থেকে প্রাইজ নিয়ে আসায় কি বলল, সুপর্ণা উত্তরে বলেছিল "কুছু বলে নাই গো!"

অনু জিজ্ঞাসা করেছিল,-

"দেখিয়েছিলি প্রাইজগুলো?"

সুপর্ণা উত্তরে বলেছিল,-

"হাঁ মেডাম, দেখাছিলুম। বলল যা ওখন বাস্কায় তুলে রাখ গা।"

সত্যিই কতো তফাৎ নামি দামি একাডেমিতে পড়া ছেলেমেয়েগুলোর পেরেন্টসদের সাথে এদের বাড়ির লোকেদের। ওই সব পাবলিক স্কুলের ছেলেমেয়েরা যদি এরকম কোনো প্রাইজ নিয়ে আসতো তাহলে সেই প্রাইজের স্থান হতো চকচকে মার্বেলের বিরাট ডাইনিং এর শো'কেসের সব চেয়ে উপরে। স্লাইডিং কাঁচের ভিতর জ্বলজ্বল করতো গৌরবান্বিত সেই প্রাইজ। বাবা মা গর্ব ভরে দেখাতো আরো দশ জনকে তাদের ছেলে বা মেয়ের কৃতিত্বের স্মারক। কিন্তু সুপর্ণার মতো প্রতিভাদের জায়গা সত্যিই মাটির ঘরের বাক্সের অন্ধকারে।

আজকে অভ্রর স্কুলে এ্যানুয়াল স্পোর্টস। অনু নিজেই অভ্রকে স্কুলে নিয়ে যাবে। অভ্রও খুব খুশি। রোজ রোজ স্কুল বাসে করে স্কুল যেতে অভ্রর একদমই ভালো লাগেনা। প্রায়ই অভ্র অনুকে বলে, "মাম্মাম, সবার মতো তুমি কেন আমাকে স্কুলে দিতে যাওনা? আন্টিগুলো এক্সামের সময় সারাদিন স্কুলের গার্ডেনে বসে থাকে, তুমি কেন থাকো না?"

অনু বোঝায়, "দেখো অভ্র, আন্টিদের তো স্কুল যেতে হয়না মাম্মামের মতো৷তোমার মাম্মামের স্কুল আছে না?"

অভ্র বলে, "তাহলে আমি তোমার সাথে তোমার স্কুলে যাবো।"

অনু বোঝে অভ্রের মনে জমা ওর প্রতি চাপা অভিমানগুলো। অভ্রকে যথেষ্ট টাইম দেওয়ার চেষ্টা করলেও যে কিছু ঘাটতি থেকেই যায়, তা অনু জানে। আর এই নিয়ে সুদীপ্তর সাথেও মাঝে মাঝে ঝামেলা হয় ওর। তাও অনুর আশা একদিন ঠিক অভ্র বুঝবে ওর মায়ের পরিস্থিতিটা।

অভ্রকে রেডি করতে করতে অনুর মোবাইলটা বেজে উঠলো। অনুর স্কুলের হেড মাষ্টারের ফোন। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই হেড মাষ্টার বলতে শুরু করলেন,

-"অনিন্দিতা, বলছি সুপর্ণাকে তুমি মাঠে নিয়ে যেতে পারবে? শেখর বাবু যেতে পারছেন না, আজ ভোরে ওনার বাবার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় হসপিটালাইজ করতে হয়েছে। আর আমাকে তো স্কুলটা খোলা রাখতে হবে।"

অনু বলল,-"স্যার আমি মানে, আজ তো অভ্রর স্কুলে  এ্যানুয়াল স্পোর্টস... বলছি সুমন বাবুকে বললে হয়না?"

-"আরে বলাই হয়নি, কাল সন্ধ্যায় ফোন করেছিল সুমন। ওর তো মেয়ে হয়েছে, কলকাতা থেকে ফেরেইনি এখনো! কি করা যায় বলো তো?"

-"সুপর্ণার বাড়ি থেকে যদি কেউ..."

-"আরে দেখো না, সেই সাতটার থেকে আমার বাড়িতে এসে বসে আছে মেয়েটা, বলছে বাবা মা মুড়ি খেয়ে ভাটায় চলে যাবে, কেউ যাওয়ার নেই। আচ্ছা সুপর্ণাকে দিচ্ছি তুমি কথা বলো তো...."

সুপর্ণা ফোনের ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, "মেডাম গো, এবারেও আমার ডিস্টিকে যাওয়া হলো নাই। শেখর সের না আইলে কার সাথে যাবো?"

অনু বোঝাবার চেষ্টা করলো বাড়ির কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। সুপর্ণা বলেই চলেছে, "কেউ যাবেক নাই আমার লেগে। বলছে ভাটায় না গেলে পয়সা জুটবেক নাই, খাবি কি! তুমি লিই চলোনা মেডাম।"

হেডমাষ্টার ফোনটা সুপর্ণার কাছ থেকে নিয়ে বলল,

-"পায়ে চোট লেগেছে, ইনজিউরড বলে দিচ্ছি। নিয়ে যাবার তো কেউ নেই। আর স্কুলের একজনের জন্য পুরো স্কুল বন্ধ করে আমার তো আর যাওয়া চলবেনা।"

এদিকে সুপর্ণা হেডমাষ্টারের ফোনের পাশে দাঁড়িয়ে বলেই চলেছে, -"আমার এবারে পায়ে চোট লাগে নাই গো। আমি খেলতে যাবো।"

অনু এপাশ থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সুপর্ণার কান্না ভেজা গলায় কথাগুলো। আর কিছু ভাবতে না পেরে অনু শুধু বলল, "আমি এক ঘন্টার মধ্যে যাচ্ছি। ওকে তৈরি থাকতে বলুন।"

অভ্র বেশ বুঝতে পেরেছে কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে, ওর মাম্মাম আর ওর সাথে যেতে পারবেনা। তাই মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে সাদা প্লে ইউনিফর্মটা পরে। অনু কেডসগুলো পায়ে পরাতে পরাতে বোঝাতে লাগলো অভ্রকে,

-"একটা দিদিকে না অনেক দূরের একটা মাঠে খেলতে যেতে হবে। দিদিটার সাথে কেউ যাবার নেই। দিদিটার তো কোনো বন্ধুও নেই। দিদিটা খুব কাঁদছে। তাই মাম্মামকে একটু যেতে হবে। কিন্তু মাম্মাম প্রমিস করছে সন্ধ্যায় যখন অভ্রের স্কুলে সকলকে প্রাইজ দেবে, আর অভ্রও প্রাইজ পাবে, মাম্মাম ঠিক পৌঁছে যাবে অভ্রের স্কুলে।"

অভ্রর ওর মাম্মামের সাথে আর একটাও কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। ওর বারবার মনে হচ্ছে ওর মাম্মাম সত্যিই ওকে একটুও ভালোবাসেনা।

অভ্রকে স্কুলবাসে চাপিয়ে অনু নবজীবনপুর যাবার বাসে উঠল। অনু জানে আজ ওর অভ্রের সাথে থাকাটা উচিত ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক অভ্রের সাথে না গেলেও অভ্র সব ইভেন্টে খেলতে পারবে, আর অভ্রের স্কুলের ওই বাচ্চা বাচ্চা খেলায় হার-জিত টা তেমন কিছু ইম্পর্টেন্ট না। অভ্র ফার্স্ট হোক বা লাষ্ট তাতে বিরাট কিছু পরিবর্তন হয়ে যাবেনা। কিন্তু সুপর্ণার সাথে যদি ও না যায়, তাহলে সুপর্ণার আর আজ খেলতে যাওয়াই হবেনা। মেয়েটার এক বছর ধরে করা প্র‍্যাক্টিস, গত বছর থেকে দেখা স্বপ্ন সব বিফলে যাবে। তাছাড়া একবার জেলাস্তরে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যদি ও কোনো স্থান পেয়ে যায়, তাহলে ওর জীবনপথ অনেকটা পালটে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

জোসেফ পাবলিক স্কুলের খেলার মাঠটা আজ দারুণ করে সাজিয়েছে। মাঠের মাঝে আবির দিয়ে রঙ্গোলী আঁকা। চারপাশে রকমারি রঙের ফ্ল্যাগ। অভ্রর সব ফ্রেন্ডরা খেলার ইউনিফর্ম পরে এসেছে। মাঠের একপাশে ছোটার জন্য সাদা সাদা দাগ কাটা। ম্যামদের বসার জায়গাটা নানা রকম ফুলের টব দিয়ে সাজানো। এসব দেখেও অভ্রর চোখদুটো জলে বারবার ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। ঠোঁটগুলো ফুলে উঠতে লাগলো মাম্মামের প্রতি অভিমানে।

অভ্রর সমস্ত ফ্রেন্ডসদের মাম্মামরা, পাপারা এসেছে। অভ্রই শুধু একলা প্রতিবারের মতো। এক একটা ইভেন্টের পর অভ্রর সব বন্ধুদের ওদের মাম্মামরা এনার্জি ড্রিংক, ফ্রুট জুস খাইয়ে দিচ্ছে। ড্রেস ঠিক করে দিচ্ছে। চুল ঠিক করে দিচ্ছে। অভ্র যেন ওখানে সত্যিই খুব বেমানান। স্নিগ্ধা ম্যাম যখন ওকে জিজ্ঞাসা করলো ওর মাম্মাম কোথায়! অভ্র আরেকটু হলে কেঁদেই ফেলেছিল। পাশ থেকে মালবিকা আন্টি অংশুমানকে আপেলের টুকরো গুলো খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, "আহারে! আজকের দিনেও ছেলেটাকে একলা ছেড়ে দিল।"

সমস্ত কষ্ট জমা করেও অভ্র স্টার্টিং লাইন থেকে ছোটার চেষ্টা করলো, কিন্তু যখন দড়িতে ঝোলা বিস্কুটগুলোর কাছে পৌঁছল তখন ওর চোখ ভরা জল নিয়ে দড়িতে ঝোলা বিস্কুটটা আর কিছুতেই দেখতে পেলনা। অংশুমান ফার্স্ট, অদ্রিজা সেকেন্ড, আর অভ্রতো বিস্কুটটাতে কামড়ই লাগাতে পারেনি।

অভ্রর ইচ্ছে করছিল মাটির সাথে মিশে যেতে। দেখতে পেল কিভাবে অদ্রিজার পাপা ওকে কোলে করে নিয়ে গেল ওর মাম্মামের কাছে। ওর মাম্মাম ওর চুলটা শক্ত করে বাঁধা আছে কিনা আরেকবার চেক করছে। এরপর হবে এগ এন্ড স্পুন ইভেন্ট। মানে প্রত্যেকে হাতে একটা করে চামচ নিয়ে, তার মধ্যে ডিম রেখে ছুটবে।

স্টার্টিং লাইনে যাওয়ার আগেই অভ্র বুঝতে পারলো ওর পাপাই-এর আনা নতুন কেডসের বাঁ পা টা আলগা হয়ে গেছে। তবুও ওর ইচ্ছে করলো না, ওই আন্টিগুলোকে বলে কেডস বেঁধে দিতে। অভ্র চামচে ডিম নিয়ে ছুটতে শুরু করলো। ওর ভাবনা বাঁ পায়ের কেডসের দিকে, যদি খুলে যায়। অভ্র যখন ফিনিশিং লাইনে পৌঁছল তখন ওর কেডসটা পুরোপুরি খুলে গেছে। তার অনেক আগেই ওর চামচের ডিমও পড়ে গেছে। ও ডিসকোয়ালিফাই।

অংশু তো অভ্রকে বেশ মজা করে বলল, তোর ডিম পড়ে ফেটে গেল আর তুই বুঝতেই পারলিনা! অভ্র লক্ষ্য করলো কয়েকটা আন্টির চোখে ওর জন্য সিম্প্যাথি। নীলিমা আন্টি বলল,

-"মাম্মাম মনে হয় কেডসটা ভালো করে বাঁধেনি, তাই খুলে গেছে। আমাকে দাও বেঁধে দিচ্ছি।"

অভ্রর সমস্ত রাগ জমা হলো মাম্মামের উপর। আজ ওর ব্যাড পারফর্মেন্সের জন্য দায়ী কেবল মাম্মাম।

অভ্রকে বাড়ি নিয়ে আসার সময় অনু কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে অভ্রর সাথে। কিন্তু অভ্র একটা কথাও বলতে চায়নি। সারা রাস্তা মুখ গোমড়া। অনু জানে এই বয়সের বাচ্চাদের একটুতেই যেমন অভিমান হয় তেমনি ঠিক ও হয়ে যায় একটু পরে। অনু অভ্রকে বলল,

-"জানো ওই দিদিটা আবার ফার্স্ট হয়েছে, এবার ডিস্ট্রিক্টে খেলতে যাবে। তুমি যাবে সেখানে! অনেক বড়ো মাঠ। অনেক লোক আসবে। তোমাদের স্কুলের থেকেও অনেক বেশি বাচ্চা আসবে।"

অভ্র কোনো সাড়ায় দিলনা।

বাড়ি ফিরে অনু অভ্রর ফেভারিট এগ চাউমিন বানিয়ে অভ্রকে খাবার জন্য ডাকতেই অভ্র এতোক্ষনের নীরবতা ভেঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

-"ইউ আর এ ব্যাড মম। ইউ ডোন্ট লাভ মি। আই অলসো হেট ইউ। যাও ওই দিদিটাকে খাইয়ে দাও। আমি খাবো না।"

অভ্রর এবারের রাগটা যে অন্যবারের মতো সহজে ভাঙ্গবেনা, সেটা অনু বুঝতে পারলো।

অভ্রকে ঘুম পাড়াবার পর অনুর সারা রাত্রি ঘুম এলো না, ও ভাবতে লাগলো সত্যিই কি ও ব্যাড মম হয়ে যাচ্ছে!

অভ্রর এ্যানুয়াল স্পোর্টসে অনুর না যাওয়াটা নিয়ে কাল রাত্রে পাটনা থেকে ফিরে সুদীপ্ত ভীষণ রাগারাগি করেছে। বাসে যেতে যেতে অনু সুদীপ্তর বলা সেই কথাগুলোই ভাবছে। অনু কি সত্যিই অভ্রের প্রতি কেয়ারলেস! সত্যিই কি ও দিন দিন ইরেস্পন্সিবেল হয়ে যাচ্ছে!

আজকে জেলাস্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, অনুর স্কুল এই প্রথম বার ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টসে যাবার পাশ পেয়েছে। আর ওদের হেডমাষ্টার চায় অনু অবশ্যই ওদের সাথে চলুক। সুপর্ণারও তাই ইচ্ছা। না হলে কাল রাত্রে সুদীপ্তর সাথে ঝামেলার পর অনুর আজ বাড়ি থেকে বেরোতেই ইচ্ছা করছিল না।

সুদীপ্ত সকালে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে, ও আজ অভ্রকে নিয়েই স্কুলের পথে বেরিয়েছে।

অভ্র দু একবার জিজ্ঞাসা করেছে, "মাম্মাম আমরা কোথায় যাচ্ছি?"

উত্তরে অনু বলেছে, -"তুমি তো আমার স্কুলে যেতে চাইতে অভ্র, আজ আমাদের স্কুল থেকে একটা জায়গায় যাবো, দেখবে তোমার ভালো লাগবে।"

অভ্রকে মেইনলি ওর খেলার মাঠে নিয়ে যাবার কারণ কদিন ধরে অভ্র কেমন গুমরে আছে, তাই যদি খোলা মাঠে অনেককে দেখে মনটা ভালো হয়।

অভ্র দেখল এই মাঠটা ওদের স্কুলের মাঠটার চেয়েও বড়ো। কতো লোকজন এসেছে। কতো বাচ্চা এসেছে, কেউ কেউ ওর মতোই, তবে বেশির ভাগ ওর চেয়ে বড়োই হবে।

ওদের কোনো ইউনিফর্ম ও নেই, কেডস ও নেই। বেশির ভাগ বাচ্চাই স্কুলের টিচারদের সাথে এসেছে। ওদের সাথে মাম্মাম, পাপা কেউ-ই আসেনি।

একটু পরে খেলতে আসা সব বাচ্চাগুলোকে একই রকম ড্রেস দিল। অনু বুঝিয়ে বলল অভ্রকে,

-"দেখছো ওদের তো তোমাদের মতো ভালো ইউনিফর্ম থাকেনি, সেই জন্য ওদের সবাইকে একই রকম ইউনিফর্ম দিল যারা এই খেলাটা করাচ্ছে।"

একই রকম ইউনিফর্ম পরে মাঠ প্রবেশ করলেও অভ্র দেখল খেলার সময় ওদের বেশির ভাগের গায়ে পুরোনো গেঞ্জি। খালি পায়েই কি ভীষণ ছুটছে ওরা।

সকালে অনু সুপর্ণার সাথে অভ্রের পরিচয় করিয়ে দিলেও অভ্র কোনো কথা বলেনি সুপর্ণার সাথে। কারন অভ্র জানে এই দিদিটার জন্যই মাম্মাম ওর স্পোর্টসে যায়নি। একটু পরে অভ্রর সামনে দিয়ে ভীষন গতিতে ছুটে সুপর্ণা ফার্স্ট হলো আর মাইকেও ঘোষনা করল ১০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছে সুপর্ণা হেমব্রম। এরপর সুপর্ণা ওদের কাছে আসতেই অভ্র আর কথা না বলে থাকতে পারলো না। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,-

"দিদি তুমি কি ব্রেকফাস্টে এনার্জি ড্রিংক খাও?"

সুপর্ণা হয়তো এনার্জি ড্রিংক মানেও জানেনা, ও শুধু হেসে অভ্রর গাল গুলো টিপে দিল। তারপর সকালে টিফিনে পাওয়া কলা আর পাউরুটিগুলো থেকে এক পিস পাউরুটি অভ্রর হাতে দিল।

অনু সুপর্ণাকে বলল, "সকালে তুই কি খাস জিজ্ঞাসা করছে।"

সুপর্ণা হাসতে হাসতে বলল,- "চপ বা ঘুগনি দিয়ে মুড়ি"

অভ্র বলল,-" আমার মাম্মাম, স্যান্ডুইচ আর কর্ণফ্লেক্স বানায় রোজ, পচা ব্রেকফাস্ট।"

সুপর্ণা বলল, "আমার মা তো ভাটায় কাজ করে, তার লেগে খাবার বানাতে সময় পায়নি সকালে, সন্ধ্যেতে গরম গরম ফ্যান ভাত আর আলুমাখা করে দেয়।"

অভ্র আর কিছু বলল না, শুধু বুঝলো যে কোনো হেলথ ড্রিংকস, ফ্রুট জুস, সফট কেডস বা প্লে ইউনিফর্ম ছাড়াও এরা খেলোয়াড়। আর ওদের পাবলিক স্কুলের অংশুমান, অদ্রিজা বা অভিলেখার থেকে অনেক ভালো দৌড়তে পারে।

জেলা স্তরে ১০০ মিটারে ফার্স্ট, আর ২০০ মিটারে সেকেন্ড হয়ে ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সুপর্ণা হেমব্রম। মঞ্চে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নেবার সময় কেমন লাগছে জিজ্ঞাসা করায় সুপর্ণা বলল, " বড়ো ভালো লাগছে, আমার তো এখানে আসাটাই হতো নাই যদি না আগের খেলাটাই আমাকে অনিন্দিতা মেডাম লিয়া যেত। অনিন্দিতা মেডামের লেগেই এতো লোক আমারে চিনল গো। এতো কুছু প্রাইজ পেলাম।"

ঘরের কেউ এসেছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় সুপর্ণা বলল, "বাবা-মা ভাটায় কাজ করে, উয়াদের কারুর সময় হয় নাই আমার লেগে কাজ ফেলে আসার, তাছাড়া ঘরে আরো ছোটো ছোটো ভাই বুনরা আছে। মেডামই আমাকে লিয়া এসেছে, মেডামই লিয়া যাবেক। মেডাম বড়ো ভালো বটে, মেডাম আমার ঘরের লোকই হলো গো।"

সুপর্ণার কথা শুনে অনুর চোখ গুলো চিকচিক করে উঠল। হয়তো ও আদর্শ মা হয়ে উঠতে পারেনি অভ্রের। কিন্তু সুপর্ণার মতো কোনো গরীব ঘরের মেয়ের আদর্শ পথ-প্রদর্শক তো হয়ে উঠতে পেরেছে। একজন শিক্ষিকার জীবনের স্বার্থকতা এর চেয়ে বেশি আর কি বা হতে পারে!

সুপর্ণাকে ওর ঘরে পৌঁছে, সন্ধ্যে বেলা অভ্রের সাথে বাড়ি ফিরল অনু। আজও অভ্র আগের দিনের মতোই চুপচাপ। অনু ভাবছে চারিদিক ঘুরেও অভ্রটার কোনো চেঞ্জ হলো না। সেই একই রকম অভিমান জমা করে গুমরে বসে আছে।

খাবার রেডি করে অভ্রকে দুবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে অভ্রর কাছে গিয়ে দেখল ওর দু চোখে জল। অনু ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-"সরি অভ্র, মাম্মাম এর পরের বার অভ্রের স্কুলের স্পোর্টসে যাবেই, প্রমিস।"

অভ্র কাঁদতে কাঁদতে বলল,-"না মাম্মাম, আই এ্যাম সরি। আমি বুঝতে পারিনি। আই এ্যাম ভেরি ব্যাড। কারন আমি তোমাকে ব্যাড বলেছি। আই লাভ ইউ মাম্মাম। সুপর্ণা দিদি ঠিকই বলেছে ইউ আর ভেরি গুড মাম্মাম।"

সুদীপ্ত অফিস থেকে ফিরে দেখল, মা আর ছেলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে একে অপরকে কি ভাবে সরি বলছে। সুদীপ্ত মনে মনে হেসে ভাবল মা আর ছেলের ভাব হয়ে গেল, মাঝখান থেকে ওই বোধহয় গল্পের ভিলেন রয়ে গেল।

-সমাপ্ত- 


Rate this content
Log in