ছায়াযুদ্ধ
ছায়াযুদ্ধ
---"বল আমি কী করলে তুই পড়বি? - - - আমি রোজ একবার করে ফোন করলে তুই পড়াশোনা ঠিকঠাক করবি?”
- - - পরপর প্রশ্নদুটো ছুঁড়ে দিয়েই আমার চোখে চোখ রাখে সৃজা। ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে একটা স্পষ্ট অসহায়তার ছাপ। কিছু একটা অপছন্দের ঘটনা ঘটছে বুঝেও সে কিছুই করে উঠতে পারছে না। আর ওই করতে না পারাটা যেন ওকে ভেতরে ভেতরে দুর্বল করে দিচ্ছে।
--- আমি নির্বিকার। সবে শীত পড়তে শুরু করেছে। কলেজের ছাদ টপকে মিষ্টি রোদ এসে পড়ছে আমার পিঠের ওপর। কোনোকিছুই না শোনার ভান করে আমি কলেজের মাঠের ঘাসগুলো এক এক করে উপড়ে চলেছি। একটু দূরেই সুশান্ত’রা বসেছে দল বেঁধে। সুশান্ত কিশোর কুমারের গান ধরে জমিয়ে রেখেছে চারপাশটা।
- - - “আমি তোকে কিছু বলছি কৃষ্ণেন্দু”
--- জলের বোতলটা দিয়ে আমার পিঠে একটা জোর ধাক্কা দেয় সৃজা।
- - - যতটা সম্ভব গলাটাকে সিরিয়াস করে বলি - “আমি তো আগেই বলেছি, বহুবার বলেছি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর কী করে বললে তুই বুঝবি যে আমি তোর গলাটা না শুনে থাকতে পারি না সৃজা।“
- - - ওপাশ থেকে সুশান্ত দরাজ গলায় ধরেছে –‘মন খুশি উর্বশী সেই রাতে’।
- - - মিতা আর শিবানি হাসতে হাসতে সুশান্ত ‘দের কাছে গিয়ে বসে। এখন একঘন্টা ক্লাস নেই। তিনটে পনেরোর সময় আবার অনার্স এর ক্লাস আছে। সুশান্ত’র কাছে একে একে আরও ভিড় বাড়বে। কিশোরের গান ও খুব দরদ দিয়ে শোনায় সবাইকে।
---"পাগলামি করিসনা কৃষ্ণেন্দু। সামনে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। তোর যা মেরিট তাতে তোর ফার্স্ট ক্লাস অবধারিত। এখন তুই যদি জেনেশুনে নিজের কেরিয়ারটাকে শেষ করিস তাহলে আমার কিছু বলার নেই। ইনফ্যাক্ট কিছু করারও নেই। তোকে তো আমি বলছি রোজই একবার করে ফোন করবো। কোনও আর্জেন্ট দরকার থাকলে তুইও আমার পাশের বাড়িতে ফোন করে আমাকে ডেকে দিতে বলতে পারিস, আমি এসে কথা বলবো। রোজ রোজ আড্ডা মারার জন্য পাশের বাড়িতে ফোন ধরতে গেলে সবাই খারাপ ভাববে এই সহজ কথাটা বুঝছিস না কেন বলতো?”---ততক্ষণে রীতিমত ক্ষোভে ফুঁসছে সৃজা। নিজের অসুবিধাটা আমার কান ও হৃদয় অব্দি পৌঁছে দিতে না পারার যন্ত্রণাটা যেন ও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অন্য কেউ হলে পাত্তা না দিয়ে মিসবিহেভ করে ঠিক বেড়িয়ে যেত সৃজা। কিন্তু আমার সঙ্গে সেটা করতে পারবে না। পারবে না বলেই বোধহয় নিজেকে আরও বেশি করে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। আসলে ওর বাড়ি প্রত্যন্ত গ্রামে। পরিবারের ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার বলতে যা বোঝায় সৃজা আসলে তাই। ওর বাবা নামসই পর্যন্ত করতে পারেনা। এইচ এসে গ্রামের স্কুল থেকে ভালো রেজাল্ট করে ইংরেজী অনার্সে ভর্তি হয়ে গেছে অনেকটা উত্তেজনার বশেই। নাহলে ওইরকম দুর্বল গ্রামার আর লো প্রোফাইল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে ইংরেজী অনার্স টা ঠিক স্যুট করেনা। স্যুট করেওনি। প্রথম থেকেই কমপ্লিট ইংলিশ এ লেকচার সৃজা একেবারেই করায়ত্ত করতে পারেনি। তারপর আস্তে আস্তে আমি ওকে হেল্প করতে থাকি। লেকচার বোঝার ক্ষেত্রে গাইড করতে থাকি। ইংরেজী গ্রামার শেখাতে থাকি। নোটস বানিয়ে দিতে শুরু করি। ওর ইংরেজী লেখা কারেকশন করে দিতে থাকি। ওকে হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটেরেচার বোঝাতে শুরু করি। মিলটন এর গুরুগম্ভীর ভাষা আর শেকসপিয়ার এর সনেট ওর আয়ত্তে এনে দিতে শুরু করি। আস্তে আস্তে কনফিডেন্স ফিরে পেতে শুরু করে সৃজা। ওর কোনোমতেই অনার্স টিকবে না এই বদ্ধমূল ধারণাটাও আস্তে আস্তে চলে যেতে শুরু করে। এমতাবস্থায় অন্তত কৃতজ্ঞতার খাতিরেও সৃজা’র পক্ষে আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করা বা আমার কথার বিরুদ্ধে কথা বলা একপ্রকার অসম্ভব। আর অসম্ভব বলেই বোধহয় ও অনেক বেশি অসহায়।
---”আর তুইও কেন আমাকে বুঝছিস না বলতো? আর কতবার তোকে বলবো সৃজা, তোর সঙ্গে কথা না বললে আমার কিচ্ছু ভাল্লাগেনা। তোর গলা শুনতে না পেলে আমার পড়াতে মনই বসেনা। শুধু ল্যান্ডফোনটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। এই বুঝি রিং হলো”। - - - আমি বর্ধমান থেকে যাই। তারপর ইংরেজী গ্রামার জানি। লেকচার বুঝতে পারি। স্যার ম্যাডাম দেরও বেশ স্নেহধন্য। মোদ্দাকথা একটু হামবড়া টাইপ। সময়মতো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছদ্মকবির লুকসও নিতে পারি। সাধারণত আমার প্রোফাইলের সঙ্গে ওর প্রোফাইল ম্যাচ করার কথা নয়। প্রথম প্রথম ম্যাচ করেওনি। বেশ কয়েকমাস ওর সঙ্গে আমার সৌজন্য বিনিময়ও হয়নি। আমাদের গ্রুপটাকে রীতিমত সমঝে চলতো সৃজা। কিন্তু একদিন হঠাত করে ওর কন্ঠস্বরটা আমাকে নাড়িয়ে দিল। আবিস্কার করলাম ওর কন্ঠস্বরের সঙ্গে রানী মুখার্জি’র কন্ঠস্বরের বেশ মিল আছে। ব্যাস স্বপ্নের নায়িকার কন্ঠস্বরটা উপলব্ধি করার জন্য সৃজা’র কন্ঠস্বরের অপেক্ষা করতে থাকলাম। রোলকলের সময় ২৭৫ এর রেসপন্স শোনার জন্য পাগল হয়ে যেতে লাগলাম। - - - সুশান্ত’র দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওকে ঘিরে অনেকে বসে গেছে। ওর মাথা দেখা যাচ্ছে না। ওর গলায় অনুরণিত হচ্ছে কিশোরের ‘সেদিনও আকাশে ছিল কত তারা’। - - - মাঠের ঘাসের ওপর পড়ে থাকা জলের বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে গলায় খানিকটা জল চালান করে সৃজা। নিজের অসহায়তাটা খানিকটা কাটিয়ে দৃঢ়কন্ঠে বলে-“ আমি জানি না আর কীভাবে বললে তুই বুঝবি। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কৃষ্ণেন্দু। বন্ধু হিসেবে তোকে আমি ভীষণ রেসপেক্ট করি। আর যাকে অতটা রেসপেক্ট করি তাকে আর যাই হোক ভালোবাসতে বলিস না কৃষ্ণেন্দু। প্লিজ। যাকে রেসপেক্ট করা যায় তাকে ভালোবাসা যায় না। আমি কোনোদিনই তোকে ভালোবাসতে পারবো না। তুই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আশা করবো ভবিষ্যতটা নষ্ট করবি না। কাকু কাকিমার স্বপ্নপূরণ করার দায়িত্ব পালন করতে আশা করি অস্বীকার করবি না। ভালো থাকিস। পড়াশোনায় মন দিস। বন্ধু হিসেবে আমাকে তুই সবসময়েই সঙ্গে পাবি কিন্তু আমার কাছে কোনোদিন ভালোবাসা এক্সপেক্ট করিস না। আবারও বলছি তোকে মানুষ হিসেবে ভীষণ রেসপেক্ট করি কৃষ্ণেন্দু তাই ভালোবেসে তোকে ছোট করতে পারবো না, কোনোদিন পারবো না। আমাকে জোর করিস না প্লিজ। - - - - কথাগুলো একনিঃশ্বাসে উগড়ে দিয়েই ঘাসের ওপর থেকে ব্যাগ আর জলের বোতলটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সৃজা। হাঁটতে থাকে একচল্লিশ নম্বর ঘরের দিকে। অনার্স এর ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। এই প্রথম সৃজা’র চালচলনে গাম্ভীর্য আর দাম্ভিকতার ছাপ পড়লো যেন। সৌমিত্র কি তাহলে ঠিক বলেছিল? বায়োলজি অনার্স এর ওই লম্বা ছেলেটার সঙ্গে তাহলে সৃজা’র - - -তাহলে কেন সৃজা আমাকে এতটা প্যাম্পার করে গেল এতদিন ধরে? কেনই বা আমাকে ওর জীবনে এতখানি স্পেস দিল? শুধুমাত্র ভালো বন্ধু বলে নাকি অনার্স টিকিয়ে রাখার জন্য? মানুষ হিসেবে আমার এত প্রশংসা করে গেল আর ও এইটুকু বুঝলো না যে আমাকে সরাসরি রিফিউজ করলেও বন্ধু হিসেবে ওইটুকু সাহায্য ওকে আমি করবো। যে মানুষটাকেই কোনোদিন চেনার চেষ্টা করলো না তাকেই এতখানি রেসপেক্ট করে ফেললো যে ভালোবাসা সম্ভব হলো না আর। রেসপেক্ট করে বলে ভালোবাসতে পারবে না এটা বলার চেয়ে তোকে নয় অন্য কাউকে ভালোবাসি বলার মধ্যে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। কিরকম যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। - - - সুশান্ত’র কাছে ভিড় টা তখনও কমেনি। আমি সুশান্ত’র দিকে এগোতে থাকলাম ধীর পদক্ষেপে। সুশান্ত দরাজ গলায় গাইছে-‘ মেরে ভিগি ভিগি সি’। রোদটা একেবারে কমে এসেছে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার ছায়াটা ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে কেমন যেন শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। কালকের রঞ্জনবাবুর লেকচার টা মনে পড়ছে খুব-‘আওয়ার স্যুইটেস্ট সংস আর দোজ দ্যট টেল অফ স্যাডেস্ট থটস’। বিরহই প্রেমের শ্রেষ্ঠ কবিতা। - - - আমার ছায়ার সমান্তরালে একটা কাক নিজের ছন্দে উড়ে চলেছে। বাসায় ফেরার তাড়া আছে বলে একদমই মনে হচ্ছে না। সাইড ব্যাগটাকে বামহাত দিয়ে চেপে ধরে আমি এগিয়ে চলেছি। তবে কি সৌমিত্র’র ওই আশঙ্কাটাও ঠিক। বায়োলজি অনার্স এর ওই লম্বা ছেলেটার বেসিক ট্রেনিং করা আছে। কলেজ শেষ হতে হতেই ও চাকরি পেয়ে যাবে। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি। - - - না না আমার মানুষ চিনতে এতটা ভুল হতে পারে না। সৃজা এতটা নীচ মানসিকতার মেয়ে হতেই পারে না। আমাকে ব্যবহার করা নিশ্চয়ই ওর উদ্দেশ্য ছিল না। - - - সুশান্ত’র দিকে হাঁটতে হাঁটতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমার ছায়া টাকে গ্রাস করে নিল অন্য দুজনের ছায়া। মুখচেনা। বাংলা ডিপার্টমেন্ট এর। স্পষ্ট শুনলাম মেয়েটি ছেলেটিকে বলছে – ‘আমাকে ভুলে যাও। তোমরা কায়স্হ আর আমরা... ছাড়ো’। - - - ওরা এগিয়ে যেতেই আমার ছায়াটা আবার প্রতীয়মান হলো। আমার ছায়াটাকে জাজ করার চেষ্টা করলাম। না সৃজা’র প্রতি রাগ, ক্ষোভ কিছুই নেই মনে হচ্ছে। না ও এস সি কোটাতে ইংরেজী অনার্স পেয়েছে বলে সৌমিত্র’র মতো আমার মনে কোনও রাগের উদ্রেক হচ্ছে না। বরং ওর জন্য গর্ব হচ্ছে। - - - ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আমার ছায়াটা। মিলিয়ে যেতে যেতে ছায়াটা আবার ফিরে আসছে। আবারও দেখছি। না সৃজা আমাকে ব্যবহার করেছে এটা ভাবা যাচ্ছে না। - - - বাম হাত দিয়ে কাঁধের ব্যাগটাকে চেপে ধরে আমি এগিয়ে চলেছি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একচল্লিশ নম্বর ঘরের কাছেও একটা লম্বা ছায়া পড়েছে। ছায়াটার আদলটা খুব চেনা লাগছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছায়াটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। না সেই চোখ দুটোতে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা ধরা পড়ছে না। চোখদুটো থেকে একটা বিষন্নতা যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে। চেনা আদলের ছায়াটাকে যেন একটা অন্ধকার আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।