Madhumita Sengupta

Romance Classics Others

4  

Madhumita Sengupta

Romance Classics Others

ভালোবাসার সংজ্ঞা শারদ সংখ্যার জন্য গল্প

ভালোবাসার সংজ্ঞা শারদ সংখ্যার জন্য গল্প

11 mins
350



 


   সপ্তাহে অন্তত তিনদিন বাটিতে তেলের মধ্যে মেথি দিয়ে ফুটিয়ে থালার উপরে গরম বাটি রেখে কাঠের চিরুনি নিয়ে শ্রেয়া দিম্মার কাছে যায় । দিম্মা রিটায়ার করে ওদের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে । বাড়ি ফিরতে পারেন নি লকডাউনের সৌজন্যে । দাদু মারা যাওয়ার পরে উনি কল্যানীর বাড়িতে একাই থাকতেন । সকাল ছটা থেকে রাত দশটা অবধি বাড়ি সমলাতো অনিমা মাসি । দিম্মা স্থানীয় স্কুলে চাকরি করতেন বলে খুব একটা আসতে পারতেন না তাঁর একমাত্র সন্তান শ্রেয়ার মা শম্পার কাছে । 


    চুল কম বলে দিম্মার প্রেসক্রিপশন মতো তাঁর কাছে এই বাজে গন্ধের তেল ম্যাসাজ নিতে হয় শ্রেয়ার । মা হাসেন কারণ ‛মাথায় তেল মেখে কোনো লাভ নেই’ জাতীয় সহপাঠীদের গুগল গবেষণালব্ধ ফল নিয়ে সে মায়ের সাথে প্রচুর বাকবিতন্ডা চালিয়েছে । কিন্তু দিম্মার কথায় সে কোনো উত্তর তো দেয়ই নি উল্টে নিজের হাতে তেল গরম করে দিম্মার কাছে গিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো তাঁর পায়ের কাছে বসে চোখ বন্ধ করে ম্যাসাজ নেয় । মাঝে মাঝে আরামে সে ঘুমিয়ে পড়ে । তাই তাকে জাগিয়ে রাখতে আজকাল দিম্মা তাকে নানাধরনের গল্প শোনান । 


  আজ রবিবার বলে শ্রেয়ার অনলাইন ক্লাস নেই বাবা বাজারে গেছে সারা সপ্তাহের বাজার করতে । মা নানা রকম কাজে ব্যস্ত তাই এই সময় দিদিমা নাতনির মন খুলে গল্প করার অবাধ সুযোগ ।


―“ ওদের মা একটু দাদুর সাথে তোমার প্রেমের গল্প বলো না একটু শুনি ।" আদুরে গলায় চুপি চুপি বলে শ্রেয়া । মার কানে গেলে তিনি ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেবেন । কিন্তু দিদিমার সাথে সে প্রাণ খুলে সব ধরনের গল্প করে । 

  দিদিমা মানে তো বন্ধু আবার সবচেয়ে ভালো গাইড ও বটে । দিদিমা বা দিম্মা শব্দটার মধ্যে তো দিদি শব্দটা আগে রয়েছে তাই না । তাই এই বয়সে মেয়েরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে যে ধরনের কথা বলে সেই ধরনের কথা সে দিদিমার সঙ্গে অকপটে বলতে পারে । দিদিমা এসব কথা শুনলে তার কঠোর ব্যক্তিত্ব পাশে সরিয়ে মুচকি হেসে তার সাথে আলোচনা করেন প্রেম পুরুষ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে । এই নিয়ে তার মেয়ে তাকে এই নিয়ে একবার আপত্তি জানালেও তিনি বলেছিলেন 

―“এই ছোট ছোট মেয়েদের বন্ধু হয়ে যা । এরা কি ভাবছে সেটা তুই তোর বুদ্ধি দিয়ে ধরতে পারবি না । আমি যদি ওর প্রাণের কথাটা জেনে নি তাহলে ওকে ট্যাকেল করতে সুবিধা হবে । এটা মনে রাখিস । আমাকে এসে কিছু শেখাতে আসিস না মা । তোকে আমি বড় করেছি এটা মনে রাখবি । " 


―“ তোমার সাথে মনের কথা বলা যেত মা ? চিরদিন তো তুমি মানুষ হিসেবে গম্ভীর রাগী । কই নাতনির বেলায় তোমার সেই ভয়ংকর রাগী মুখটা তো দেখতেই পাই না ? " বলেন শম্পা । 

 

   শম্পার মা সুচরিতা হাসেন । প্রায় চল্লিশ বছরের মেয়ে যা বলছে সেটা তার অভিযোগ না অভিমান সেটা বোঝা যাচ্ছে না । তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে দেন । 


―“ তোর দাদু আর আমি একই স্কুলে চাকরি জয়েন করেছিলাম আমার দু বছর আগে তুমি উনি চাকরি পেয়েছেন । এবারে মুশকিল হলো এটাই যে তিরিশ জন পুরুষ সহকর্মীর ভিতরে আমি একমাত্র মহিলা হয়ে চাকরি জয়েন করেছি ।এর আগে দু তিন জন লেডি নন টিচিং স্টাফ এই স্কুলে কাজ করে গেছেন । 


   টিচার্স রুমে আমি কোথায় বসবো এই নিয়ে হেডস্যার অনেক ধরনের চিন্তাভাবনা করেছিলেন । কিন্তু সেই পরিকল্পনা একজন পুরুষ করলে যা হয় আর কি । আমার বসার জায়গা হল টিচার্স রুমের একদিকে দেয়াল ঘেঁষে । একটা টেবিল ফ্যান অবশ্য দেওয়া হয়েছিল শুধু আমার জন্য । কিন্তু বসেই আমার মনে হত তিরিশ জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে । বুঝতেই পারছিস তখন মাত্র চব্বিশ বছরের মেয়ে আমি । লজ্জায় সবসময় গুটিয়ে থাকতাম । 

   একদিন বাড়ি ফেরার সময় দেখি সহকর্মী ইতিহাসের অম্লান দা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন । টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। উনি একটা খবরের কাগজ দিয়ে মাথাটা বৃষ্টি থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন । এখনকার মতো আধুনিক বাস স্ট্যান্ড তখন ওখানে ছিল না । রাস্তার উপরেই আমাদের দাঁড়াতে হতো ।


   স্কুলের অনেক কাজ উনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাই আমিও বেশ কিছুটা কৃতজ্ঞ ছিলাম ওনার উপরে । ভালো মানুষ নিরীহ ভদ্রলোক । আমি গিয়ে আমার ছাতাটা ওনাকে দিয়ে বললাম “আপনি এটা ধরুন দাদা ।" বলে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । উনি বললেন “ বাঁচালে বোন ।" 


   অনেক দেরিতে দেরিতে বাস আসতো । তাই আমরা দাঁড়িয়ে আছি অপেক্ষা করছি । এক ছাতার তলায় দুজন দাড়ালে যা হয় দুজনেই অল্পবিস্তর ভিজছি । হঠাৎ আমার চোখ পড়ল রাস্তার উল্টোদিকে । সেখানে দাঁড়িয়ে তোর হবু দাদু । কী ভীষণ রাগী মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! একবার আমাকে দেখছে একবার অম্লানদাকে দেখছে । 


   আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল । এ আবার কি ! লোকটা তো ভারি অসভ্য ! এরকম ভাবে তাকিয়ে আছে কেন আমাদের দিকে ! আমরা কি কোনো নিষিদ্ধ কাজ করছি নাকি ! অদ্ভুত গাঁইয়া ভূত কোথাকারের ! 


   অম্লান দাও বোধহয় কিছু লক্ষ্য করেছিলেন । তিনি হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন “ যাবে ? ওই যে দূরে একটা চায়ের দোকান আছে। চলো গরম গরম চা খাই একটু । বাস আসলে তো ওর পাশ দিয়েই আসবে তখন হাত দেখালে থেমে যাবে । ভাঁড় নিয়ে উঠে পড়বো কেমন ? " 


   আমি তো তখন তোর দাদুর চোখের সামনে থেকে যেতে পারলে বাঁচি । সাগ্রহে রাজী হয়ে গেলাম । দুজনে এক ছাতার তলায় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম সেই চায়ের দোকানের সামনে । একটা লোক একটা ছোট সসপ্যান বসিয়ে চা তৈরি করছে আর আগ্রহের সঙ্গে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে যে আদৌ আমরা ওর খদ্দের হবো কিনা । বোধহয় বৃষ্টিতে খদ্দের কম আসছিল । অম্লান দা গিয়ে আদা দিয়ে কড়া দু কাপ চা চাওয়াতে লোকটি প্রসন্ন মুখে হাতের সামনে রাখা ছোট একটা হামানদিস্তার মধ্যে আদা কুচি নিয়ে ধমাধম বাড়ি দিতে লাগলো । 


   বৃষ্টি ধরে গিয়েছিল । আমাদের হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের ভাঁড় । একটা একটা করে খাস্তা বেকারীর বিস্কুট নিয়ে আমরা দুজনে চা খাচ্ছি আরাম করে । হঠাৎ শুনি ভীষণ গম্ভীর গলায় তোর হবু দাদু বলছেন “এক কাপ চা দিন তো" ।


   রাগে আমার হাড় পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল । ভারী অসভ্য লোক তো ! আমাকে ফলো করছে ! স্কুলে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে । সেটা খারাপ লাগে না আমারও । দেখতে শুনতে তো মন্দ ছিল না । 

   একটু বাদে একটা বাস আসলো । সেটা অম্লানদাদের বাড়ির সামনে অব্দি যায় কিন্তু আমার গন্তব্য আরো কিছুটা দূরে তাই আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম । অম্লান দা টা টা করে বাসে উঠে গেলেন ।


  ব্যাস তোর হবু দাদুকে আর পায় কে ভাঁড়টাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল । চা টা অবশ্য খাওয়া হয়ে গেছিল । তারপর আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল “আপনি লোকটাকে ভালো করে চেনেন ? আপনার কোনো আইডিয়া আছে লোকটা কেমন ? লোকটা কিন্তু বিবাহিত । " 


“ আপনি নিজের কলিগ কে লোকটা বলছেন কেন ? অম্লানদা বলুন । আর উনি বিবাহিত না অবিবাহিত তাতে আমার কি কি এসে যায় ! আপনি আমায় সবকিছু শিখিয়ে দেবেন নাকি ? " .. বুঝতেই পারছিস মাথা গরম ছিল । একে বলে ঝেড়ে কাপড় পরানো । " হাসতে থাকেন সুচরিতা । 


“ আহারে ! তুমি খুব খারাপ ! কেন দাদুকে এরকমভাবে কষ্ট দিচ্ছিলে ? দেখছিলে যে লোকটা ঈর্ষায় একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিল ! পোড়া গন্ধ পাও নি নাকে ? " হাসতে হাসতে বলে শ্রেয়া । 


“ আরে না শোন না তারপর কি হলো । ..তোর হবু দাদুর তখন অপমানিত মুখ লাল হয়ে গেছে । প্রচন্ড আমতা আমতা করে সে বলল ― না মানে আপনি নতুন .. । আসলে একটা বিবাহিত পুরুষ ..


   আমারতো আরো মাথা গরম হয়ে গেল । আমি বললাম ..আবার বাজে কথা ! বলছিনা লোকটা বিবাহিত না অবিবাহিত সেটা বড় প্রশ্ন নয় । উনি আমার একজন কলিগ এবং যথেষ্ট সাহায্য করেন এটাই বড় কথা । ভীষণ ভদ্র আচরণ করেন আর যাকে দাদা বলে ডাকি শ্রদ্ধা করি তার প্রসঙ্গে এসব কথা আমি শুনতে চাইনা । এসব আজেবাজে কথা কোনদিন আমাকে বলতে আসবেন না । আমি কিন্তু তাহলে আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করে দেবো প্রধান শিক্ষক মহাশয় কাছে । 


   ও বললো .. আসলে আমার মাথার ঠিক নেই । নিজে কি বলছি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । আমি সত্যি খুব লজ্জিত । আমাকে ক্ষমা করে দেবেন । আপনাকে আমার এরকম ভাবে বলা উচিৎ হয়নি । কিন্তু আমি ওনার পাশে আপনাকে না সহ্য করতে পারছিলাম না ।


   রাস্তায় উল্টোদিকে একটা বাস এসে থেমেছে দেখে তোর হবু দাদু দৌড়ে গিয়ে তাতে উঠে পরল । এতেও আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেল । কি অসভ্য লোক রে বাবা! একজন মহিলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল আর ও বাসে উঠে চলে গেল ! 

  ভাগ্য ভালো তারপরে আমার বাসও এসে গেছিল । স্কুলে যা হতো বাড়ি এসে দিদির সঙ্গে সব গল্প করতাম । সেদিন খুবই রেগে ছিলাম । মায়ের হাতে বাদাম চানাচুর দিয়ে মাখা মুড়ি আর চা খেতে খেতে পুরো ঘটনা দিদিকে বললাম । 


   দিদির বাড়ির কাছাকাছি অঞ্চলেই বিয়ে হয়েছিল । তখন দিদির বাচ্চার বয়স মাস দেড়েক তাই ও মায়ের কাছে ছিল । আমার বলা সমস্ত কাহিনী শুনে ও বলল.. বাবা ছেলেটি দেখছি তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । ওকে একদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আয় আমি থাকতে থাকতে । সামনাসামনি দেখে সিদ্ধান্ত নেব । 


  ঘটনার বিশ্লেষণ দিদির মুখে শুনে আমিতো হাঁ ! মুড়ি চিবানো ভুলে গিয়ে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি চোখ গোল গোল করে । বলে কি এসব কথা ! ওই লোকটাকে আমি বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসব ! অসভ্য একটা ! আমাকে রাস্তায় মেজাজ দেখালো অপমান করলো ! জীবনে বিয়ে করব না সেও ঠিক আছে । এরকম লোককে ত্রিসীমানায় আসতে দেবো না । সারাজীবন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করব সেও ভালো । আমার উত্তর শুনে দিদির সে কি হাসি ! 


   দিদিতো ঘটনাটা মাকে জানিয়ে দিল । এত রাগ হয়েছিল সেদিনকে দিদির উপর। মনে হয়েছিল বাচ্চা হয়ে ওর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে । 


   পরেরদিন রবিবার ছিল । দুপুর বেলা খেয়ে ঘুমিয়েছি । সুযোগ পেয়ে ছোট্ট একটা ভাতঘুম দিচ্ছিলাম আর কি । ওমা স্বপ্নে দেখি তোর দাদু একটা পাঞ্জাবী পরে লাল টকটকে একটা গোলাপ এনে আমার হাতে দিলো । আমি তো ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম । আমার প্রথম উপলব্ধি হলো পাঞ্জাবী পরলে তো তোর দাদুকে দারুন লাগে দেখতে । অথচ বাস্তবে কোনদিন আমি তাকে পাঞ্জাবী পড়তে দেখিনি। আমার নিজের মনোভাব আমার কাছে বড় অদ্ভুত ঠেকলো । ভাবলাম দিদি পাগল তাহলে তার মতো আমিও পাগল হব এটাই স্বাভাবিক । জেনেটিক্যাল ডিজঅর্ডার ।


   সোমবার স্কুলে গিয়ে দেখি তোর দাদু চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আমার দিকে পেছন করে বসেছে । মানে পুরোটাই ঘুরে গেছে । টেবিল শুদ্ধ ঘুরে যাওয়ায় অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছে । তারা বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন কিন্তু তোর দাদু অসম্ভব গম্ভীর আর নিরুত্তর । আমি খালি পিঠ টাই দেখতে পাচ্ছি । মনে হলো একটু বেশি অপমান করে ফেলেছি আগেরদিন । এত টা না বললেও হতো । দিদি বলেছে ও আমাকে পছন্দ করে । যদিও সেরকম প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু পাওয়া যায়নি কিন্তু দিদি শত হলেও বড় তার অভিজ্ঞতা বেশি । হয়ত ছেলেরা এরকমই হয়। নিজের পছন্দের মেয়ের পাশে অন্য কোন পুরুষের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না । 


   যাইহোক সারাদিনে একবারও ওর মুখটা আমি দেখতে পেলাম না । টিফিনের পর থেকে আমার মেজাজটা গরম হতে শুরু করলো । দিদি কিছুই জানেনা । যদি ওর কোন দুর্বলতা আমার উপর থাকতো তাহলে এতক্ষণ একবারও না তাকিয়ে পারতো ? আমিও ওর দিকে তাকানো বন্ধ করলাম । দিদি পাগল আমিতো পাগল নই । 


   তখন আগস্ট মাসের দু তারিখ । খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন । আমি ছাতা মাথায় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি । দেখি চুপচুপে ভিজে তোর দাদু মাথায় রুমাল বেঁধে উল্টোদিকের বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে । কিন্তু তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ অন্যদিকে । বাসস্টান্ডে আরো অনেকে অপেক্ষমান । আমিও উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । কোন অহংকারী লোকের দিকে তাকাতে আমার বয়ে গেছে ।


   তোর দাদুর বাস সব সময় আগে আসত । সেদিনও এল । বৃষ্টি পড়ছিল । স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়াল বাসটা । সবাই হৈ হৈ করে ছুটলো সেদিকে। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে আমি তাকিয়ে দেখি তোর দাদুর মাটিতে পড়ে আছে উপুড় হয়ে । আমি আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটলাম সেদিকে । বাসটা চলে গেল । আমি দৌড়ে গিয়ে তোর দাদুর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম । বিস্মিত কাদামাখা মুখে আমার দিকে সে তাকিয়ে ছিল । কিন্তু আমার হাত সে ধরল না । উঠে বসারও চেষ্টাও করল না ।


   একজন পথচারী ছুটে এসে ওকে ধরে তুললো । ওই অবস্থাতেও আমার মুখের দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে ছিল তোর দাদু । আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ভয়ে আমার দু চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে । আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তোর দাদু বোধহয় বাসের ধাক্কা খেয়েছে । সেই লোকটি ধরে ধরে ওকে আবার স্কুলে ফেরত নিয়ে আসলো । আমিও সঙ্গে সঙ্গে এলাম । যারা তখনো স্কুলে ছিলেন তাদের তত্ত্বাবধানে ওকে ভালো করে পরিষ্কার করে দারোয়ানের একসেট কাচা জামাকাপড় পরতে দেওয়া হল । ডাক্তার ডাকা হল । সে একেবারে হুলুস্থুলু কান্ড । 


   একটা গাড়ি করে দুজন সহকর্মীর সঙ্গে আমি গিয়ে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসলাম । কেউ আমাকে বারণ করল না আর বারন করলেও আমি শুনতাম না । আমার তখন তোর দাদুর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল । খালি ভাবছিলাম একটা বিরাট বড় ফাঁড়া কেটে গেল । একটা দুর্ঘটনা হতে হতে হয়নি । হলে আমার সারা জীবনটা বোধহয় নষ্ট হয়ে যেত । তোর দাদু কিন্তু সেদিন আমার দুর্বলতা বুঝে ফেলেছিল তাই মাঝে মাঝে সে সুখের বা বিজয়ীর হাসি হাসছিল । 


   বাড়িতে ফিরে দেরি হওয়ার কারণ বোঝাতে গিয়ে সব ঘটনা বলতে হল । আমি তো দিদির কাছে কেঁদে ফেললাম । দিদি সেদিন রাতে জামাইবাবুকে কি মন্ত্র দিলো কে জানে । পরেরদিন আমার কাছ থেকে ঠিকানা জেনে জামাইবাবু সোজা চলে গিয়েছিল তোর দাদুর বাড়ি । ব্যাস তারপর আর কি তোর দাদুই জিতল । পরের মাসে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এলেন আমাকে দেখতে পাকা কথা দিয়ে চলে গেলেন । " 


―“ আর সেই একমাস দাদুর সাথে তোমার কি কি কথাবার্তা হল ? স্কুলের বাইরে কতবার তোমরা দেখা করলে ? সেই রোমান্টিক কথা গুলো বলো । ওগুলোই তো আসল কথা । " কৌতুহলী শ্রেয়া দিম্মা র পাশে বসে প্রশ্ন করে । 


―“ওই তো পনেরোই আগস্ট তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ায় আমরা একটা পার্কে গিয়ে বসেছিলাম । তোর দাদু সেদিন পাঞ্জাবী পরে ছিল । হাতে কোনো গোলাপ ছিল না ।

   

   দেখা করা মানে ওই একদিনই আর স্কুলে তো রোজই দেখা হতো চিঠিপত্র আদান-প্রদান হতো । বাগদত্তা সামনে থাকলে যা হয় ।সেদিন পার্কে বসে তোর দাদু প্রথম প্রশ্ন করেছিল .. সেদিনকে এরকম বোকার মতো সবার সামনে কাঁদছিলে কেন ? 

    বুঝতেই পারছিস এরকম প্রশ্ন শুনে তো শুরুতেই আমি খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম । তারপর ফুঁসে উঠে বললাম ,..কখন কাঁদলাম ! মিথ্যা বলার জায়গা পাওনা না ? তাছাড়া চোখের সামনে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হতে দেখলে ভয়ে সবার চোখে জল এসে যায় । 

 ―“লজ্জার কিছু নেই সুচি । তোমার চোখে জল না দেখলে তো বিশ্বাসই করতাম না যে তুমিও আমায় ভালোবেসে ফেলেছ । নিজেকে তখন শাহজাহান মনে হচ্ছিল জানো ? " 


–“ আমি বাড়ি যাব । এরকম আজেবাজে কথা বললে আমি কিছুতেই এখানে থাকবো না । " শুনে তোর দাদু তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করল । "


―“ইসসস এরকম রোমান্টিক কথাবার্তা কেউ থামিয়ে দেয় ! কি অদ্ভুত তুমি দিম্মা ! " কপট রাগ দেখায় শ্রেয়া । 


―“ ভালোবাসা তো একটু অনুভূতির জিনিস । সেটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো । এটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার বিষয় । মুখে বলে প্রমাণ করার জিনিস নয় । " বলেন দিম্মা । 


  মা দিম্মাকে ডেকে নেন রান্নাঘরে । কি একটা রেসিপি জানার জন্য । শ্রেয়া চুপ করে বসে থাকে । ভালোবাসা সম্পর্কে তার বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে যা যা জেনেছিল সেই থিওরি গুলো আজ যেন সব গুলিয়ে গেল । সত্যিই তো ভালোবাসা একটা অনুভূতি । দুঃখ বিষাদ আনন্দ ইত্যাদির মতোই । এর তো কোন আধুনিক পুরাতন বলে কিছু হয়না । তাহলে বন্ধুদের কাছ থেকে যে কথাগুলো সে জেনেছে সেগুলো তাহলে একটাও এরকম ভালোবাসা নয় । আজ সে স্থির প্রতিজ্ঞ । যদি কোনদিন কারো জন্য এভাবে বুক কেঁপে ওঠে অথবা চোখ দিয়ে জল বের হয় তবেই নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করে কোন সম্পর্কে এগোবে । ভালোবাসার সংজ্ঞা তার কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন দিম্মা । 


  যদি এভাবে প্রেম আসে আসুক নইলে প্রেম নৈব নৈব চ ...। 


   




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance