ভালোবাসার প্রকাশ
ভালোবাসার প্রকাশ
# ছোটগল্প
কলেজে পড়তে পড়তেই যখন বিয়ে ঠিক করলো বাবা, তখন খুব কষ্ট হয়েছিলো আমার। গ্র্যাজুয়েশন টা করতে দাও না বাবা, কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। বাবা তখন খুবই অসুস্থ, হার্টের অসুখে ভুগছেন, মা বাড়িতে একা, তাই তো বিয়ে দেবার তাড়া, সব টা জেনেও এত তাড়া তাড়ি বিয়ে করতে ইচ্ছা ছিল না আমার। তুই তো সব বুঝিস মা, অসহায় গলায় বলা বাবার কথাগুলো আর ফেলতে পারিনি। যেদিন অরুণ দের বাড়ি থেকে দেখতে এলো, বুকে পাথর চেপে গিয়ে বসেছিলাম । আমার হবু শ্বশুর মশাই যখন বলেছিলেন, বিয়ের পরে পড়াশুনা করতে পারো তুমি, মনে মনে হেসে ছিলাম । আমার কত বন্ধুদের শ্বশুর বাড়ি থেকেই তো এইরকম বলেছিলো, কিছুই হয় নি আর বিয়ের পরে, জানতাম আমি।
তারপর অরুণ এলো একদিন, ওর দিদি, জামাইবাবুর সঙ্গে। আলাদা কথা বলতে চেয়েছিলো ও। কেনো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করছি, জানতে চেয়েছিলো আমার কাছে। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে চুপ করে ছিলো কিছুক্ষন, তারপর বলেছিলো, ভালো কোথাও নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য। আমাদের অত সামর্থ্য নেই শুনে আর কথা বাড়ায় নি। এরপর বিয়ের ঠিক হয়ে গেলো । স্বভাবে গম্ভীর আমার বর খুব বেশি কথা বলতো না, প্রয়োজন ছাড়া।
ছোটো থেকেই মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে খিদে পেতো আমার, তাই মা রাত্রে বিস্কুটের কৌটো রাখতো মাথার কাছে। নতুন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি এসে লজ্জায় কাউকে বলতে পারিনি সে কথা। একদিন রাত্রে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই খিদেয় পেট জ্বলছে, কিছুতেই ঘুম আসছে না। আমার ছট ফটানি দেখে ঘুম ভেঙে গেছে আমার বরের। কি হয়েছে জিজ্ঞাসার উত্তরে লজ্জায় চুপ করে ছিলাম আমি। কোনো কথা না বলে চুপ করে শুয়ে আছি দেখে এক সময় ও ও শুয়ে পড়লো। পরের দিন সন্ধ্যে বেলা যখন অফিস থেকে বাড়ি ঢুকলো হাতে একটা বড়ো প্লাস্টিকের ব্যাগে একটা বড়ো বিস্কুটের কৌটো নিয়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বললো মা কে ফোন করেছিলাম বাবার খবর নেবার জন্য, উনি বললেন রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে খিদে পায় তোমার, তাই।
একদম অন্যরকম লাগলো অরুণ কে, এত টা খেয়াল রেখেছে ও, অবাক হয়ে ভাবলাম আমি। এর কয়েকদিন পরের কথা। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকেছি, বরের অফিস এর তাড়া, হটাৎ আমার শাশুড়ি মা বললেন যাও তোমাকে অরুণ ডাকছে, ওর সঙ্গে একটু বাড়ি যেতে হবে। খুব টেনশন হচ্ছিলো, শুধু মনে হচ্ছিলো বাবার কিছু হয়নি তো? অরুনের গম্ভীর মুখ দেখে সারা রাস্তা টা ভয়ে কোনো কথা বললাম না আর। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে বাড়িতে ঢুকে দেখি, বাবা বসে আছে খাটে, পাশে মা, ভীষণ শান্তি হলো মনে। দুজনকে দেখে মনে হলো আমরা আসবো জানতেন ওঁরা। মা কে জড়িয়ে ধরে বললাম কি হয়েছে মা? মা হেসে বললো জানিনা তো। অরুণ গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো বিয়ের সময় সুটকেসে করে এত জিনিস নিয়ে গিয়েছ আর মার্কশিট গুলো যে নিয়ে যেতে হয় সেটা জানোনা? খামোকা, একদিন অফিস কামাই করে দিলে আমার, তাড়া তাড়ি করো কলেজে ভর্তির সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, অনেক টা পথ ফিরতে হবে আবার।
ভিতর টা আনন্দে লাফাচ্ছিলো যেনো, দ্রুত মার্কশিট নিয়ে বেরিয়ে এসে সেদিনই কলেজে ভর্তি হলাম আমি। খুব ইচ্ছে করছিল ও কে জড়িয়ে ধরে বলি আমি কতটা খুশি হয়েছি, কিন্তু সারাটা রাস্তা এমন গম্ভীর মুখে বসে রইলো যে সাহসই পেলাম না। কলেজ, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম ক্রমশ। পরীক্ষা শুরু হয়েছিলো। অরুণ ও কিছুদিন ধরেই বেশ দেরি করে ফিরছিলো অফিস থেকে। ও ওর গম্ভীর ভাবের খোলস ছেড়ে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইতো না যেনো। তাই অনেক কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারতাম না আমি। অফিস থেকে ফিরেও কার সঙ্গে ফোনে কথা বলতো প্রায়, আমি গেলেই রেখে দিতো লক্ষ্য করছিলাম। মন টা খুব খারাপ লাগছিলো। এমনি এক সময়ে হটাৎ একদিন অফিস থেকে ফিরে বললো আমাকে অফিস ট্যুরে যেতে হবে কাল, ব্যাগ টা গুছিয়ে রেখো। কতদিনের জন্য যাবে? আমার প্রশ্নের উত্তরে বললো ঠিক নেই। তারপরের দিন চলে গেলো ও। কলেজ থেকে ফিরে এসে মন খারাপ লাগতো খুব। যদিও ও কথাই বলতো না আমার সঙ্গে তাও চোখের সামনে থাকতো তো অন্তত। শাশুড়ি মা কে বললাম বাড়ি থেকে ঘুরে আসি কদিন, মা কে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। উনি বললেন অরুণ আসুক, তারপর ওর সঙ্গেই যেও। খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতেও দেবেন না এরা। এর মধ্যেই একদিন অরুনের অফিস থেকে একটি ছেলে ফোন করলো। আমি তখন পড়ছি বসে, ট্যুরে গেছে শুনে অবাক হয়ে বললো উনি তো ছুটি তে আছেন, জানেন না আপনি? সারা শরীর কাঁপছিলো, একি সর্বনাশ হলো আমার? রাত্রে খেতেও উঠলাম না আর সেদিন। পরের দুদিন আর কলেজে ও গেলাম না, সব কিছুই যেনো শেষ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছিলো। এ ভাবেই কাটলো দিন তিনেক, সকালে শাশুড়ি মা এসে বললেন দোতলার গেস্ট রুম টা কে একটু গুছিয়ে রেখো, বিকেলে দিদিরা আসবে। আমার মুখ দেখে অবাক হয়ে বললেন কি হয়েছে তোমার? শাশুড়ি মার প্রশ্নের উত্তরে শুধুই কান্না পাচ্ছিলো, কিছু না, মাথা নেড়ে বলেই দোতলায় উঠে গেলাম, ঘর গোছাতে।
বিকেলে চুপ করে শুয়ে আছি ঘরে, অন্ধকার হয়ে আসছে, তাও আলো জ্বালতেও উঠতে ইচ্ছা করছেনা আর, যার জীবনের আলোই নিভে যাচ্ছে তার আর বাইরের আলো কি করবে। এতো তাড়া তাড়ি কি ভাবে এত পাল্টে গেলো অরুণ, চুপ করে শুয়ে ভাব ছিলাম আমি। দরজায় বেলের শব্দ শুনতে পেলাম তাও উঠে দরজা খুলতে যেতে ইচ্ছা করছিলো না একটুও। একটু পরেই অনেক লোকের কথার আওয়াজের সঙ্গে আমার ঘরের দরজা খুলে গেলো, মাসি শাশুড়িরা এসেছেন বুঝতে পেরে উঠে বসলাম, ঘরের আলো টা জ্বালিয়ে দিলেন শাশুড়ি মা, চমকে উঠে দেখলাম সামনেই দাঁড়িয়ে আমার মা। লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি, এসে দেখি সিঁড়ি দিয়ে বাবাকে ধরে ধরে ওপরের গেস্ট রুমে নিয়ে যাচ্ছে আমার বর। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে মা বললো ভেলোর থেকে অপারেশন করে নিয়ে এসেছি তোর বাবার, সব টাই তো অরুণ ই করলো, ও সঙ্গে না গেলে আমার একার পক্ষে কি সম্ভব হতো এত কিছু। তোর পরীক্ষা ছিলো তাই আর বলিনি তোকে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, কেউ কেউ এরকম ভাবেও, কিছু না বলেও ভালোবাসা দেখায়! ওপরের ধাপে উঠতে থাকা বাবা আর অরুণ কে দেখতে পাচ্ছিলাম না আর, চোখ টা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে খালি, ধুর! আনন্দ হলেও এত কান্না পায় কেনো কে জানে।