অপরাহ্নের আলো
অপরাহ্নের আলো
অপরাহ্নের আলো
বৈশাখের মাঝামাঝি হয়ে গেল এখনো কালবৈশাখীর দেখা পাওয়া গেলো না। উঃ কি গুমোট গরম । চারি দিক যেন থম মেরে আছে ।গাছের পাতাও যেন নড়ছে না। সকাল থেকে ভ্যাপসা গরমে শরীরটাও যেন ক্লান্ত লাগছে।একটু নুন চিনির জল করে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল সুদেষ্ণা।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ,
না ঠিক আছে,কাপড়টা যা আছে চলে যাবে , চারিদিক তো ফাঁকা কে আর দেখছে! চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল।আজ আর হাঁটবেনা ,পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসবে।তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে,গতিক ভালো ঠেকছে না।বেলা গড়ার অনেক আগেই রোদ টা পড়ে গেছে।বাতাসটা ভারী ঠেকছে, কিছু হলেও হতে পারে।
পা চালালো সুদেষ্ণা," সহচরী"-এপার্টমেন্ট থেকে পার্ক টা একটু দূরে, শরীরের জন্য এই হেঁটে আসাটাই যা একটু কাজের হয়। পার্কে এসে আর না হাঁটলেও চলে।একটু বসে আবার তো ফিরতে হবে ।
বেঞ্চে এসে বসেই শরীরটা এলিয়ে দিলো সুদেষ্ণা,চোখ বন্ধকরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ।মনে মনে গুন গুন করতে লাগলো , "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পূর্ণ করো......"।এই এক বদ অভ্যাস সুদেষ্ণা র গান ধরলে কোনো স্থান কালের হিসেব থাকেনা।গুন গুন শব্দ টা এখন একটু জোরেই শোনা যাচ্ছে।
--------------------------------------------
দুপুরের খাবার টা একটু ভারী হয়ে গেছে
বুঝতে পারছে অপরেশ চিংড়ি মাছের মালাইকারি,তার সঙ্গে আবার কিমা চচ্চড়ি, ধোকার ডালনা।মিনতি আজকে যত্ন করে কাকাবাবুকে খাইয়েছে।বৌদি বলে গেছে খেতে দিয়ে যেন সামনে থেকে চলে না যায়।দুপুরে মালবিকা বাড়ি থাকে না তাই খেতে দেওয়ার দায়িত্বটা মিনতির। সকাল সকাল মিনতি এসে মালবিকা কে রান্নায় সাহায্য করে।রান্নাটা মালবিকা নিজেই করে।শশুর মশাই মালবিকার হাতের রান্না খেতে ভালোবাসেন। দুপুরে কাছে বসিয়ে খাওয়ানো হয়ে ওঠে না তাই মিনতি কে বলা আছে শশুর মশাইকে খাইয়ে যেন নিজেও খেয়ে নেয়।বিকেলে বাবা হাঁটতে বেরোবার আগে এক কাপ চা দিয়ে তবে তার ছুটি।তবু মিনতি এ বাড়িতে কর্তব্যের খাতিরে কাজ থেকে পালাই পালাই কোনদিনই করতে পারেনা।কোথায় যেন একটা টান অনুভব করে।সব কাজ সারা হয়েও যেন হয় না ,যাই যাই করেও যেতে পারে না।মালবিকা ফেরা পর্যন্ত ঘর আগলে বসে থাকে।
কিন্তু আজ অপরেশ মিনতি কে চা করতে বারণ করলো।
" মিনতি এখন চা কোরোনা, মালবিকা ফিরলে
একসঙ্গে চা খাবো ,এখন একটু হেঁটে আসি পেটটা
ভারী হয়ে আছে ।"
মিনতি এ বাড়িতে কাজ করছে তা প্রায় বছর পনেরো হয়ে গেছে।কাকিমা বেঁচে থাকতে তাকেও হাতে হাতে সব রকম সাহায্য করত। কাকিমা মারা যাওয়ার পরতো একরকম সংসারের হাল ধরেছিল এই মিনতিই ।এক বছর সমস্ত সামলেছে।
বছর ঘুরতেই দাদার বিয়ে দেওয়া করিয়েছে।বৌদি
আসতেই সংসারের ছিরি ফিরেছে,তাও কি কপালে সইল ।সেই যে ওপরে বসে যিনি সব দেখছেন আর কলকাঠি নাড়ছেন,তারই চোখ লেগেছে এ সংসারে।
তাই তো এমন সুন্দর বউ কে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য
হলো।এ সব তারই কারসাজি ছাড়া আর কি বলবো!
এ বাড়ির সুখ দুঃখের থেকে নিজেকে তাই আলাদা
করে দেখতে পারেনা মিনতি ।আপনি আজ্ঞের পাট
তাই অনেক দিনই উঠে গেছে ।
চায়ের জল চাপাতে বারণ করতেই মিনতি বললো ,
" বেরোবার আগে কাকাবাবু এই ওষুধটা দু চামচ খেয়ে নাও তো দেখি, বৌদি আমায় দিয়ে রেখেছে,দেরি কোরোনা খেয়ে নাও।"
- ওঃ পাগল করে দিবি।সবসময় খবরদারি , কিসের জন্য কার জন্য এত সাবধানতা , সব তো গেছে আর আমিই বা বাদ থাকি কেন।?------------
মিনতি ধমকের সুরে বললো
অমন কথা কখনও বলো না কাকাবাবু ,বৌদির মাথায় ছাতাটা ধরবে কে শুনি? যখন তখন মুখে যা খুশি আনবে না।
যাও দুগ্গা দুগ্গা করে ঘুরে এসো দেখি।
পায়ে চটি জোড়া গলিয়ে বেরিয়ে এলো অপরেশ । কানে না এলেও মিনতি লক্ষ্য করলো মুখে কি সব বিরবির করছে কাকাবাবু।
মিনতি টাও আজকাল বাড্ডোবেশী মাথা ঘামাছছে এ বাড়ি নিয়ে, মালবিকা ওকে দায়িত্ব দিতে দিতে আস্কারা বাড়িয়ে দিয়েছে।রাগ হলেও ভালো লাগছে অপরেশের তাঁর জন্য ভাবার লোকের অভাব নেই ,আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে ।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে মালবিকার ব্যাপারটা অপরেশকে ভাবিয়ে তুলছে ।অলকেশ চলে যাবার পর থেকে মালবিকা নিজের চারপাশে একটা অদ্ভুত আচ্ছাদন ফেলে রেখেছে যে টা সরিয়ে অনেক সহজ কথাই সহজ ভাবে বলা যায় না। ওর বয়সী মেয়ে বউ দের দেখলে মনটা হু হু করে ওঠে, মেয়েটা শখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়েছে, শুধু সংসারটা নিয়ে পড়ে আছে। তাও এ পোড়া সংসারের কি ছিরি। না আছে ওর স্বামী সন্তান , না আছে শাশুড়ি। এ ভাবে বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না ।
পথ চলতে চলতে নিজের অজান্তেই অস্থির ভাবে মাথা নাড়লেন। না হয় অলকেশ মালবিকা দুজনে ভালোবেসে বিয়ে করে ছিল , তাই বলে বাকি জীবনটা সেই ভালোবাসার দায় বহন করে চলতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই। যা করার অপরেশকেই করতে হবে। বাপের বাড়ি তে থাকলো না।তাঁরা তো হাত ধুয়ে ফেলেছে।
বয়স্কা মাকে তো দোষ দেওয়া যায় না।আর দাদা
বৌদির তো চক্ষুলজ্জা মুখো লজ্জা বলতে কিছুই
নেই। জামাই একসিডেন্ট এ মারা গেলে বোন টার
ওরকম অবস্থাতেও বলে কিনা,
" মা তো এ বাড়ি ছেড়ে যেতেই চাইছে না , এদিকে যাদবপুর এ আমাদের ফ্ল্যাট টা খালি পড়ে আছে , ভাড়া দিলে বাড়ির যা হাল করবে তা বলার না, মালা যদি মায়ের কাছে থাকতো তো মায়ের ও ভালো লাগতো "।
আসলে শাশুড়িকে ঘাড় থেকে কি করে নামানো যায় তার অজুহাত আর কি ।মালবিকাই সেদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল।কোনো দ্বিধা না করেই বলে ছিল বৌদিকে ,
আমার ব্যবস্থা তো সুন্দর করে ফেললে, তা আমার শশুর মশায়ের কি ব্যাবস্থা করবে , তাঁর কে আছে?
অপরেশ এ সবের মধ্যে কোনো মন্তব্য না করলেও মালবিকাকে সেদিন শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আরো নীবিড় করে কাছে টেনে নিয়েছিল।কিন্তু এ ভাবে চলতে দেওয়া যায় না।বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।স্বার্থপরের মতো নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছে অপরেশ।এই বেলা কিছু করা দরকার। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনটা ভারী হয়ে উঠছে, পার্কের কাছাকাছি এসে ভাবনায় ছেদ পড়লো।দূর থেকে সুদেষ্ণা দেবীকে দেখা যাচ্ছে।
গেটের দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন।ওনাকে বসে
থাকতে দেখে মনটা হালকা লাগছে।অপরেশ নিজেও
ভালো করে জানেনা ওই মহিলা কে দেখলে কেন এই
ভালো লাগার অনুভূতি টুকু উপলব্ধি করে।অথচ রোজ যে নিয়ম করে ওনার সঙ্গে দেখা হয় তাও নয়।সুদেষ্ণা দেবী একটু তাড়াতাড়ি এসে ঘুরে যান।হয় তো কখনো সখনো পার্ক থেকে বেরোবার সময় ক্ষনিকের দেখা, শুধু এক আধ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে কুশল আদান প্রদান।বোধহয় বছর দুয়েক হবে ওনাকে দেখছেন অপরেশ।
মনে পড়ে যায় বছর দুয়েক আগের এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলের কথা ।পার্কে পৌঁছনোর মুখে বৃষ্টি নেমেছিল তাই সেদিন আর হাঁটা হয়নি অপরেশের।গেটের পাশেই বেঞ্চে বসে ছিলেন,দেখলেন চটি হাতে সুদেষ্ণা দেবী পার্ক থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তখনও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আলাপ না থাকলেও সকলেই মোটামুটি চেনা।অপরেশ ছাতাটা খুলে এগিয়ে গেলেন ,সুদেষ্ণা দেবীর মাথায় ছাতা ধরতে উনি হকচকিয়ে গেলেন।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ,
বৃষ্টি বেশি পড়ছে না আর আমার মাথায় ছাতা ধরতে গিয়ে আপনি নিজে ভিজে যাবেন।
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, আমার ছাতাটা এত বড়ো যে এক মাথায় দিতে অস্বস্তি হচ্ছিল,এবার একটু স্বাভাবিক লাগছে।
সুদেষ্ণা দেখলো সত্যিই একজনের জন্য ছাতাটা অনেকটাই বড়ো।
এখান থেকে আমার ফ্ল্যাটটা তা অনেকটা দূরে।আপনি শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন।
এই সব কথা বলে আজ কাল সবাই আমার বয়সটা বাড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ বলে ওষুধ খান ,কেউ বলে বাজার থেকে রিক্সা করে ফিরবেন, তার সঙ্গে আপনিও জুড়ে দিলেন। এখন চলুন, ওই দেখুন জুতো সারাবার জন্য ডাকাডাকি করছে আপনাকে।
সুদেষ্ণা আরও বিপদে পড়লো, সঙ্গে পয়সাকড়ি কিছুই নেই একরকম খালি হাতে বেরিয়ে এসেছে, আমতা আমতা করছে ,
না না এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়াবার দরকার নেই ।ঘরে আরো দুজোড়া চটি আছে চলুন এগোই।
তা বললে হয় নাকি ,বেচারা বৃষ্টির মধ্যেও বসে আছে পয়সার দরকার তাইতো , অথচ তারই সামনে দিয়ে আপনি ছেঁড়া চটি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন এটা কি অন্যায় করবেন না।
নাছোড়বান্দা ভদ্রলোকটিকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লো সুদেষ্ণা । মনে মনে ভীষণ বিরক্তি বোধ করছে। চটি সারানোর পর পয়সা মিটিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।নিরুপায় সুদেষ্ণা বোকার মতো চেয়ে রইলো।সেই দিনই সুদেষ্ণা দেবীর " সহচরী "
এপার্টমেন্ট টা বাইরে থেকে দেখে ছিলেন অপরেশ।
রাজারহাট এর এই দিকটায় কখনো আসা হয় নি।
কথায় কথায় জেনে নিয়েছিলেন নামটা আর জেনে
ছিলেন একটাই মেয়ে,মেয়ে জামাই ইংল্যান্ড এ থাকে
ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণা একাই থাকে।তারপর আর সেরকম ভাবে দেখা হয়নি।
,আজ অনেক দিন পর সুদেষ্ণা দেবী কে বসে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি পা চালালেন অপরেশ।বেলা পড়ে গেছে তাও চেনা পরিচিত কাউকেই চোখে পড়ছে না।এখন তো সবে চারটে বেজেছে ।সুদেষ্ণা দেবীর ফ্লাট তো অনেকটা দূরে, মনে হয় অনেকক্ষণ বেড়িয়েছেন। কাছাকাছি আসতেই সুর ভেসে এলো ,
তাই চলার গতি কমিয়ে দিলেন অপরেশ ।ভালো লাগছে গান শুনতে পেয়ে।চাপা গরমে ভারী পরিবেশ
টা যেন হঠাৎ ই হালকা মনে হচ্ছে।পিছন ফিরে বসে
ছিলেন তাই অপরেশ কেই জানান দিতে হলো গান
থামতেই বললেন ,
আমার সৌভাগ্য যে এই সুন্দর জিনিস টা থেকে বঞ্চিত হই নি।
ও মা,আপনি কতক্ষণ
ছি ছি এভাবে বলবেন না।চারিদিকে এত শূন্যতা হাঁপিয়ে উঠে ছিলাম তাই ।
দম বন্ধ করা গরমে আমিও তো ক্লান্ত, আপনার গান শুনে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম।
দুজনে প্রায় এক সঙ্গে হেসে উঠলেন, চারিদিক সঙ্গে সঙ্গে গম গম করে উঠলো।লজ্জা পেয়ে সুদেষ্ণা একটু কুঁকড়ে গেল ।পরিস্থিতি হালকা করতে অপরেশ বললেন,সত্যি কতদিন এভাবে হাসিনি।হাসতে যেন ভুলেই গেছি।
সুদেষ্ণা - হাসতে তো ইচ্ছে করে
কিন্তু হাসার পর মনে হয় ঐ হাসি টা যেন আমাকেই
বিদ্রুপ করছে ।মনে হয় বলছে ও হাসি হাসার অধিকার তোমার নেই।
অপরেশ - ওটাই তো আমাদের সমস্যা, জটিলতা তো আমাদের মনে।আমরা নিজেরাই অনেক কিছু ঠিক করে ফেলি।যার জন্য আমরা নিজেরাই কষ্ট পাই ।
সুদেষ্ণাকে যেন অপরেশের কথা গুলো সাহস জোগাল,একটু যেন বেপরোয়া ভাবেই বললো চলুন ওই দিক টা একটু ঘুরে আসি ।
অপরেশ একটু কৌতুক করে সুদেষ্ণার চোখে চোখ রাখলো ,বললো যাবো বলছেন? উদাসীনতার সঙ্গে প্রত্যুত্তর করলো,
কেন, এই যে বললেন ,বেশি কিছু না ভাবটাই সুস্থতার লক্ষন।কথাটা বলেই সুদেষ্ণা আর এক বার প্রাণ খোলা হাসি হেসে নিলো।
শরীর মনে যে বিষন্নতা মেখে অপরেশ ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলেন ,সুদেষ্ণার হাসিতে যেন তা কর্পূরের
মতো উবে গেল। হালকা হাসি মাখা মুখে হাঁটতে হাঁটতে বললেন ,
এদিকটায় একটা শপিংমল আছে না?
হ্যাঁ, শপিংমলটার পিছনে বেশ কতগুলো ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে।বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে সামনে থেকে।
আপনি তো বেশি দিন ফ্লাট কিনে এদিকে আসেন নি।এদিকটায় কিনতে পারতেন পার্কের কাছাকাছি হতো।আপনার এপার্টমেন্ট টা অনেকটাই দূর পড়ে।অবশ্য একদিকে ভালোই, যেতে আসতেই হাঁটা হয়ে যায়,মাঝে একটু পার্কে জিরিয়ে নিলেই হলো।
সুদেষ্ণা আবার মজা করে বললো,তাহলেই
দেখুন , কত ভেবেচিন্তে কিনেছি । বলে বেশ শব্দ করে
হেসে উঠলো।
আজ যেন সুদেষ্ণাকে হাসিতে পেয়েছে।
হাসি থামিয়ে বেশ একটু গম্ভীর হয়েই বললো ,
আসলে ব্যাপারটা তা নয়,"সহচরী "এপার্টমেন্ট এর ভিতরে থাকার অনেক কিছু সুবিধে আছে। বছর দুয়েক আগে মেয়ে জামাই ইংল্যান্ড চলে গেল। আমাকেও ওদের সঙ্গে নেবার জন্য জেদ ধরলো। শেষে আমি রাজি না হওয়ায় দুজনে মিলে খোঁজাখুঁজি করে এটা কিনেছে।
এই এপার্টমেন্ট এ যাঁরা থাকেন তাঁরা অনেক সুবিধে
পান , বিশেষ করে যাঁরা বয়স্ক তাদের জন্য আলাদা
ব্যাবস্থা আছে।ভিতরে ছোটখাটো একটা নার্সিং হোম
আছে।নিয়মিত ডাক্তারের ব্যাবস্থা আছে,বাড়িতে কেউ অসুস্থ থাকলে তাদের জন্য নার্স কিংবা লোকের দরকার হলে তাও পাওয়া যায়।ফ্লাট কেনার সময় এককালীন টাকার বিনিময়ে নিয়মিত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হয়, আবার মাসে মাসেও দেওয়া যায়, সে ব্যাবস্থাও আছে ।যার যা প্রবলেম ওদের কাছে সব নথিভুক্ত থাকে ,তাকে সেই ভাবে চিকিৎসা করা হয়।
পঞ্চাশের ওপর যাদের বয়স তাদের প্রত্যেককে নিয়মিত ভাবে ব্লাড প্রেসার ,ব্লাডসুগার পরীক্ষা করার
ব্যাবস্থা রয়েছে, এটার জন্য কোনো পয়সা লাগে না।
বছরে দুবার ঘুরতে যাওয়ার ব্যাবস্থা আছে,নিজেরাই
বাস ছাড়ে।এর জন্য মাথাপিছু খরচ নির্ধারিত থাকে।
নিশ্চিন্তে কাটাবার জন্য সহচরী তে আসা।এছাড়া সব
ঋতুতে নানারকম আনন্দ উৎসব তো লেগেই আছে।
একটানা বলে সুদেষ্ণা হাঁপ ছাড়ল।
আপনি যা বললেন শুনে আমার সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে।আমাকে এবার মালবিকা কে রেহাই দিয়ে এরকমই একটা জায়গা খুঁজে নিতে হবে।
সুদেষ্ণা একটু অবাক হলো ,ভদ্রলোক বলেন কি!
কাকে রেহাই দিতে চাইছেন? তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটাই বা
কি? আসলে ভদ্রলোকের সঙ্গে নামমাত্রই দেখা হয়েছে
কথা যা হয়েছে তা হাতে গোনা ,ভদ্রলোকের সম্মন্ধে
কিছুই জানা হয়নি ,কোথায় থাকেন বা নাম কি কিচ্ছু না।কোনো রকম আপনি আজ্ঞে করেই ভদ্রতা সারছে সুদেষ্ণা ।তাই বাধ্য হয়েই বলল ,
আপনার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি নিজের ব্যাবস্থা করে কাকে রেহাই দিতে চাইছেন ,কথাটা বলেই সুদেষ্ণা লজ্জা পেল।আমতা আমতা করলো,না না থাক ও সব আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার,শুধু বলছিলাম আপনার নাম টা জানা আমার উচিত ছিল।
কোথায় থাকেন, নাম টা কি , কিছুই জানিনা। আমি
সুদেষ্ণা মৈত্র ,সহচরী তে থাকি।
অপরেশকে অনেকটাই চিন্তিত দেখাচ্ছে, গম্ভীর মুখে বললো,পরিচয় যখন হয়েছে তখন ব্যক্তিগত বলে আলাদা কিছু হয় না,
"অপরেশ রায় "ওই নাম টুকু ছাড়া আমার ব্যক্তিগত বলে আর কিছুই নেই। স্ত্রী ছিল আমার, নানান প্রবলেম ছিল অনেক বছর কষ্ট পেয়েছে, শেষে আমার রিটায়ারমেন্ট এর দু বছর আগেই সবাই কে ছেড়ে চলে গেল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিলাম, কচি মেয়েটাকে রেখে একটা একসিডেন্ট এ ছেলে টা ও চলে গেল।
বলতে পারেন আমার মতো অভাগার কে আছে! 'মালবিকা' আমার ছেলের বউ,আর সেই পরিচয় আঁকড়ে ধরে কর্তব্য করে চলেছে।নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে ভবিষ্যতের কথা না ভেবে এভাবে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার কোনো মানে হয় !
পনেরো বছর ধরে মিনতি ' কাজের মেয়ে' আমার দেখভাল করছে।পরমা আমার স্ত্রী থাকতে ওরই কাজের সুবিধের জন্য মিনতি কে রাখা, তারপর পরমা অসুস্থ হয়ে পড়ায় মিনতিই পরমার দেখাশোনার ভার নেয়।পরমা চলে যেতে সংসারের হাল ধরে মিনতি ।এখন তো মালবিকাও মিনতির উপর ভরসা করে অনেকটাই নিশ্চিন্ত।রাতে বাড়ি যাওয়া ছাড়া আমার বাড়িতেই থাকে ।
পরমা চলে যাওয়ার পর ও খুব ভেঙে পড়েছিল।কাকিমা বলে ডাকলেও পারোমাকে মায়ের জায়গা দিয়েছিল মিনতি।সবাইকে এতটাই ভালোবাসে ওকে আর আলাদা করে দেখি না ।ও বাড়ির একজন হয়ে
গেছে।মালবিকা আর মিনতি দুজনই আমার কাছে মেয়ের মতো।সবাই কে একে একে ছেড়ে দিতে বাধ্য
হচ্ছি ।সবই কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে। কোনো কিছু তেই আর অসুবিধে হয় না। এই বুড়োটার জন্য বসে থেকে নিজের অমূল্য সময়টা মালবিকা নষ্ট করছে।ওর বাবা থাকলে কি মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতো
না ।আমার মতো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকত। এর পর তো আমি নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাবো।
অপরেশের কথা শুনতে শুনতে সুদেষ্ণার মনটা খুব ভারী হয়ে উঠেছিল।কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। শঙ্খ বাজছে ,আওয়াজ ভেসে আসতেই সজাগ হলো সুদেষ্ণা। কি যে বলবে ভেবে পাচ্ছে না , এত তরতাজা রসিক মনের মানুষটার ভিতরটা এরকম ভগ্নদশা! পরিবেশটা ভারী মনে হচ্ছে।
সময়টা যেন থমকে গেছে।অপরেশবাবু কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই থেমে পড়ছেন সুদেষ্ণা লক্ষ্য
করেছে, তাই বললো , আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে
অপরেশবাবু, চলুন ওই বেদীটায় একটু বসা যাক।
না সুদেষ্ণা দেবী কথায় কথায় অনেক দেরি হয়ে গেছে।
দোয়ামনা করতে করতে বললেন, বসতে তো কোনো
আপত্তি নেই কিন্তু যতই অস্বীকার করি না কেন।ভাববার জন্য তো ঘরে আছে একজন ,দেরি দেখলেই মিনতিকে বলবে, দ্যাখোতো এগিয়ে একটু পার্কের রাস্তাটা ।
আপনার কাছে যা শুনলাম তাতে মালবিকার প্রতি শ্রদ্ধা গর্ব দুই হচ্ছে আমার।
ওর জন্য যতটা বলবো কম বলা হবে সুদেষ্ণাদেবী।
অপরেশবাবু আপনি মালবিকার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করুন,
ওর ব্যাপারে সত্যি আপনার একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া
প্রয়োজন।
হ্যাঁ দেখি কি করতে পারি বলে অপরেশ আর দাঁড়ালেন না।
বাড়ি ফিরে দেখলেন তখনও মালবিকা ফেরেনি। কিছু কেনাকাটা থাকলে অফিস ফেরত করে নিয়ে আসে।সবটা অপরেশকে সামলাতে হয় না।অপরেশ এও লক্ষ্য করেছে ,যে দিন মালবিকার দেরী হয় সেদিন প্রবালের গাড়িতে ফেরে।প্রবাল ছেলেটা ওদের কলেজে বছর তিনেক হলো এসেছে ।প্রবালের সঙ্গে মালবিকার সম্পর্কটা কতদূর এগিয়েছে তা আন্দাজ করতে না পারলেও, দুজন দুজনকে পছন্দ করে তা অপরেশ বোঝেন ।মালবিকা ফিরতেই মিনতি কে বলে রেখেছিলেন অপরেশ,তাই সে প্রবাল কে ভেতরে ডেকে আনল।
মালবিকা প্রবাল কে আসতে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে কপট রাগ দেখালো,এই যে বললে আসবে না।"
আসতাম না তো কিন্তু মিনতি দি বললো কি স্পেশাল বানিয়েছে খাওয়াবে , তাই না এসে পারলাম না।
"- তাই বুঝি, আমি আসলেই তো তার যাই যাই শুরু হয়ে যায় ,সে আবার কি খাওয়াবে।
হ্যাঁ গো বৌদি , তোমরা কি চাইনিজ খাও,আমি বানাতে চেষ্টা করেছি, খেয়ে দেখবে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর মো মো।
আনন্দে লাফিয়ে উঠলো মালবিকা, বলো কি মিনতিদি
সঙ্গে চাটনি কিছু বানিয়েছো ,না আমি বানাবো?
মিনতি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললো ,লাল চাটনি সবুজ
চাটনি দুটোই বানিয়েছি।
ওঃফ মিনতিদি সামলাতে পারছিনা।হাতে মুখে জল দিয়ে এখনই আসছি, তুমি রেডি করো।সঙ্গে তোমারটাও আনবে এক সঙ্গে খাবো।
না বৌদি, তোমরা আনন্দ করে খাও, আমি দেখবো ওটাই আমার ভালো লাগে।সে তো লাগে আমিও জানি কিন্তু বাড়ি গিয়ে দাদার সঙ্গে খেতে যে আরও ভালো লাগে সেটাও জানি।ঠিক আছে ,তোমার আর দাদার টা আগে তুলে রাখো।
মো মো আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর ঠ্যালায় প্রবাল যে কেন
আসবো না বলেও এলো তা আর মালবিকার সন্দেহের তালিকায় ধরা পড়লো না।
এরই মধ্যে প্রবাল এসে বসতেই কোনো রকম কিন্তু না করেই অপরেশ বললেন মিনতি খাবার নিয়ে আসার আগেই তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করছি প্রবাল, মালবিকার কথা আমাদের কথা তুমি সবই জানো,আর আমার মনে হয় তোমরা দুজন দুজনকে পছন্দও করো। তাই বলছিলাম তোমার যদি আপত্তি না থাকে তা হলে ব্যাপারটা আর একটু এগিয়ে নিলে --------- আসলে বুঝতেই তো পারছো আমার তো বয়স হয়েছে,তোমাদের সম্পর্কের একটা পরিণতি
হলে ভালো হতো।
মেসোমশাই ডাকতেই বুঝতে পেরেছিল প্রবাল, এরকমই একটা কিছু বলবেন তাই
উত্তর দেবার আগে বেশ কিছুক্ষণ মাথা তুলতে পারে নি, তারপর মাটির দিকে চোখ রেখেই বললো,আমার
দিক থেকে তো আপত্তির কোনো কারণ নেই, বাড়িতে
পিসিরও শরীর স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না, প্রায়ই আমাকে
ব্যাস্ত করে তুলছে।মালা আসলে কোন সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে চাইছেনা।ওঁর মধ্যে কিছু সংস্কার কাজ করছে, এরকম কিছু আলোচনা ও সব সময় এড়িয়ে যেতে চায়। কারণ জিগ্যেস করলে বলে
”আমি অমলেশের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ও আমাকে ভরসা করে ছিল।আমি স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হতে পারবো না।আমি আমার নিশ্চিত আশ্রয় টুকু হারিয়ে রাতে শান্তিতে একটু ঘুমোতেও পারবো না। এই বেশ আছি।"
প্রবালের কথা গুলো শুনতে শুনতে অপরেশের পারদ চড়ছিলো ,অস্থির ভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।প্রবাল
যখন মালবিকাকে মালা বলে কথা শুরু করেছিল তখনই অপরেশ বুঝতে পেরেছেন ওদের সম্পর্কে কোনো কিন্তু থাকতে পারে না।তাই বললেন,
ও কি ভাবছে এটাই ওর একমাত্র জায়গা ,শেষ ঠিকানা।কেন তুমি কি ওকে একটা সুস্থ জীবন, নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারোনা ,সে আস্থা টুকু নেই!
এই ভাবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ,মনকে প্রবোধ দিয়ে কতো দিন বাঁচবে?
একে কি বাঁচা বলে ?
ও আমার কথা ভেবে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে আর আমাকেও অপরাধী করে তুলছে।আমার জন্য তো মিনতি আছে,ওতো ছেড়ে যাচ্ছে না।সে রকম হলে ওর স্বামী প্রকাশ কে নিয়ে ও এ বাড়িতেই থাকবে।
শেষের কথা গুলো শুনতে শুনতে মিনতি খাবারের প্লেট নিয়ে চলে এসেছে পিছনে মালবিকা।মালবিকা হাসতে হাসতে বলল সেই ভালো বাবা ,
মিনতিদির এই আসা যাওয়ার ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না।প্রকাশ দা এখানে থাকলে আমি
অনেকটা হালকা থাকবো।
অপরেশ কথার খেই ধরেই বললেন ,
তোমাকে থাকতে হবে না,
তুমি এখন আমার মেয়ে,
বাবা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে,
আমি এবার তাই করবো।প্রায় ধমকের সুরেই বললেন,
আমার এমন কিছু বয়স হয়ে যায়নি যে আমার পাশে
সব সময় শিখন্ডী হয়ে কাউকে হাজির থাকতে হবে।
পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে এলো, মিনতি খাবারের প্লেট রেখে চলে গেল। মালবিকা নিঃশব্দে খাবারের প্লেট হাতে তুলে দিতে দিতে বললো, বাবা আপনি তো জানেন, আপনাকে ফেলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
এসব কথা আগেও অনেক বার শুনেছি, এসব কথা বলে আর কতো আমাকে দোষের ভাগী করবে? শুধু তুমিই সব দায়িত্বের বোঝা কাঁধে তুলে নেবে, আর আমার কপালে শুধুই অপরাধীর তকমা লাগিয়ে দেবে ,সে বোঝা বয়ে বেড়ানোর শক্তি আমার নেই। মেয়ের বিয়ে হলেও দায়িত্ব কর্তব্য করা যায়। এভাবে অজুহাত গুলো খাড়া করে নিজের থেকে পালিয়ে একে অপরকে কষ্ট দিও না মালবিকা।
সব কিছুরই সময় আছে, সময়ের কাছে আমরা হার মানতে বাধ্য হই,আবার ঘুরেও দাঁড়াতে হয়, সেটাই জীবন, অলকেশের কাছে যাই কথা দাও না কেনো তুমি এভাবে থাকলে সেও ভালো থাকতে পারে না।আর সময় বসে থাকে না, ভেবে দেখার সময় এসেছে মালবিকা।
-----------------------------------------------------
অপরেশ আর কথা বাড়ালেন না ।
গ্রীষ্মের তপ্ততা থেকে বর্ষা এবার একটু তাড়াতাড়িই প্রকৃতিকে রেহাই দিয়েছে। এক নাগাড়ে কদিন বৃষ্টিতে সকলে নাজেহাল।দিনে যদিও এক আধ বার থামছে কিন্তু সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের বেগ যেন বাড়ছে। মনে হচ্ছে নিম্ন চাপের বৃষ্টি।
আজকাল কি অভ্যেস হয়েছে সুদেষ্ণার রাতে শুতে
যাবার আগে শখের ভাবনায় পেয়ে বসে। শতরুপা আর বিশ্বজিৎ সুদেষ্ণার মেয়ে আর জামাই।আজ এই
বৃষ্টির দিনে ওদের কথাই সুদেষ্ণা র মনে পড়ছে।
বছর দুয়েক আগে এরকমই সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি পড়ছিলো ।
প্রতি শনিবারের মতো শতরূপা ও বিশ্বজিৎ এসেছে
সুদেষ্ণার সঙ্গে দেখা করতে। পরের সপ্তাহে ওদের ইংল্যান্ড চলে যাবার কথা ,একরকম বাধ্য হয়েই এসেছে।ঝোড়ো হাওয়ার বেগ এতটাই ছিল যে ওদের
ফেরা হলো না।খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে চলে গেল।
দুঘরের মাঝখানে একটা দরজা এটা অতিরিক্ত তাই
ওটা বন্ধ করে একটা আলমারি রেখে দিয়েছে।তবুও
একটু জোরে কথা বললেই আন্দাজ করা যায়। তাই
বুঝতেই পারছে ওদের কারো চোখে ঘুম নেই।
প্রথমে ভাবলো নতুন জায়গায় যাচ্ছে তাই আবার বিদেশ, চিন্তা একটু তো হবেই।যতক্ষণ ওখানে গিয়ে থিতু না হচ্ছে ততক্ষণ দুজনে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে না।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বিশ্বজিতের গলা শুনতে পেল সুদেষ্ণা।
"আরে এভাবে উনি একা পড়ে থাকলে আমরা ওখানে নিশচিন্ত কিভাবে থাকবো।মা আমাদের সঙ্গে গেলে কত ভালো হতো।না হয় উনি আলাদা নিজের মতো করে থাকবেন।
শতরূপা চেঁচিয়ে উঠলো,আলাদা থাকবে মানে!
না মানে আমি বলেছিলাম যে কিছু দিন একা থাকতে থাকতে ও দেশে আকছার যা হচ্ছে আর কি।ও দেশে কেউ একা থাকে না। কাউকে না কাউকে পছন্দ হয়েই
যেত । বিশ্বজিৎ কে থামিয়ে দিয়ে বললো ,
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ,কি বলছো তোমার হুঁস আছে!
বিশ্বজিৎ আবার শুরু করলো, আসলে আমি বলছি- লাম ,তোমার মাকে কারো না কারো পছন্দ হয়ে যেতেই পারে ।দেখলে না কদিন আগে টি ভি র নিউজ
এ বললো,আশি বছর এর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে একাত্তর বছরের মহিলার বিয়ে হলো। আর তোমার মা তো এখনো -------------
শতরূপা মুখ চেপে ধরল বিশ্বজিতের,কি সব যা তা বলছ, মা শুনতে পেলে এই বয়সেও চড় খাবে তুমি।
আরে রূপা মাকে শোনাতে যাবো কেন, এসব আপনা আপনি হয়ে যায়।
ও সব আজে বাজে কথা ছাড়ো বলে পাশ বালিশটা
কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো।
বিশ্বজিৎ বুঝলো ওর মা কে নিয়ে বলাটা বেশি হয়ে গেছে। আদর করে ওর গালে নিজের গালটা ঘষে দিয়ে কাছে টেনে নিল।
কপট রাগ দেখিয়ে আস্কারা বাড়িয়ে দিলো।
উম ছাড়ো ,তুমি বাজে ,ভাল্লাগছে না।
এ বাবা, আমি বাজি কোথায় ? এই দেখো আমি চুপটি করে তোমার বুকের খাঁজে মুখ লুকিয়েছি। এ এক স্বর্গ সুখ, এখানে কি বাজা যায়? এখানে নিশ্চিন্তে খুঁজে নিতে হয় ।
কি খুঁজবে
এই যে তোমার নরম শরীরটা আমাকে বিছানার থেকেও বেশী আরাম দিচ্ছে,
তাই বুঝি?
শতরূপা মাথার ওপর দুহাত তুলে শুয়ে ছিলো। বিশ্বজিৎ হাত দুটোকে চেপে ধরে বগলে নাক ঘষে দিল।
শতরূপা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
এই যাও , কাতুকুতু লাগছে ।
কুঁকড়ে গিয়ে জিতের বুকে মুখ ঘষতে লাগলো।
শতরুপা আবেশে চোখ বুজল,আদূরে গলায় বলল, মা
তো কিছু শুনতেই চাইছে না। এভাবে মা'কে রেখে কি
করে থাকবো।
সোনা আমি তাইতো বলছিলাম, ঠিক আছে এখন কিছুদিন থাকতে দাও , দু-এক মাস পরে এসে ঠিক রাজি করিয়ে নিয়ে যাবো ।
হুঁ ... উম ....উম ছাড়ো ------।
উম হুঁ ....... একটুও ছাড়াছাড়ি নয় , এখন আমার ইচ্ছে মতো আমার সোনা টাকে আদর করবো ।
মা'র ঘর থেকে সব কিছু শোনা যায় প্লিজ....... লক্ষ্মীটি ।
তাই বুঝি! কাছে,আরও কাছে,গভীরভাবে জড়িয়ে নিতে নিতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। শতরূপা কপট ভঙ্গিমায় নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলো। তারপর স্বেচ্ছা পরাজয় মেনে নিয়ে এক অপার্থিব সুখে চোখ বুজে ফেলল। সেই সুযোগে বিশ্বজিৎ ওকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। দুইজনের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসতে শুরু করলো। বিশ্বজিতের বুকের পশম এর মধ্যে আঙ্গুল চালাতে চালাতে শতরূপা খামচি দিয়ে ধরল। ততক্ষণে বিশ্বজিতের মুখ নেমে এসেছে শতরূপার কানের লতিতে। কানের লতিতে আলতো চাপ অনুভব করতেই শতরূপা শীৎকার করে উঠলো। বিশ্বজিৎ সকৌতুকে বলল,
- মার ঘর থেকে সব শোনা যায় তো।
-উমমমম জানি না যাও।
--------------------------------------
ওদের কথা কানে আসার পর থেকে সুদেষ্ণা
হাসি চাপতে পারছিলো না।বাচ্চা বুদ্ধি আর কাকে বলে।নিজের বিছানায় এসে বালিশে মুখ লুকিয়ে ছিল।
আর তখনই মনে পড়ে গেল কত ভাবনা কত চিন্তা কত ভরসা কত ভালোবাসার সঙ্গী সুবিমল এর কথা,
ছোট্ট মেয়েটাকে রেখে কি ভাবে একা করে দিয়ে চির-
দিনের মতো চলে গেছে।একান্ত নিজের মতো করে পাওয়া সেই দিন গুলো,একান্ত নিজের সেই মুহূর্ত গুলো সবটাই তো ছিল অথচ আজ যা আছে তা মনে হয় কিছুই নিজের নয় ,কেউ যেন করুনা করছে। চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
একটানা বৃষ্টিতে কলকাতার যান চলাচল ব্যাহত হলেও নতুন গড়ে ওঠা রাজারহাটে তার বিশেষ প্রভাব পড়ে না।বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া চারপাশে ধুলোর প্রকপও নেই। সকাল থেকেই কিছু টা পরিষ্কার আকাশ দেখে বেলা পড়তে না পড়তেই অপরেশ বেরিয়ে পড়েছেন। কদিন না বেরিয়ে শরীর টা যেন ভারী হয়ে গেছে।একবার ভাবলেন কেষ্টপুরের দিকে যাই, ব্রিজের কাছটাতেই মিনতির ঘর,প্রকাশ এ সময় বাড়িতেই আছে।কি ভেবে অপরেশ নিজেকে বিরত করলেন।
না এখন থাক,মালবিকার যা বক্তব্য তাতে করে যা করার অপরেশকেই করতে হবে।সমস্ত ব্যাপার
টা মনের মধ্যে তোলপাড় করছে,ওঃ বড্ড ভারী লাগছে।পার্কে এসে বেঞ্চিটাতে বসে পড়লেন।এসময়
অনেকটা ফাঁকা থাকে।এত তাড়াতাড়ি কেউ এসে পৌছয় না। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে বেঞ্চটা ,বিকেল
টা এখনো পড়ন্ত বেলার মিষ্টি রোদ মেখে আছে।বৃষ্টির পরে হওয়াটা বেশ ঠান্ডা।মানসিক চাপে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন।
বেশিক্ষণ একা থাকতে হলো না, সুদেষ্ণা দেবী পায়ে পায়ে এসে নীরবতা ভাঙলেন,
আরে, অপরেশ বাবু , আপনি কতক্ষণ। আজ দেখছি আপনি আমারও আগে এসে পড়েছেন। কথা শেষ করে খুক খুক করে সুদেষ্ণা কেশে নিলো দুবার।
বৃষ্টির জল পড়লো কি পড়লো না,ঠান্ডা লাগিয়ে বসে আছেন দেখছি।
অপরেশের কথার মধ্যে যেন সুদেষ্ণার ছেলেমানুষি আচরণের ইঙ্গিত রয়েছে বুঝতে পেরে একটু লজ্জা পেল।
বললো না না কদিন যা বৃষ্টি গেল , চেনা মানুষের দেখা মেলা ভার হয়েছিল।
আমি তারই মধ্যে একদিন বেরিয়েছিলাম। গেট খোলা ছিল কিন্তু আমায় ঢুকতে দিলো না,কেয়ার টেকার দুজন লোককে নিয়ে সাফ সাফাই করছিল।অনেক গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল।
কেয়ার টেকার ভদ্রলোক বললেন, এখোনো হাওয়া দিচ্ছে ম্যাডাম ,রিস্ক হয়ে যাবে।
বৃষ্টি জোরে এলো, হাওয়া চলছিল, আর ছাতা টা উল্টে গিয়ে ভিজে একাকার।
আজ আমি ঘর থেকে বেরোইনি, ঘর ই আমায় বের করেছে। একরাশ বোঝা বুকে চেপে বসেছে, হাঁপিয়ে উঠেছি ।ঘরে থাকতে পারছিলাম না, কে যেন ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দিলো। বেরিয়ে এসে বুঝলাম কদিন না বেরিয়ে কলকব্জা গুলোয় জং পড়ে গেছে। সুদেষ্ণা দেবীকে নিজের সমস্যার কথা বলে অযথা ওনার চিন্তা বাড়িয়ে লাভ নেই, তাই বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন অপরেশ।
বুঝতে পেরেই সুদেষ্ণা বললো,
হ্যাঁ দেখছি তাই পরিস্থিতিটা সত্যি ভাবিয়ে তুলেছে আপনাকে।
আর আপনাকে কি বলবো আমারও অবস্থা দেখুন ,মেয়ে জামাই বিদেশে তাও কি শান্তি আছে ,মনে হয় যেন পাশের ঘরে বসে কথা বলছে ।একটা কাজ করার উপায় নেই ।ওদের কে আমার দিনের হিসেব দিতে হবে।কোথায় মন দিয়ে সংসার করবে তা না আমায় নিয়ে পড়ে আছে ।এখানে থাকতে তো মাসের মধ্যে বেশিরভাগ সময় আমার কাছেই পড়ে থাকতো।জামাই একা চালিয়ে নিতে পারে বলে মেয়ে তার সুবিধে নিত।আরে তোদের নতুন বিয়ে, এতো ছাড়াছাড়ি থাকলে প্রেম করবি কখন।তিন বছর হয়ে গেল এখনো নাতি নাতনির মুখ দেখলাম না।আমার মেয়ে তো জামাইয়ের সঙ্গে যেতেই চাইছিল না। আমি পরিস্কার বলে দিয়েছি, যেতে হলে দুজনে এক সঙ্গে যাবে।
মায়ের এরকম মেজাজ শতরুপা কখনো দেখেনি। তাই আর থাকার জন্য জেদ করেনি।আসলে কি জানেন অপরেশ বাবু ,একা মানুষ করার এটা কুফল ।আদর ভালোবাসা টাকে এরা দুর্বলতা ভাবে।আর ছেলে মেয়েরা তার সুবিধে নেয়।
হা হা হা বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেন অপরেশ ।খুব রেগে আছেন দেখছি। সত্যি কথা বলতে কি,আমরা এমন মমতার ঝুলিতে ভরে ছেলে মেয়ে মানুষ করি সুদেষ্ণা দেবী যে নাড়িছেড়া ধন হলেও মায়ার গাঁটছড়া আপনি কিছুতেই খুলতে পারবেন না।
সে আপনি যাই বলুন না কেন, ছেলেমানুষ হলেও ছেলেমানুষই বুদ্ধি গুলো সব সময় হজম করা যায় না। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেছে, মাথার মধ্যে ভাবনার পাহাড় টা মাথা তুলে থাকলেও বুকের চাপ টা যেন অনেকটাই কমে গেছে। ফের অপরেশ কৌতুক দৃষ্টিতে মুচকি হাসলেন, বললেন কেন, কি এমন করলো মেয়ে।বেশ উত্তেজিত লাগছে সুদেষ্ণা কে,বললো না না শতরুপা র এত দুঃসাহস হবে না।
তা হলে বাকি থাকলো জামাই বাবাজি।
সুদেষ্ণা মাথা ঝাঁকিয়ে হাত নেড়ে বললো,হ্যাঁ হ্যাঁ ওটার বুদ্ধি ততই ফাজিল।বলে কিনা ,তোমার মাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেব।ও দেশে ষাট সত্তর আশি বয়সটা কোনো ব্যাপার ই না।
বাঁচুন সুদেষ্ণা দেবী বাঁচুন।ওদের চোখ দিয়েই আমাদের এখন বাঁচতে হবে। আর আমার মনে হয় আপনি সবে চল্লিশ পেরিয়েছেন।
আরও রেগে গেলো সুদেষ্ণা, না না চল্লিশ কেন তিরিশ ও হয় নি।
ঠিক আছে আমার ষাট হয়েছে, আপনার বয়স যাই
হোক ওতে আমার কোন আগ্রহ নেই।
শুধু এই টুকু অনুরোধ জামাইয়ের ওপরে হোক বা আমার ওপরে হোক ,রাগ করে প্রেসার বাড়াবেন না। তারপর অপরেশ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন ।খোস মেজাজ টা আর দেখা গেল না।নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলে চললেন ।
"আমি যে খুব একটা ভালো আছি তা নয়, নিজের সঙ্গে নিজেই যেন যুদ্ধ করছি ।এই কদিন শান্তি তে ছিলাম না,মালবিকার ব্যাপারে ভীষণ চাপে আছি।ভেবে ছিলাম ওর জীবন টা যদি গুছিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তা সম্ভব নয়, আসলে মালবিকার ব্যাপারে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না।ওটা ওর একান্তই ব্যক্তিগত। ও আমার ছেলের ইচ্ছে পূরণ করতে নিজেকে উজার করে দিতেও প্রস্তুত।বাবা হয়ে আমি তা হতে দিতে পারি না। তাই সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার তা আমাকেই নিতে হবে।"
অপরেশের দৃঢ়তা দেখে সুদেষ্ণা যেন একটু ভয় পেয়ে গেল। নিজের মধ্যে নিজে যেন গুটিয়ে গেছে।অপরেশ বাবু কে যতটা চিনেছে তাতে করে সুদেষ্ণার বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে ভদ্রলোক এক কথার মানুষ। তাই আবেগের বশে যদি কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন,তাতে অবাক হবার কিছু নেই,সেটাই সুদেষ্ণা কে ভাবিয়ে তুললো। সিদ্ধান্ত টা যে খুব সহজে প্রকাশ করবেন সে মানুষও উনি নন। তবুও মনের ভাব টুকু বোঝার জন্য ভাব বাচ্যেই কথাটা বললো,
এমন কিছু করবেন না অপরেশ বাবু যার জন্য কাছের মানুষ গুলো কষ্ট পায়।
কে কাছের কে দূরের সেটা কি এক জীবনে বোঝা যায়। আমি বেশ কিছু সময়ের জন্য নিজেকে সকলের কাছ থেকে আড়াল করতে চাই।সেটা কত সময়ের জন্য তা আমি নিজেও জানিনা।বলতে পারেন এক রকম নির্বাসন।কবে কখন সেটা এখনো ঠিক করিনি। ছেলের বউ ই হোক বা মিনতি ,নিজের কাছে তো আমি একা । যতই চার পাশে হাজারো মানুষের ভিড় হোক না কেন চোখটা বন্ধ করলে আমি একা।একা জীবন টা বয়ে বেড়ানো কি নির্বাসন নয় । সে লোকালয়েই হোক বা নির্জনেই হোক ।
এই ভাবে হারিয়ে যাবেন।
আমাদের তো আর হারাবার কিছু নেই সুদেষ্ণা দেবী। এই বয়সে চেষ্টা করলেও হারিয়ে যেতে পারবেন না। সবটাই আয়ত্বের মধ্যে। জীবনের কাছ থেকে আর তো কিছু পাওয়ার নেই। এখন শুধু অন্যকে ভালো রাখার জন্য স্বেচ্ছায় ভেসে বেড়ানো ।
সুদেষ্ণা সুরে বললো , ভেসে বেড়ানো না ছাই । আপনিই তো বললেন নির্বাসন ।
হালকা হাসি মিশিয়ে অপরেশ বললেন সুদেষ্ণা দেবী এই বয়সে পরবাসও যথেষ্ট উপভোগ্য। বৃষ্টি ভেজা বিকেলের উজ্জ্বল আকাশে যখন রামধনু দেখা যায়, সেই সাতটা রঙের ভালোলাগাটুকু একসঙ্গেই পাওয়া যায়। তাকে আলাদা করে পেতে চাইলে সে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। আর ওই ভালোলাগাটুকু বড়ই ক্ষনস্থায়ী। অপরাহ্নের আলোটুকুর মতো হঠাৎই মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়।
যতই ক্ষণস্থায়ী হোক, ওই ভালোলাগাটুকু নিয়েই হাতে হাত রেখে চলার মধ্যে তো কোনো ফাঁকি নেই।
সেটার উত্তর সময়ই জানে। সময়ের তুলাদণ্ডে প্রত্যেক টা মুহূর্তের রং আলাদা। ইচ্ছেটা ছকে বেঁধে নিয়েছি। ব্যবস্থা করে আপনাকে জানাবো। আপনাকে বলে যাওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
-----------------------------------------------------
আবার ও নিম্নচাপের প্রকোপে বেশকটা দিন বারমুখী হওয়া গেল না। তিন দিন পর আজ সকাল থেকে বৃষ্টিটা যেন একটু ধরেছে। একটু দেরি করেই ঘর থেকে বেরোলেন অপরেশ। সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। সুদেষ্ণা দেবীর সাথে যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে আজি রওনা হয়ে পড়বেন। পার্কের গেটের কাছে আসতেই লক্ষ্য করলেন পিছন ফিরে কেউ বসে আছে, আরেকটু এগোতেই গান ভেসে এলো - দাঁড়িয়ে পড়লেন অপরেশ। যদি আর কখনো ওই গান আর না শুনতে পান, তাই প্রাণ ভয়ে শুনতে লাগলেন -
" দিবস রজনী আমি যেন কার
আশায় আশায় থাকি"
গান তা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুইপা এগোতেই আবার ভেসে এলো
" আমি রূপে তোমায় ভোলাবনা .... ভালোবাসায় ভোলাব "
গানের মাঝখানে এগোতে পারছেন না। এই মধুর সুরে আকণ্ঠ ভরিয়ে নিতে চাইছেন। গান শেষ হতেই অপরেশ নির্জনতা ভেঙে বললেন, " আজ যে আপনি এরকম একটা সুরে মুগ্ধ সন্ধ্যা উপহার দেবেন, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।"
"অনেক্ষন দাঁড়িয়ে আছেন বুঝি। আওয়াজ দেননি কেনো"
"ছি ছি, এরকম বেরসিক ভাবেন নাকি আমাকে"
"আপনাকে আমি অনেক কিছুই ভাবি"
অপরেশ কথার খেই ধরে বললেন, " অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর, কাপুরুষ... এগুলো ওর সাথে জুড়ে নিন"
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো সুদেষ্ণা - " কেন, ওগুলো কেন"
অপরেশ বললেন " আজ আমি আপনার কাছে বিদায় নিতে এসেছি। ওই বিশেষণ শব্দগুলো আমার চরিত্রে না থাকলে এরকম ভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়না।"
অনেক টা সময় কেউ কোন কথা বলতে পারলনা। চারপাশটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিঃসীম শূন্যতায় স্বাস ফেলতেও যেন সংকোচ হচ্ছে। সুদেষ্ণার নিজের অজান্তেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেছে। কুড়িটা বছর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে আজ যেন বড়ই ক্লান্ত সে, কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো -
"সহচরী" তে আমিও তো নির্বাসিতই হয়ে আছি। এর পর তো এই পার্কে আশার ইচ্ছেটাও থাকবেনা। আপনার অজ্ঞাতবাসের ঠিকানাটি তাহলে কোথায়।
আপাতত কালিংপঙ এর একটি নির্জন পরিবেশে। মরগান সাহেবের বাংলো আছে। পাশে তাসিডিং নামের একটা গেস্ট হাউস আছে। একবার স্ত্রী পরমা কে নিয়ে গিয়েছিলাম। নীচে কালিমপঙ শহর থেকে ওই জায়গাটা অনেকটাই উপরে। ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। নির্জন তো বটেই, অসীম শূন্যতায় প্রকৃত সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবো, পাইন বনের সাথে কোলাকুলি করবো।
সুদেষ্ণা কান্না ভেজা গলায় বললো, "মেয়ে জামাই এর ইচ্ছেটাই থাক, আমাকেও আপনার সাথে নেবেন।"
অপ্রত্যাশিত অনুরোধে অপরেশ এর বাকরুদ্ধ হয়ে এলো। অনেক্ষন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। সুদেষ্ণা কে বোঝার চেষ্টা করলেন। তার পর ধীরে ধীরে সম্বিৎ ফিরেপেতে বললেন, "কোনোরকম আবেগের বশে ঝুঁকি নিচ্ছেন নাতো।"
বাকরুদ্ধ সুদেষ্ণা যেন সংগাহীন। ভীষণভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কান্নায় ভেঙে পড়লো। এতদিন যেন নিজের চারপাশে সংযমের পাহাড় তুলে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। আজ হঠাৎ ই সে আড়াল যেন বাঁধ ভাঙা বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
অপ্রকৃতিস্থ সুদেষ্ণা দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নার দমকে ফুলেফুলে উঠছে।
এভাবে সুদেষ্ণা কে ভেঙে পড়তে দেখবেন ভাবতে পারেননি অপরেশ। জড়িয়ে ধরে সংযত করার চেষ্টা করলেন। পরম স্নেহে চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। বললেন, " সুদেষ্ণা প্লিজ, আমরা নিজেরাই কষ্ট পাই, অন্যকেও শান্তিতে থাকতে দিইনা।
নিজেকে কষ্টি পাথরে যাচাই করতে করতে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছো। সুদেষ্ণা, এ সমাজের চোখে তুমি যতই নিজেকে শূলে চড়াবে, ততই সুনাম পাবে। যত নিজেকে ঠকাবে, কষ্ট পাবে, ততই বাহবার তকমায় তুমি সেজে উঠবে। অনেক হয়েছে সুদেষ্ণা, এবার নিজেকে মুক্তি দাও।
আজ যদি তুমি নিজের লোকের কথা শুনে নিজের দিকে ফিরে তাকাও, তাতে কার কি ই বা এসে যায়। অপরাহ্নের আলো যদি একটু গায়ে মেখে নাও তাহলে অপরাধ কোথায়। সকলের বিচারের মাপকাঠি সমান নয়। অন্যের দাঁড়িপাল্লায় নাই বা নিজেকে মাপলে! এই পড়ন্ত বেলায় দিনের রং টুকু সবটাই ধোঁয়াটে। সুদেষ্ণা, জীবনের কাছথেকে আর কিছুই পাওয়ার নেই আমাদের। এই অবকাশ টুকুতে আর নাইবা করলে হিসেব নিকেশ। অপরাহ্নের আলো যদি একটু গায়ে মেখে নাও, তাহলে অপরাধ কোথায়।"

