অনু (Part I)
অনু (Part I)
আজ হঠাৎ মায়ের কাছে বকা খেয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পুরোনো আলমারিটা পরিষ্কার করতে বসতে হল। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও হোয়াটস্যাপ আর ইন্সটাগ্রামের থেকে বিরতি নিতেই হল। পুরোনো জামাকাপড়ের ভাঁজের থেকে একটা কাগজের বান্ডিল পায়ে এসে পড়ল। চট করে তুলে প্রণাম করলাম, এখনো ইউনিভারসিটির পরীক্ষা শেষ হতে পাঁচ দিন বাকি।
কাপড়গুলোর দিকে আর একবারও না তাকিয়েই বিছানার দিকে দৌড় দিলাম।কাগজের বান্ডিলটার বাঁধা রশিটা কেটে ফেললাম নিমেষেই।এর মধ্যেই মায়ের চিৎকার, "কিরে এখনো পরিষ্কার করলি না"। আমি উত্তরে বললাম, "এখন যাও না, খাওয়ার আগেই করে ফেলব"।
বান্ডিলটা খুলে দেখি, এত আমার স্কুলের সময়কার চিঠির সেট, কাগজে মোড়ানো।এগুলো তো আমার আর আমার প্রিয়বন্ধু অনুপমার চিঠিপত্র। যার সাথে যদিও আজ আর সেরকম যোগাযোগ নেই কিন্তু চিঠিগুলো দেখেই আমার মুখে একটা আলাদাই হাসি এসে গেল আর চোখ ভরে গেল।
আজ আবার তোর কথা মনে পড়ে গেল রে অনু।এই নিয়ে এই সপ্তাহে তিনবার।তোর লেখা চিঠিগুলো আবার কেন জানি না পড়তে ইচ্ছে করল।ইচ্ছে করল আবার সেই ক্লাস এইটে ফিরে যাই, যখন সবার কাছে স্মার্টফোন ছিল না।এসএমএস প্যাক ভরে সবাই সবার সাথে কথা বলতাম।কিন্তু তোর আর আমার বন্ধুত্ব তো সবার থেকে আলাদা ছিল, তাই না বল? আমরা থাকতাম দুই-তিনটে বাড়ির পর কিন্তু তাও টিফিনের এক টাকা বাঁচিয়ে আমরা একে অপরকে চিঠি লিখতাম পোস্টের মাধ্যমে। আমার কাছে আজও তোর সব চিঠি আছে রে অনু।তোর কাছেও কি আমার সব চিঠি আছে? আমাকে ভুলে যাসনি তো তুই?
কি সব না করতাম আমরা বল? সেই পল্টু কাকুর ধুতি ধরে টানাটানি আর গরমের ছুটিতে তোর বাড়ির পেছনের নারকোল গাছের নীচে বসে আম মাখা খাওয়া। শীতকালে পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার মতো হাতে লন্ঠন নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো।কিন্তু সময় কি আর কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকে রে অনু?
একে একে দিন পেরিয়ে আমরা কতটাই না বড় হয়ে গেলাম। আজও তোর কথা মনে পড়লেই মনকে বোঝাই যে সব গল্পের যেমন শেষ থাকে না তেমন সব বন্ধুত্বের দড়িও চিরকাল বাঁধা থাকে না।ক্লাস ইলেভেনের সেই দিনগুলোর কথাও প্রায় মনে পড়ে যখন আমরা বাড়িতে এক্সট্রা ক্লাসের নাম করে দুজনে সিনেমা দেখতে যেতাম।পুরোনো কলকাতার প্রতি তোর ভালবাসার কথা ভেবে ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই হেসে ফেলি তোর কথা ভেবে।কত না মারপিট করেছি দুজনে যার জন্য আমাদের মা-বাবা কী ডানপিটেই না বলতো আমাদের!
কিন্তু কলেজে ওঠার পর কী যে হঠাৎ হয়ে গেল, সব পাল্টে গেল রে অনু।তুই ফিলোসফি নিয়ে নিলি আর আমি লিটেরেচার।প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই তোর চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল।আমি রোজ পোস্ট বক্সের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম কিন্তু তোর চিঠি আর আসত না।কিছুদিন পর যখন দেখা হল তুই বললি, তুই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস কলেজের কাজ, কলেজের পড়া নিয়ে তাই চিঠি লেখার সময়ই আর পাস না।মোড়ের মাথায় নতুন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় থাকলেও একটা চিঠি লেখার মতো সময় বা মাসে এক-দুইবার আমার সাথে দেখা করা ছাড়া আর সময় ছিল না।
গল্পের মতোন আজও সব কিছু মনে আছে।একদিন আমায় ডেকে তুই বলেছিলি, কলেজে তোর আর ভালো লাগছে না, "সবাই খুব স্বার্থপর হয়ে গেছে জানিস"। তোর চোখের নীচে কালি পড়ে গেছিল। রাতে ঘুমচ্ছিস না নাকি ? কত ইচ্ছে করলেও পারিনি কিছুই বলতে।আমাদের ছোটোবেলার বন্ধুত্বটা বড় হওয়ার সঙ্গে কেমন যেন কুয়াশার মতো আবছা হয়ে যাচ্ছিল।যেই অনুকে দিনের শেষে সারাটা দিনের গল্প শোনাতাম তাকেই কেমন যেন অচেনা, পর মনে লাগল তারই বিপদের দিনে।
একটা বন্ধু হারালাম কোনোদিনও কেন জানি না সেরকম মনে হয়নি।হারিয়েছিলাম নিজের জীবনের একটা অংশ।
থার্ড ইয়ার শেষ হতে না হতেই তুই দিল্লী চলে গেলি।আমাকে একবারও জানালিও না।প্রায়ই জানলার ফাঁক দিয়ে দেখি তোর বাড়িটা। মনে হয়, এই বোধয় বাড়ির কথা মনে পড়বে তোর, মনে হবে ফিরে আসার কথা,মনে পড়বে হারানো বন্ধুটার কথা এই বেলায়।
তোর লেখা শেষ চিঠিটা বের করলাম।প্রিয় আদিত্য লেখাটার ওপর হাত বোলাতেই চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।শেষ চিঠিটা লিখেছিলিস সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার সময়।আমরা এক সাথে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন।তুই চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে বললি, "আর পোস্ট করলাম না আদি।হাতেই দিলাম।পড়ে নিস।" আজও মনে আছে অটো টা থামতে না থামতেই বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলি তুই।সেদিন প্রথম ছিল যে তুই আর ফিরে তাকাসনি আমার দিকে।চিঠিতে এই প্রথমবার তুই বলেছিলি, ''আদি তোকে আমি ভুলিনি রে, সবটাই সময়ের খেলা। তোর মতো বন্ধু পাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।ভুলিস না আমায়, আমি কখনো তোকে ভুলবো না।মনে রাখিস আমায় আর আমাদের হারানো বন্ধুত্বটাকে''।
আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে আমাদের শেষ কথা হয়েছিল।আর পিএইজিডি করতে করতে হঠাৎ খুব ইচ্ছে করল আজ একবারের জন্যও যদি ফিরে যাওয়া যায় সেই ছোটোবেলায়।আর কখনো যদি বলতে না হয় আমার হারানো বন্ধু কোথায়।
চিঠি গুলো নিয়ে ছাদে চলে এসেছিলাম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে দিতে না দিতেই মা ডাক দিল।"দাঁড়াও আসছি " বলে আবার প্যাকেটে সিগারেট পুরে নীচে নেমে এলাম।মা আবার ঘরে আসার আগেই সব পরিষ্কার করে ফেললাম।খাওয়ার পর ছাদে গিয়ে আবার সব চিঠিগুলো পড়লাম আরও একবার।শঙ্খের আওয়াজে হুঁশ হল সন্ধ্যা নেমে গেছে। সূর্য আবার অস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আজ যখন সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে বেরলাম, আবার তোর বাড়ির কাছে এসে থেমে গেলাম জানিস অনু।কেন জানি না। সেই পুরোনো ল্যাম্প পোস্টের আলোর নেশা নাকি সত্যি কোনো চমৎকার দেখলাম। দু-এক পা করে এগিয়ে তোর জানলার নীচের ল্যাম্পপোস্টটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম তোর ঘরে আলো জ্বলছে।বোধয় আজ অনেক বছর পর কেউ তোর ঘরের জানলা খুলেছে, পুরোনো টিউব লাইটটা জ্বলতে দেখলাম, যা অনেক বছর ধরে জ্বলতে দেখিনি।ছাদের দিকেও তাকালাম একবার।কিন্তু তুই নেই।না, ওভার এক্সাইটেড হয়নি যদিও। কিন্তু তোর বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ভাবলাম মনে মনে দুই-একবার কলিং বেলটা বাজাবো কিনা।তারপর সন্ধ্যের আলোর ওপর ভরসা রেখেই বাজিয়ে দিলাম।ঘরের ভেতরে কাউকে বলতে শুনলাম, "মা, দেখতো কে এসেছে"। আর আমার মনে একই প্রশ্ন ঘুরছে বার বার তাই দরজা খুলতেই বলে ফেললাম, "তুই ফিরেছিস অনু?"