অমৃতের সন্ধান
অমৃতের সন্ধান
অঘাত ধনের মালিক এক ধনকুবের এখাগনে বাস করত। এই ধনকুবের শ্রীনরেশচন্দ্র জানত না তার কাছে আজকের দিনে কত টাকার সম্পত্তি আছে। অনেক শহরে তার ঘর, সোনা ও জহরতের হিসাব তার অজানা । তাদের সংযুক্ত সংসারে কুড়িজনা সদস্য। যে কাজে হাত দিত তাতেই মাটি সোনা হয়ে যেত। এই সব সম্পত্তি ও আয় ব্যায়ের হিসাব তাদের ম্যানেজার শ্রী অনিল দেখা শুনা করত। লোকটি অতি সৎ নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাসের পরম পাত্র ছিল। কখন কাকে কি দিতে হবে কিম্বা নিতে হবে সবারই হিসাব এই অনিলের উপর ছিল।
সেদিন সকালে শ্রীনরেশের অজানা মনে জানতে ইচ্ছা হল যে তার কাছে আজকের হিসাবে স্থায়ি অস্থায়ী ও নগদ মূল্য তার কাছে কত ! এই অজানা চিন্তা তার মনের উপর চেপে বসল। আজ তার কোন কাজে মন বসাতে পারছেনা। মনে হটাৎ করে সব শান্তি হারিয়ে গেল। গৃহ অফিসে রোজ সকালের মতোন ম্যানেজার এলে তাকে ডেকে তার মনের ভার লাঘব করতে বলল। কয়েক দিনের সময় চেয়ে নুতন কাজে লেগে গেল।
একদিন সকলে শ্রীঅনিল একটা হিসাবের খচরা তৈরি করে মালিকের সামনে এনে হাজির হল। মালিক এই হিসাবের উপর চোখ রেখে শুধু হু ' শব্দ করল এবং আরো বলে যে যদি এই টাকার প্রতি বছর কুড়ি প্রতিশত খরচ ও ত্রিশ প্রতিশত আয় হয় তবে বছর শেষে তার কি রূপ হবে। ম্যানেজার আয় ব্যায়ের হিসাব নিকাশ করে জানাল আর মালিকের এই অদ্ভূত পাগলামী দেখে নিজের কৌতূহল নিবারনের জন্য মালিককের কাছে জানতে চাইল। মালিক এবার তার মনের গুপ্তরহস্য নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত হল। এবার তুমি বলো -আমার অবর্তমানে এই টাকায় এই সংসারে কত পিড়ি পযর্ন্ত কাজ না করে ভালোভাবে খেয়ে পরে জীবন কাটাতে পারবে ? যদিও পরিবারে লোক সংখ্যা খরচ ও আয় বাড়বে কিন্তু আজ হলে কত পিড়ি এমনি আনন্দে দিন কাটবে ? ঠিক আছে বলে সেদিনের পাট গুটিয়ে আপন গৃহের পানে চলে গেল।
হিসাবের শেষ পরিনতি নিয়ে ম্যানেজার পরেরদিন হজির হল এবং হিসাব দেখে জানাল আজ থেকে আপনার এই টাকায় অষ্টম পিড়ির বিনা কাজে তাদেরকে না খেয়ে মরতে হবে না। তবে নবম পিড়িকে কাজ কর্ম করে খেতে হবে। শ্রী অনিল চলে যাবার পর ধনকুবেরের চিন্তা এবার দ্বিগুণ বেড়ে গেল। রাতের ঘুম উড়ে গেল। মন ও শরীরের প্রতি কোন নজর নেই কারন তার নবম পিড়ির দূর্দশার কথায় আয়ের কাজ বাড়িয়ে নিল। শরীর ধীরে ধীরে ভেঙ্গে গেল।
প্রতিদিনের ন্যায় ম্যানেজার এসে অফিস ঘর ঠিক ঠাক গুছিয়ে বসল। মনকষ্ট নিয়ে মালিকও এসে গেল। এমন সময় এক সাধু মহারাজ তার অফিস গৃহের সম্মুখে এসে ভিক্ষা চাইল। ত্রিশুল এক হাতে অন্য হাতে কমন্ডল। ক্তঁ অলখ নিরঞ্জন বলে হুঙ্কার দিল। মালিক হয়তো এমনি একজনকে খুজছিল। সামনে দেখে নতমস্তকে ভিতরে আসতে বলে। তিনি গেটের বাইরে থেকে তথাস্তু বলে ভিক্ষা স্বীকার করিল। যাবার সময় এইটুকু বলে যে - 'তোমার মনে যে চিন্তার পাহাড় জমেছে তা এক বুড়িমা নিবারন করতে পারে '। সে এখান থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিনে এবং জঙ্গলের শেষ প্রান্তে নদীর কিনারায় তার ভাঙ্গা কুঠিরে বাস করে। প্রতিদিন তার এক পোয়া আটা লাগে, যদি সে গ্রহণ করে তবে জানবে তোমার সব চিন্তার উপায় হয়ে যাবে। কুবের এখন বুঝল যে - সাধু মহারাজ তার জন্যই আবির্ভূত হয়েছে। তাই কুবের অনেক মিনতি করে বলে - আপনি অন্তর্যামী ভগবান, আমার মনের কষ্ট কেমনে দূর হবে? বুড়িমা যদি তোমার আটা গ্রহণ করে তবে জানবে - তোমার নবম পিড়ির পর আরো আট পিড়ি তোমার থেকেও ভালো ভাবে তাদের জীবন অতিবাহিত করবে। এবার কথা না বাড়িয়ে সাধুবাবা তথাস্তু ও অলখ নিরঞ্জন বলে স্থান ত্যাগ করিল আর নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
ধনকুবেরের আজ মনটা হালকা হয়েছে কিন্তু কিসের আনন্দে দু'চোখের পাতা এক করতে পারল না। অতি প্রাতে স্নানাদির পর ঐ বুড়িমার সন্ধ্যানে লোক লস্কর সাথে এক কুইন্টল আটা সঙ্গে নিয়ে চলল। খুজতে খুজতে সেই জঙ্গলের পরিসীমায় এক অর্ধভঙ্গুর নদীর কিনারে কুঠির দেখতে পেল। তাদের মাথা থেকে আটা নামিয়ে বাইরে দাড়াতে বলে। একটু এগিয়ে যেতেই বুড়িমার দর্শন পেল। নতমস্তকে নমস্কার সেরে নিল এবং তার জন্য এক কুইন্টল আটা এনেছে জানাল।বুড়িমা কুবেরের দৃষ্টি আকর্শন করে বলে - আমার প্রতিদিন এক পোয়া আটা লাগে তবে আজ আমার কাছে এখন আধাকিলো আটা আছে। এই আটায় আমার দুদিন ভালো ভাবে চলে যাবে। তুমি বাপু আজ যাও, দুদিন পর এক পোয়া আটা এনো। অনেক মিনতির পর একই উত্তর পেল। ধনকুবের শেষমেশ আগের দুঃখের সাথী হয়ে স্থান ত্যাগ করে।
রাতে ধনকুবের ক্তঁ অলখ নিরঞ্জন বাবা ও বুড়িমার কথা ও ব্যাবহারে সকাল হয়ে গেল। তার ভবনার শেষ হল না। শুধুই মনে আসে যে - যার কাছে মাত্র দুদিনের আটা আছে তার কোন ভাবনা নেই এবং বস্তা ভরা আটা কিনা ফেরত দিল। এই কথা ভাবতে ভাবতে তার মাথায় বুড়িমার কথার অর্থ বোধগম্য হল। যে পরশুর কথা চিন্তা করছে না আর সে নবম পিড়ির ভাবনায় শরীর মন দুঃখে ব্যাথিত করছে। এই প্রকার চিন্তা অবাঞ্চিয়। এখন তার মনের দরজার তালা খুলে গেল উক্ত মহান ব্যক্তিত্বের ইঙ্গিতে।
পরিশেষে আজ বুঝল ইন্দ্রিয় সমূহ মন ও বুদ্ধি কর্মের আশ্রয় স্থল। ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবনের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছান্ন করে ও চিন্তায় পথ বিভ্রান্ত হয়। নিজেকে জড় ইন্দ্রিয় মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে নিশ্চয়ান্তিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির করে এবং অনিশ্চিত কাজ দুর্জয় আকাক্ষাকে জয় করা অসম্ভব ও অকল্পনীয়। এখন ধনকুবেরের শরীর মন সুস্থ সবল হল। তাদের ইশারায় মনের আশক্তি দ্বার রূদ্ধ হল।
যতার্থ জ্ঞান সদগুরূ বা পথ প্রদর্শকের নিকট অমৃত ভাবনা শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম হয় যার ফলে মনের অন্ধকার দিনর সূর্যের আলোয় যেমন দূর করে তেমনি তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। মনের চাহিদার আশক্তি থেকে মুক্ত হয়ে সহজ সরল জীবনর পথ খুজে পেল। এমনি মহাত্মার সংস্পর্শে অমৃতের সন্ধানে হদয়ের আশক্তি মুক্ত হল ।