অজ্ঞাত
অজ্ঞাত
১।।.
ভোর পাঁচটা । সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো সন্দীপন । ক্লান্তি আজ শরীরকে গ্রাস করেছে তার । তবু নূতন উৎসাহে সে ক্লান্তি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলছে , কিছুটা হলেও । কাঁধের ওপর যা ঝুলছে ; তা নয় নয় করে কিলো বিশেক হবেই । এত বাঁধা বিপত্তি সকালের এই ঊষা লগ্ন প্রকট করেছে ছেলেটির এই সকাল জুড়ে , তবু মনের কোনো এক কোণায় প্রার্থনাচারিত হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে মনের এক কামনা ,
“ ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু” ।
নব আনন্দে ; বাঙলা ছেড়ে সুদুরে যাত্রা শুরু হয়েছিল গত পরশু ; সতেরই জানুয়ারি । রাজধানিতে বসে সন্দীপনের মনে পড়ে যাচ্ছিল বাড়ির দিনগুলো ; বন্ধু আর তাদের সাথে দেবা দার দোকানে কাটানো সন্ধ্যেগুলো ; যেগুলোতে ছিল নিকোটিনের আসক্তি । এখানে অবশ্য সেসব কিছুই নেই ; শুধুই ছুটে চলা আর ব্যাস্ততা । সে জানে সে আজ সবকিছু ছেড়ে চলেছে বহুদুরে ; বহুদুরে চলেছে তার বাবার শেষ স্মৃতিগুলো ফেলে রেখে ; আর ফেলে রেখে তার পুরনো চাকরি ; পুরাতন স্বপ্ন দেখা সেই অধ্যায়গুলো ।
বদলই জীবনের মূল – সেকথা সন্দীপন বেশ ভালভাবেই জানতো আর জানতো বলেই তার বন্ধু সমরেসের মতো সেও এস এস সি পরীক্ষার স্বপ্ন দেখত । দীর্ঘ আঠ বছর ধরে এই নিয়েই তো এতো সংগ্রাম । তবে দুজনেই বারবার একই জায়গায় গিয়ে আটকে পড়ছিল ; সেটি হল মেন্স পরীক্ষা । একদিন তো এই নিয়ে সমরেস বেশ আক্ষেপ করেই বলেছিল ,
--- দেখ বন্ধু , পরীক্ষার প্রথম পর্যায় পার করা এখন আমাদের কাছে জল ভাত হয়ে গেছে । কিন্তু দ্বিতীয় ধাপ , খুবই কঠিন হয়ে উঠছে । এই গতিতে পরীক্ষা পাস করলে আমাদের আর চাকরি পেতে হবে না ।
এরই মধ্যে একদিন সুখবর ধেয়ে এলো তাদের কাছে । মিষ্টির প্যাকেট হাতে সন্দীপনকে আসতে দেখে সমরেসের মধ্যে আনন্দের মাত্রাটা আরও তীব্রতর হলো । বন্ধুকে বুকে টেনে নিয়ে সে বলে উঠলো ,
--- অবশেষে একটা হেল্লা হলো তাহলে । শুভেচ্ছা আজ দুজনের জন্য । আর তার থেকেও বড় খবর দুজনের কর্মক্ষেত্র একই , ব্যাঙ্ক । একসাথে স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে কর্মক্ষেত্র একই হবে এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না ।
কিন্তু পরক্ষণেই উল্টো দিক থেকে যে উত্তর ধেয়ে এলো তা সত্যিই সমরেসের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল । সন্দীপন বন্ধুর বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো ,
--- আমি ব্যাঙ্ক জয়েন করছি না । আমি নিউ ইন্ডিয়া জয়েন করবো । ওর মাইনে বেশি ।
বন্ধুর এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সমরেশ সেদিন মোটেও মেনে নিতে পারে নি । তাই তো বেশ চিৎকার করেই সন্দীপনকে সে বলে উঠলো ,
--- কী পাগলামো এসব ! ভুলিস না আমাদের লক্ষ এস এস সি আর সেটা আজ নয় কাল আমরা পাবোই । তখন ৬ লক্ষ টাকা চাকরি ছাড়তে দিবি তুই ! মাথা খারাপ হয়েছে তোর !
সমরেসের কথায় মুচকি হেসে সন্দীপন সেদিন বলেছিল ,
--- ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে দেখবো । আগে এস এস সি পাস করি তো , তারপর ....
বন্ধুর কথায় রীতিমতো হতাশ হয়ে সমরেশ বলে ,
---- তোর অবশ্য বাবার অনেক টাকা কিন্তু আমার সেসব নেই । তুই বড় লোক মানুষ । যা তাহলে তোর পথেই এগো । তবে একদিন আমার কথাগুলো মনে পড়বে । সেদিন বিচার করে দেখিস , এই বন্ধুটা তোর ক্ষতি চায় নি রে ।
সন্দীপন অবশ্য বুঝতে পারে নি সে যুগে রেলের সামান্য পদে চাকুরিরত এক সাধারণ কর্মচারীর কাছে সত্যিই কি অনেক টাকা আসতে পারে । আর থাকলেও তার বাবা তাকে সেসব দেবে কেন তাও চাকরি ছাড়ার জন্য ! সে শুধু এই ভেবে চাকরিটা করতে চায় যে , এই চাকরিতে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ আছে আর ভারতে শহরগুলো ছাড়া এর পোস্টিং হয় না । অবশ্য সমরেশ তার সিদ্ধান্তের সমর্থন না করলেও অনেকেই তার সিদ্ধান্তের পাশে এসে দাঁড়ায় ।
এসব ভাবতে ভাবতেই রাত নেমে আসে । রাজধানীর বাতিগুলো নিভে আসে ধীরে ধীরে নৈশ ভোজনের পর । বাইরে চেনা প্রকৃতি পিছিয়ে চলেছে আর ভিতরে নতুনের সন্ধানে এগিয়ে চলেছে সে । আজ বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে তার , মাঝরাতে । বাবা থাকলে তাকে নিশ্চই একলা ছাড়তো না । অবশ্য এসব কি বাবা বুঝতো কিছু , নিজেই নিজের মনে বলে চলেছে সন্দীপন । এলজাইমারের প্রভাবে বর্তমানটা ভুলেই গেছিলো । ছেলে বউ কাউকেই চিনতে পারতো না শেষদিকে । তারপর একদিন চলে গেল । সেদিন আবার বিজয়া । কত ঝামেলা করে বাবার নিথর শরীরটা নিয়ে এসেছিল ওরা সেদিন । সন্দীপন চোখ বন্ধ করে সে সব দেখতে পাচ্ছে আজ । কষ্ট , যন্ত্রনা , নিজের আত্মীয় , প্রতিবেশি --- মানুষ চিনেছিলো সে সেদিন । এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোন ভিজে যায় আর ওদিকে ভোরের কুয়াশায় ভিজে যায় প্রকৃতি ; আজ দুটোই সমার্থক । নীচে ঝুকে প্রশ্ন করে সে একবার,
---- কাহা পৌছা ?
দুবার জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে ,
--- সাত ঘন্টা লেট হ্যায় গাড়ি । দিল্লি পৌঁছতে তিন হো জায়গা ।
উত্তরটা শোনা মাত্রই তিন তলা থেকে নিচে নেমে ছুটে যায় সে বাইরের দিকে । তারপর বাইরের দরজাটা একঝলক খুলে যা দেখলো সে তা তার কল্পনার অতীত । বাইরের সব রং গ্রাস করেছে সাদা । দূর অবধি এই ঘন সাদা ছাড়া কিছুই নজরে আসে না । হতাশ হয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সন্দীপন , তারপর নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিতে মনে মনেই বলে ওঠে ; এই ঘন কুয়াশায় লেট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় । তবে রাজধানী যখন ঠিক কিছুটা লেট মেক আপ করে নেবে ।
সময় এগিয়ে চলেছে যত , ততই টেনশন বেড়ে চলেছে । প্রতি ঘন্টার হাত ধরে লেটটাও কম বেশির অদ্ভুত খেলা খেলছে । এরই মধ্যে বিপদ হলো টুনডলা স্টেশনে । গাড়িটি ওখানে প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে যখন , তখন হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো সন্দীপনের । মায়ের ফোন , আর তাই জলদি ফোনটা ধরতে হলো তাকে ,
---- হ্যালো মা ।
---- কত দুর পৌছালি বাবা ।
----মা , ট্রেন লেট থাকায় এখনও অনেকটা পথ বাকি । বুঝতেই পারছো .... সকালের কুয়াশা ... হ্যালো ... ট্রেন .... উফ কি জ্বালা রে ভাই .... কিছুই শোনা যায় না ।
এদিকে যখন মায়ের সাথে ছেলেটি ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত , ঠিক তখনই বগির মধ্যে একটা প্রবল চিৎকার ও শীঘ্রই একটা ঝামেলা সৃষ্টি হয়ে গেল । কথাকাটাকাটির মধ্যে বেশ বিরক্ত হয়ে সন্দীপন ফোনটি কেটে দিলো । মা অবশ্য এক দুবার চেষ্টা করলো ফোন করার , কিন্তু বারবার ফোন কেটে দেওয়ায় সে সকল চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়ে গেল । এক বুক চিন্তা নিয়ে মা ঘরের কাজ করতে চলে গেল ।
দূর থেকে এগিয়ে আসা , আস্তে থেকে ধীরে ধীরে জোর হতে থাকা আওয়াজে কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে এসেছে । কত ঘন্টা দেরিতে তারা এসেছে এসব হিসাবের সময় আজ কারুর নেই , সন্দীপনেরও একই হাল । এখন তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ভোপাল যাওয়ার কোন গাড়ি আছে এখন । অবশ্য সমস্ত রিসার্ভেশন সে করে এনেছিল নিজের সঙ্গে , কিন্তু ভাগ্য .... ঘড়িতে এখন বিকেল ৬ টা আর যে ট্রেন তাকে ভোপাল নিয়ে যেত সেটি বিকেল ৪টের সময় নতুন দিল্লি ছেড়ে চলে গেছে । ট্রেনের মধ্যে বসে বসেই ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করেছিল সে তবে লাভ হয়নি , কারন দোকান বন্ধ ।
ভিড় থেকে একটু সরে এসে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো ছেলেটি । পেটিএম খুলে কিছু ট্রেনের রিসার্ভেশন খুঁজে দেখলো সে । শেষমেষ দিল্লি নিজামউদ্দিন ব্যাঙ্গালোর রাজধানী এক্সপ্রেসে একটা সিট বুক হওয়াতে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে । ট্রেন ছাড়বে রাত ১১: ৩০ ।
ভিড় কাটিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ালো সন্দীপন । পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মা কে ফোন লাগালো সে এবার । ট্রেনে ঝামেলার কারনে মা কে আর ফোন করার সুযোগ পায়নি সে সেরকম । এতক্ষনে কিছুটা হলেও ফাঁকা হওয়া গেছে । ফোনটা দুবার তিনবার বেজে উঠতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই চেনা আওয়াজ ,
--- হ্যাঁ বাবু বল । কোথায় আছিস এখন ? সারাদিনে এই মনে পড়লো বুঝি মা কে তোর ?
ছেলে চুপচাপ মায়ের কথা শুনে যাচ্ছিল । এবার সিগারেটের কাউন্টারটা শেষ করে বলে উঠলো সে ,
---- মা , মা , এই মাত্র দিল্লী পৌছালাম । সকালে কুয়াশার জন্য ট্রেন দেরি করতে শুরু করে আর দেখতেই পাচ্ছ এতক্ষনে দিল্লি এসে পৌঁছেছে সে আজ । হিসাব মত প্রায় ৬ কি ৭ ঘন্টা লেট । যাই হোক , আমি ব্যাঙ্গালোর রাজধানীতে সিট পেয়েছি । নিজামউদ্দিন থেকে ট্রেন রাতে । কাল ভোর বেলায় ভোপাল নামিয়ে দেবে ।
---- দুগ্গা দুগ্গা । সাবধানে যেও আর এই বুড়িটার কথা মনে করে ফোন করে দিও । তুমি ওদিকে ফুর্তি করছো আর এদিকে আমি যে কত টেনশনে থাকি বুঝবে না তো । সারাদিনে দুপুর বেলা একটা ফোন করেছি , তাও উনি নয় , আমিই করেছি । লাড সাহেবের সময় নেই কথা বলার । পেছন থেকে এত ক্যাঙর ম্যাঙর হচ্ছে যে কোন কিছু শোনা গেলে হয় । চলন্ত ট্রেনেই পার্টি শুরু হয়ে গেছে যেন ।
সন্দীপন মায়ের কথা শুনেছিলো আর সমানে মুচকি মুচকি হেসে চলেছিল আর তারপর মায়ের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তর দিলো সে ,
---- পার্টি নয় মা । ঝামেলা হচ্ছিল আমাদের কেবিনে । আসলে কি জানোতো আজ ট্রেন লেট করেছে সে ইস্যু আলাদা কিন্তু রাজধানীর খাবার , এসি , বিদ্যুৎ -- সব পরিষেবা এত জঘন্য ছিল যে যাত্রীদের আওয়াজ তোলাটা সত্যিই প্রয়োজন ছিল। রাজধানী , শতাব্দীর মতো ট্রেনে এত এত টাকা ভাড়া দিয়েও মানুষ যাতায়াত করে শুধুমাত্র পরিষেবার জন্য আর যদি আই আর সি টি সি থেকে সেই পরিষেবা ঠিক মতো না পাওয়া যায় তাহলে আন্দোলন তো হবেই । এত দূরের গাড়ি চলছে অথচ ব্রেক ভ্যান জেনারেটর নেই ট্রেনে । স্টেশনে দাঁড়ালেই চার্জ ও অন্যান্য ইলেকট্রিক্যাল বস্তু কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল । খাবারের কোয়ালিটি ভালো তো ছিলই না , উপরন্তু সেগুলো ঠান্ডা পরিবেশন করা হচ্ছিল । এসব কতক্ষন সহ্য করা যায় বলো । যাই হোক , এখন ফোন রাখছি আমি । আমাকে আবার নিজামউদ্দিন বেরোতে হবে । তুমি সাবধানে থেকো মা ।
এই বলে সন্দীপন ফোনটা কেটে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো এবার । ওপাশে মা দুগ্গা দুগ্গা বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজের কাজে ।
প্রায় কুড়ি কেজি ভার দুকাঁধে ঝুলছে । ভোরে আলো আবছা হয়ে ফুটেছে এখন । লোকজনের ভিড় আসেপাশে বেশ উল্লেখযোগ্য । ব্যাঙ্গালোর রাজধানী থেকে ভোপাল স্টেশনে নামা ছেলেটি একপা একপা করে এগিয়ে চললো ওভার ব্রিজের দিকে । সব কিছু নতুন হলেও এক আলাদা আনন্দ তার গোটা চোখ মুখ জুড়ে ঝরে পড়ছে । সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালো সে । ডিভিশনাল একাউন্টেন্ট পদে এস এস সি পাস করা সন্দীপনের পোস্টিং এই মধ্য প্রদেশে । সেই জন্যই তার এই আগমন । ইচ্ছে আছে আজই এজি ভোপালে গিয়ে জয়েনিং প্রসিডিওরগুলো শেষ করে নেওয়ার । তবে এই মুহূর্তে সে চিন্তা মোটেও তার কাছে মুখ্য নয় । এই মুহূর্তে চিন্তা তার এক জায়গায় এসেই আটকা পড়ছে বারবার । তবে মুখে সে সব কিছুই প্রকাশ হতে না দিয়েই এক মুখ হাসি নিয়ে নিজেই নিজেকে উৎসাহ দিচ্ছে সে বারবার
---- গুড মর্নিং ভোপাল ।
২।।
--- সাহাব কহা জায়েঙ্গে ?
বেশ উদগ্রীব স্বরে স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটো প্রশ্ন করলো সন্দীপনকে । কাঁধ থেকে ঝোলা তিনটে নামিয়ে রেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে সবে এক ঢোক জল খেয়েছে সে , হঠাৎ এই প্রশ্নে একপ্রকার ঘাবড়ে গিয়ে বিষম খেয়ে উঠলো সে । দেখা মাত্রই ড্রাইভারটি তৎক্ষনাৎ অটো থেকে নেমে এসে তার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে একই প্রশ্ন করলো আবার ,
--- সাহাব কহা জায়েঙ্গে ?
সন্দীপন মুখের মধ্যে ঢেলে দেওয়া জল গিলতে গিলতে উত্তর দিলো ,
---- সস্তা হোটেল কহা মিলেগা ইহা ?
---- কিতনে দিন কে লিয়ে চাহিয়া সাহাব ?
অটো ড্রাইভারটি সন্দীপনকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করায় , সে একটু মাথা চুলকোতে চুলকোতে উত্তর দিলো ,
---- উহ তো নেহি পতা । অভি নৌকরি কে লিয়ে আয়া হু । উসকা পোস্টিং কহা হোগা কেয়া পতা । সব মিলাকর কুছ নেহি কহ সকতে । অভি হোটেল লে চলো , ফির অফিস যাকে পতা করতে হ্যায় । বাদ মে কিসি বয়জ হোস্টেল ...
ততক্ষনে অটো চালকটি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে । আপাতত মহারানা প্রতাপ নগর ; ফেস ২ তে দৈনিক ৭০০ টাকার বিনিময়ে একটি হোটেল পাওয়া গেলেও , খরচটা বেশ চিন্তায় রাখলো সন্দীপনকে । বাড়ি থেকে তেমন কোন টাকা আনে নি ; এই মুহূর্তে মাইনেও হবে না আর আগের চাকরিটা জোর জুলুম করে ছেড়ে আসার ফলে ওখানেও স্যালারি বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে কোম্পানি । এসব মিলিয়ে চিন্তার স্রোত কুড়ে কুড়ে খেয়ে চলেছে তাকে । আবার বাবার রেখে যাওয়া সামান্য টাকা আর পেনশন মায়ের একমাত্র সম্বল । তাই সেখান থেকেও কিছু চাইতে পারছে না সে । বাড়িতে ফোন করলে তাই এসব এড়িয়ে যাচ্ছে সুনিপুণভাবে সন্দীপন দত্ত ।
অফিসের প্রথম দিন আজ । হোটেলের কামড়ায় বসে বসে দরকারি কাগজগুলো গুছিয়ে নিলো সে । তারপর আস্তে করে মোবাইলে বাড়ির নাম্বার ডায়েল করলো । দুটো রিং হতে না হতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ,
--- হ্যালো । বাবাই । কোথায় এখন ?
---- মা । আমি ভোপাল পৌঁছে গেছি । আপাতত একটা হোটেলে আছি । এখন অফিস বেড়োবো তাই ফোন করেছিলাম জানাতে , উত্তর দিলো সন্দীপন ।
---- সাবধানে যাস বাবু । আর কোন টাকাপয়সার দরকার হলে আগে ভাগে বলে রাখিস । আমি ব্যাংকে জমা করে দেবো , কেমন ।
সত্যি কথা হজম করে নেওয়া সত্যি খুব কষ্টের । সন্দীপনের আজ টাকার সত্যিই প্রয়োজন কিন্তু একজন একলা বিধবা মাকে এই নিয়ে চাপ দেওয়া উচিত নয় । এই অদ্ভুত দোলাচলের মধ্যেই সে ফোনটা কেটে দিলো এবং রুমের দরজায় তালা ঝুলিয়ে হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লো । এবার লক্ষ একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিস , আরেরা হিলস । অন্যদিকে কয়েক যোজন দূরে একলা সেই বৃদ্ধা মা একা ফোনটা তার বিছানায় রেখে দুগ্গা দুগ্গা বলতে বলতে ভেতরের ঘরে চলে গেলো , বিশ্রাম করতে ।
অরেরা হিলস , সহজ কথায় ভোপালের অফিস পাড়া । রিজার্ভ ব্যাংকের ঠিক পিছনে যে বাড়িটি সেটিই একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিস । ঘড়িতে তখন সকাল ১১:৩০ । যদিও হোটেল থেকে দশটার মধ্যে বেড়িয়ে পড়েছিল সন্দীপন আর অফিস তার হোটেল থেকে বেশি দূর নয় ; তবু অটো জায়গাটি ঠিক করে চিনতে না পারার জন্য একটু দেরি-ই হয়ে গেলো তার পৌঁছাতে । অডিট আর একাউন্টস দুটি অফিস পাশাপাশি থাকায় , সেখানে ডাব্লু এম ১ সেকশন খুঁজে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে । সব মিলিয়ে এই ১১:৩০ ।
সেকশনের সামনে যাওয়ার আগে সন্দীপন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো । সমস্ত ডকুমেন্টস ঠিক করে সাজিয়ে সে এসে উপস্থিত হলো দরজার সামনে , তারপর বেশ নিচু গলায় বললো ,
---- মে আই কাম ইন স্যার ?
দরজার পাশেই একজন মোটা ভদ্রলোক বসে আছেন । মাথায় হালকা টাক , দাড়ি নেই তবে মোটা একটা গোঁফ আছে । সবাই তাকে গুপ্তা জি বলে ডাকছে । তার পাশের চেয়ারটি ফাঁকা আর তৃতীয় কেদারায় এএও মুলানি জির পাশে বসে আছে নরোত্তম । উল্টো দিকে দুজন ম্যাডাম এবং একজন লোক বসে । তাদের আকার আকৃতি ঠিক করে সে অনুধাবন করতে পারতো , তার আগেই গুপ্তা জি নিজস্ব কায়দায় ডাক দিলেন তাকে ,
----- আ জাও । বোলো । কেএয়া কাআম হ্যায় ।
সন্দীপন এক মুখ হাসি নিয়ে উত্তর দিলো ,
---- উও স্যার জয়ন করনে কে লিয়ে আয়া থা ।
মুখের দিকে না তাকিয়ে খাতায় কিছু একটা লিখতে লিখতে গুপ্তা জি প্রশ্ন করলো আবার ,
--- নাম !
---- সন্দীপন দত্ত ।
উত্তর দিলো সন্দীপন ।
এবার বেশ উৎসাহ নিয়ে হাসি মুখে মুখ তুলে তাকালেন তিনি । প্রথমে সন্দীপন ভেবেছিলো যে তাকে হয়তো চিনতে পেরেছেন গুপ্তা জি , কারন জয়েনিং আগে এক দু বার তার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল সন্দীপনের , কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই সে আবিষ্কার করলো যে একটি কালো সালোয়ার পরা মেয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে । গুপ্তা জি তার দিকেই তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ,
---- নাম ?
মেয়েটি আস্তে করে নিচু গলায় উত্তর দিলো ,
---- নিশা চৌবে ।
গুপ্তা কিছুক্ষন আবার ওর দিকে তাকিয়ে থেকে , মাথাটা নিচে খাতার দিকে নামিয়ে নিলেন । হাতের কলমটা কিছুক্ষন একই অবস্থায় ধরে রাখার পর , মুখটা তুলে নিশা ও আমার দিকে এক এক করে ফিরে তাকালেন এবং বললেন ,
---- ডকুমেন্টস ইহা জমা করো । আপন সাইন করেঙ্গে তব মুলানি স্যার কে পাস দে দেনা ।
সন্দীপন ব্যাগ থেকে ডকুমেন্টস বের করে গুছিয়ে নিতে নিতেই পিছন থেকে নিশা ডকুমেন্টস জমা করে দিল । সন্দীপনও জলদি করে নিজের সমস্ত ডকুমেন্টস জমা করলো টেবিলের ওপর ।
এরপর কিছুক্ষনের অপেক্ষা করে নিশাকে মুলানি স্যারের কাছে ছাড়পত্র দিলেও আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন ,
---- সব কুছ কহা হয় ? আসলি চিজ তো দিয়েই নেহি । আপন নেহি ভেজ সকতা ইসে আগে ।
সন্দীপন এই শোনা মাত্রই তার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এলো । চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে টেবিলের সামনে । তার মাথায় একটাই জিনিস ঘুরছে তখন শুধু ,
আসলি চিজ কেয়া হ্যায় !! ডকুমেন্টস !! রিসওয়াত !! য়া কুছ ঔর !!
------ স্যার ! কোনসি চিজ নেহি হেয় ইহাপর ।
গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্নটা গুপ্তা জির দিকে ছুড়ে দিতেই , তিনি বড় বড় চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো , যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে ,
----- তুমহারা এড্রেস ভেরিফিকেশন কহা হ্যায় ? এড্রেস ভেরিফিকেশন মাঙ্গা গেয়া থা কি নেহি !
নিশারও ততক্ষনে সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং অন্যদিকে ইতিমধ্যে দরজার বাইরে অপেক্ষমান নতুন জয়েনিং এর বাকিরা । গুপ্তা জির গম্ভীর স্বরে চিৎকার শুনে তারাও বেশ হতচকিত হয়ে গেছে । এদিকে সন্দীপনের চোখের সামনে পরিষ্কার ভেসে উঠছে সেই দিনটা ।
সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল । তারই মধ্যে সে বাইক নিয়ে রূপনারায়নপুর থেকে রওনা দিল আসানসোল জেলা হাসপাতালে মেডিক্যাল টেস্ট করতে । যেহেতু ভোপাল এর এই অফিস মেডিক্যাল করিয়ে আনার ছাড়পত্র দিয়েছিল যে কোন জেলা হাসপাতাল থেকে , তাই এই সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি । মেডিক্যালের সমস্ত ছাড়পত্র পেতে পেতে দুপুর হয়ে গেল । ঘড়িতে তখন ০১:১০ । বৃষ্টিটাও একটু কম হয়েছে । তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সাব ডিভিশন অফিস হয়ে বাড়ি ফিরবে । যদি বলে কয়ে রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেটটা জোগাড় করা যায় ।
এস ডি ও স্যার তখন মিটিংয়ে ব্যস্ত । সন্দীপনকে তাই বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো । এস ডি ও স্যারের পার্সোনাল এসিটেন্ট দুপুর দুটোয় এসে উপস্থিত হলে , সে আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে হাজির হলো চেম্বারের দরজার সামনে । আস্তে করে ভেতরে মাথা ঝুকিয়ে সে অনুমতি নিলো এবং তারপর ধীরে ধীরে ভিতরে উপস্থিত হলো ।
----- বলুন , কি সেবা করতে পারি ।
ভদ্রলোক ছেলেটির দিকে না তাকিয়ে , নিজের টেবিল গোছাতে গোছাতে বললো । সন্দীপন কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলো , তারপর আস্তে করে জয়েনিং এর চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো ,
----- একটা রেসিডেন্সিয়াল চাই তিন দিনের মধ্যে ।
ভদ্রলোক এবার মুখ তুলে বড় বড় চোখ করে তাকালো সন্দীপনের দিকে , তারপর ঘাড় নেড়ে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । এদিকে সন্দীপন কোন উত্তর না পেয়ে আবার একবার শান্ত গলায় একই প্রশ্ন করতেই , সেই সরকারি ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বলে উঠলো ,
------ হবে না । আগে দেখো ।
সন্দীপনের কাছে তার উত্তর একটি অপমান মনে হলেও সে শান্ত গলায় আবার একবার স্যার বলতেই ; সরকারি সেই কর্মচারী সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে , তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বললো ,
------ বললাম তো হবে না । ফর্ম ভরুন । পুলিশ ভেরিফাই করুক । তারপর পাবেন । অন্তত ১ মাস ।
------ দেখুন । পুলিশ ভেরিফিকেশন আমার হবেই । সরকারি চাকরিতে সব জায়গায় হয়েই থাকে । কিন্তু এই রেসিডেন্সিয়ালটা ওরা আলাদা করে চেয়েছে তাই....
সন্দীপনের কথা শেষ না হতেই , এস ডি ও অফিসের সেই সরকারি লোকটি রীতিমতো জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললো ,
----- গেট লস্ট । সরকারি চাকরির নিয়ম শেখাতে এসেছেন উনি , আমাকে শেখাবে সরকারি চাকরি । গেট লস্ট । নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারবো না । আর যদি তাও লাগে , যারা চাইছে তাদের বাড়িতে এনে , রেখে নিজের বাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যান । হয়ে যাবে ভেরিফিকেশন ।
সন্দীপন এতক্ষন ধৈর্য্য ধরে সব সহ্য করছিল । তবে এবারের কথাগুলো আর হজম হলো না তার । রীতিমতো চিৎকার করে সেও বলে উঠলো ,
---- এই যে শুনুন , আপনি কতটা জানেন সেটা আমি জানি না আর জানতেও চাই না । এটা ভারত সরকারের নিয়োগ পত্র , যেটা আমার হাতে গতকাল এসেছে । আমাকে আগামী তিন কি চার দিনের মধ্যে জয়েন করতে যেতে হবে আর ভারত সরকার এই সার্টিফিকেট যখন চেয়েছেন তখন এটি নিশ্চই পাওয়া সম্ভব । এখন কিভাবে সেটা সম্ভব সেটা আপনি জানবেন । না জানলে স্যারের কাছে যেতে দিন , যা বলার উনাকেই বলবো । দেখি , কি করে একটা রেসিডেন্সিয়াল দিতে আপনাদের ১ মাস , ২ মাস ; আবার কারুর কারুর ৩ মাস লেগে যায় । শালা আপনারা যা পারছেন তাই করে চলেছেন । স্যার কোথায় বসেন এবার সেটা বলুন তো ভালোয় ভালোয় ।
সরকারি সেই বেতনভোগী কর্মচারী তো চুপ । মুখে কোন রা নেই আর ; এদিকে প্রবল চিৎকারে বাইরে সাধারণ মানুষের ভিড় জমে গেছে রীতিমতো , কেউ কেউ আবার বলছে ,
----- এত দিনে ঠিক লোকের পাল্লায় পড়েছে ব্যানার্জি বাবু । খুব যা তা করতো । ঠিক বলেছে ছেলেটি ।
একজনকে তো এও বলতে শোনা গেল ,
------ ছেলেটির ধৈর্য্য আছে । আমি হলে তো কষিয়ে দিতাম দু গালে । শালা ঘুষখোর সব ।
সন্দীপন মৃদু হেসে ভদ্রলোকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বললো আবার ,
----- শুনছেন তো । জনগন আপনাদের নিয়ে কি বলছে । এখন বলুন , উনাদের হাতে এই কেসটা তুলে দেবো । শালা , একটা মার বাইরে পড়বে না , বুঝেছেন ।
এস ডি ও র সেই পার্সোনাল এসিস্টেন্ট ভয়ে ধীর স্বরে বসতে বললো তাকে । তারপর আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে বললো ,
----- দেখুন , নিয়ম বলে একটা জিনিস আছে । আমরা কিসের ভিত্তিতে আপনাকে রেসিডেন্সিয়াল দেবো বলুন । বিডিও স্যার যদি সার্টিফাই করে দেন , তাহলে আমরা দিয়ে দেবো ।
চেয়ার ছেড়ে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সন্দীপন বললো ,
----- এই কথাটা ভালো ভাবেই বললেই হতো । তা নয় অপমান করে গেলেন সকাল থেকে । শুনুন মশাই , এখানে কেউ অপমানিত হতে আসে নি । ভবিষ্যতে সেদিক খেয়াল থাকে যেন ।
এরপর সন্দীপন দুবার বিডিও স্যারের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছিল , তবে দেখা মেলেনি । অবশেষে ফোন করে সে গুপ্তা জিকে সব জানায় । গুপ্তা জি তাকে ওই সার্টিফিকেট ছাড়াই চলে আসার অনুমতি দেন । আজ সেকশনে দাঁড়িয়ে একথাগুলোই সে পুনরায় মনে করিয়ে দিলো ।
৩।।
অফিস ক্যান্টিন । চেয়ারে বসে কেউ চা , কেউ কফি , কেউ দুধ , আবার কেউ দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত । সুবিশাল এই হলের বামদিক চাপা কোনায় কিছু জন চেয়ারে গোল করে বসে আছে । প্রথমে হালকা মোটা , গায়ে কি সব লাল সাদা দাগ , সন্দীপন । পাশে রোগা মত একটি ছেলে , উচ্চতা ৫ ফুটের মতো ; নাম রজত । তার পাশে নিশা । তার পাশে রোগা , লম্বা একটি ছেলে ; নাম রজত । তার ডানদিকে ছোটখাট একটি ছেলে , নাম আরিফ । পাশে লম্বা দুজন , যথাক্রমে অজিত ও অঙ্কিত ।
----- আজ কি চায় দাদা কে নাম ।
নিশা একথা বলে উঠতেই সকলের দৃষ্টি একসাথে এসে জড়ো হলো সন্দীপনের দিকে । তারপর এক সাথে সকলে মিলে বলে উঠলো ,
------ দাদা , টিম ভোপাল মে আপকা সোয়াগত হয় ।
সন্দীপন এতক্ষন ধরে চুপচাপ বসে ছিল । সকলের এই অভ্যর্থনা তাকে বেশ পজিটিভ করে তুলেছে । সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে ক্যান্টিন বয় কে হাঁক দিয়ে বললো ,
---- ভাইয়া , সবকে লিয়ে চায় আউর গরম সমোসে ।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল । বাড়ির থেকে এত দূরে বসে থাকলেও সকলের ভালোবাসা সন্দীপনকে সব ভুলিয়ে রেখেছিল । আজকাল তো মা কে ও ফোন করতে ভুলে যায় সে । তবে ওই একটা চিন্তা তাকে বেশ ভোগাচ্ছিল , ঠিকানা , টাকা । একদিকে যখন সে প্রতিটি দিন কাটাচ্ছে হিসাবের মধ্যে , ঠিক তখনই একটি ইমেল তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে এই কদিনে । অফিসের ক্যান্টিনে বেশি দেখা যায় না আর , দেখা গেলেও চুপচাপ বসে থাকে । এমন নয় যে বিষয়টি কলিগদের নজর এড়িয়ে গেছে , তবু তারা সাহস করে জিজ্ঞাসা করে নি । এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল , কিন্তু সোমবার সন্দীপনের সাথে যা ঘটে গেল , তা তার সমস্যা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল । সোমবার বিকেলে হোটেলে পৌঁছালে হোটেল এর রিসেপশনে তাকে জানানো হয় ,
----- স্যার , আপ বহত দিনো সে ইহা পর হয় , ভাড়া ভি মিল রহা হয় ; ইসলিয়ে কহনে মে খারাব লগ রহা হয় । লেকিন কহনা পড়েগা স্যার ..... স্যার , কাল শাম তক আপকো হোটেল ছোরনা পড়েগা । পুলিশ আয়া থা , কহ কে গয়া হয় ।
খবরটা শোনা মাত্রই সন্দীপনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । মঙ্গলবার সকাল থেকেই কোন পাত্তা নেই তার । থাকবে কি করে ! এক বেলার মধ্যে একটা নতুন ঠিকানা খুঁজতে হবে । তারই ব্যস্ততা গ্রাস করেছে আজ । রাস্তায় একটি অটো ভাড়া করে শহরের সস্তা হোটেল ঘুরে বেরিয়েছে সে , সব খুলে বলেছে তাদের । কিন্তু কোন রুম ফাঁকা থাকলে তো ! এরই মধ্যে কয়েকদফা মোবাইলটা বেজে উঠলো , কিছু ফোনকল কেটে দিলো সে আর কিছু কেটে গেলো রিং হতে হতে । সমস্যা হলো ফোন যে করেছিলো সে হলো সন্দীপনের মা । ফলে ছেলের খবর না পেয়ে , রীতিমতো চিন্তিত ও অস্থির হয়ে সে ছুটলো বাড়ির পাশে , সমরেসের বাড়িতে , তার মা লাবণ্যের বাড়িতে । সন্দীপনের মা কে রীতিমতো হাঁপাতে হাঁপাতে গেট খুলতে দেখে লাবণ্য দত্ত বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো । মনে মনে নানা উৎকণ্ঠার কথা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে এসে বললো ,
---- কী হয়েছে ? সব ঠিক আছে তো ? সন্দীপনের কী খবর ? এত হাঁফাচ্ছেন কেন দিদি ? ভেতরে আসুন ।
---- ছেলেটার ....
এটুকু বলেই শাড়ির আঁচলে ভিজে দুচোঁখ মুছে ঘরের ভেতরে এসে দাড়ালো সন্দীপনের মা , ভারতী ।
লাবণ্যের বুঝতে একটুও বাকি রইল না যে সন্দীপনের কিছু একটা হয়েছে কিন্তু ঠিক কী হয়েছে তা জানার জন্য ভারতীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন ,
----- ছেলেটার কী হয়েছে ? সে ভালো আছে তো ।
---- সেটাই তো জানি না । আজ সকাল থেকে প্রায় পাঁচ থেকে ছ বার ফোন করলাম , কিন্তু ধরলো না । বেশ কয়েক বার কেটে দিলো । বুঝতে পারছি না , ও কোন বিপদে পড়লো না তো !
কাঁদো কাঁদো গলায় ভারতী বললো ।
----- সব ঠিক হবে । নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছে ।
এটুকু বলেই সমরেসের মা , প্রতিবেশীকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু নিজেকে নিজেই শান্ত রাখতে পারলো না এবং ঠাকুর ঠাকুর করে প্রণাম করতে লাগলো বারবার ।
তখন বেলা বারোটা । ক্লান্ত হয়ে ঘেমে নেয়ে সন্দীপন এসে হাজির হলো অফিসের সামনে । বাইরে লোক বলতে ওই মালি আর দারোয়ান । এদের পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই তার দেখা নরোত্তমের সাথে । এত দেরি করে অফিস আসতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো সে । বললো ,
---- কেয়া জি । ইতনা দেরি । তবিয়ত তো ঠিক হয় না ।
এরই মধ্যে পিছন থেকে এসে উপস্থিত আরও দুটি ছেলে ; ২৫ কি ২৬ বয়স হবে । নরোত্তমকে দেখতে পেয়ে তার দিকেই এগিয়ে গিয়ে বললো ,
--- কেয়া নরোত্তম । কিসকা তবিয়ত খরাব হয় ?
---- উওহ দাদা আজ লেট আয়ে তো উসি লিয়ে হাল চাল পুছ রহা থা । কহি তবিয়ত তো খরাব নেহি হুই উনকি । ওয়েসে দাদা সে মুলাকাত হুয়া কি নেহি ?
নরোত্তম উত্তর দিলো । এরই মধ্যে সেকশন থেকে তার খোঁজ করায় সে এইটুকু বলেই স্থানত্যাগ করলো । সন্দীপন-ও গুটি গুটি পায়ে তাকে অনুসরণ করলো । বাকি দুজন লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো ।
ক্যান্টিন এর ফাঁকা ঘর । কোনায় একলা কেদারায় বসে সন্দীপন । মোবাইলে হালকা চালে গান চলছে বটে , কিন্তু মন সে দিকে নেই তার । কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সে । এরই মধ্যে মোবাইলটা বেজে উঠলে অবচেতন মন তার খানিকটা চেতনায় ফিরে আসে । ফোনটা রিসিভ করলো সে এবার ,
---- কি রে , সকাল থেকে ফোন ধরছিস না । কি হয়েছে তোর !
সমরেসের সেই চেনা গলা ভেসে এলো ওপাশ থেকে ।
সন্দীপন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো । যেন গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে , কি বলবে সে , তারপর উত্তর দেয় ,
---- ঠিকানা খুজছিলাম । যে হোটেলে ছিলাম সেখানে পুলিশ এসে বলে গেছে , কাউকে বেশি দিন রাখা যাবে না । তাই ....
---- তোর ডকুমেন্টস দেখাস নি ! তুই কেন এসেছিস , কি জন্য .... এসব বলিস নি ওদের ।
সমরেস বেশ অবাক হয়ে উত্তর দেয় ।
সন্দীপনের আজ কথা বলার একটুও ইচ্ছে নেই । তবু বন্ধুকে সে সব বুঝতে না দিয়ে বলে চললো ,
---- ওরা মানতে চাই নি । আর তাই আজ বিকেলে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে ।
----- তা কিছু ব্যবস্থা হলো তোর ?
সমরেস জানতে চায় ।
সন্দীপন নিজের খেয়ালেই বলে চললো ,
---- হয়েছে । তবে খুব ভালো কিছু নয় । একটা বয়েজ হোস্টেলে .... সিঙ্গেল রুম , ছয় হাজার টাকা । তুই ফোনটা রাখ । মা ফোন করছে ।
এই বলে সে , সমরেসের ফোন কেটে দিয়ে , দ্বিতীয় কলটি রিসিভ করলো এবার । আজ ক্লান্ত ছেলেটি , খেয়াল করে নি ফোনটি কার । সকাল সকাল হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল একটুকরো আস্থানার খোঁজে । অচেনা এই দেশে , অচেনা মানুষগুলো তাকে সাহায্য করবে কেন ! কতটুকু জানে তার সম্বন্ধে ! এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সে হোটেল থেকে বেড়িয়ে এসে দাঁড়ায় বড় রাস্তার সামনে । কোথায় যাবে , কি বলবে কিছু জানা নেই তার । এরই মধ্যে কোথা থেকে এক অটো ওয়ালা এসে উপস্থিত হলো তার সামনে । বেশ চিন্তিত দেখে জিজ্ঞাসা করলো ,
---- সাহাব , কেয়া বাত হয় ।
সন্দীপন তখন কোন কিছুই বিস্তারে বলতে পারে নি , শুধু বলেছিল ,
---- ভাড়ে পে ইহা কোই রুম মিলেগা ? কোই হোস্টেল ওয়াগেরা ।
অটো ওয়ালা কিন্তু না বলে নি । অটোর পিছনে বসিয়ে এম পি নগর ও অরেরা হিলস সংলগ্ন বয়জ হোষ্টেলগুলি একের পর এক দেখাতে শুরু করে । কোথাও ঘর পছন্দ হয় না তো কোথাও তাকে থাকতে দেবে না বলে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয় । অটোর পিছনে বসে সন্দীপন ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এ কোনা থেকে অন্য কোনা । খিদেতে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আর বাইরে দৌড়াচ্ছে সে । থামছে , নামছে , কিছু সময় কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু । একটা সময় সে ধরেই নিয়েছিল যে কোন সুরাহা হবে না আর । ঠিক সেই মুহূর্তে তারা এসে উপস্থিত হল ১২ নম্বর বাজারের কাছে । এখানে একটি ফ্ল্যাট আছে , ওয়ান বি এইচ কে ; ডান দিকের একটি সরু গলির ভিতরে । সন্দীপন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে ।
তার কাছে উপায় যে কিছুই নেই , রাজি হওয়া ছাড়া । মাসিক ভাড়া ৬০০০ টাকা , ইলেক্ট্রিসিটি আলাদা । যখন থাকার ব্যবস্থা ফাইনাল হয় তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোর ঘর ছুঁই ছুঁই । তাই সেই অটো করেই সে সোজা উপস্থিত হয় অফিসে ঘেমে স্নান করে । এর মধ্যে মায়ের এক গাদা নম্বর আজ কল লিস্টে এসে জমা হয়েছে , কিন্তু সে সময় হয়নি তার ঘুরিয়ে কল করার । আর এখন ফোন বেজে উঠতে সন্দীপন কোন কিছু না দেখেই ধারণা করে নেয় যে , এ কল নিশ্চই তার মায়েরই করা । ফোনটা ধরেই হ্যালো বলতে না বলতেই ওপাশ থেকে এক চেনা কিন্তু অপ্রত্যাশিত গলা ভেসে এলো তার কানে ।
----- হ্যালো । সন্দীপ জী । ড্রয়ার খুল্লা হ্যায় কেয়া ?
৪।।
বাংলা ছেড়েছে আজ হপ্তা খানেক হয়ে গেছে । এর মধ্যে মা আর সমরেস ছাড়া সেভাবে অন্য কারুর সাথে কথা হয় নি সন্দীপনের । আজ এই চেনা কন্ঠস্বর শুনে একটা আলাদা আনন্দ চোখে মুখে ভরে উঠল তার , তবে তার পাশাপাশি পুরোনো কোম্পানির কোন চাল হতে পারে তাকে খুঁজে বের করার এই ভেবে সে কিছুটা সাবধান হয়ে গেল । পরক্ষনেই মনে জেগে উঠলো সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনগুলোর কথা ---
" সাবধানিরা বাঁধ বাঁধে সব , আমরা ভাঙি কুল " ....
এই কুল ভাঙার স্বপ্ন নিয়ে প্রবল উদ্যমে সে উত্তর দিলো ,
---- কে বলছেন ?
ওপাশ থেকে কিছুর হাসির ধ্বনি শোনা গেল এবার আর তারপর তারই মাঝখান থেকে সেই চেনা কন্ঠ বলে উঠলো আবার ,
----- আমাদের ভুলে গেলেন অফিসার ! নতুন চাকরিতে ঢুকে ঢুকেই , মাল কামাতে শুরু করেই পুরোনো লোকেদের ভুলে গেলে অফিসার ।
বেশ চিনতে পারছিলো সে , এ নিউ ইন্ডিয়া থেকে স্নেহাশীষ চক্রবর্তী ফোন করেছে তাকে , কিন্তু কেন এটা বোঝা হয় নি এখনো । তার ভাবনাগুলো এখনো জানে না , এটা নরম্যাল কল নাকি স্পেশাল কিছু । তাই সে সাবধানতা আরো খানিকটা বাড়িয়ে উত্তর দিলো এবার ,
------ স্নেহাশিষ দা হঠাৎ ! এত দিনে মনে পড়লো আমায় ?
ওপাশ থেকে সেই চেনা পরিচিত হাসি হেসে স্নেহাশিষ উত্তর দিলো ,
------ ঠিক তা নয় । সময় পাই না । আজ একটা বিশেষ কারনে ফোন করতে হলো । দেখো পরি কি বলবে তোমায় ।
সন্দীপন কিছু বলতো তার আগেই পরিতোষের গলা ভেসে এলো ওপাশ থেকে ,
----- কেমন আছো ? কোথায় আছো ?
উত্তর দেবে কি দেবে না , দিলে ঠিক কি বলা উচিত হবে এসব আজ বেশ ভাবাচ্ছে আর সবার ওপরে ভাবাচ্ছে যে স্নেহাশিষ দা র বিশেষ কারণটি কি !
---- ভালো আছি পরি দা । তোমরা কেমন আছো ?
হাসির স্বরে উত্তর দিলো সে । এই মুহূর্তে সে বিন্দুমাত্র চায় না যে , তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিন্দু মাত্র আন্দাজ করুক নিউ ইন্ডিয়ার কেউই । তবে সব তো তার ইচ্ছামতো হয় না বা হতে পারে না । ভবিষ্যত মানুষের চোখে সেভাবে সবসময় ধরা দেয় না আর দেয় না বলেই বিশ্বাস নামক বস্তুটি পৃথিবীতে আজও জীবিত আছে । সেই বিশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখেই সে বলে চললো আবার ,
---- এই তো দুদিন হলো ভোপাল পৌঁছেছি ।
এটুকু বলেই চেতনার গোড়ায় কে যেন নাড়া দেয় একবার । অজ্ঞানতার অন্ধকার কাটিয়ে জ্ঞানে ফিরলে মানুষ বেশ বুঝতে পারে কী সর্বনাশ সে করে ফেলেছে অথবা করতে চলেছে । এই একই অবস্থা তারও এবং সে তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে ,
------ তবে এখনও জয়েন করিনি ।
----- সেকি ! এখনো জয়েন করোনি ।
অপরদিক থেকে পরিদার উৎকণ্ঠা যুক্ত গলা ভেসে আসে । সে স্বর বলে চলে ,
----- তাহলে চলছে কি করে তোমার !
----- এই চলে যাচ্ছে ।
বেশ হতাশ হয়েই উত্তর দেয় সন্দীপন ।
----- তোমাদের কথা বলো । পরেশ দা , বাঘ দা , সর্বাশিষ দা , ম্যানেজার কেমন আছেন ? অফিসের খবর কি ?
দীর্ঘ বক্তব্য তার দীর্ঘতর হতে থাকে আরও , এই আশায় , যদি ফোন কেটে দেয় ব্যস্ত লোকটা । সে বলে চললো আরও ,
---- এজেন্টদের খবর কি ? ব্যবসা কেমন চলছে ? মাইনে হয়ে গেছে পরি দা ।
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে হোঁচট খায় সে । কোথাও না কোথাও সত্যের মুখোমুখি হতেই হয় সকলকে আর সেখানেই হোঁচট খেতে হয় সকলকে বারবার । সন্দীপনও এর ব্যতিক্রম নয় ।
জবাব ফেরত এলো যখন , তখন সন্দীপনের মুখ শুকনো । হয়তো কান্নাও দানা বেঁধেছিলো চোখে , তবে সকলের সামনে প্রকাশ পায় নি আর । পরিতোষ যা বললো তা দুশ্চিন্তার মেঘ টুকু আরও ঘন করে দিলো সন্দীপনের আকাশে ।
ফোনটা বন্ধ করে দিলো সে এবার । ভাবনার গভীর সাগর তলে ডুব দিচ্ছে আজ , যদিও সে বেশ জানে এখানে কোন মুক্ত সে পাবে না আজ । ভেবে পাচ্ছে না , কোম্পানি এত টাও মারাত্মক হতে পারে । তবু মোবাইলে মেল খুলে সে নিশ্চিত হতে চাইলো একবার । পরিষ্কার ভাষায় মেল করা হয়েছে দুটো --- প্রথমটি মুম্বাই হেড অফিস থেকে আর পরেরটি কলকাতা রিজিওনাল অফিস থেকে । দুজনের বক্তব্য একই , যার সারমর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে , যেহেতু সে কোম্পানিকে না জানিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ; তাই তার বর্তমান মাইনে দেওয়া হবে না । এর সাথে আরও জানানো হয়েছে যে , শ্রী সন্দীপনকে কোম্পানির এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ১৯ মাসের মাইনে অর্থাৎ ৯ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরত দিতে হবে এবং এর অনাদায়ে তার বিরুদ্ধে কোম্পানি আইনি ব্যবস্থা নেবে ।
১০ লক্ষ টাকা ! ১০ লক্ষ টাকা ! এই একই কথা মনের মধ্যে সে বলে চলেছে অনবরত । একটা গভীর চাপ গ্রাস করেছে তাকে আর হবে নাই বা কেন ! এত টাকা জোগাড় করে মধ্যবিত্ত ঘরে চাড্ডিখানি কথা নয় । কি হবে এবার !!
৫।।
ভাবনার স্রোতের গভীরে হারিয়ে গিয়ে ভেসে যায় সকলেই । এ যেন এক গভীর খাদের মত , যার কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন তলিয়ে যায় অনেক গভীরে । বাঁচার চেষ্টা করে নিশ্চই , কিন্তু বাকিটা থাকে ঈশ্বরের সহায় , যদি কোন বুদ্ধি এসে ধরা দেয় মগজে । সন্দীপনের অবস্থাও আজ ঠিক তাই , ছটফট করে চলেছে ভেতরে ভেতরে আর বাইরে সমস্ত কাজ দিব্যি করে চলেছে ; ঠিক যতটা না করলে নয় । মায়ের ফোন সময়মতো ধরছে , খোঁজ খবর নিচ্ছে সকলের ; এই কদিনে সমরেসের সাথেও কথা হয়েছে প্রায় প্রতিদিন , রাত জেগে আড্ডা দিয়েছে বাল্য বন্ধু শুভর সাথে । শুধু অফিসের ওই কয়েকটা ঘন্টা তার কাছে দায় মনে হচ্ছে । ক্যান্টিনে বসে বসে মনে ভেসে উঠছে একটাই কথা ---
১০ লক্ষ টাকা ! ১০ লক্ষ টাকা ! এই একই কথা মনের মধ্যে সে বলে চলেছে অনবরত । একটা গভীর চাপ গ্রাস করেছে তাকে আর হবে নাই বা কেন ! এত টাকা জোগাড় করে মধ্যবিত্ত ঘরে চাড্ডিখানি কথা নয় । কি হবে এবার !!
এমনি একদিন , বুধবার ক্যান্টিনে একলা বসে একা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল সে , সেই দুটি ছেলে যাদের সেকশনের সামনে সেদিন সে দেখেছিল , এসে ঢুকলো ক্যান্টিনের ভেতর । সন্দীপনকে একা বসে থাকতে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো তার দিকে , এবং একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললো ,
----- হায় , মের নাম সৌরভ , সৌরভ শর্মা ।
দ্বিতীয় জন ছেলেটিও সটান লম্বা করে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো ,
------ ম্যায় , রাজীব , রাজীব ইয়াদভ ।
সন্দীপনের আজ পরিচয় করার একটুও ইচ্ছে নেই কারুর সাথে । পরিচয় তো দূরের , কথা বলার ইচ্ছে নেই তার । তবু হাসি মুখে হাত মিলিয়ে বললো ,
---- সন্দীপন , সন্দীপন দত্ত ।
উত্তর শেষ হতে না হতেই রাজীব বেশ ইয়ার্কির ছলেই বলে উঠলো ,
---- বাঙ্গালী বাবু ...
সন্দীপন আজ আর সহ্য করার অবস্থায় নেই । একদিকে মাথায় চাপ আর অন্য দিকে এদের ইয়ার্কি , ফাজলামি ; দুঃসহ মনে হচ্ছিল তার কাছে । চেয়ার ছেড়ে উঠে বেড়িয়ে যেতে চাইলো সে আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে ভেসে এলো সৌরভের শ্লেষাত্মক কন্ঠ ,
---- আরে দাদা । রুঠ কে কহা চল দিয়ে । আজাইয়ে , মছলি খিলাউনগা ।
সন্দীপনের থেকে এসব সহ্য হচ্ছিল না আর । পেছন দিকে পিছিয়ে এলো সে । চোখ মুখ তার লাল । ঝড়ের ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সকলে । চিৎকার করে বলে উঠলো সে ,
---- হা ম্যায় হু বাঙ্গালী । হা ম্যায় খাতা হু মাছ ভাত । তো ....
ইতিমধ্যেই বাকি কলিগরাও এসে উপস্থিত হয়েছে । সন্দীপনের ওই রূপ দেখে তারা থ । কেউ নড়ছে না , কেউ কিছু বলছে না ; শুধু সন্দীপন বলে চলেছে আজ ,
---- হাম বাঙ্গালী তুমহারে জাইসা কিপটা নেহি হেয় । হমে খানা দিখাতা হ্যায় । শালা বাঙালী খানা , ফুটবল ঔর রাজনীতি মে তুম সব সে আগে হ্যায় । ঔর আগে কিউ হ্যায় পতা হ্যায় না , বুদ্ধি কে বাজাহ সে আউর বুদ্ধি আতা হয় মাছ ভাত সে । এক বাঙালী তুম সব পে ইউহি রাজ কর সকতা হ্যায় । সমঝে ...
এই বলে সে কোন দিকে না তাকিয়ে গট গট করে ক্যান্টিন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো । নিশা ও বাকিরা ধীরে ধীরে ভেতরে এসে প্রবেশ করলো এবার । সম্পূর্ণ ঘটনায় তারা বেশ অবাক ।
---- দাদা কো আচানক কেয়া হুয়া ?
অজিত জানতে চাইলো । বাকিরাও একই প্রশ্ন ছুড়ে দিলে রাজীব সেখান থেকে উঠে চলে গেল । সৌরভও উঠে যাচ্ছিল তবে সকলে মিলে তাকে জেরা করতে থাকায় সে যেতে যেতে বলে যায় ,
----- দেখো মিত্রো বাঙ্গালী হোতে এয়সেহি । মজাক করনা উনকো আতা কহা হ্যায় ।
তার কথাগুলো অজিতের ঠিক লাগলো না , তবে কলিগ বলে প্রতিবাদ করতেও পারলো না সে ; শুধু মাথা নেড়ে গেল পেন্ডুলামের মতো আর ওদিকে সৌরভও ক্যান্টিন ছেড়ে বিদায় নিলো সেই সুযোগে ।
৬।।
মাথায় হাজার চিন্তার স্রোত বইছে । বাড়ি ছেড়ে একলা এত দূরে পড়ে থাকা , অন্য দিকে কোম্পানির চাপ ; প্রায় দশ হাজার টাকা । পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা তার । নিস্তব্ধ রাতে ব্যালকনিতে বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে । এরই মাঝে চোখের সামনে পুরোনো বন্ধুর মুখটা ভেসে উঠছে বারবার , শুভর গতকালের ফোনটা খুব একটা সুখকর ছিল না ; ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কান্নার আওয়াজ আর শুভ ও তোতনের কথাগুলো বড় কানে বাজছে তার ,
----- অরিজিৎ চৌবে , আর নেই । জীবনের কাছে হার মেনে নিয়েছে সে । কুইট....
ভীষন অবাক হয়েছিল সন্দীপন কথাটা শুনে । সে জানতে চেয়ে বলে ,
---- হঠাৎ ! কি হয়েছিল যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো ।
ভেজা ভেজা গলায় উত্তর দেয় তোতন ,
----- বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মা , দিদিকে রেলের চাকরিটা দিয়ে দিয়েছিল । আর সেই চাকরির সুযোগ নিয়ে ওর দিদি বিয়ে করে ওর মা আর ভাইকে ঘর থেকে বের করে দেয় । অরিজিৎ এর কোথাও কিছু হচ্ছিল না । পেনশনের টাকাগুলো ওদের কাছে অকর্মের ঢেঁকি মনে হতে লাগলো । অরিজিৎ বহু বার মিটমাটের চেষ্টা করে , ফল কিছুই হয়নি । দিনদিন সাইকো হয়ে যাচ্ছিলো সে । বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল । কাল রাহুল ফোন করে জানায় ....
বাকি কিছু বলার আগেই কান্নায় ভেসে যায় দুজনে । আজ সন্দীপনের এসব মনে হচ্ছিল আর সে ভেবেছিলো যে তারও তো বাবা নেই .... বাবার ভূমিকা কত বড় সে আবার একবার উপলব্ধ করছিলো আজ । এভাবে অনেক সময় কেটে গেলে তার মনে হয় , মন ভালো করা উচিত । আর তাই ফেসবুকটা খুলে বসলো সে আবার । আজকাল একমাত্র এখানেই যে শান্তি পায় সে ...
ফেসবুকের দপ্তরে সন্দীপন এখন এক ডেলি কাস্টমার । এখানেই সে ভবিষ্যৎ আঁকে তার কবিতার মধ্যে দিয়ে । কবিতাই এখন তার সব , এ সবে কারুর কোন প্রবেশাধিকার নেই । সময়টা ওই মে জুন মাস । কবিতার দুনিয়ায় সদ্য পরিচিত নাম তখন সন্দীপন । এমনই এক সন্ধ্যায় একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতে গিয়ে মিনিট দু এক থামলো সে । কি অপরূপ দেখতে তাকে !! বোধহয় একেই বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট । দেরি না করে প্রোফাইলটা একবার খুলে দেখল সে । ঠিক যেটা চেয়েছিল , সেটা যে খুঁজে পেয়েছে সেটা তার মুখ চোখ থেকে স্পষ্ট । নাম ; সত্যবতী , সিঙ্গেল, ফেসবুক বলছে , তার বয়স ২২ । মনের মত কাউকে পেলে বন্ধুত্ব না করে কি থাকা যায় আর যদি কেসটা হয় লাভ এট প্রথম দেখা তাহলে দেরি না করাই ভালো । সুতরাং , শুভ কাজে দেরি করে কি লাভ ! তড়িঘড়ি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে পা রাখলো সন্দীপন এবার । রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে নিলো সে ঠিকই কিন্তু সমস্যা একটাই , মেয়েটিকে কিকরে বোঝাবে সে যে সন্দীপন ইস ইন লাভ উইথ হার । নিজের লাজুক স্বভাবের জন্য মেয়েদের সাথে খোলামেলা ভাবে সে মিশতেও পারে না । আর তাই ভয় হচ্ছে বেশ আজ , যদি সত্যবতী অন্য কারুর হয়ে যায় । পাগলের মত হন্যে হয়ে সন্দীপন পথ খুঁজে চলছিল দিনরাত , কয়েকবার ভেবেওছিল সে , মনের সব কথা বলে দেবে সত্যবতীকে । কিন্তু লাজুক স্বভাব তার , সে সাহস দেয়নি তাকে ।
এমন এক পরিস্থিতিতে তার একমাত্র অস্ত্র হল কবিতা । এই জায়গাটা সন্দীপনের খুব স্ট্রং । গোপনে কবিতার মধ্যে দিয়ে সে ঠিক করলো মেয়েটাকে মনের কথা বোঝাবে । তারপর ....
শুরু হল একের পর এক প্রেমের সিরিজ আর প্রেমের কবিতা । কিন্তু কোন কিছুই কাজ দিচ্ছে না তার । এদিকে পুজো কাছে এসে যাচ্ছে । কিছুই মাথায় আসছে না । সুতরাং , ভাগ্যই ভরসা । ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে সন্দীপন নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
পরদিন সকালে মেল চেক করতে গিয়ে সন্দীপন যা দেখলো তাতে সে বেশ অবাক । কোম্পানির প্রাপ্ত এগ্রিমেন্ট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব না মেটালে কোম্পানি তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে ---- এই হলো মেলের সারমর্ম । যেটুকু আনন্দ তার মনে জন্ম নিয়েছিল এই কদিনে , আজ যেন হট করেই তারা মারা গেল একসঙ্গে । তাই তো সন্ধ্যা নেমে গেলো সন্দীপনের ঠিকানা ফেসবুক না হয়ে , একটি বারে স্থানান্তরিত হলো । মা ফোন করেছিল এর মাঝে প্রতিদিনের মতোই কিন্তু সে জানায় ,
----- মা । কাজ আছে । খুব চাপ । রাত হবে ফিরতে । কাল কথা বলবো । বাই।
মায়ের মন তো , ছেলের কথাগুলো কেমন কেমন মনে হলেও , বিস্বাস করে নিলো । পরদিন সকাল হতে না হতেই তাই যথারীতি মোবাইলের ঘন্টা বেজে উঠলো তার । আধঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল সে । আগের দিন একটু বেশিই খেয়ে নিয়েছিল , তাই ঘুমটাও আজ একটু বেশিই গভীর হয়ে গেছে । তবু আধ চোখেও সে দিব্বি টের পাচ্ছিল যে মা ফোন করেছে তাকে । অনেক দিন পর প্রাণ খুলে কথা বললো সে । সে জানে বাড়ি বিক্রি ছাড়া তার কোন পথ নেই এই বিশাল অঙ্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার । কত দিন লুকিয়ে রাখবে সে । অগত্যা সে সাহস করে মাকে সব খুলে বললো আজ ,
----বাড়িটা বিক্রি করতেই হবে । তবে চিন্তা কোরো না । আমি তো চাকরি করছিই , কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে নেবো ।
বৃদ্ধা বিধবা মহিলাটি বেশ বুঝতে পারছে , ছেলের ওপর ঘনিয়ে আসা আসন্ন বিপদটা । তাই সেরাম কিছুই বলতে চায় না । নিস্তব্ধ নীরবতা তার সন্দীপনকে আরও আঘাত হেনে দেয় , দুশ্চিন্তা বাড়ায় , ধরমরিয়ে উঠে বসে চিৎকার করে ওঠে সে মোবাইলের এপাস থেকে ,
---- মা । ও মা । কি হলো মা । ঠিক আছো তো ? কি গো কথা বলছো না যে !
উত্তর আসে না কোন । ছেলের গলা ধরে আসছে । মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে আসছে । চারপাশের নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে তাকে । সে আধো গলায় চিৎকার করে ওঠে আবার ,
----- আ... ও আ । আ.... মা.....
একটা শান্ত গলা ভেসে ওঠে এবার ,
---- আমি ঠিক আছি বাবা । তুই খেয়াল রাখিস নিজের । এখন রাখি , কেমন ।
ছেলে বেশ বুঝতে পারছে যে কোন কিছুই ঠিক নেই বিধবার মনে । যতই হোক বাড়িটাই স্বামীর শেষ সম্বল । আর অন্যদিকে ছেলের ওপর ঘনিয়ে আসা বিপদ । মা হয়ে সেটুকু প্রতিহত করতে না পারলে কি লাভ তার মাতৃত্বের । সন্দীপন তাই ফোন কেটে , মা কে যেতে দিলো আজ । গেরুয়া না পড়েও সন্যাসী হওয়া যায় , সন্দীপন আজ যেন তার বলিষ্ঠ উদাহরণ । মা , বন্ধু , প্রেমিকা সব ভুলে সে আজ একক ।
সেদিন ১৪ই আগস্ট । ভোপাল স্টেশনে বড় ঘড়িটায় তখন সন্ধ্যে ছ'টা বাজছে । সন্দীপন পিঠে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওভার ব্রিজের ওপরে । একদিনের ছুটিতে বাড়ি ফেরার অনুমতি এজি অফিস থেকে আগে ভাগেই নিয়ে রেখেছিল । গত সন্ধ্যায় মা কে ফোন করে জানিয়েও দেয় । মা অবশ্য একটু রাগই করেছিল প্রথমে , বলেছিলো ,
----- এক দিনের জন্য আসার কি দরকার ছিল ! এতগুলো টাকা খরচ করার কোন মানে হয় !
কিন্তু মায়ের মন তো , ছেলেকে আটকায় নি পরে আর । ট্রেন ঠিক ৭:১০ এ ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাড়ালো । স্লিপার বগি প্রায় ফাঁকা । সন্দীপন ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে নিজের সিটে এসে বসলো । সাইড লোয়ার ব্যার্থ , সিট নম্বর ১৫ ।
৭।।
চোরি করতা হ্যায় শালা --- দূর থেকে শব্দটা ভেসে আসতেই , আধ ঘুম চোখে ধরমাড়িয়ে উঠে বসলো সন্দীপন । আধো আলো কম্পার্টমেন্টে দু পা এগিয়ে যেতেই দেখে মাথার ভিড় । ঘিরে থাকার জনতার মাঝে , হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করছে একটা ছেলে , বয়স ওই দশ কি বারো হবে । ওদিকে ক্ষুব্ধ জনতার উগ্র চিৎকার আর এদিকে সন্দীপনের প্রশ্ন একটাই , ইস্কুলে পড়ার বয়সে চুরির পথ কেন ? ইতিমধ্যে রেল পুলিশের হস্তক্ষেপে ঝামেলা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে । ছেলেটিকে রেল পুলিশ গ্রেফতার করেন । সন্দীপনের এসব দেখতে ভালো লাগছিল না , তাই নিজের সিটে এসে বসে পড়লো সে আবার ।
পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো ট্রেন তখন অজানা পথে ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে তখন সকাল ৭টা বাজে । আর চার ঘন্টার রাস্তা , তারপর আসানসোল নেমে পড়বে সে । তাই ধীরে ধীরে উঠে ব্যাগটা ঠিক ঠাক করে নিলো সে আরেকবার । তারপর চোখে মুখে হালকা জল দিয়ে এসে বসে একটা চা কিনে উপভোগ করতে লাগলো ।
ঘড়ির কাঁটা তখন বারোর ঘরে । আসানসোল স্টেশনে গাড়ি এসে থামলে , আস্তে আস্তে সে নেমে এলো ট্রেন থেকে । চেনা পথের আনন্দে বাইরে বেরিয়ে হাঁক মারলো জোরে ,
--- ট্যাক্সি । রূপনারায়নপুর যাবে ?
দু তিন জন তার ডাক শুনে এগিয়ে এলো । তাদের মধ্যে একজন লাল গেঞ্জি পড়েছিল । মাঝারি উচ্চতা । সেই প্রথমে এগিয়ে এসে বললো ,
---- কোথায় যাবেন ?
---- রূপনারায়নপুর , অমল নার্সিং হোম
সন্দীপন হেসে উত্তর দিলো ।
---- চারশো লাগেগা ।
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ড্রাইভারটি বললো । সন্দীপন আর দর দাম না করে রাজি হয়ে গেল ওই ভাড়াতেই ।
সারাটা দিন মায়ের সাথে কাটিয়ে দেওয়ার যে আনন্দ তা সন্দীপন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছিল আজ । বুঝতেই পারে নি কখন যে যাওয়ার সময় এসে উপস্থিত হলো , কখন চোখের পলকে ভোপালে এসে উপস্থিত হলো সে । আজ ১৮-র রাতটা সন্দীপনের একদম ভালো লাগছে না । ঠিক সেই মুহূর্তে মায়ের ফোন কলে কিছুটা সামলে নিলো সে নিজেকে । বেজে ওঠা ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো মায়ের কণ্ঠস্বর ,
---- ওরা এসেছিলো বাড়ি দেখতে । কুড়ি দিতে চায় । বাবু , বলছিলাম কি , বাড়িটা বিক্রি না করে কোন উপায় হয় না ।
সন্দীপন বেশ নিচু গলায় বললো ,
----- উপায় থাকলে কি বলতাম মা । তাও চেষ্টা করে দেখছি , যদি কিছু হয় ফোন করে দেবো ।
এটুকু বলেই মোবাইলটা কেটে দিলো সে । মন আজ প্রচন্ড ভারাক্রান্ত । ইতিমধ্যে কোম্পানি দু দুটো মেল পাঠিয়েছে যার কথা সন্দীপন বেমালুম চেপে গেছে সবার কাছে । আজ সে একা । তাই একটা শেষ চেষ্টার আশায় ল্যাপটপটা খুলে বসলো একবার । মেল আইডিটা খুলে লিখতে শুরু করলো একটা চিঠি সি এম ডি কে সে ,
---- Respected sir ,
This letter written to you is just a formal request to look after the matter regarding a demand of bond of about 10 lakhs which is taken from your company due to my resignation. I served your company for the post of administrative officer from may 2015 . I worked there for a long tenure of 19 months in the Burdwan branch at West Bengal under KOLKATA RO , but couldn't got myself confirmed as I couldn't pass the licenciate exam .
After the death of my father in October 2016 it became impossible for me to serve the both end I.e home and company . Finally , I had to resign from the company on 13 Jan 2017 for very personal and domestic reason . The company demands my total gross salary of the entire period as the bond amount . I repeatedly send mails to my branch officials, DIVISION , KRO OFFICIAL, DGM sir and even HO requesting them to lessen the amount because of my financial downfall but everytime my request met with a rejection.
Sir , it is impossible for me to explain the pain of a just widow woman , who had nothing left except a house and a few pension . Her condition is also not good and being the only son I had to look after her .
On the other hand , the official were putting pressure for the collection of this huge amount and there were even mails indicating of taking legal action. With no way out , I am forced finally sold out the house , the lonely belonging of my just widow mother and submitted the bond .
Sir , it is my request to you to reconsider the entire situation once again . I fully believe in you and so I am writing this letter . I served the company full heartedly and in lieu receive my salary . There were fooding and lodging expenses that might had spent from the amount . But after resignation the company took the entire gross salary that make my income zero . I believe the company is not so worst that it can't even provide food and basic amenities to its employers .
But on the other hand , taking entire gross salary is equivalent to zero salary paid . I would request you to consider it once again and do something not for the sake of me but a just widow woman .
Sir , humanity is the greatest thing in the earth and you had proved it repeatedly from time to time . Please consider and reply me soon that can an employee's salary be made zero only in the name of a bond ?
Thanking you
Sandipan
প্রতিদিন উত্তর পাওয়ার আশায় সন্দীপন মেল বক্স চেক করতো একবার । আশা ছিল কিছু একটা সুরাহা হবে । কিন্তু সবটাই ব্যর্থ করে কোম্পানি দশ লক্ষে অটুট থেকে গেল আর তারপর একদিন বাবার স্মৃতিটা বিক্রি করতে হলো তাকে । জীবন পথে তার মায়ের নতুন ঠিকানা হলো তার মামার বাড়ি , হাওড়া আর সন্দীপনের , হ্রদ নগরী । কিছুটা কষ্ট হলেও একটা বড় বোঝ হালকা হলো সন্দীপনের কাঁধ থেকে ।
৮।।
সেদিন আগস্টের শেষ দিন । জন্মদিনের আগে আগে এমন একটা ঝটকা সন্দীপনের কাছে খুবই কষ্টকর ছিল । ফেসবুকের পাতা খুলেও তাই শান্তি নেই একটুও । কবিতাও আসছে না ভালো করে । এরই মাঝে একটা শীতল ঝোড়ো হাওয়া বয়ে এলো কোথা থেকে যেন । ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেজ বাক্সে সেই অচেনা সুন্দরী ডাক দিয়েছে তাকে , লিখেছে ;
---- আপনি ভারি সুন্দর কবিতা লেখেন তো ?
----- চেষ্টা করি মাত্র । তা আপনি কি করেন ?
মনে মনেই একটু হেসে উত্তর দেয় সন্দীপন ।
---- আমি । এখনও কিছু করি না । চাকরির চেষ্টা করছি ।
উত্তর দেয় মেয়েটি ।
---- কি রকম চাকরি খুঁজছেন ? মানে কোন পরীক্ষা দিয়েছেন এর মধ্যে ।
সন্দীপন জানতে চায় ।
--- ব্যাংকের কিছু পরীক্ষা দিয়েছি । সামনে স্টাফ সিলেকশনেরও পরীক্ষা আছে ।
উত্তর ভেসে আসে স্ক্রিনের ওপাশ থেকে ।
--- দেখুন । ব্যাঙ্ক আর এস এস সি - এক নয় । যেটা করবেন একটা করুন ।
লিখে পাঠায় সন্দীপন । কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি অফলাইন হয়ে যাওয়ায় কথা এখানেই স্থগিত করে দিতে হয় ।
এরপর আর কি ! খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুম । পরের দিন সন্দীপন অফিস পৌঁছায় সময়ের বেশ আগেই । তার মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে আর স্বভাবতই এ বিষয়ে সকলেই আজ বেশ অবাক ।
সন্দীপনকে দেখে নিশা এগিয়ে এলো কাছে । হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলো ,
---- আজ তো বহত খুস লগ রহে হো তুম । বাত কেয়া হ্যায় ।
নিশার কথা শুনে সন্দীপনের মুখে একগাল হাসি ফুটে উঠল এবার । ঝকঝকে পরিস্কার কথায় উত্তর দিলো সে ,
----- পূজা আ রহা হয় । খুশ তো রহনা পরেগা ।
---- হা ইহে ভি সহি হয় ।
নিশা উত্তর দিলো ।
এরই মধ্যে বাকিরাও এসে উপস্থিত । সকলে ক্যান্টিনের দিকে প্রস্থান করলো এবার ।
সেদিন সন্ধ্যায় ফেসবুক খুলতেই সন্দীপনের চোখে পড়লো একটা ছবি । ছবিটি সত্যের আর ওপরে ঝুলছে একটা ক্যাপশন ---
একজন ডাকহরকরার খোঁজে কত দিন রয়েছি যে আমার মনের খবর বয়ে নিয়ে আসবে একদিন ।
মনে মনে একটু হেসে কমেন্টে লিখে ফেললো সে ---
ডাকহরকরা তো কত বার এসে ফিরে গেছে খালিহাতে । চিনে নিতে হয় তাকে নাহলে চেনাবে কি করে সে নিজেকে ।
ফল কি হবে জানা নেই তার , তবে বন্ধুত্বের শক্তিশেলে অপর পক্ষ যে আহত তা বলতে বাকি থাকে না আর ।
৯।।
চারদিকে কাশ ফুল ফুটে আছে আর মাঝখান দিয়ে বাইক নিয়ে ছুটে চলেছে সন্দীপন ও তার বন্ধু শুভ । নবমীর এই রাতটি কোনদিন ভুলতে পারে নি সন্দীপন । জীবনে শেষ বারের মত মদ খেয়েছিল তারা আর তারপর মনে জমে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে এসেছিল বুক ফেটে । নিউটাউনে কাটানো সেই রাত্রে ওরা তিনজন , মানে ,শুভ , নব আর সন্দীপন ছাড়াও সেই কষ্টের ভাগ নিয়েছিল কিছু গেলাস ও রঙিন জলের বোতল । নবমীর শেষে বিজয়ার সকালে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এলো শুভ । ওর আবার অফিস আছে । প্রাইভেটের পৃথিবীতে ছুটি বড়ই কম । সন্দীপন অবশ্য ফিরেছিল ঘন্টা খানেক পরে । ব্রেকফাস্ট সেরে উবের শেয়ার বুক করে নিয়েছিল সে । সন্দীপনের মন আর কলম সেদিন উবেরে বসে বসেই লিখে ফেলেছিল কয়েকটা লাইন ---
" আগামী বছর আমাদের হবে ,
রাতগুলো আমাদের নিয়ে জাগবে
সন্দীপনের সন্দীপন এসেছে ,
সত্যবতীও ঠিক দেখা দেবে সেই ফাঁকে ।"
আজ কোজাগরী লক্ষী পুজো । সবাই যখন দেবী আরাধনায় ব্যস্ত , সন্দীপন তখন ফেসবুকের পাতায় তাকিয়ে । হঠাৎ একটি শব্দে হোস ফিরল তার । মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ এসেছে আর মেসেজ করেছে সত্যবতী ,
---- হায় ।
সেও দেরি না করে উত্তর দিল,
--- হ্যালো । পুজো কেমন কাটলো ।
---- ধুর । বৃষ্টিতে কেমন কাটবে ।
বেশ বিরক্তি নিয়েই উত্তর দিলো সত্য ।
---- বৃষ্টি ভালো লাগে না বুঝি ।
সন্দীপন লিখে পাঠালে , ওপাশ থেকে এক গুচ্ছ হাসির ইমোজি ভেসে এলো স্ক্রিনে । তারপর উত্তর এলো ,
----- ভালোই লাগে । তবে পুজোর দিনে বৃষ্টি কি ভালো লাগে !
সন্দীপন কিছু স্যাড ইমোজি পাঠালো এবার । তারপর লিখলো ,
---- বাড়ি কোথায় ?
সত্য মিনিট কয়েক থেমে লিখে পাঠালো ,
----- চন্দননগর ।
---- ওয়াও । ডাকতে পারতে তো । চলে আসতাম কোম্পানি দিতে ।
লিখে জানায় সন্দীপন ।
সত্যবতী তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে অফলাইন হয়ে যায় ,
----- মাম ডাকছে । এখন আসি ।
এরপর আর সত্যবতীর সাথে কোন কথা হয় নি সন্দীপনের । সুতরাং , এই টুকু তথ্য নিয়েই সন্দীপনকে পরের দিন ফিরে যেতে হবে তার কাজে । এর মানে হল ছুটি শেষ আর তাই ভোপালের টিকিট এর সিটটাও কনফার্ম হওয়ার মেসেজ চলে এসেছে মোবাইলে । পরের দিন বিকেল ছটায় তার ট্রেন , শিপ্রা এক্সপ্রেস ।
১০।।
ভোপাল রওনা দিলেও সন্দীপন তার হৃদয়ের একটা টুকরো ফেলে গেছিল ফরাসি নগরে । সে সত্যবতীকে প্রচণ্ড ভালোবাসত আর প্রতি মুহূর্তে সেটা বোঝাবে কি করে তাই ভেবে চলেছিল । ট্রেনের কামরায় লোয়ার বার্থে বসে সন্দীপনের মাথায় যখন এসব ঘুরপাক খাচ্ছে তখন মোবাইলের শব্দে বেশ চমকে উঠলো সে । পকেট থেকে ফোনটা বার করতেই দেখে মা ফোন করছে । আস্তে করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ,
---- কি রে কতদূর পৌছালি ?
বেশ অন্য মনস্ক হয়েই সন্দীপন উত্তর দিলো ,
---- বিন্দাচল পেড়িয়ে গেছি ।
---- কিছু খেয়েছিস ?
মা প্রশ্ন করলে , সন্দীপন বেশ তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিলো ,
---- খেয়েছি । খেয়েছি । এখন ফোন রাখো তো । চার্জ শেষ হয়ে যাবে নাহলে ।
এই বলে সন্দীপন ফোন কেটে দিলো । আসলে সন্দীপনের মন আজ নিজের জায়গায় নেই একটুও । ভালোবাসার সাগরে হাবু ডুবু খাওয়া মানুষের বাস্তবের কোন ঠিকানা থাকে না । সন্দীপনেরও সেই এক দশা । মনের মধ্যে একটাই চিন্তা এখন । সত্যকে কিকরে সত্যটা বলবে সে । তার ফলই বা কি হতে পারে ?
অবশেষে সে ঠিক করলো ফেসবুকে প্রেম পত্র লিখবে , তবে সরাসরি নয় কবিতার আকারে । যেমন ভাবনা তেমন কাজ । ফেসবুক জুড়ে সৃষ্টি হতে লাগলো হৃদয়ের না বলা কথা নিয়ে প্রেমপত্র । দু এক দিনে সন্দীপনের ওয়াল ঢেকে ফেললো প্রেমপত্র সিরিজ কবিতার , যার প্রথমটির জন্ম হয় সেই ট্রেনের এস ২ কামড়ার ; ১৭ নম্বর সিটে ।
এমন কিছু মন আজও আছে এ পৃথিবীতে ,
সহজ , নম্র , সরলতায় ঠাসা
অসংখ্য কথা মনে পুষে রেখেও বলে যায়
না বলা অনেক কটা মনেরই ভাষা ।
আমি দেখেছি তাকে প্রতিদিন
এই পথের ধারে , কাঁচের ওই দেওয়ালের ওপারে
চিনেছি তাকে কাছে গিয়ে ; অপেক্ষায় বসে
এক সুন্দর প্রভাতের আলোর ।
চোখ দুটো তার : যেন অসীম স্বপ্ন বয়ে বেড়ায়
প্রতিদিন , প্রতিবার -- কাব্যিক ছন্দে গড়ে ওঠা
সে মনীষী আমার চোখে , অন্ধকারের পথে এক নতুন আলো :
যেন ডাকছে আমায় ।
সাহস হলনা ঠিক , যদি তাড়িয়ে দেয় ;
বিস্বাস টুকু বেশ নেমে গেছে মাটিতে --
তাই ফিরে এলাম নিজের ঠিকানায় উদাস ভাবে ।
তবে দেবী অপেক্ষা কর , একদিন ফিরে আসব ঠিক
বলব সমস্ত গল্প তোমায় ; কিভাবে একটু একটু করে
আবার প্রেমে পড়লাম তোমার ।
এটুকু লিখে সন্দীপন নেট বন্ধ করে দিলো ; উদ্দেশ্য কিছু খাবার জোগাড় ও তারপর একটু দুপুরের ঘুম ; যদিও ভোপালে থাকতে এ অভ্যেস তার মোটেও ছিল না । ভিতরে উদ্বিগ্ন মন , চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে যখন ; তখন বাইরে পৃথিবী পিছিয়ে যাচ্ছে সময়ের হাতে হাত রেখে । এখন অপেক্ষা কাটনির ।
১১।।
কাটনি ঢুকতে ঢুকতে দুপুর দুটো বেজে গেলো । ভোপাল এখনো ৫ ঘন্টার পথ । আপাতত এখানে ট্রেন থামবে প্রায় ৩০ মিনিট । সুতরাং , দুপুরের খাবারটা এখান থেকেই কিনে নিতে হবে বলে সন্দীপনের মনে হলো । খাবার কিনে ট্রেনে উঠে মা কে ফোন করে দিলো সে । আজ সকালের মেনু ডাল , ভাত , সবজি আর দুটো রুটি । এছাড়াও পথের জন্য কিছু ফল কিনে নিলো সন্দীপন । ভোপাল পৌঁছাতে প্রায় রাত আটটা বেজে গেলো ।
---- মা , আমি হোস্টেলে ঢুকে গেছি । কোন সমস্যা হয় নি , শুধু একটু খারাপ লাগছে তোমাদের ছেড়ে আসতে ।
হোস্টেলের রুমে ঢুকে মা কে ফোন করে জানায় সন্দীপন ।
ওপাশ থেকে হেসে মা জানায় ,
---- পাগল ছেলে কোথাকার । দরজা লাগিয়ে এবার শুয়ে পড় ।
সন্দীপন নীরব থেকে ফোনটা কেটে দেয় । কিন্তু নীরবতা যে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি কোনদিন তার জীবনে । ফোন কাটতে না কাটতেই তাই মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে আবার । এবার শুভ র পালা ।
---- কি স্যার পৌছেছেন ?
শুভ বেশ তাচ্ছিলের স্বরে ফোনের ওপাশ থেকে বললো ।
সন্দীপন সাথে সাথে একটা মুচকি হেসে উত্তর দিলো ,
----- এই জাস্ট । তা তোর খবর কি ?
শুভ এবার গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলো ,
----- আমার খবর কি ! শালা লজ্জা করে না তোর , বন্ধু হয়ে অন্যের পোষ্ট বাক্সে চিঠি দিতে লজ্জা করলো না ।
উত্তরটা শোনা মাত্রই হো হো হেসে উঠলো সন্দীপন । ঠিক এমন সময়ে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে একরকম বাধ্য হয়েই ফোনটা কেটে দিতে হলো তাকে । শব্দটা একবার নয় , বেশ কয়েকবার হয়ে থেমে গেল । তারপর আবার কয়েকবার বেজে উঠলো শব্দটা । সন্দীপন আর অপেক্ষা না করেই এগিয়ে গেলো দরজার দিকে । অন্ধকার এই রাত এগারোটার সময়ে দরজায় কড়া নাড়া দেওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল তার । তবু , রহস্য ভেদ তো হওয়া চাই ; আর তাই ,
------ কৌন হ্যায় ।
সন্দীপন চিৎকার করে বলে উঠলো এবার ।
কথায় আছে অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। সন্দীপনের জীবন যেন ঠিক সেই অভাগার মতোই আর তার ভাগ্য যেন একটি সাগর যা বারবার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে । প্রথমে বাবা , তারপর বাড়ি , এখানে এসে থেকে আস্তানা নিয়ে বিপত্তি লেগেই আছে তার ।
সন্দীপনের চিৎকার শুনে দরজার বাইরে থেকে ভেসে এলো একটি পাতলা কন্ঠস্বর , মনে হলো কোন মহিলার ,
---- দরওয়াজা খোলনা একবার ।
সন্দীপন সাহস করে দরজা খুলে দিলো এবার । বাইরে এক ৫০-৫৫ বছরের মহিলা ও সাথে এক পুরুষ দাঁড়িয়ে । পুরুষটিকে সে চেনে । ইনিই এই হোস্টেলের মালিক , বেশ স্বাস্থ্যবান , বয়স ওই ৭০ এর কাছাকাছি হবে । নাম দিননারায়ণ চৌবে ।
চৌবে জি কে দেখে সন্দীপন এক গাল হাসি নিয়ে বললো ,
---- আরে চৌবে জি , আন্দার আইয়ে না ।
চৌবে নিজের চির পরিচিত গম্ভীর মুখ নিয়েই উত্তর দিলো ,
---- নেহি ডট বাবু । ইতনে রাত কো আন্দার নেহি আয়েঙ্গে হম । বস ইতনা কহনা থা , সাহাব কা আদেশ হ্যায় , এক দিন কে আন্দার আপকো কমরা খালি করনা হোগা । তো কল আপ কহি ঔর কমরা তলাস লিজিয়ে ।
সন্দীপন খবরটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো ।
---- এক দিন মে .... কহা সে ...
সন্দীপন বারবার অনুরোধ করে বলে চললেও চৌবে জি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলো কোন অনুরোধ না শুনেই ।
১২।।
"সূর্যের কিরণে পুষ্ঠ এ পৃথিবী ,
কত দূরে ! তবু তার উর্যার প্রখর তেজ , পৃথিবী কে চলার শক্তি দেয় ।
অন্যদিকে , অভাগা পৃথিবীর আর, কি আছে তাকে দেবার ! এমনকি , কাছে টেনে নিয়ে জ্বলন্ত বুকের আগুনটুকু ভাগ করে নেওয়ার অধিকারও নেই । তাকে নিজের ভাবার ধৃষ্টতা চিরদিন শুধুই এক দিবাস্বপ্ন এই পৃথিবীর ।
দূর থেকেই দেখে গেলো সে চিরকাল " ।
পরেরদিন সকালের আলো সন্দীপনের জীবনে নিয়ে এলো নতুন এক সংগ্রামী ব্রত । ঠিক করলো আর কোন হোটেল বা হোস্টেল নয় , একটা ওয়ান বি এইচ কে হলেও ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে । কিন্তু অদৃষ্টের পরিকল্পনায় অন্য কিছু অপেক্ষা করছিল যা আগে ভাগে জানা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয় , সন্দীপনেরও হয় নি । আজ এজি অফিসের চৌকাঠ পেড়িয়ে সন্দীপন প্রতিদিনের মতোই সই করতে সেকশনে উপস্থিত হয় । তাকে দেখে মুলানি স্যার এই প্রথম হাঁক দিয়ে বলে ,
---- মুবারক হো । তুমহে উজ্জয়িন মিলা হ্যায় । উহা ভূ জল কা ডিভিশন মিলা হ্যায় তুমহে । আজ রাত কে গাড়ি মে রিসার্ভেশন কর লো । কল সুবাহ তক পহচ যাওগে ।
সন্দীপন এক মুখ হাসি নিয়ে উত্তর দিলো ,
----- জ্বি স্যার !
পাশ থেকে গুপ্তা জি বলে উঠলো ,
----- চিন্তা মত করনা । উহা আলী হ্যায় , সিনিয়ার তুমহারা । রহনা , খানা কোই প্রবলেম হো সাম্ভাল লেঙ্গে । বড়ে আচ্ছে আদমি হ্যায় । উস্কা ফোন নম্বর রখ লো । কল কর লেনা ।
একটা চৌকো কাগজে দশ সংখ্যার একটা মোবাইল নম্বর লিখে গুপ্তা জি বাড়িয়ে দিল সন্দীপনের দিকে । সন্দীপন নম্বরটা বুক পকেটে সামলে রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল , কিন্তু গুপ্তা জি পিছন থেকে আবার ডাক দিলে থমকে দাঁড়ায় আর তারপর ঘুরে তাকিয়ে বলে ওঠে ,
---- জ্বি স্যার !
---- তুমহারা পুলিশ রিপোর্ট আ গয়া হ্যায় ।
গুপ্তা জি উত্তর দেয় ।
সন্দীপন জোরে দুবার দম ফেলে সেকশন ত্যাগ করে লিফটের দিকে এগিয়ে যায় ।
ক্যান্টিনে আজ প্রচন্ড ভিড় । বসার জায়গা ফাঁকা নেই আর তাই সবাই তার পাশের রুমে বসে আছে । সন্দীপনকে দেখতে পেয়ে আরিফ হাত নেড়ে ভেতরে আসবার ইশারা করলো । সন্দীপন-ও আস্তে আস্তে এসে ঢুকলো রুমের ভেতর । আর কিছুক্ষন পর এজি থেকে রিলিসিং অর্ডার দেওয়া হবে আর তাই সকলের মুখেই অপেক্ষার ছাপ । ওই ঘরে উপস্থিত সকলেই নিজের নিজের ডিভিশন জেনে নিয়েছে আর আজ সেই নিয়েই আলোচনা তুঙ্গে ।
---- অজিত ভাই কহা মিলা ?
সন্দীপন বেশ হাসি মুখে প্রশ্ন করলো ।
---- জব্বলপুর । ঔর তুমহে ?
উত্তর দিয়েই সন্দীপনের দিকে ফিরতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সে ।
---- মেরা তো উজ্জয়িন ...
সন্দীপন হাসি মুখে উত্তর দিলো ।
তার উত্তর শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে রাকেশ নামে একজন টেবিলে জোরে থাপ্পড় মেরে বলে উঠলো ,
----- মিল গয়া উজ্জয়িন ? আরে ওয়াহ । কোই লিঙ্ক থা তুমহারা ।
বলে রাখি এই রাকেশের পুরো নাম , রাকেশ শর্মা । বাড়ি বিহার । বয়স ২৫ কি ২৬ হবে । তার কথা শুনে সন্দীপনের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল । মনে হল দু থাপ্পড় কষিয়ে দিই । কিন্তু পরক্ষণেই নিজের রাগ সংবরন করে , হাসি মুখে উত্তর দিলো ,
---- থে না । মহাকাল সে লিঙ্ক । উহ কেয়া হ্যায় না , হম বাঙালি লোগ ছোটে জগহ হাত নেহি মারতে , সিধে ভগবান সে লিঙ্ক বনাতে হ্যায় । ইহা ভি বানায়া ঔর মিল গয়া উজ্জয়িন ।
উত্তর দেওয়া মাত্রই সন্দীপন নিজের জায়গা ছেড়ে বেড়িয়ে গেল । সবাই হাঁ করে তখনও তাকিয়ে ।
১৩।।
রাতের ট্রেনের গতি আর বয়ে আসা হাওয়ায় আজ এক অন্য আনন্দ । ট্রেনটা প্রধানত ফাঁকাই যায় আর তাই রিসার্ভেশন করতে হয় নি তাকে । সন্ধ্যের অন্ধকার পথে আকাশটা কেমন একটা নতুন বলে মনে হচ্ছে তার । ধীরে ধীরে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফেসবুক খুলে বসলো সন্দীপন । সত্যবতীকে অনলাইন দেখতে পেয়ে ছোট্ট করে একটা ম্যাসেজ লিখে পাঠালো সে ,
---- আকাশের চাঁদ আজ পৃথিবীতে হঠাৎ ।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেও সত্যবতীর দিক থেকে কোন উত্তর এলো না আজ । তাই সে ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ফেসবুকে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । নানা পোস্ট ভিড় করেছে এসে । হাজার নোটিফিকেশনের স্তুপ জমে আছে । এক এক করে সবই খুলে দেখতে লাগলো সে , তবে কোনটাই সেরকম কাজের নয় তার । এরই মাঝে চোখ এসে থামলো তার আগের দিনে লেখা কবিতাটিতে । সত্যবতী লাভ রিয়াক্ট করে কমেন্ট করেছে সেখানে । একটি নয় , দু দুখানা কমেন্ট ।
প্রথমটিতে লিখেছে ,
---- ভারি সুন্দর লেখো তো তুমি । কলম থেকে বান মেরে দিতে পারো সোজা হৃদয়ে ।
কোন উত্তর না পেয়ে দু দিন পর আবার ওই ছবির তলায় কমেন্ট করেছে ,
------ ভারি দুষ্টু লোক তো তুমি । বান মেরে আর দেখতেও আসো না ।
চলন্ত ট্রেনের কামড়ায় বসে বসে সন্দীপন মনে মনেই হেসে উঠলো । তারপর পুনরায় সত্যবতীর ইনবক্সে টোকা দিয়ে লিখে পাঠায় ,
----- ব্যস্ত ছিলাম । আসলে বাংলা ছেড়ে , বাড়ি ছেড়ে ভিন রাজ্যে পড়ে থাকা ছেলেটির দায়িত্ব যে অনেক । কাজও তেমনি অনেক ।
বেশ কয়েক মিনিট নিস্তব্ধ অপেক্ষা । তারপর স্ক্রিনের ওপর ভেসে উঠলো কিছু কথা সৌজন্যে সত্যবতী তার ,
----- তুমি কোথায় থাকো ?
সন্দীপন তৎক্ষনাৎ লিখে পাঠালো ,
----- থাকি তো হাওড়া । তবে কর্মস্থল মধ্যপ্রদেশ ।
সত্যবতীর দিক থেকে কয়েক মিনিটের নীরবতা আবার ,
------ বাংলায় ফিরবে না আর কোনদিন ।
সন্দীপন উত্তর দিলো ,
------ না । আমি বাংলাকে ঘেন্যা করি । কোনদিন যেন ফিরতে না হয় ওখানে ।
উত্তর গেলো ঠিকই , সত্যও সেটি পড়লো কিন্তু তারপর .... পূর্ণ বিরাম । আর কোন কথা ফিরে এলো না স্ক্রিনে । সন্দীপনের মনে হলো , না চাইতেও তার কথায় আঘাত পেয়েছে মেয়েটি । তাই ট্রেনে বসে বসে আর একটি প্রেম পত্র লিখে , পোস্ট করলো সে । উৎসর্গ বর্ণনায় উল্লেখ করা না থাকলেও বিধাতা কিন্তু আজ সব জানে ; এ লেখার গুরুত্ব ।
" বয়ে যাওয়া একটা ঝড়ের মত
আমার চোখে ধরা দিয়েছ তুমি ,
শূন্যতার এক অদ্ভুত খেলায়
মেঘ হয়েই বর্ষে গেছ ভালবাসার চিঠিখানি ।
তোমায় সামনাসামনি দেখি নি কোনদিন
হয়ত সুযোগ হয় নি দেখা করবার --
তবু একটিবার তোমায় সামনাসামনি দেখতে চাই
জানতে চাই এক অচেনা পাখি হয়েও
কেন এত বিস্বাস করতে শুরু করেছি তোমায় ।
কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলতে চাই
ভালবাসি তোমায় , ভালবাসবে তুমি কি আমায় ?
তোমার ছবিটা প্রথম দেখি এই পাতাতেই
ফুটে উঠেছিল আমার এই ঝাপসা চোখের সামনে ,
মনে হয়েছিল আবার একবার তোমার জন্য তো
বাঁচাই যায় ।
তারপর বহু বার পত্রের আদান প্রদান ঘটে গেছে
তুমি আমায় চিনেছ খানিকটা আর অল্প আমি তোমায়
ভাষার মধ্যে দিয়েই প্রথম দৃষ্টি পড়েছিল
তোমার চাউনির দিকে , যেন রাম সিতার প্রাক স্বয়ম্বর মিলন ।
নানা হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি আর কবিতার প্রতি
তোমার ভালবাসা আমাকে আরও কাছে ঠেলে দিয়েছে ।
ডাক হরকরার মত ফেরি করে ফিরেছি এত দিন
নানা সুখ দুঃখ প্রেম যন্ত্রণার কাহিনী ,
তবু অপেক্ষা রয়ে গেছে আজও যখন বসে আছি
এই ভিনদেশে , তোমার থেকে অনেক দূরে ;
অপেক্ষা যেন বন্দিনী সিতার তার ভালবাসার থেকে
একটা চিঠির অপেক্ষা : একটা বার্তার অপেক্ষা ।
ভেবে দেখতে পার , হতে পারে তোমার মনের অনেক গভীরে
আগ্নেগিরির হৃদয় থেকে ম্যাগমা একই ভাবে বেরিয়ে আসতে চায় :
প্রচুর ধাক্কা খেয়ে আমারই মত সাহস হারিয়ে ফেলেছে " ।
ভিতরের এই চাপা সংগ্রামের মাঝে বাইরের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে উঠছে আরও । রাত নেমে আসছে প্রকৃতির কোলে । তবু সময় ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে ; থামছে আবার ছুটছে , উজ্জয়িন এর পথে ।
১৪।।
বম ভোলে । মহাকাল নগরী উজ্জয়িন এসে দাঁড়াল ট্রেনটা । এখানেই ওর শেষ স্টপ । ধীরে ধীরে কাঁধে তিনটে ভারি ঝোলা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা রাখলো সন্দীপন । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তখন ভোর সাড়ে চারটে বাজে । হালকা আলো অন্ধকারে ঢাকা নীল আকাশ আর মাঝে মাঝে লাল আলোর তরঙ্গ । কাঁধ থেকে ঝোলা গুলো নামিয়ে রাখল সে প্ল্যাটফর্মের মেঝে । তারপর দুদণ্ড জিরিয়ে নিতে বসে পড়লো একটা ফাঁকা বেঞ্চে । যথেষ্ট মানুষের ভিড় প্ল্যাটফর্মে তখন , তবে সকলেই তন্দ্রার কবলে । বসে বসে কোন কাজ না পেয়ে ফেসবুকটাই খুলে বসলো শেষ মেস । নোটিফিকেশনের ভিড়ে তখন তার অনুসন্ধানের একটাই নাম । লক্ষ করলো দ্বিতীয় কবিতায় এখনো তার ছোঁয়া লাগে নি । ততক্ষনে ভোরের আলো বেশ অনেকটাই ফুটে গেছে আর তাই ফেসবুক থেকে বেড়িয়ে আসতে উদ্যত হলো সে । যতই হোক , দায়িত্বের বোঝা তার অনেক । কুলি মজুরের জীবন তাকেও বাঁচতে হয় , তবে সবটাই ছদ্ম ।
বেড়িয়ে আসার আগে উজ্জয়িন এ অবস্থানের খবরটি লিখে নীচে লিখে এলো ,
" সকালের সূর্যটা কেমন নতুন মনে হল ,
যেন পূর্ণ প্রাণ ভরে দিয়ে কেউ ছেড়ে দিয়েছে ।।
আকাশ লাল করে বয়ে চলেছে
তার তরুণ রক্ত ।।
বাতাসে এক খুশির আনন্দ ,
এক অদ্ভুত নেশায় যেন আসক্ত পৃথিবী ,
বাঁচবার নেশা , বাঁচাবার নেশা ,
নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলার নেশা ।।
পুরোনো জীর্ণ পাতা উড়ে গেছে
দখিনা বাতাস বইছে প্রকৃতির প্রতি অক্ষরে ,
সে মহা আনন্দের উৎসবে আমায় যেন
কে টেনে নিয়ে চলেছে , উল্লাসের এই জোয়ারে ।।
পরিচয় হীন , নাম গোত্র জানি না কিছুই ,
তবু তার ধ্বনি আমি শুনতে পাই ,
ঐ পুব আকাশের ওপারে যে পথ রয়েছে ,
ওখানেই , হ্যা গো ওখানেই
আমি রোজ তাকে দেখতে পাই ।।
সে অচেনা , অজানা মুখ আমায় ডাকে রোজ
কত কথা কয় ,
তবে একবার তার মনের পুরো ঠিকানাটা
মন আমার লিখে রাখতে চায় ।।
জানা নেই , কেন এতো দিন পরে
নতুন মনে হলো সব কিছু ,
একি কোন মায়া , নাকি তার ছায়া
যা নতুন করে গড়ছে আমায় " ।।
কাঁধের ভার ঝুলিয়ে একপা একপা করে বাইরে বেড়িয়ে এলো সে । তখনও শহরটি সে ভাবে জেগে ওঠেনি , তবে কিছু কিছু অটো এসে ভিড় করেছে স্টেশনের সামনে । তাদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বললো ,
----- কোই হোটল চলোগে ?
যদিও উজ্জয়িনের রেলস্টেশনে বসেই সে মনস্থির করে ফেলেছিল যে পূর্বত্রুটি সে অনুসরণ করবে না আর । চাকরির প্রথম দিন থাকার একটা পাকা পোক্ত ব্যবস্থা করে নেবেই । ভোপাল তাকে যথেষ্ট শিখিয়েছে । আজ তার ব্যবহার করবে সে ।
------ মন্দির কে পাস লে চলু
অটো ওয়ালা প্রশ্ন করলো সন্দীপনকে ।
সন্দীপন দুচোখ পাকিয়ে উত্তর দিলো ,
----- নজদিক মে কহি সস্তা নহি হোগা ।
----- মিলেগা না সাহাব । আপন একদম নজদিক মে সস্তা হোটেল লে চলতে হ্যায় আপকো । পর দো-শ লাগেগা , ভাড়া ।
সন্দীপন এই দীর্ঘ পথ যাত্রা করে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে , তাই ওই ভাড়াতেই রাজি হয়ে গেল ।
----- ঠিক হ্যায় , চলো ।
এই বলে সে অটোর ভেতরে উঠে বসে পড়লো ।
১৫ ।।
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে দশ । হোটেলের রুমে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে সন্দীপন বেড়িয়ে পড়লো পি ডাব্লু ডি র দিকে । অফিসটা এমন কিছু দূর নয় তার হোটেল থেকে সেটা আলি স্যারকে ফোন করে আগে ভাগেই জেনে নিয়েছিল সে । হোটেলের কামড়ায় তালা মেরে সে বেড়িয়ে এলো হোটেল থেকে । অটোর অভাব নেই , তাতে চেপেই প্রস্থান করলো আলি স্যারের অফিসের দিকে ।
----- আন্দার আউ ।
হাসি মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো সে ।
ডিভিজানল একাউন্টেন্ট লুকমান আলি নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল । মাথা ঝুকিয়ে তিনি কিছু কাগজ পড়ে দেখছিলেন । আওয়াজ শুনে , মাথা না তুলেই মিষ্টি স্বরে উত্তর দিলেন ,
----- আন্দার আ কে ব্যয়ঠো । দো মিনিট ।
সন্দীপন আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লো । লুকমান আলি নিজের কাজ শেষ করে মুখ তুলে তাকালো তার দিকে । বেশ ফর্সা আর উচ্চতাও ৬ ফুটের কাছাকাছি হবে । এক মুখ হাসি নিয়ে বলে উঠলেন ,
---- বোলিয়ে । কেয়া সেবা কর সকতা হু ।
সন্দীপন নিজেকে সংযত করে উত্তর দিলো ,
----- স্যার । মেরা নাম সন্দীপন দত্ত হ্যায় । ডি.এ নিউ এপয়েনটেড ।
লুকমান এতক্ষণ তাকে সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও এবার মুখ তুলে দেখলো এবার । তারপর হাত বাড়িয়ে অভিবাদন জানিয়ে বললো ,
----- আচ্ছা তো আপ হ্যায় .... তুমহারা পোস্টিং তো উস ডিভিশন মে থে ন ।
সন্দীপন ঘাড় নেড়ে উত্তর দিলো ,
----- হাঁ স্যার ... লেকিন উহা কে বারে মে মাঝ কুছ নহি পতা । আপ অগর ....
তার কথা শেষ হতে না হতে লুকমান নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো ,
---- চলো ।
তারপর সন্দীপনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের প্রাইভেট কারে তারা উপস্থিত হলো ভূ জল ডিভিশনে । উপস্থিত সকলে নতুন একাউন্টেন্টকে যেভাবে স্বাগত জানালো তা সন্দীপন কোনদিন কল্পনাও করে নি । আলী স্যার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
------ স্যার । ইনকা নাম সন্দীপন ডট হ্যায় । ইহা পোস্টিং হুয়া হ্যায় । কাম সারে ম্যায় হি করুঙ্গা , এস ইউজুয়াল । ইহে বস শিখেঙ্গে ।
------- ইহা তো কাম হি নহি হ্যায় । শিখেঙ্গে কেয়া ।
পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধ এক্সিকিউটিভ হেসে উত্তর দিলো । পাশাপাশি ডিভিজানের অল ইন ওয়ান সোলাঙ্কি কে উদ্দেশ্য করে বললো ,
----- সোলাঙ্কি জি । আব আপ কো ইয়ে জিম্মেদারি ভি লেনা পরেগা ।
সোলাঙ্কি মুচকি হেসে যা উত্তর দিলো তার থেকে পরিষ্কার তিনি কিছু রাগ আজ উগড়ে দিতে সক্ষম ,
----- এস ইউজুয়াল স্যার । মাই রেস্পন্সিবিলিটি । আপন তো ইসি কাম কে লিয়ে বনে হ্যায় সাহাব । ইয়ে ভি লে লিয়া ।
অফিসের প্রথম দিন আজ । তাই সন্দীপনও বিদায় নিলো আলি স্যারের পিছু পিছু , উদ্দেশ্য , ঠিকানা অন্বেষণ ।
সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েও সন্দীপনের উদ্দেশ্য অপূর্ণই থেকে গেলো । অধিকাংশ ভাড়া ঘর যুতসই নয় আর যেগুলো পছন্দ হয়েছিল সে সব ব্যাচেলরকে ঘর দিতে রাজি নয় । উদাস অবস্থায় হোটেলে ফিরতে সন্দীপনের জীবনে রাত নেমে এলো । একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে সোজা নিজের রুমে ঢুকে পড়লো সন্দীপন ।
১৬।।
আজ রাতে সন্দীপনের মন ঘরে একটুও বসছে না । মায়ের সাথে একটু আগেই কথা হয়েছিল তার । কিন্তু সাগরের জলে যখন উত্থাল পাতাল লেগে থাকে তখন ভাসমান জাহাজের সময় হয় না নিজের লোকের সাথে মিশে যাওয়ার । অবশেষে হোটেলের কামড়ায় তালা মেরে বাইরে বেরিয়ে আসে যুবক । আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন , তারপর রিসেপশনে প্রশ্ন করে সে ,
----- মন্দির কিধর হ্যায় ?
লোকটি হাসি মুখে উত্তর দেয় ,
----- ডায়ে সিধে যাকে ফির ডায়ে জাইয়ে , মন্দির মিল জায়েগা ।
সন্দীপন দুপা সবে এগিয়েছে , পিছন থেকে হোটেলের লোকটি আবার ডেকে উঠলো তাকে ,
----- ইতনে রাত কো মন্দির ! আরতি দেখনা হ্যায় ?
সন্দীপন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ,
------ আভি আরতি !
----- আভি নহি । রাত ১০ বজে শুরু হোতা হ্যায় ।
উত্তর দিল ভদ্রলোকটি ।
সন্দীপন আর কোন উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে এলো এবার । শান্ত শহরের বুকচিরে এগিয়ে চলা শীতল হাওয়ার উপলব্ধি তার মনকে উৎফুল্ল করে তুলছে বারবার । এক অচেনা আনন্দে হারিয়ে যেতে মন চাইছে বারবার যখন , তখন নির্জন পৃথিবী ভেদ করে বেজে ওঠা শব্দে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে আবার । বোম ভোলের গর্জন সরিয়ে মোবাইলের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হয়েছে তার । চেয়ে দেখে রিম্পা ফোন করেছে এত জন্ম পরে হঠাৎ ।
----- বল রে শয়তান । হঠাৎ কি মনে করে !
সন্দীপন হাসতে হাসতে বলে উঠলো ।
------ তোর ছবিটা ফেসবুকে দেখে ফোনটা করলাম । কোথায় তুই ?
বেশ অবাক হয়েই উত্তর এলো রিম-এর দিক থেকে ।
----- বোম ভোলে । বোম বোম ভোলে ।
চিৎকার করে উঠলো সন্দীপন । তারপর শান্ত গলায় উত্তর দিলো সে ,
----- কেন রে । দুক্কু হচ্ছে । প্রেমিক হাতছাড়া হয়ে গেলো , এবার তোর কি হবে ।
রিম ও একরাশ ন্যাকামি মেরে সাথে সাথে উত্তর দিলো ,
----- আহা ! যেন তুই ছাড়া ছেলে নেই ইহ লোকে । মিস বিশ্বাসকে বিয়ে করার জন্য লাইন পড়ে আছে । বুঝেছিস ?
সন্দীপন তার উত্তর শুনে হা হা করে হাসতে লাগলো ।
রিম্পা রাগ করে ফোন কেটে দিলো তার ।
১৭।।
সংগ্রামের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা জীবন সুখী হয় না কোনদিন । জীবন ধারায় ভেসে চলতে হয় প্রতিটা দিন , প্রতিটা মুহুর্ত তাদের । সন্দীপন ভোপাল ছেড়েছিল যে ঘরের সন্ধান বুকে নিয়ে , উজ্জয়িনের বুকে তার সমাপ্তি তো হল ; তবে পেয়িং গেস্ট । গৃহহীন বিধবাটি , যাকে সে মা বলে ডাকে , ভেবেছিল নিজের সাথে নিয়ে আসবে , নিজের কাছে রেখে দেবে ; তা আর পূর্ণ হলো কই ?
মাকে তার বাপের বাড়িতে রেখে আসার কারন ছিল একটাই । ছোট বোন একলা থাকে , যদি এতে তার কিছু সুবিধা হয় ; কিন্তু সবটাই যে উল্টে গিয়ে পাল্টে যাচ্ছিল । পান থেকে চুন খসলেই নেমে আসতো অশান্তির ঝড় এই বিধবার জীবনে । সেদিন বৃষ্টি মুখর এমনই এক সন্ধ্যায় মায়ের গলাটা বেশ নাড়া দিয়ে গেছিল সন্দীপনকে ,
----- ফ্ল্যাট পেলি কোথাও বাবু ?
সন্দীপন কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিলো ,
----- আবার কিছু হয়েছে ?
---- না বাবু কিছু হয়নি তো , জিজ্ঞাস করছিলাম ।
মা ধীর স্বরে উত্তর দিলো ওপাশ থেকে ।
সন্দীপন কিছুই বুঝতে পারছে না । তার মন কেন জানা নেই বারবার বলছে যে কোন কিছু ঠিক নেই । ঠিক এমনই এক মুহূর্তে পিছন থেকে একটা চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পেল সে । গলাটা যে মাসির তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় নি তার । চিৎকার করে বলে চলেছে সেই কন্ঠস্বর ,
----- লাগা , লাগা । ছেলের কাছে ভালো করে লাগা । আমি কি বুঝি না কিছু এখানে কেন এসেছিস । নিজের ঘর বাড়ি স্বামী সব কিছু গিলে রাক্ষুসীর এখন বাপের বাড়ির ওপর নজর পড়েছে । গিলতে এসেছে এখানে ।
মায়ের কণ্ঠস্বরে বারবার সে শুনে চলেছে একই অনুরোধ ,
----- রুমি , চুপ কর । চুপ কর এবার । তুই যা ভাবছিস তা ঠিক নয় ।
সন্দীপন এসব কিছু শুনে চলেছে আর দুচোখের জলে ভেসে চলেছে এক অজানা পারের দিকে । এভাবেই আধ ঘন্টা পেড়িয়ে গেলে সে হ্যালো হ্যালো করে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে ফোনের এপাস থেকে , কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ফোন কেটে গেছে । এরপর বেশ কয়েকবার রিং ব্যাক করলেও মা আর ফোন তোলে না । হতাশ হয়ে ঘরের মাটিতেই চুপটি করে বসে পড়ে সে । ভারি উদাস মন ধুয়ে যাচ্ছে আজ ক্রমাগত দুই চোখের জলে আর অন্যদিকে ফেসবুকে লেখা হচ্ছে নতুন এক স্ট্যাটাস ----
" ফেলে আসার খোঁজে পেড়িয়ে যায় পথ , ঠিক ওই ঝর্ণার মতোই --- একদিন নদী হয়ে হারিয়ে যাবে সব । ফেলে এসেছি কত স্বপ্ন না পাওয়া শত শত , ফেলে এসেছি রূপের পাহাড় মেঘে ঢাকা সূর্যের মত । ফেলে এসেছি কত ছোঁয়া যা ভালোবাসা হতে পারতো আজ । ফেলে এসে বন্ধু পরিবার , শুধুই আপন করেছি পরোয়া কাজ ।
এখন ওদের দিকে দেখি আর হাসি লাগে ভারি । ওরাও একদিন দেখবে ফেলে আসা পথ আর হয়তো আমারই মতন হাসবে বারবার ।
সেদিন সব একই থাকবে , শুধু , আমি প্রকৃতি হবো আর ওরা আমার মতোই মৃত্যুলোভি ইনসান " ।
১৮।।
হতাশ আর নৈরাশ্য র সাথে সংসার পাতা এক অসম্ভভ কাজ হয়ে উঠছিল তার জন্য । একা ডিভিশনে ফাঁকা বসে বসে তার মনে পড়ছিল বন্ধু সমরেসের কথাগুলো আজ ভীষন রকম । সত্যি তো ! নিউ ইন্ডিয়ার চাকরি করে সে কি পেল , উল্টে সব হারিয়েছে । আজ মায়ের ওপর নেমে আসা এই অত্যাচার ব্যথিত করে সন্দীপনের মন , কিন্তু সে যে অসহায় । কি করে নিস্তার পাবে কিছুই জানা নেই তার । অফিসে বসেও মনে মনে ই এক করুনতার সুর বেজে চলেছে তার অন্তরে ,
" হে প্রভু , তোমার চরণে আজ প্রনাম
অনেক পাপে পূর্ণ পাপি এ মন আমার ,
অনুতপ্ত ভীষন আজ ।।
শুনেছি তোমার আলয় ভুলোকের কণায় কণায়
তাই তো এই ব্যথিত হৃদয় আজ
নতজানু , চোখের জলে গাইতে চায় তোমার জয়গান ।।
রক্ষা কর আমায় , দাও একটু শান্তির আশ্রয়
নিজের লক্ষ থেকে বিচ্ছুরিত যে মন
তাকে তোমার করুণায় দাও একটু অভয় ।।
হে প্রভু , তুমি তো সর্বজ্ঞানী ,
অজ্ঞান নয় কোন কিছুই পৃথিবীতে জানি
তোমার আদেশ ছাড়া যেখানে নড়ে না
একটি ধুলো কনা ,
সেখানে এত ভীত কেন আমি ?
কেন এত লোভ বেঁধেছে এই মনে ,
আমায় সদবুদ্ধি দাও , জয় দাও
মুক্তি দাও সমস্ত বদ হতে আজ ।।
তোমার শরনে আজ এসেছি ছুটে
একবার তো এই অভাগার দিকে ফিরে চাও ,
ভালবাসা দাও তার মনে
যাকে ভালবেসে আমি ভালবেসেছি জীবনে ,
যার জন্য কাঁদে পাগল মন বারবার
তাকে জয় দাও , প্রেম দাও , হে পয়গম্বর ।।
হে প্রভু , তোমার চরণে আজ কোটি কোটি প্রনাম " ।।
এই গভীর চিন্তার স্রোত এসে বাঁধা পেলো মোবাইলের রিংটোনে । বেশ কিছুক্ষণ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে না পারলেও , কিছুক্ষনের মধ্যেই চেতনা ফিরলো তার । মোবাইল বের করে দেখে মায়ের ফোন । ঈশ্বরের নাম নিয়ে পুনরায় সে কল দিলো ওই নম্বরে ।
কপাল যার অশান্ত , তার কি কোনদিন শান্তি নামতে পারে জীবনে । হাজার হাজার শুকনো ফুলে সে সুবাস থাকে না বলে , তাদের দিয়ে মালা হয় না গাঁথা । তবু তো আমরা চেষ্টা করে চলি ভালোর খোঁজে , পচাদের মধ্যেই ।
" জীবন , তোর ওপর কোন রাগ নেই আমার
শুধু অবাক হয়ে দেখছি এপার ওপার ,
তোর সরল কথায় অবাক হই আবার ,
সে যে অবাক হই বারবার ।
বাঁচার কথা মনে আসে না একবার
দুঃখ গুলো বয়ে যেতে পারি না যে আর ।।
হাসলে পরে থেমে আসে স্বাস্
মনে হয় এ যেন কোন কারাবাস ,
কোথাও কখনও হেসে দিলে একবার
মনে হয় জীবনে এ হাসি এক
গভীর দুঃখের বহির্প্রকাশ ।
আজ যখন ভেসে গেছে দুচোখ আমার ,
ফোঁটা ফোঁটা বর্ষেছে দু গাল বেয়ে ।
কাল কে জানে এরই জন্যে
খোলা চোখে রাত্রি থাকবে চেয়ে ।।
কে জানে কখন , কোথায় হারিয়ে যাবে
এক ফোঁটা লুকিয়ে রাখা জলে সেদিন
হয়তো আমায় আবার খুঁজে নেবে
অতীতের সেই দিন ।
জীবন , তোর ওপর কোন রাগ নেই আমার
শুধু অবাক হয়ে দেখছি এপার ওপার ,
শুধুই অবাক হয়ে দেখছি এপার ওপার " ।
১৯।।
এতবার চেষ্টার পরে মা ফোন তুললো তার । আবহাওয়া শুনে মনে হচ্ছে একদম নীরব । নীরবতাও কখনো কখনো ঝড়ের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে আসে ; আর তাই সন্দীপনের এত ভয় ,
----- হ্যালো । তুমি কোথায় আছো মা ?
মা মিষ্টি করে হেসে উত্তর দেয় ,
----- বাড়িতে । তোর মাসি স্নান করতে গেছে ....
মায়ের কথা ছেলের মন বুঝবে না , এও তবে পৃথিবীর এক আশ্চর্য । তার মেকি হাসির গন্ধ বিচলিত করছে সন্দীপনকে বারবার আর তাই সে একই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মায়ের দিকে আবার ,
---- তুমি কোথায় আছো মা এখন ?
মা ও বেশ বিরক্তি প্রকাশ করে উত্তর দিলো ,
---- উফ ! বললাম তো বাড়িতে ।
বেশ গম্ভীর হয়ে উত্তর গেলো এবার ,
----- মা ! বলবে কী । কি হয়েছে তোমার ? তুমি বাড়িতে নেই আমি বুঝতে পারছি ...
ছেলের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই মা এর গলার স্বর নেমে এলো হঠাৎ । বেশ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো ,
------ এ আমাকে কোথায় ফাঁসিয়ে দিলি বাবু । কোথায় রেখে গেলি আমায় ? সকালে উঠে জানলা গুলো খুলে দিয়েছিলাম শুধু , ব্যাস , শুরু হয়ে গেল । পাড়ার লোকেদের ধরে ধরে চিৎকার করে যা নয় তাই বলে চললো । আমি এই বাড়ি দখল করতে এসেছি । আমি ওর ক্ষতি করে দেবো । আমায় বাঁচা বাবু ।
সন্দীপন চুপচাপ সব শুনে চলেছিল । তার কাছে আজ কোন উত্তর নেই দেওয়ার মতো । তবু শান্ত স্বরে সে জিজ্ঞাসা করলো ,
----- কিছু খেয়েছো , মা ?
ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে এলো বেশ ঘৃণা ভরা স্বরে ,
------ ওই বাড়ির অন্ন জল গ্রহণ করতে আমার ঘেন্যা হয় ।
------ কিছু না খেলে শরীর খারাপ করবে । বাড়ি যাও , কিছু খেয়ে নাও ।
সন্দীপন বললো ।
মা এর দিক থেকে ভেসে এলো এবার বেশ রুঢ় কণ্ঠে একটা অপ্রত্যাশিত উত্তর ,
----- আমার খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না । পথে বসিয়ে দিয়েছো যখন , তখন এসব খেয়াল দেখানো বন্ধ করো ।
এই টুকু বলে মা ফোন কেটে দিলো । সন্দীপন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়ে গেল শুধু । মনের গভীরে বেজে উঠছিল আজ বারবার ,
" আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো
এ জীবন পুণ্য করো " ...
২০।।
কত রাত কাটিয়েছে বিনিদ্র দুটো চোখ তার । কোন কিছুতেই মন নেই । কাজের দফতরের মানুষেরাও এই নিয়ে অনেক কথা বলছে । পাওরে জি একদিন সোলাঙ্কি জি-র সাথে এই নিয়েই কথা বলছিল । সন্দীপন তখনও অফিস আসেনি ।
---- উওহ একাউন্টেন্ট সাহাব কা খবর কুছ পতা হ্যায় , সোলাঙ্কি জি । বরে উদাস রহতে হ্যায় ।
প্রমোদ পাওরে আগ্রহ সহকারে প্রশ্ন করলো ।
----- আপন কো নেহি পতা । নয়া জগহ হ্যায় , সায়েদ ইসলিয়ে ...
সোলাঙ্কি উত্তর দিলো ।
----- এক বার পতা করনা চাহিয়ে না ।
পাওরে বেশ ধীর স্বরে প্রশ্ন করলো তাকে ।
সোলাঙ্কি আড় চোখে তাকালো এবার , তারপর উত্তর দিলো ,
----- কেয়া জরুরত হ্যায় । আদত পর জাতা হ্যায় সবকো ।
এরই মাঝে অনিল এসে উপস্থিত । ঢুকতে ঢুকতেই সোলাঙ্কির সা এ সা মিলিয়ে উত্তর দিলো সে ,
---- সহি কহা । আদত হো জাতা হ্যায় ।
ঠিক এমনই সময় সন্দীপন এসে প্রবেশ করলো তার নিজস্ব কামড়ার আড়ালে । সকলকে দেখেও সে আজ কোন কথাই বললো না । এসি অন করে চুপ করে বসে রইল সে , সঙ্গি বানালো সেই ফেসবুকের ডিজিটাল চরিত্রদের । ফেসবুক জুড়ে আজ বেশ জবুথবু অবস্থা । একমাত্র ঈশ্বর ই জানেন এই নীরবতার কারন , হয়তো এও সন্দীপনের মনের প্রতিবিম্ব মাত্র । তবু কিছু শব্দ মনের বাঁধন ছিন্ন করে প্রতিধ্বনিত হয় মনের গভীরে । আমরা তাদেরই ভালোবাসা বলি ।
----- কি গো দেখা নেই , কথা নেই কেন এতদিন ?
ম্যাসেঞ্জারে ফুটে উঠলো একটা লেখা । মুখ তুলে , চোখ খুলে সে দেখে ম্যাসেজ করেছে সত্যবতী ।
----- ব্যস্ত ছিলাম ।
কি বলবে স্থির করতে না পেরে এই উত্তর দিলো সে ।
সত্যবতী সময় নষ্ট না করে সাথে সাথেই লিখে পাঠালো তাকে ,
----- বাবা ! ভীষণ ব্যস্ত মানুষ যে । তা একটুও সময় হয় নি তাও ।
সন্দীপন আজ কোন উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই । তাই বাধ্য হয়েই সে লিখে পাঠালো বিরক্তি দেখিয়ে এবার ,
----- ভালো লাগছে না । ভালো লাগছে না আমার । মামার বাড়িতে , মা আর মাসির মধ্যে প্রতিদিন ঝগড়া লেগেই আছে । আমার মূর্খতার জন্য মা অভিশাপ কুড়াচ্ছে প্রতিদিন ।
----- অভিশাপ !! কে অভিশাপ দিলো আবার ।
বেশ অবাক হয়েই সত্যবতী উত্তর দিলো ।
সন্দীপ বেশ রাগি মুখ নিয়ে কিছু লিখতে গিয়েও লিখলো না । ওদিকে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে সত্যবতী লিখে পাঠালো অফলাইন হওয়ার আগে শেষবার ,
----- যাও , বিশ্রাম নাও । সব ঠিক হয়ে যাবে । আর শোনো , সবসময় মনে রাখবে , শকুনের অভিশাপে কোনদিন গরু মরে না । তুমি যাও এবার । আমিও আশি । বাই ।
সত্যের কথাগুলো সন্দীপনকে কেমন যেন ছুঁয়ে গেল । একটা অন্য রকম শান্তি সে পেয়েছে খুঁজে আজ । একদম অন্য রকম ....
২১।।
উদাসীনতা আর মানসিক অস্থিরতাকে সঙ্গী করে কাটতে লাগলো সন্দীপনের জীবন । খুব যখন অসহায় মনে হয় নিজেকে তখন মহাকালের চরণে ঠাঁই নিতে চলে যায় । ভীষন শান্তি পায় জীবন চঞ্চল নদী বুকে । অসহায় যে মনে হয় না তা নয় , তবে পুরাতন স্মৃতিরা আজও আছে , তাদের সাথেই কেটে যায় সময় ।
সময়টা ২০১৫ সাল । নিউ ইন্ডিয়ার নাগরিক হওয়ার সময় প্রথম প্রেমের উপলব্ধি হয় তার । ঝাঁসির মঞ্জলি মনজিল ছিল তার । কত দেখা , কত কথা , এক নিমেষে ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে লিখে রাখা কিছু চিঠি আজ খুঁজে পেয়েছিল হঠাৎ করে । বিকেলের শান্ত আঁচলের ছাওয়ায় চলন্ত বর্ধমান থেকে আসানসোলের ট্রেনে বসে বসে সে লিখেছিল কিছু চিঠি । আজকে সে সব উড়িয়ে দিলো সে ফেস বুকে ; নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে ; নতুন সে সুন্দরীর ঠিকানায় ।
উজ্জয়িনের ছটা মাস এভাবেই কেটে গেল , এবার ট্রেনিংয়ের ডাক আসতেই ভোপাল ফেরত যাওয়ার পালা ।
" ১।।
Dear love ,
আজ এক বছর পর এই জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে তোকে একটা চিঠি লিখছি । ভাবতে পারিস , আজ হটাৎ কেন ! এত দিন পর তোকে মনে পরল ! উত্তরে আগেই জানিয়ে রাখি , মনে তোকে রোজ পরে , প্রতি মুহূর্তে তোর জন্য বুকটা হাহাকার করে । মানতেই পারি না যে তুই আজ আমার সঙ্গে নেই , আর তাই বারবার খুঁজি তোকে , অবশেষে ভুল ভাঙে ।
আজ জন্মাষ্টমী , কৃষ্ণের জন্মদিন । কৃষ্ণ মানেই ভালোবাসার প্রতীক আর তাই আজ এই চিঠিটা লিখতে বসলাম । প্রথমেই বলি ধন্যবাদ তোকে , আজ যে এত নির্ভেজাল অভিনয় করে বেঁচে আছি , এ তোর জন্যই । তুই সেদিন শিখিয়েছিলিস যে তোকে ছাড়াও বর্তমানে বেঁচে থাকা যায় , হাসা যায় । দ্বিতীয়টা তবে পারি নি । ওটা অভিনয় করে যাই সবার সামনে । আজ এক বছর হয়ে গেল তোর সাথে কথা হয়েছিল । আর এই একটি বছরে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে । জানিস , তোকে তো বলাই হয়নি , আর বলবো বা কি করে , আগের চাকরিটা ছেড়ে দেবো , একটা আরো ভালো চাকরি পেয়েছি । সেই ছাড়া নিয়ে বেশ চাপে রয়েছি । কারণটা আর নাই বা শুনলি ।।
এদিকে বাবার শরীর টাও বেশ খারাপের দিকে, দিন কে দিন । এখন বেশ কষ্ট পাচ্ছে । চলতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছে , বাড়িতে মা একলা আর এই বর্ধমান শহরে আমি ভীষণ একা , খুব চাপে থাকি । মাঝে মাঝে রাতে খাওয়া দাওয়া টাও ঠিক মতো করা হয় না । এখন বন্ধু বলতে এই ফেস বুক আর আমি , কথা হয় , বা বলতে পারিস কথা বলি এরই সাথে মাঝে মাঝে । খুব একটা অনলাইন থাকাও হয় না , আজকাল ।
একটা জিনিস বলবো , রাগ করিস না যেন । করলে আই এম সরি । মাঝে মধ্যে তোর একাউন্ট টা লুকিয়ে চেক করি । কি করবো বল , তোর জন্য খুব মন কেমন করে রে । ভালো লাগে না আর । মাঝে মাঝে কেঁদে মনটা হালকা করে নি । কেউ তো আর এসব শুনবে না , আর বললেও ঠাট্টা করবে আমাকে নিয়ে । ওরা রোজ প্রেম বদল করতে পারে , তবে আমি তো পারি না । তোকে ছাড়া ভাবতেই পারি না , কাউকে । আজ ও তুই আছিস জীবনে আমার ।
লেখাটা একটা বদ অভ্যেস হয়ে দাঁড়াচ্ছে । একটা নেশার মতো , তোর দুঃখ গুলো এরই মধ্যে পুষে রাখছি । আসলে তোর মতো পারফেক্ট কাউকে পাইনি আর পাবোও না । সবাই এখন ভেজাল মেশানো । শুধু লেন দেন এর সম্পর্ক । বাড়িতে প্রায় চাপ দেয় বিয়ে করার জন্য । না বলে দিয়েছি । কথা দিয়ে তোকে কথার খেলাপ করি কি করে ?
তোর খবর কি রে ? কেমন আছিস ? মা কেমন আছে ? আর বাবা ? চাকরির চেষ্টা করছিস না ছেড়ে দিয়েছিস । লেগে থাক , আমি চাই তুই অনেক বড় পোস্টে চাকরি কর । শেষ বার বলেছিলিস , তোর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে । জানি , বিশ্বাস করি যে ওটা মিথ্যে ছিল । তুই আমাকে এত সহজে ভুলে যাবি , এটা হতে পারে না । কারণ তুই তো ওদের মতো নোস । তোর চাহিদাও সিমিত । কিন্তু এই মিথ্যের কারণটা কি তা আজও বুঝলাম না রে ।
খুব ভালো মেয়ে তুই । দেখিস একটা সুন্দর বর পাবি , যে তোকে আমার থেকেও বেশি ভালো বাসবে , খুব ভালো বাসবে ।
আমি দু দিনের যোগী , ভালোবাসা কি তাই বুঝি না । তাই তো বড্ডো খেয়াল রেখে ফেলেছিলাম ।
আমার কষ্ট নিয়ে একদম ভাবিস না যেন ।দুদিনের জীবন , দেখিস ঠিক কাটিয়ে দেবো । নিজের খেয়াল রাখিস , আর বাবা মা র যত্ন নিস । চাকরি পেলে জানাস কিন্তু । অপেক্ষায় থাকলাম । আর নিজের বিয়েতে নিমন্ত্রণটা করতে ভুলিস না যেন ।
আজ চলি রে । রাত অনেক হলো , কাল আবার অফিস আছে ।
ইতি
তোর দুষ্টু প্রেমিক
২৫/০৮/২০১৬
২।।
Dear love ,
শুভ বিকাল । আজ শুক্রবার আর শুক্রবার মানেই সপ্তাহের শেষ । এখন দুদিন ছুটি । তাই এই মুহূর্তে ট্রেনে করে বাড়ি ফেরার পালা । ভাগ্য আর ভগবান মানি না যদিও , সে তো তুমি জানোই , তবু ভাগ্যের কি ফের দেখো , প্রতি শুক্রবার এই চম্বল এক্সপ্রেস ধরে বাড়ি ফিরতে হয় । এই ট্রেনটি আবার গোয়ালিয়র অবধি যায় , মানে তোমার বাড়ির খুব কাছে । মনে হচ্ছে , তুমি যেন আমার জীবনে এমনি জড়িয়ে গেছো , যে যত্ন সহকারে আজও বাড়ি পৌঁছানোর পথে , এক দিশারী হয়ে ফুটে উঠছো , বার বার । ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে ছুটে চলে যাই ওই গাড়িতেই তোমার ঠিকানায় । অফিস চুলোয় যাক ।
ট্রেনে খুব ভিড় নেই , আরামে বসে বসে যাচ্ছি । নাহলে কষ্ট করে যাওয়াটা আমার পোশায় না , একটু ভারী শরীর তো , তাই আর কি । তবে আমি বসে নেই চুপ করে , তোমার কথাই ভাবছিলাম ।
এই সন্ধ্যা সাতটা মানেই এক অদ্ভুত নস্টালজিক ফিলিংস । সেই দিন গুলোর মতো যদি আবার ফোনটা বেজে উঠতো , সেই আসাতেই বারবার ফোনটা দেখি । আমার তো আর অধিকার নেই তোমাকে ফোন করবো । তুমি কি ভাববে তাতে কে জানে ? আর তাছাড়া আমি তো জানিও না যে তুমি কখন কখন ফ্রি আছো । তাই অপেক্ষা টা তোমার দিকেই ছেড়ে দিলাম ।
আজ শরীরটাও বেশ খারাপ । কাল রাত থেকে পেটে হালকা একটা ব্যথা হচ্ছে । জানিনা , এ ব্যথা কিসের । তবে , আসা করছি কমে যাবে ।
সময়টাও খুব একটা ভালো চলছে না । এই কদিনের মধ্যে দু দুবার একসিডেন্ট হয়ে গেল । একবার তো বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছিলাম । হাতের কনুই টা বেশ কেটে গেছিলো । তবে এখন সুস্থ আছি ।
এদিকে বাড়িতে বাবাকে নিয়ে একটা চিন্তা রয়েই যাচ্ছে । সারা গায়ে আঘাত নিয়ে কি যে হবে কে জানে । এখন তো ঠিক করে বসে থাকতেও পারছে না , বয়স টাও তো কম হলো না । জানো, এখন মনে হয় , তোমার সেদিনের কথাটাই ফলে যাচ্ছে । আমি সত্যি বড় একা হয়ে যাচ্ছি ।ব্রাহ্মণের অভিশাপ , না ফলে যায় কোথায় বলো । এতেও খারাপ লাগে না , শুধু খারাপ লাগে যখন আমার বন্ধু তোমায় খারাপ বলে , ও বলে নাকি তুমি এরামি , এই পুরো গল্পটা নাকি তোমার লেখা , আর এটা আগে থেকে ঠিক করাই ছিল । আমি মানি না, বিশ্বাস করি না , ওর কথা । এই নিয়ে ওর সাথে বেশ কবার ঝগড়াও হয়ে গেছে আমার । কারণ অন্য কেউ হলেও হতো , তুমি অন্তত এরাম করতেই পার না । নিশ্চই কোনো দায় ছিল , তাই তুমি দূরে সরে গেছো । তবে , একবার আমাকে বলে দেখলেই পারতে ।
যাই হোক তোমার সে স্কুল এখনো আছে ,মানে পড়াতে যাও না ছেড়ে দিয়েছ ? ছেড়ে দিলে ভালোই করবে , সময়টা নিজের পড়ায় দিতে পারবে । মন দিয়ে , পড়া করে যাও । চাকরিটা কিন্তু চাই ।
আর কি বলবো বল ? বাবা আর মা এর খেয়াল রেখো , নিজের প্রতি খেয়াল রেখো । আর আমাকে নিয়ে যেন একদম ভেবো না । সামনে তোমার বিশাল ভবিষ্যৎ , সেই নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করো , আর আমি তো সবসময় রইলাম ই তোমার পাশে সব সময় ।
আসানসোল ঢুকছে ট্রেন , নামতে হবে । আজ তাই আসি কেমন , পরে আবার কথা হবে ।
ইতি
তোর দুষ্টু প্রেমিক
২৬/০৮/২০১৬
৩।।
Dear Love ,
রাত কেটে সকাল হতে চললো । সূর্যি মামা আকাশে উকি মারছে । সকাল সকাল ওঠার পুরোনো অভ্যেস টা এখনো পুরোপুরি যায় নি । কিন্তু ফারাক তো অবশ্যই দেখছি , এই একটি বছরে । এখন সকাল টা ভালো হোক এ আশীর্বাদ কেউ আর দেয় না । তুমি দিতে , সেটাই বারবার মনে পরে কষ্ট দেয় । ভাবি মাঝে মাঝে তোমায় একটা মেসেজ করি , গুড মর্নিং , আবার ভাবি তোমার কেমন লাগবে , কি ভাববে । এসব , আটঘাট বেঁধে আর পাঠাই না । আচ্ছা , তুমি তো পাঠাতে পারো , নাকি আমায় পুরোপুরি ভুলেই গেলে । আমার আসা আর বিশ্বাস টুকু এভাবে ভেঙে যেতে দিও না , আর জানি পারবেও না ।
আজ তো শনিবার । আমার অফিস ছুটি । বাড়িতে বসে আছি আজ চুপ করে । পড়ানোটাও আজ নেই , সব মিলিয়ে একটা ছুটির দিন , তবে আমার ছুটি নেই । নিজের কাজ করার জন্য এই একটা দিন ই তো পাই , সেটাও হাত ছাড়া করে দিলে চলবো কি করে ।
তোমার আজ কি পরিকল্পনা ? বন্ধুদের সাথে দেখা করে এনজয় নাকি রোজের জীবন । আসলে কি জানতো জীবনটা আমরা যা ভাবি , ঠিক তা নয় । এটা সত্যি খুব কষ্টের । কত যে সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় , তা বুঝি না ।
আজ বাড়ি এসে বুঝলাম , বাবার অবস্থা খুব খারাপ । ভাবছি , হসপিটালে ভর্তি করি একবার । মা একলা পেরে উঠছে না । আবার এটাও ঠিক , বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করলে সে দৌড় ঝাঁপ কে করবে ? মা অতো বোঝেও না , আর পারবেও না । তুমি সাথে থাকলে অনেক সুবিধা হতো , অনেক ভরসা পেতাম । যাই হোক , যা ভালো বুঝেছ , তাই করেছ ।
তোমার খবর কি বল ? মা কি এখনো হাসপাতালে ভর্তি ? তোমার চোখে যে ফেকো করালে , তার পর আর অন্য কোনো সমস্যা নেই তো ? একটা কথা সত্যি করে বলবে , তোমার কি সত্যি বিয়ে হয়ে গেছে ? না হলে , করে নাও আর হয়ে গেলে বলবো যে পার্টি কবে দিচ্ছো ? এই সুযোগে তোমার বরের সাথেও দেখা হয়ে যাবে ।
সামনে তো পুজো আসছে । ও , তোমাদের ওখানে তো বোধহয় নবরাত্রি হয় । উপোস করো নাকি , আমি তো ওসব কিছু মানি না । আমাদের এখানে অফিস সব ছুটি । দেখা করার মন হলে আওয়াজ দিও । চলে আসব । আর সেটা যে আমি করতে পারি , তা তুমি খুব ভালো বোঝো । মনে আছে স্টেট ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেখা করতে পালিয়ে গেছিলাম । এর জন্য অনেকে আমাকে বোকা বলে বাট আই ডোন্ট মাইন্ড ।
ঠিক আছে , অনেক কথা বলে ফেললাম । আবার পরে লিখবো , আজ চলি । ভালো থেকো , সবাইকে ভালো রেখো আর কি বলবো বলো ।
ইতি
তোর দুষ্টু প্রেমিক
২৭/০৮/২০১৬
৪।।
Dear love
সুপ্রভাত । আজ রবিবার । আর রবিবার মানে তো জানোই । সবচেয়ে প্রিয় দিন । তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথেই এই প্রিয় দিনটার গুরুত্ব টুকুও বেশ হ্রাস পাচ্ছে । আগে যখন ছোট ছিলাম এই রবিবার সকালে দশটা বাজলেই বেরিয়ে যেতাম , খেলতে আর ঠিক বারোটায় বাড়ি চলে আসতাম , কারণ শক্তিমান দেখবো । সেই দিন গুলোই বেশ ভালো ছিল । আজ কাল আর বন্ধুও নেই আর খেলাও নেই । সবাই আজ সেটল । কেবল আমি ছাড়া ।
বাড়ির কাজ করতে হয় সকাল থেকে । বাবা তো আর পারে না , তাই সকাল বেলায় বাজার করে দিতে হয় ,আর এর পর ও অনেক কাজ থাকে ,
সারা সপ্তাহের পড়ে থাকা কাজ । মা বুঝতেই পারছো ততটা বোঝে না , পারে না । সেগুলো আমাকেই করে দিতে হয় । এই দেখতে দেখতে সকাল পার । তারপর দুপুর থেকে স্টুডেন্ট আসে , তাদের দেখিয়ে দিতে দিতেই দিন পার ।আজ অবশ্য সব ছুটি । কেউ আসবে না । তাই বেশ আরাম । অবশ্য আমার ওই জীবনটাই ভালো লাগে , ব্যস্ত রাখা যায় নিজেকে ।
কাল সকাল হলেই আবার দৌড় । অফিস যেতে হবে যে । এ কোনো জীবন হলো , বলো । এই জীবন তো চাইনি । একলা একলা পচে মরছি , এটাও স্বপ্নেও ভাবতে পারি না । মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে সুযোগ পেলে খাতা পেন নিয়ে বসে যাই । লেখালেখির বদ অভ্যেস টা আছে না ! ওটুকুই তো বেঁচে থাকার স্বম্বল । নানা জিনিস কল্পনা করি আর লিখি । সবচেয়ে বেশি কল্পনায় ভেসে ওঠে , তোর মুখটা আর তাই বেশির ভাগ লেখার বিষয় বস্তুও আমাদের ভালোবাসা ।
একটা ইচ্ছে আছে , লেখাগুলো ছাপানোর । লোকে আমার লেখা পড়বে , আরও বেশি পাঠক বা পাঠিকা এর মজা নেবে , এটুকুই আশা । তবে সব স্বপ্ন কি আর সত্যি হয় ? প্রকাশক আর পাচ্ছি কই ? চেষ্টা করে যাচ্ছি , কিন্তু কেউ ছাপতে রাজি নয় ।
তোমার খবর কি ? আজকের কি স্পেশাল প্ল্যান ? কিছু ভেবেছো নাকি ? আমার মতো বোরিং জীবন নিশ্চই তোমার নয় ? আচ্ছা আমি তো ফ্রি আছি , যদি খুব বোর লাগে আমাকে কল করে নিয় , আর না হলে একটা মিস কল দিও , আমি কল করে নেব । অনেক দিন কথা হয় নি । এক ঢিলে দুই পাখি ধরা যাবে । এই , এতে আবার রাগ করলে না তো ?
আজ চলি । রাগ করো না , সত্যি বলছি আজ অনেক কাজ । তোমার দিব্বি , কাল আবার লিখবই লিখবো , যদিও জীবনে কাল কি হবে কে জানে ? ভালো থেকো ।
ইতি
তোর দুষ্টু প্রেমিক
২৮/০৮/২০১৬
৫।।
Dear love
প্রথমেই বলি , আই এম সরি । আজ একটু দেরি হয়ে গেল । কি করবো বল , সোমবার মানেই ট্রেন ধরার তারা থাকে । আজ বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল । তার পর বাইকে আসানসোল আসা । আজ আবার সব ট্রেন লেট । বেশ চাপে ছিলাম ,টাইমে অফিস ঢুকতে হবে যে । ভাগ্য ভালো , যে পাঞ্জাব মেল পেয়েছি । এখন এতেই চললাম ।
তুমি ভাবছো নিশ্চই , আমি আগের মতোই কোনো মিথ্যে কথা বলছি । কিন্তু বিশ্বাস করো , আমি একটুও মিথ্যে বলছি না , পুরো ষোলো আনা সত্যি কথা । আর মিথ্যে বলি না , আর তাই অনেকেই আমার ওপর খছে যাচ্ছে ।
যাই হোক , আজ তো এদিকে খুব গরম । তোমাদের ওখানেও কি তাই । উত্তর প্রদেশে তো আবার বন্যা হয়েছে , খবরে দেখলাম । তোমাদের ওখানে কি অবস্থা , সব ঠিক আছে তো ? সাবধানে থেকো , বন্যা হলে আবার খুব রোগ ছড়ায় ।
এই দেখো , খবর টা শুনে আবার চিন্তা করতে শুরু করে দিয়েছি । আসলে এটাই বোধহয় ভালোবাসা যে তুমি কাছে না থাকলেও , তোমাকে নিয়ে সবসময় এত ভাবি ,আর এই ভাবনাতেই আমি মরলাম ।
এ সপ্তাহে বাড়ি গিয়ে একটা জিনিস দেখে খুব নিশ্চিত হলাম । বাবার শরীর আগের তুলনায় অনেক টা ভাল , তবে পুরপুরি নয় । কেমন যেন একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব । কি আর করা যাবে , প্রকৃতির নিয়ম কেউ বদলাতে পারবে না । ডাক্তারের ওষুধ শুধু কিছু আরাম দিতে পারে । তাই না ?
তোমার প্রোফাইল পিকচার টা খুব সুন্দর । লাল শাড়িতে একেবারে মহারাণী লাগছে । ভয় হয় নজর না লেগে যায় ।
এই একটা ভালো খবর তো দেওয়াই হয় নি । আমার দুই ছাত্র lic র ado পোস্ট এ চাকরি পেয়েছে । দারুন খবর না । অনেক দিন ধরে লেগে ছিল , খুব খেটেছে । তুমিও খাটো , তুমিও পাবে । এবারে এস এস সী পরীক্ষা দিচ্ছো নাকি ? পরীক্ষা কবে ? প্রশ্ন তো খুব সোজা হচ্ছে শুনছি । এবারের টা হওয়া চাই কিন্তু । নাহলে আরো খারাপ লাগবে ।
আজ চলি সোনা , কেমন । নামতে হবে । বর্ধমান এসে গেল । নাহলে তোমাকে ছেড়ে যেতে কি আমার একটুও ইচ্ছে হয় বলো । তুমি বরং আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ । আমি তো আজও তোমারই অপেক্ষায় বসে । পারলে একদিন স পরিবারে বাড়ি চলে এস । মনের রাগটা দেখবে ধুয়ে জল হয়ে যাবে ।
আজ চলি গো । পরে আবার কথা হবে । ভালো থেকো আর যা বললাম , সেগুলো মনে রেখো ।
ইতি
তোর দুষ্টু প্রেমিক
২৯/০৮/২০১৬
৬।।
Dear Love
শুভ বিকাল । কি হলো সোনা , রাগ করে আছ । অনেকদিন কোনো চিঠি লিখি নি তাই । কি করবো বল , বাবা কে নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি । বাবা হাসপাতালে ভর্তি । ডাক্তার বলছে খুব সিরিয়াস অবস্থা । সোজা আই সি ইউ তে ঢুকিয়ে দিয়েছে । এখন আমাদের কাউকে চিনতেই পারছে না । ডাক্তারের ভাষায় , ব্রেইন এ ইনফেকশন হয়েছে । মারাত্মক অবস্থা । তাই সময় পাই নি । অফিস ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছি । শুধু হাসপাতাল আর বাড়ি । বাবার যে কি হবে তাই নিয়ে খুব চিন্তিত গো । তবে তাই বলে তোমার কথা যে ভাবিনি তা নয় । সবসময় ভাবতাম যে তুমি যদি আমার কাছে থাকতে , তবে একটা সাহায্যের হাত পেতাম । খুব একলা লাগছে নিজেকে । মা আর কত সামলাবে ।
তুমি তো এ বিষয়ে পোক্ত । তোমার মায়ের বেলায় কত দৌড় ঝাঁপ তো করেছ ।
ভালো কথা , তোমার মা এখন কেমন আছেন ? ভালো আছে তো ? উনারও তো ব্রেন প্রবলেম । কত মিল না আমাদের । শুধু দুরত্বটাই বড্ডো বেশি ।
এই দেখো না , তোমার বাবাও রেলে আমার বাবাও রেলে , তোমার পছন্দ এস এস সি , আর আমারও তাই । এখন এখানেও মিল এসে গেল । তাহলে আমরা কেন আলাদা ? চলো না , আমরাও এক হয়ে যাই ।
আচ্ছা এই ক দিনে তুমি আমাকে কখন মনে করতে ? কতবার করতে ? মনে পড়ত যদি , একটা ফোন করলেই পারতে । আমি এত ব্যস্ত ছিলাম , মন টাও খুব খারাপ । একটু মনটাও ভালো হতো ।
যাই হোক তোমার একটি উত্তরের আসায় রইলাম । প্রশ্নটা আগেই করে দিয়েছি তাই আর লিখলাম না । তোমার পরীক্ষা কবে ? মন দিয়ে পড়াটা চালিয়ে যাও আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে বল । আমি তোমার সাথে সব সময় আছি । আজ আসি । খুব তারাতারি আবার লিখবো ।
LAST WORDS
এখন দুপুর দুটো ,
বাইরে কাঁচের জানালায় রোদ
তবে ভিতরটা বেশ অন্ধকার ,
নিজেকেই চিনতে কষ্ট হচ্ছে বেশ
পৃথিবীটা তো মনে থাকছে না কিছুতেই ।
কৃত্তিম কি সব যন্ত্রপাতি ,
কোনোটা গলা , আর কোনোটা নাক
আবার কোনোটা শরীর ভেদ করা
কি যেন মেপে যাচ্ছে প্রতিবার ।
খাবারে শুকনো রস , আর ভালোলাগছে না
মন চাইছে আমিষ কিছু ভালোবাসার ছোয়া ।
চেয়ে চেয়ে অতীতটা দেখছি ,
বর্তমান তোমার কাছেই থাকুক
অনেক ভারী বোঝ , দ্বায়িত্ব এবার তোমায় দিলাম
রাত পোহালেই যাবার সময় হলো ।
কান্না হাসি অনেক দিলাম ,
অনেক বদনাম কুড়িয়ে গেলাম
এবার মাফ করো ভাই ,
যাবার সময় হলো , দেখো
সন্ধ্যা নেমে এলো ,
অচেনা একটা কাঁচের ঘর আমার
আসে পাশে চেনা যে আজ কেউ নাই ।
বাবার অবস্থা নিয়ে একটা লেখা । পড় , অনেক কিছু জানতে পারবে ।
ইতি
তোর দুষ্টু প্রেমিক
০১/০৯/২০১৬ " ....
২২।।
রাত তখন এগারোটা । রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে সন্দীপন আজ প্রস্থানের পথে । এর আগে অফিসে যাবতীয় পেপার ওয়ার্কস রেডি করে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ঘরে ফিরে আসে সে । যদিও এই স্থান তার জন্য নতুন , মাত্র মাস ছয়েকের পরিচয় ; তবু কেমন যেন নিজের মতো হয়ে গেছিল সব । যতই হোক , হাসি কান্না , মান অভিমান , রাগ , শান্তি অশান্তি যেন এই কদিনে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিল মহাকালের পায়ে । এই তো সেই শহর যার ছাওয়ায় কিছু দিন আগে দেখেছিল সে রাজনৈতিক উত্থান পতন । কৃষক আন্দোলনের যে ঝড়ে মধ্যপ্রদেশ সরকার কেঁপে উঠেছিল ; সেই আন্দোলন তো এই উজ্জয়িনের চরণ ছুঁয়েই গেছিল সেদিন । ইন্টারনেট ডাউন , কারফিউ সব কিছুই অভিজ্ঞতা করেছিল সে এই মহানগরীর বুকে ।
আজ সে সব ছেড়ে বিদায়ের পালা । যদিও চিরকালীন নয় এ বিদায় । মাস দশেক পরে আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে তাকে , তবু ইচ্ছে যে হয়না । রাত এগারোটায় ঘর থেকে বেড়িয়েই মা কে ফোন করে দিয়েছিল সে , তাই সে দিক থেকে কোন রকম দায়িত্বের বোঝা নেই তার কাঁধে । পাড়ার মোড়ের দোকানটা বন্ধ হবে হবে করছে । সেদিকেই এগিয়ে গিয়ে হাঁক মেরে বলে উঠলো ,
----- পান্ডে জি । হো কেয়া ?
দোকানের পেছন থেকে তার ছেলে বেড়িয়ে এসে উত্তর দেয় ,
----- পাপা নেহি হ্যায় । কেয়া দু বোলিয়ে ?
সন্দীপন একটা ফ্লেক কিনে টাকা মিটিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে গেল মূল রাস্তার দিকে । গভীর রাতের নির্জনতা আজ গোটা শহরকে গ্রাস করেছে । পিঠে ও দুই কাঁধের বোঝা নিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে চলা পা দুটিও বেশ ক্লান্ত । এই অবস্থায় একটি অটো না পেলে চলছে না আর । সিগারেটের শেষ টান দিয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো সে একবার । অসহায়তার মধ্যেও এবার এক আলোর কিরণ দেখা দিলো । কাছে আসতে সে দেখলো একটি ভিড় অটো , ভেতরে পাঁচ জন বসে আছে ইতিমধ্যেই । হতাশ হয়ে হাত নামিয়ে নিলো সে । কিন্তু ওই কথায় আছে না ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায় , আজ এই অটো তার ভাগ্য হয়েই এসেছে আর তাই কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ব্রেক কষলো সে ।
----- কিতনা দূর চলোগে ?
পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলো অটো ড্রাইভার ।
সন্দীপন ধীর স্বরে স্টেশন বলতেই উত্তর এলো ওদিক থেকে ,
----- পচাস লাগেগা । আ যাও আন্দার ।
আর বিলম্ব না না , আর বিলম্ব নয় ; গানটা যেন বেজে উঠলো সন্দীপনের দেহ মন জুড়ে । দুজন সামনে গিয়ে বসলো আর সে পিছনে কোন রকমে উঠে বসলো । অন্ধকার ভেদ করে এই তিন চাকার আলো ধরেই স্টেশন অভিমুখে যাত্রা শুরু । বাকি পথ রেল বাহনে পূর্ণ হবে ।
স্টেশন যখন পৌছালো তারা তখন বারোটা পনেরো । ট্রেন ছাড়বে রাত দুটো । তার মানে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে কোন বেঞ্চের ওপর পা ছড়িয়ে বিশ্রাম , তবে সময় নিয়ে সাবধান থেকে ।
২৩।।
ট্রেনের মুহুর্মুহু চিৎকার আজ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে । সন্দীপনের দুচোখে ঘুম নেই । হাজার দায়িত্বের বোঝ তার দুই কাঁধে । এরই মাঝে কেটে যাওয়া মুহূর্ত গুলোতে একটু আরাম বলতে ওই সত্যের স্পর্শ । আজকের পৃথিবী জুড়ে যখন প্রেম মানে শরীর হয়ে উঠছে , তখন সন্দীপনের কাছে প্রেম আজও এক মগ কফির উষ্ণতা শীতল সকালে , নিকোটিনের আসক্তি থেকে মুক্তিদায়িনী প্রাণবায়ু , জ্যোৎস্নার আলোতে নির্জন জঙ্গলে বসে থাকা ঘন্টার পর ঘন্টা আর পেশাদারিত্বের মধ্যেও একটু সময় বের করে নেওয়া সুখ দুঃখের খবর লেন দেনের তাগিদে ।
ট্রেনের হুইসাল হোক অথবা নির্জন হোটেলের কামরা ফেসবুকে আজ সারাটাদিন সত্যের জন্য তুলে রাখা । ভোপালের হোটেলে চায়ের কাপ হাতে অপেক্ষায় থাকা এক রাস বসন্তের । ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে নটা । ম্যাসেজ বাক্সে এসে উপস্থিত কাঙ্খিত সেই চিঠি ; একটু অভিমানী আজ ;
----- কোথায় ছিলে এতদিন ?
সন্দীপন হেসে উত্তর দেয় ,
----- ব্যস্ততার জগতে । অতীতের দরজায় কড়া নাড়ছিলাম ।
উত্তর আসে ,
----- সব চিঠি পড়েছি । মাম কেও পড়িয়েছিলাম । এভাবে কাঁদায় কেউ ?
সন্দীপন নিজের মনেই মুচকি হেসে লিখে পাঠায় ,
------ মন ভেঙে গেলে শব্দ হয় না গো । শুধু এরকম অক্ষরের জন্ম হয় ।
উল্টোদিক থেকে উত্তর আসে না আর । এদিকে সন্দীপনেরও অফিসের সময় হয়ে আসে । তাই বিদায়ী সম্ভাষণ লিখে অফলাইন হয়ে যায় সে এবার ,
---- অফিসের সময় হলো । আজ আবার ফ্ল্যাট দেখতে হবে , থাকার ব্যবস্থা করতে হবে । সম্ভব হলে রাতে অনলাইন আসবো । বাই ....
ওপাশ থেকে তখনও কোন উত্তর এলো না আর ।
২৪।।
এ জি ভোপালের মূল ফটকে পৌঁছানো মাত্রই মিলিত স্বরে চিৎকার শোনা গেল বাইরে থেকে ,
---- গুড মর্নিং ইন ভোপাল ।
তীব্র সে শব্দের কম্পনে থমকে দাঁড়ালো সন্দীপন । পিছন ফিরে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই একত্রে তীব্র স্বরে সকলে গর্জে উঠলো আবার ,
---- ভোপাল মে আপকা সোয়াগত হ্যায় ।
তীব্র এ স্বর কম্পনে সন্দীপন বেশ হকচকিয়ে উঠলো , তারপর , কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সকলের দিকে ফিরে তাকালো আবার ,
----- আরে নিশা , রজত , শামীম , অজিত ; তুম সব আ গয়ে ।
সন্দীপন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো ।
----- আ গয়ে !! বহত পেহেলে হি আ গয়ে হম ।
নিশা বলে উঠলো ।
------ তো দাদা মহাকাল ক্যায়সা লগা ?
পাশ থেকে অজিত বলে উঠলো ।
সন্দীপন একগাল হেসে উত্তর দিল ,
------ বরে জোর সে লগা অজিত ভাই ।
রজত হঠাৎ ই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে উঠলো এবার ,
----- ইয়েহি সারে খতম কর দোগে কেয়া । চলো উপর চলতে হ্যায় ।
সকলে এগিয়ে এলেও সন্দীপন আস্তে করে বললো ,
----- তুম সব যাও । মুঝে থোড়া কাম হ্যায় ।
এই টুকু বলেই সে অফিস লঞ্জ ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল আর বাকিরা .... এগিয়ে গেলো লিফটের দিকে ।
২৫।।
সন্ধ্যা ঘন্টা বেজে উঠছে চারদিকে । শঙ্খের গম্ভীর স্বর আজ বিজয় ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করছে বারবার । অন্ধকার আকাশ গঙ্গা জুড়ে বয়ে চলা অমৃত যে তৃষ্ণা তার ধারায় ধারায় বিজয় উল্লাস । সত্য যে সেই তো সুন্দর আর বিজয় তাই তার , সদা সর্বদা ।
ফ্ল্যাটের ব্যাবস্থা হয়ে গেছে । একটু দূরে , আরেরা মার্কেট , ১২ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে । কাল হ্যান্ডওভার পাওয়া যাবে আর তাই সন্দীপন বেশ ব্যস্ত আজ বিকেল থেকেই । সন্ধের আগে মুক্তির কোন সুযোগ নেই তার ।
সন্ধ্যা তারা তখন শুক হয়ে জ্জ্বলছে আর নিভছে , সুখময় কপালে । ক্লান্তি অন্যদিকে গ্রাস করছে বারবার , তবু মনের কোন এক কোনায় ক্লান্ত চেতনায় শীতলতা এখনো বেঁচে , নতুন মেঘের ইশারায় । ম্যাসেঞ্জারের পাতা খুলে গুটি গুটি পা ফেলে ঢুকে পড়লো সে যখন , তখন কাঁটা দুটো জুড়ে প্রায় নৌনে প ; অর্থাৎ পৌনে ন । নীরব ম্যাসেঞ্জারে সত্যবতী একবার এসে হাই তুলে গেছে , তার ছাপ স্পষ্ট । সন্দীপন গুটি গুটি পায়ে ছেড়ে এলো গোপনে , সেখানেই , মনের শীতলতা ;
" ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস ,
পরান ছেড়ে যাস না উড়ে , যাস না
এ পরানে গাঁ আছে তোর
ওরে মায়ের দুচোখ আজ
বারির জলে ভেজাস না ।
অসময়ি মেঘলা বাতাস
রোদের ঘরে তোর ঠিকানা
আকর ছেড়ে গোটা সৃষ্টিটাকে
আঁধার আকাস আর ছড়াস না ,
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস
পরের ঘরে যাস না উড়ে , যাস না ।
কত কথা বলতে গিয়েও
পারেনি রাঙা পথের একতারা
তোর ওই দুই চোখে কবিতা আছে
কালো অক্ষরে আজ সব হয়েছে ছন্নছাড়া
মেঘলা বাতাস , একতারে আর মন লাগাস না
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস
পরের ঘরে যাস না উড়ে , যাস না ।
বৃষ্টি পটে দেখি দু চোখ ভরে
মা আমার আসছে ওই সোনার রথে করে
মেঘলা বাতাস , মনের কোণায় চুপটি করে দেখ
উতল প্রেমে ঝড়ের কথা , আজ আর বলিস না
মা আসছে চারটি দিন , প্রেম গড়া ওই হৃদয় ভাঙিস না
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস
পরের ঘরে যাস না উড়ে , যাস না ।
মেঘলা আকাশ , তারায় ভরা ,
কবিতার এ ঘর , আজ ভাঙিস না ।
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস ,
পরান ছেড়ে যাস না উড়ে , যাস না " ।
তবে পালিয়ে আসতে পারেনি আর । চোর পালানোর আগেই গ্রেফতার করা হলো সত্যের বাঁধনে । তারপর ,
------ বাড়ি পেলে ?
গম্ভীর হয়ে লিখে পাঠালো সত্য ।
----- পেয়েছি । একটু দূরে , আরেরা মার্কেট , ১২ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে । কাল হ্যান্ডওভার পাওয়া যাবে ।
সন্দীপন উত্তর দিলো ।
----- বেশ । কাল কথা হবে তাহলে । আজ যাও বিশ্রাম করো । অসময়ি মেঘলা বাতাস সঙ্গে থাকলো সবসময় ।
উত্তর এলো ওদিক থেকে । এরপর বেশ কিছুক্ষণ অনলাইন কাটালেও সত্য দেখা দেয় নি একবারও । শেষে সন্দীপনও ঘুমিয়ে পড়লো , মাথায় প্রশ্নটি জড়িয়ে রেখেই ,
শেষ কথাটির অর্থ কি ?
২৬।।
----- নয়ে ঘর মে আপকা সওয়াগত হ্যায়
ব্রোকার মশাই , মিস্টার শেখ এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বলে উঠলেন । তিন তলার ওপরের ফ্ল্যাট । গোকুল আবাসনে ঢুকেই সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি পার করে ডান হাত ঘুরেই সিঁড়ি । তাই ধরে তিন তলার ওপরে উঠে প্রথম ঘর তার । ঢুকতেই সামনে বড় বারান্দা । তার তিন দিক ঘেরা তিনটি কামড়া --- একটি কিচেন , একটি স্নানাগার এবং একটি থাকার ঘর । বাইরে সুবিশাল ব্যালকনি । এক কথায় সন্দীপনের সৌদাটি মোটেও খারাপ মনে হয় নি , বিশেষ করে ভোপালের বড় বড়লোকি শহরের বুকে মাসিক ৮০০০ টাকা ভাড়া , ইলেক্ট্রিসিটি আলাদা । বাড়ির মালিক ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করেন , তাই পরিবার নিয়ে বাইরেই থাকেন । ভোপালের ফ্ল্যাটটির সব দায়িত্ব ওই ব্রোকারের হাতেই তাই দিয়ে গেছেন উনি ।
অন্ধকার কামড়াটিতে আলো জ্বেলে দিলো ব্রোকার শেখ । ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রেখে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই ।
----- মি. সন্দীপন দত্ত , আজ থেকে এই প্রোপার্টি আপনার । ভাড়া নীচে চৌবে জি কে দিয়ে দেবেন । আমি নিয়ে নেবো সময় করে ।
এই টুকু বলে মি. শেখ বিদায় নিলেন ।
ঘরের চারপাশ সন্দীপন ভালো করে দেখতে লাগলো । পাথর বসানো ঘরগুলি তাকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ঠ করছে ক্রমাগত । ব্যালকনির দিকে দরজা খুলে সে বাইরে এসে দাড়ালো একবার । পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দুটান দিতে দিতে মাকে ফোন লাগলো সে ,
----- মা , ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে । আমি ওখান থেকেই কথা বলছি ।
----- আমাকে কবে নিয়ে যাবি বাবা । আর যে সহ্য হয় না ।
মা করুন স্বরে উত্তর দিলো ।
---- মা কিছু হয়েছে আজ ? তুমি ঠিক আছো তো মা ?
বেশ উদগ্রীব হয়েই সন্দীপন জানতে চাইলো এবার ।
----- আমার কথা বাদ দে ।
মায়ের কথাগুলো শেষ না হতেই পিছনে দূর থেকে ভেসে এলো কিছু কথা যা সন্দীপন স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন ।
----- তোর মতো দিদির না থাকাই ভালো । অভিশাপ দিলাম তুই মুখে রক্ত উঠে মরবি ...
হতাসগ্রস্থ নাবিকের কাছে দুটি পথ জীবিত থাকে । হয় সে সব মেনে নিয়ে নদীর স্রোতে ভেসে চলে যাক কোন অনন্ত গভীর অন্ধকারে , নয়তো ছুটে চলুক সেই অসময়ের মেঘলা বাতাসের পিছনে । মেঘ পিয়নের চিঠি হয়ে উড়ে যাক সে অন্য এক পৃথিবীর খোঁজে । ফেসবুকের পাতাগুলো নেড়ে ছেড়ে দেখতে দেখতে এসব কথা ভাবছে যখন , তখন কোথা থেকে ভাবনা এসে ছেপে দিয়ে গেল মনের কথাগুলো সে নিজেও বোঝে না । হয়তো সত্যকে খুঁজছিল মন , সব বলে দেওয়ার তাড়নায় আর অনুপস্থিত থেকেও সত্য খুঁজছে তাকে কিছু শুনতে মুখ থেকে তার ।
বেজে ওঠা ফোনের ঘন্টা শুনে চেতনা এলো যখন , তখন ঘড়িতে আট ছুঁই ছুঁই । ফোন তুলতেই ভেসে এলো সমরেসের কন্ঠ ,
----- কি রে মোটা , কি করছিস ।
----- বসে আছি রে ।
হেসে উত্তর দেয় সন্দীপন ।
----- পড়াশুনা করছিস । পরীক্ষা কিন্তু দেখতে দেখতে চলে আসবে ।
সমরেশ ওপাশ থেকে বলে ওঠে ।
----- ও হয়ে যাবে । সময় আসুক সব হয়ে যাবে ।
বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে সন্দীপন উত্তর দেয় ।
বন্ধুর উত্তর শেষ হতে না হতেই , সমরেস বেশ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে ,
----- এত সহজ নিও না । এই পরীক্ষাটা এত সোজা নয় । আমাদের অবস্থাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।
সন্দীপন , সমরেসের কথায় হেসে উঠে বলে ,
------ বেশ তো । ট্রেনিংটা শুরু হোক । দেখিই না কত কঠিন .... নিজের সাথে সকলের তুলনা করছিস কেন ?
------ যা ভালো বুঝিস কর । আমার বোঝানোর তাই বললাম ।
এই বলে ফোন কেটে দেয় সমরেস তার । এদিকে সাড়ে আটটা বাজছে , সন্দীপনও রাতের খাবার আনতে বের হবে বলে ল্যাপটপটি গুটিয়ে রেখে জামা প্যান্ট পড়তে উঠে পড়ে । দুই বন্ধুর বেড়ে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্তের মাঝে ভালোবাসা বসে থাকে , কবিতা হয়ে । ভিজানো ল্যাপটপ জানে শুধু আজ ভালোবাসা উপস্থিত অনুপস্থিত কিছু চেনে না ; শুধু সাজানো অক্ষর জাল বন্দি হয়ে রয়ে যায় আমরণ ...
" একগুচ্ছ জনতার ভিড়ে আমি একলা
অনেকের কথায় বোকা , তাই পারিনি আজও
জীবনের পূর্ণগোলক এঁকে দিতে ।। হয়ত ওরা কিছুটা ঠিকই বলে ,
কিন্তু যেটুকু জানে সেটুকুই বলে , যেটা জানেনা সেটা হল
রাজকন্যার সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারিনি আজও
খাঁটি হৃদয়ের খাঁটি তিনটে কথা ।।
বাড়ির কাছেই বিশাল ঝিল আছে , জলের ধরে কত পাখি
রোজ বসে আড্ডা দেয় , খেলা করে ।। সেদিন নজরে এল
দুইজন দূরে একলা বসে ।। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে উপভোগ করছে
ভালবাসার মুহূর্ত ।।
এরকম কত তো রয়েছে , চোখ খুলে তাকালেই দেখা যায়
গাছে গাছে , পাতায় পাতায় , জলের স্রোতে , হাওয়ায় হাওয়ায় --
সবাই পেরেছিল বলতে ।। শুধু আমি ছাড়া ।।
সূর্যের অস্তগামী চেহারার পিছনে অন্ধকার নেমে আসছে ,
ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বাভাস -- ফিরতি পাখিদের দলে আমরা দুজন ;
চলো না মনের কথা শেষবার বলে ফেলা যাক ।।
তোমার জানি অভাব নেই কোন ,
খুঁজলেই ভাল ছেলে পেয়ে যাবে অনায়াসে :
সমস্যাটা আমার ; বলেই দেখি অন্তত যদি কোন পেত্নিও
জুটে যায় শেষমেস ।। "
২৭।।
রাত কেটে সকাল হলো । সূর্যের আলোতে ভরে উঠেছে পৃথিবী । এক নতুন সূচনার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরতে উড়ে চললো দিন । প্রতিদিনের নিয়ম করে হয়ে চলা ক্লাস ক্লান্ত করে তুলছে নায়কের জীবন যখন , তখন হঠাৎই একদিন সন্ধ্যায় ডাক এলো তার বাক্সে । যে সে ডাক নয় গো এ , মেঘ পিয়নের চিঠি এসেছে আজ । এক মুহূর্তে চারিপাশ ভরে উঠল সবুজে । গেরুয়া হৃদয়ে এ হেন পরিবর্তন জীবন স্রোতে নতুন আর নতুন এ বসন্তে প্রাণ চঞ্চল না হয়ে কি পারে ! আকন্ঠ নেশায় টলমল চারিপাশ আজ চরম নেশার্ত । প্রতিটি চুমুকে এক চরম আনন্দের অনুভূতির স্পর্শ । এরই নাম হয়তো ভালোবাসা ; এক অজ্ঞাত ভালোবাসা ।
----- এই দেবী কে ?
ম্যাসেঞ্জারে ভেসে আসা প্রশ্নটিতে রীতিমত চমকে উঠলো সন্দীপন । তবু কিছু না বোঝার ভান করেই উত্তর দিলো ,
------ কে দেবী ?
------ ওই যে যার জন্য এতদিন ধরে প্রেম পত্র লিখে চলেছো ।
উত্তর দিলো সত্যবতী ।
সন্দীপন কিছুই ভেবে পাচ্ছে না কি উত্তর দেবে সে আজ । যার জন্য এত দিনের প্রচেষ্টা তার , সেই যখন ঘুরিয়ে প্রশ্ন করছে , তখন সত্য বলে দেওয়ার সাধ্যি নেই তার । তবু অনেক ভেবে বেশ কায়দা করেই লিখে পাঠালো সন্দীপন ,
------ তুমি জেনে কি করবে ? সে যেই হোক না ।
সত্যবতী একটুও সময় নষ্ট না করে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো ,
----- আমি কিছুই করবো না । শুধু বলছিলাম যে প্রেম পত্রগুলি যার তাকে পাঠিয়ে দিন ।
সন্দীপন দৃঢ় নিশ্চিত এ কথায় , যে , সত্য সব বুঝে গেছে , এবং হয়তো সেও চাইছে এটা সফল হোক । তবু সাহস করে লিখে পাঠালো সে ,
----- ঠিকানা জানলে পাঠিয়ে দেবো ।
কিন্তু ততক্ষণে সত্য অফলাইন হয়ে গেছে । উত্তরখানা পড়ে আছে উত্তরপত্রে আজ , প্রশ্ন যত রয়ে গেছে অতৃপ্ত হৃদয়ে । ভালোবাসা এমনই , শেষ না হলে তৃপ্তি হয় না একফোঁটাও । রাতের খাবারের খোঁজে বেড়িয়ে আসা ছেলেটির মাথায় তাড়া । প্রেমিকার উত্তর না শুনে ঘুমও আসবে না , সেখানে এ তো সামান্য খাওয়া ।
অনেক রাত অবধি সন্দীপন আজ অনলাইন উপস্থিত । আসলে নিজের উত্তেজনা কমাতে ইউটিউব থেকে গান শুনে চলেছে সে । এরই মাঝে কৃষ্ণদীপের গল্পটা ভীষন মনে পড়ছে । ফেসবুকেই প্রথম পরিচয় ওদের , সূত্র সেই লেখা । বাড়ি এই মধ্যপ্রদেশেই । ভোপালে আছে শুনে , সন্দীপনের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল দুদিন আগে , ফোন করে । সন্দীপনও রাজি হয়ে যায় ।
লোয়ার লেকের ধারে দুপুরে প্রায় ঘন্টা তিনেক জমিয়ে আড্ডা হয় । সন্দীপনের মেয়েটিকে নিয়ে গড়ে ভাবনা দেখে সে নিজের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিল ,
----- দাদা ভালোবেসেছো বলে নিজেকে বিকিয়ে দিও না । নিজের জন্য রেখে দেওয়া এক একটা সময় তোমার । আমিও একই ভুল করেছিলাম , আর তারপর পরিণামটাও পেয়েছিলাম । প্রায় চার বছর শ্রীতমার পেছন পেছন ঘুরেছিলাম কলেজে থাকতে । তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । মর্নিং কলেজ , তাই ভিড় কম । সাত জনের সেই ব্যাচে মেয়েটিও ছিল । সময়ের সাথে সাথে ওর ওপর একটা টান জন্মায় । আমাদের প্রথম কথা হয় ওর জন্মদিনে । ওকে একটা কানের দুল উপহার দিয়েছিলাম । তারপর থেকে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম , অবশ্য আমার চোখে সে আমার ভালোবাসা হয়ে উঠেছিল । যা বলতো তাই করতাম । এক রকম ওর পোষা কুকুর হয়ে উঠি আমি । আর সে নিজের বয় ফ্রেন্ড আছে এই একটা কথাতেই আটকে থেকে গেছিল । দাদা , এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে চার বছর লেগেছিল আমার । আজ মাঝে পর্বজুড়ে শুধু কান্না , দুঃখ আর বুকফাটা হাহাকার ।
আজ মনে হয় দাদা কত বোকামি করেছিলাম সেদিন । ও যেদিন প্রথম না বলেছিল সেদিনকেই সরে আসা উচিত ছিল আমার । যাই হোক আমি পারিনি , তাই তোমাকে বলবো , ভালোবেসেছো বলে ফেলো , তবে উত্তর যদি না হয় , তাহলে সরে এসো ।
তার কথাগুলো সন্দীপনের মনে পড়তেই , সে কেমন যেন ভেঙে পড়লো । যদি সত্যিই না বলে দেয় , তাহলে .... হয়তো সরে আসবে সে কিন্তু নতুন করে এগিয়ে যেতে পারবে তো যে কোন পথেই । ল্যাপটপ ছেড়ে বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে এবার ।
২৮।।
রাত গভীর হয়েছে এখন । আকাশের চাঁদ জ্বলে উঠেছে আকাশে । তার খণ্ডিত আলোর লাইট হাউস দাঁড়িয়ে একাকি , পথভোলা পথিককে নতুন পথের সন্ধান দিতে । অসহ্য অন্ধকার অসহায় করে দেয় জীবন যখন , তখন নতুন নতুন প্লট লেখা হয় বিধাতার কলমে । জন্ম হয় নতুন প্রেমের , ভাঙন ধরে অনেক হৃদয়ের আর প্রতিটি জন্ম ও ভাঙনের পিছনে লেখা হয় এক একটা গল্পের ; যা শুধু লেখক জানে , দৃশ্যপটে দৃষ্ট হয় বিদ্যুতের ঝলকানির মতো ।
সময়ের হিসেবে এখন রাত এগারোটা । ফেসবুক খুলে বসলো সন্দীপন আবার । মনের ভেতরটা উৎসুক । আনচান এ অবস্থায় ঘুম আসে না । সত্যবতীকে অনলাইন দেখে মনে হল , সেও একই তীরে বিদ্ধ আজ । সাহস করে লিখে পাঠালো সে ,
----- এত রাতে জেগে আছো যে ।
সত্য কয়েক মিনিট সময় নিয়ে শুধু একটি হু লিখে নীরব হয়ে গেল আবার । সন্দীপনের মন কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না । এক একবার মনে হচ্ছে সব সত্যিকথা বলে দিই তাকে ; কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে কই ! উৎসুক অবস্থা আর শঙ্কার দোলাচলে সে যখন বাঁধা পড়েছে তখন হঠাৎই ওপাশ থেকে ভেসে এলো কিছু ম্যাসেজ আবার ,
----- চিঠিগুলো ঠিকানায় পৌঁছে গেছে । সব কটি খুঁটিয়ে পড়াও হয়েছে ।
------ সত্যি !
সন্দীপনের মুখে এক অদ্ভুত আনন্দ ফুটে উঠলো এবার । কিন্তু পরক্ষনের গভীর নীরবতা তাকে দমিয়ে দিলো আবার । সে ভেবে পাচ্ছে না কোন সে উত্তর আসতে চলেছে এর পর ।
মিনিট পাঁচেকের নীরবতা ভাঙলো আবার একটি প্রশ্নে ,
---- বাড়িতে সব বলে দিয়েছি । ওরা ইচ্ছুক তবে সমস্যা একটাই ।
সন্দীপন তৎক্ষনাৎ লিখে পাঠালো ,
----- কী ? কী সমস্যা ?
উত্তর এলো না আর । প্রায় মিনিট দশেক ওই ভাবেই বসে রইল তারা । তারপর ভেসে এলো একটা প্রশ্ন সন্দীপনের দিকে ,
------ তুমি কি কোনদিন বাঙলায় ফিরবে না আর । ফিরে এসো প্লিস ।
সত্যবতীর করুন এ মিনতি সন্দীপন ফেলে দিতে পারছে না কিছুতেই । কিন্তু .... পরন্তু সব ভেবেই সে লিখে জানালো ,
------- ফিরে আসা এত সোজা নয় ; মিউচুয়াল ট্র্যান্সফার পাওয়া খুবই কঠিন । তবু সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে । বাকি ঈশ্বর যা চান ....
------ আমি তোমার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো । অপেক্ষা করবো তোমার ।
সত্যবতী উত্তর দিলো ।
সেই আনন্দের মুহূর্তটুকু সন্দীপন মিস করতে চাইনি সেদিন । সে সত্যবতীর কাছে একবার ফোন করার আবদার করে বসলো । কিন্তু সত্যবতী সব কিছু একদিনে হোক এমন চাইনি । সে সন্দীপনকে লিখে জানায় ,
------ মা পাশেই বসে আছে । আজ নয় তাই । কাল আমার ক্লাসে যাওয়ার পথে আমি তোমায় কল করে নেবো । তুমি বরং নিজের ফোন নাম্বারটা আমায় দাও ।
সন্দীপন , সত্যবতীকে বিশ্বাস করে ফোন নম্বর টি ম্যাসেঞ্জারে ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো এক বুক তৃপ্তি নিয়ে ।
পরেরদিন সকালকে আর কড়া নাড়তে হয়নি সন্দীপনের দরজায় , সূর্যের অনেক আগেই সে ঘুম থেকে জেগে গেছে । ভালোবাসা বোধহয় এমনই , মানুষকে পুরোপুরি পাল্টে দেয় নিমেষের মধ্যে । ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে । এক একটা মিনিট সন্দীপনের কাছে এক একটা দিন মনে হতে লাগল । উপায় না পেয়ে সে তার কবিতার খাতা খুলে কয়েক লাইন লিখে নিজের চাপ হালকা করতে চাইল ;
" আজ সূর্য আমার দরজায় আসেনি
আমি সূর্যের দরজায় বসে আছি
একটা মেঘ পিয়ন ফিরবে এই পথেই
তাকে বৃষ্টি করে নিয়ে যাবো বলে "।
লেখাটা তখনও শেষ হয়নি তার , হঠাৎ বেজে ওঠা মোবাইলের শব্দে ধ্যানভঙ্গ হল সন্দীপনের । ঘড়িতে ঠিক নটা আর ফোনে একটি আননোন নম্বর । ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা ভেসে এল
---- হ্যালো , সন্দীপন । আমি সত্যবতী বলছি ।
নামটা শোনামাত্রই সে কেমন যেন নিথর হয়ে গেল । সন্দীপন ভাবতে পারছে না , যে মুহূর্তের জন্য এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা তার , সেই মুহূর্ত অবশেষে উপস্থিত তার কামরায় । কি কথা বলবে কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না সে , ওদিকে ওপাশ থেকে ভেসে আসছে সত্যবতীর উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠস্বর ,
----- হ্যালো । শুনতে পাচ্ছো আমায় ।
ছেলেটি দুবার জোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবার জানান দিলো যে সে সত্যবতীর সঙ্গেই আছে । এরপর প্রায় ঘন্টাখানেক পার হল । কিছু প্রেম আদান প্রদান আর অনেকটা প্রথম পরিচয়ের আলাপ চারিতা চললো ওদের মধ্যে । তাদের চোখ , মুখের হাসি আর শরীরের ভঙ্গিমা দেখে একটা জিনিস অনায়াসেই বলা যেতে পারে , ইটস দা স্টার্টিং অভ আ লাভ স্টোরি ।
২৯।।
প্রেমের কোন দিন হয় না , কোন তিথি হয় না ; হয় শুধু অপেক্ষা । তেমনই অপেক্ষায় সন্দীপনের সকাল নামতো । চায়ের পেয়ালা হাতে ফোনের ঘন্টা বেজে উঠে বলতো ,
---- গুড মর্নিং ...
একটা বিশাল হাই তুলে সন্দীপনের উত্তর যেত সাথে সাথে ,
---- গুড মর্নিং টু ।
অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে ভিডিও কলে সত্য ফোন করতো ; প্রায়ই । এক মুখ হাসি নিয়ে বলতো ,
------ খাবার খেয়েছো ।
উত্তর যেত এক মুখ হাসি নিয়ে ,
----- খেয়েছি । তুমি খেয়ে নাও ।
বেশ আবদারি ভঙ্গিমায় উত্তর আসতো তখন ,
----- খাবো তো ।
তারপর তার প্রিয় টেডি গনসা কে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়াতো ব্যালকনিতে সে । সত্যের অপরূপ সে রূপের মায়া বিরাজ করতো তার শরীর জুড়ে সারাটা দিন । তারপর রাত নামতো আকাশ জুড়ে । গভীর নিস্তব্ধতা গ্রাস করতো ভোপাল শহরটাকে যখন , তখনও সত্যবতী আর সন্দীপনের চোখে ঘুম নেই । কত পরিকল্পনা মুহূর্তে বাস্তব হয়ে যেত ওই কয়েক ঘন্টায় । অবশেষে আসতো সেই ঘুম চুমুর পালা । সত্যের গুড নাইট শব্দে সন্দীপনের চোখে ঘুম নামতো । ঠিক মায়ের জায়গাটা সে করে নিয়েছিল সন্দীপনের জীবনে । হয়ত প্রেম ঘন হলে , প্রেমিকা এমনি করেই মা হয়ে ওঠে ।
আজ রবিবার । ছুটির দিন । আনন্দের এক একটা মুহূর্ত আজ সত্যের জন্য কষ্টের হয়ে উঠছে । সেই আটটা থেকে ফোন করে চলেছে সে , দু ঘন্টা পেড়িয়ে গেলেও সন্দীপনের কোন সাড়া নেই ।
নিজের অস্থির মনকে ধরে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই । অনবরত নিজেই নিজেকে বলে চলেছে সত্য ,
---- স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন , প্রভু অহং আজ করো সব ভগ্ন
লড়াইয়ের সুরে , শুনি ডঙ্কা বাজে বহুদূরে
দাও কালবশেখের শক্তি যত এ প্রাণে ঢালি
অন্ধকার যত হর প্রভু মম দু নয়নে ।
আলো যত ভালো আছে এ সংসারে
প্রভু আমার মনে দাও তুমি সবেরো ভরি
দাও শুভ যত যেন অশুভেরে কভু নাহি ডরি ,
প্রভু, বাঁশির সুরে দাও নতুন গান
মোরে তুমি বারেবারে দাও ভিখারির স্থান
তব চরণ ধুলার তলে ।
তবে উৎকণ্ঠা শুধু এখানে নয় আজ । সে আজ একলা নয় । পরিচয়ের বহু দূরে সন্দীপনের মা ও বিচলিত ছেলের সারা না পেয়ে । মনে মনে তারও ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে ,
------- হে ঈশ্বর , আমার সন্তান যেন সুস্থ থাকে । তুমি দেখো , যেন কোন বিপদ ওকে ছুঁতে না পারে ।
ফোনের পর ফোন জমা হয়েছে ওই ঘরে । অবচেতন সন্দীপন বুঝতে পারে নি এসব কিছুই । সত্যবতী ওদিকে কি করবে বুঝতে না পেরে , ফেসবুক খুলে বসে । বন্ধু শুভ র সাথে একটু হলেও পরিচয় ছিল , তাই তাকেই লিখে পাঠালো সে ম্যাসেঞ্জারের পাতায়,
------ শুভ দা , সন্দীপন সকাল থেকে ফোন ধরছে না । তুমি একটু দেখবে গো খোঁজ নিয়ে ।
খবরটি পড়ে শুভ যেন আকাশ থেকে পড়লো । সে তৎক্ষনাৎ ফোন করলো সন্দীপনের নম্বরে ; তারপর সত্যবতীকে লিখে পাঠালো ,
------ ও তো আমারও ফোন ধরলো না । ওর মাকে ফোন করলাম । সেও চিন্তিত । মনে হচ্ছে , পুলিশে খবর দিতে হবে একবার ।
সত্য বেশ ভয় পেয়েই লিখে পাঠায় ,
------ পুলিশ কেন ! কি হয়েছে ওর ।
------ কি হয়েছে জানতেই তো পুলিশ ।
শুভ লিখে পাঠায় ।
সত্যবতী রাজি নয় কিছুতেই ।
------ না । আর একটু দেখি না আমরা । ঠাকুর কিছু না কিছু নিশ্চই উপায় করবে ।
একদিকে শুভ চিন্তিত , একদিকে সন্দীপনের মা আর অন্যদিকে চিন্তিত সত্য যখন ; তখন বারোটার ঘন্টা বেজে উঠলো ঘড়িতে , সত্যের বাড়িতে ।
৩০।।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা নয় , প্রচেষ্টার একটা ফল থাকে । সন্দীপনের বন্ধু শুভ সেই উত্থাল সাগরের মাঝেও তীর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো । এক ঘন্টা আরও পার হলে উৎকণ্ঠা আরও তীব্র হয়ে উঠলো সকলের মনে । এরই মাঝে আশার আলো খুঁজে পেল শুভ , যখন , আজকের মত প্রথমবার সন্দীপনের ফোন ব্যস্ত এলো । সময় নষ্ট না করে সত্যবতীর দেওয়া নম্বরে ফোন করলো সে । না এখানে ব্যস্ততার চিহ্ন মাত্র নেই । উল্টে মুহূর্তের মধ্যে সত্য ফোনটি রিসিভ করেই বলে উঠলো তাকে ,
----- কোন খবর পেলে , শুভ দা ?
শুভ নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো ,
----- পেয়েছি । ব্যস্ত আসছে এই প্রথম ।
সত্যবতীর আনন্দের সীমা নেই । চিৎকার করে বলে উঠলো সে ,
----- হনুমান আমার প্রার্থনা শুনেছে । তুমি ফোনটা রাখো ।
এটুকু বলেই সত্য ফোন কেটে দিলো এবং সটান ডায়েল করলো সন্দীপনের নাম্বারে । কয়েকবার রিং হতে না হতেই ফোন তুললো সন্দীপন আর তারপর ওপর প্রান্ত থেকে এক অদ্ভুত স্বর ভেসে এলো । গলাটা সত্যর সে কথা সন্দীপন ঠাহর করতে পারলেও , ওই অদ্ভুত স্বর সে কোনদিন শোনে নি । এক অদ্ভুত আনন্দ আর অভিমান মিশে গেছে আজ , তার কন্ঠে ;
----- কি হয়েছিল তোমার ? কিছু হয় নি তো ? কেউ কিছু করে নি তো ? তোমাকে নিয়ে পারি না । কোনদিন তোমার জন্য আমার প্রানটা বেড়িয়ে যাবে দেখো ।
সন্দীপন চুপ করে সব শুনে চলেছিল ওদিক থেকে ভেসে আসা সমস্ত অভিযোগ ভালোবাসার ,
----- কোন দ্বায়িত্ব নেই একটা । পচা ছেলে । সেই সকাল থেকে ফোন করে যাচ্ছি । তোমার জন্য আমার কত চিন্তা হয় তুমি আর কি বুঝবে ।
সন্দীপন সব শুনে চলছিল এতক্ষন ধরে । তারপর আস্তে করে শান্ত গলায় উত্তর দিলো সে ,
----- সরি । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ...
কথাটা ঠিক করে শেষ করতেও হলোনা তাকে , ওপাশ থেকে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো সত্য ,
----- কুম্ভকর্ণ জুটেছে একটা । এত বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন উনি । কথা বলবে না আর আমার সঙ্গে ।
সন্দীপন দু তিনবার সত্যবতী বলে ডাক দিলেও , সত্য ফোন সুইচ অফ করে রেখে দিল । প্রেমিকা হীন নায়কের মনে হাজার হাজার চিন্তা যখন , তখন এ কলহ তাকে এক প্রকার মুষড়ে দিয়ে গেল । জীবনে তার আয়লা বয়ে গেছে এমন সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠলো আবার । সত্য অনুমান করে ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো মায়ের সেই কন্ঠ ,
----- বাবু , ঠিক আছিস তো ! কি হয়েছিল ? ফোন তুলিস নি কেন ?
এখন সে মা কে কি করে বোঝায় , ঘুমের ওপারে সে ঠিক ছিল ; কিন্তু এখন একদমই ঠিক নেই জীবন । তবু সাহস করে ধৈর্য ধরে উত্তর দিলো সে ,
----- তেমন কিছু নয় , ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
----- ঘুমিয়ে পড়েছিলিস ! এত অবেলা অবধি !
মা বেশ অবাক হয়েই উত্তর দিলো ।
ছেলের মন এদিকে আর প্রশ্ন নিতে রাজি নয় । তার এখন মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে , সত্যের কি হবে ? তার রাগ কি করে ভাঙাবে সে ? আর তাই মায়ের কথায় এক রকম বিরক্ত হয়ে সে বললো ,
----- বললাম তো ও কিছু না । হয়ে যায় মাঝে মাঝে । এখন ফোন রাখো তো তুমি ।
এই বলে সে ফোন কেটে দিলো । তবে তাতে শান্তি যে এলো তা কিন্তু নয় । বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও সত্যবতীর ফোন সুইচ অফ সে পেল বারবার ।
এরই মাঝে মোবাইল বেজে উঠলো আবার । তুলে দেখে শুভর ফোন । বেশ বিরক্তিসূচক মুখ নিয়েই ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই এক প্রশ্ন ,
------ কি ব্যাপার কি ! বোকাচোদা , গাঁজা টেনেছিলে সকাল সকাল ।
সন্দীপন বেশ মেজাজ নিয়েই উত্তর দিলো এবার ,
------ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । এবার রাখবি তুই ।
শুভও ওদিকে ছেড়ে দেওয়ার ছেলে নয় । সেও বেশ মেজাজ নিয়েই উত্তর দিলো আবার ,
------- রাখবি মানে । রাখবো কেন ? শালা , এত কিসের ঘুম তোর । প্রেম করছো , দুদিন পরে বিয়ে করবে । তখন দেখবো কটা রাত ঘুমিয়ে কাটাও । তখন তো বউকে ...
সন্দীপনের আর সহ্য হচ্ছিল না । সে ফোনটা কেটেই দিল এবার , এক প্রকার জোর করে । বন্ধুর এ হেন আচরণে শুভ বেশ অবাক । তবু মুখে কিছু বললো না আর , শুধু মনে মনে বলে উঠলো ,
" প্রেমিকা পেলে সবাই শালা বন্ধুদের ভুলেই যায় " ।
৩১।।
সাফল্যের জন্য যেমন তপস্বীকে একাগ্র চিত্তে প্রভু নাম জপে যাওয়া উচিত , শিক্ষাত্ৰীকে যেমন জ্ঞান লব্ধ করতে একলব্যের মত গুরু চরণে তপস্বী হয়ে থাকা উচিত , তেমনি প্রেম সাগরে ডুব দেওয়া মনের উচিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করা । সময় , এক শক্তিশালী শক্তি , যা বড় বড় বাঁধা সুস্থ করে তোলে অনায়াসে । সময়ের অপেক্ষা ছাড়া প্রেমিক যুগল কি আর করতে পারে ! শুধুই সময় নাম জপে যাওয়া , জপে যাওয়া আর জপে যাওয়া ।
সাগরে ঢেউ উঠবে , প্রচন্ড বেগে উঠবে ; তাই বলে লক্ষ চ্যুতি হলে তো সলিল সমাধি হওয়ারই কথা । কিন্তু যারা ইষ্ঠ নাম আঁকড়ে ধরে কর্মযোগে লিপ্ত হয় , তার নৌকা সাগরের বিশাল ঢেউ কাটিয়ে একদিন নোঙর ফেলে প্রেম সাগরের কিনারায় । জয়ধ্বনি গর্জে ওঠে চারিপাশে , ইষ্ঠধ্বনি গর্জিত হয় তার মনে আর প্রেমধ্বনি কম্পমান হয় গোটা শরীর জুড়ে ।
সন্দীপনের আজকের তপস্বা ঠিক তেমনই । সত্যর জন্য অপেক্ষা করা , সত্যের মানভঙ্গের তাগিদে । তবে অপেক্ষাটা এত সোজা নয় , সে নিজেও যে অপেক্ষা করিয়েছে আজ সারাটা দিন , তাহলে সত্যর আর দোষ কি । দেখতে দেখতে দুপুর পেড়িয়ে বিকেল , বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো আকাশে । মেঘেরা ঘরে ফিরে গেছে যখন , তখন মোবাইলের কণ্ঠে বেজে উঠলো সেই চেনা ডাক ,
------ খুব রাগ করে ফোন করিনি তোমায় ।
সত্যবতী বলে চললো ওপাশ থেকে ।
------ ওভাবে কেউ ঘুমায় । জানো কত চিন্তা করছিলাম । শুভ দা কে যোগাযোগ করেও যখন কোনো খবর পেলাম না , তখন শুধুই সংকটমোচনের কাছে প্রার্থনা করে গেছি সারাটাদিন ।
------- সরি গো । জানি না আজ কেন এত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । সরি ....
সন্দীপন উত্তর দেয় । তার গলায় এক ভালোবাসার ছাপ । আর ওদিকে সত্য , ভারি কণ্ঠে বলে ওঠে আবার ,
------- নিজের খেয়াল রাখো । আমি অনেকদিন পর হাসছি । এ হাসি থামতে দিও না গো ।
সত্যের কথায় সন্দীপনের দু চোখ ছলছল করে ওঠে । তবু নিজেকে সামলে সে উত্তর দেয় ,
------ এত ভালোবাসো আমায় !!
শান্ত গলায় উত্তর আসে এবার ,
----- আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বাইক এক্সিডেন্টে মারা যায় দু বছর হলো । ওর সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতাম । ওর এক্সিডেন্ট , মৃত্যু আমাকে ভেঙে দিয়ে গেছিল । এর পর দুজন এসেছিল জীবনে , কিন্তু , থাকেনি কেউ । বুঝেছিলাম যে ওই দুজনই ভালোবাসা নয় , অন্য কিছুর জন্য কাছে আসতে চেয়েছিল । একমাত্র তোমাকেই পেলাম , মনের মতো কেউ । এত সহজে হারাতে দিতে পারি তোমায় ।
আজ আসি । তোমার সাথে কথা বলবো বলে , বাজারে আসার নাম করে স্টেশনে বসে কথা বলছিলাম । বাড়ি ফিরতে হবে । বাঙলায় এসো , অনেক ভালোবাসা দেবো ।
সন্দীপন আর জোর করলো না তাকে । শান্ত গলায় উত্তর দিলো
------ সাবধানে যেও । আর রাতে পারলে ফেসবুকটা দেখো ।
সত্যবতী ফোন কেটে দিয়ে এগিয়ে চললো বাড়ির দিকে । এদিকে সন্দীপনের দু চোখে তখনও বাধনহারা অশ্রুধারা বয়ে চলেছে । তার বিশ্বাস হচ্ছে না , কেউ তাকেও এত ভালোবাসতে পারে !!
গভীর রাতে সন্দীপনের কথা মতো ফেসবুকে উপস্থিত সত্যবতী । ম্যাসেঞ্জারে সন্দীপন কে দেখে সে লিখে পাঠায় ,
------ কি গো আজ ফোন করবে না ।
------ বিশেষ মুহুর্ত ফোনে নয় , চোখে চোখে পালন করতে হয় । একটা উপহার ছিল তোমার জন্য ।
সন্দীপন উত্তর দেয় ।
সন্দীপনের কথায় বেশ অবাক হয়েই সত্যবতি লিখে পাঠায় ,
----- উপহার ! কি উপহার ! কোথায় ?
সন্দীপন আর কোন উত্তর দেয় না । কয়েক মিনিট নীরব থাকে সবকিছু আর তারপর সত্যবতীর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে কিছু কথা , কিছু লেখা ...
" বাইরে ঘন শ্রাবণ ধারা ঝরে পড়ে ।।
কাঁচের জানালায় ফোঁটা ফোঁটা , টপ টপ শব্দ করে ।।
ঘরের মধ্যে তারই পাশে বসে সত্যবতী ।। দূরে দাঁড়িয়ে
তার প্রিয় সন্দীপন ।।
সত্য : বরষা আমার বড়ই প্রিয় সর্বদা ।। কি সুন্দর লাগে !! কি দারুন !! যেন কোন বার্তা ভালোবেসে নিয়ে এসেছে কেউ ; ওই মেঘেদের ওপার থেকে ।।
সন্দীপন : তাই বুঝি !! তবে তো হিংসা করতে হয় ।। বৃষ্টির এই সতিনতা আমার জন্য মোটেও ভাল নয় ।।
সত্য : যা: !! কি যে বল ।। বৃষ্টি আমার গান আর তুমি আমার প্রাণ ।। বৃষ্টি জীবনে আনে অনেক খুশি আর
তুমি মুঠো মুঠো আনন্দ ।।
সন্দীপন : এইটি শুনতে চেয়েছিলাম ।। আমি জানি তুমি আমায় কত ভালবাস ...
সত্য : সে কি তুমি কম বাসো আমায় ।।
সন্দীপন এবার দুপা এগিয়ে যায় সত্যের দিকে ।।
সন্দীপন : সাহিত্য , রহস্য এই নিয়েই তো ছিলাম ।। তারপর হঠাৎ তোমাকে দেখলাম ।।
ঠিক যেন একটা হলুদ পাখি সবুজ গাছে বসে অপেক্ষায় মেঘের দিকে চেয়ে ।। নিচ থেকে অনেকেই
মুগ্ধ ভাবে চেয়ে আছে ।। তোমায় একটি বার কাছে পাবে তাই ।।
সত্য : তাই বুঝি !! তাহলে তুমি কেন ডাক দাওনি সেদিন ।।
সন্দীপন : দিয়েছিলাম তবে মনে মনে ।। তারপর একদিন সেই মনের কথাগুলোই চিঠি হয়ে ফুটে উঠলো জীবনে ।।
সত্য : তারপরেও তো মুরোদ ছিল না বলবার ।। ভালোবেসে আমাকে জোর করে কেড়ে নেওয়ার ।।
ভাগ্যিস , সব কিছু বুঝতে পেরেছিলাম আর তাই বলে দিলাম ।।
সন্দীপন : সত্য , তুমি সত্য আমার ।। তোমাকে কাছে পেয়ে জীবন সত্যিই ধন্য আমার ।।
সত্য : একটা কথা বলবে ।। তুমি এত ভাল কেন গো ??
সন্দীপন : হয়ত তুমি এত ভাল তাই ।।
এটুকু বলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল ।। দুজনের মুখে একটাই কথা তখন
আই লাভ ইউ টু " ।।
নীচে লেখা শুভ রাত্রি ।
সত্যবতী আজ শুভ রাত্রি লিখলো না আর , বরং প্রত্যুত্তরে সে লিখে পাঠালো
কবিতার শেষ লাইনটা " আই লাভ ইউ টু " ।।
৩২।।
দিনটা ২০সে অক্টোবর । সেদিন ছিল সত্যবতীর জন্মদিন । আর তারই পাশাপাশি সত্যবতীর জীবনের পরীক্ষা । আসলে পরীক্ষা মানেই ভয় , এই টা বেশ কিছু মাস যাবৎ সত্যবতীর মাথায় গেঁথে গেছিল । সুদূর দিল্লি থেকে সকাল সাতটায় যখন মোবাইল টা চিৎকার করে উঠলো সত্যবতী তখন পরীক্ষা দিতে যাবে বলে সাজুগুজু করতে ব্যস্ত । যাই হোক সবার নজর এড়িয়ে সেদিন সে ফোনটা তুলতে সফল হয়েছিল । রিসিভ বাটন টা টিপতেই ওপাশ থেকে সেই চেনা গলায় ভেসে এলো সেই লাইনটা , যার জন্য এতক্ষন ধরে অপেক্ষা ছিল তার । আসলে ভালোবাসার মানুষটির মুখ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা না পেলে অনেক কিছুই না পাওয়া থেকে যায় ।
----- হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ।
সন্দীপনের গলায় বহু প্রতীক্ষিত কথাগুলো ভেসে এলেও সত্যবতী আজ বিশেষ কিছুই বলতে পারেনি । ফোন কাটার আগে শুধু হালকা কণ্ঠে উত্তর দিলো ,
----- ধন্যবাদ ।
সারাদিন হলবন্দি সত্যবতী যখন মুক্তির আকাশ খুঁজে পেল , ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে । তারপর সেখান থেকে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরার তাড়া । বাসে ট্রেনে চন্দননগর পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যে ৭টা হয়ে গেল । এর মধ্যে সত্যবতীর যে সন্দীপনের কথা একবারের জন্য মনে পড়েনি ঠিক তেমনটি নয় , তবে মা সঙ্গে থাকায় কথা বলার বা ম্যাসেজ করার সুযোগ হয়নি তার । বাসে বা ট্রেনে বসে বা দাঁড়িয়ে , রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে সত্যবতীর মনে হচ্ছিল আর কতদিন এভাবে মায়ের আঁচলের আড়ালে চলতে হবে তাকে । আফসোস করে নিজের মনকে বারবার বলছিল সে ,
" ইস ! আজ যদি সন্দীপন সঙ্গে থাকতো তাহলে কত মজাই না হতো "।
বাড়ি পৌছেই আর সময় নষ্ট করে নি সে । মনের মানুষটিকে একটিবার কাছে পেতে সে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে । ফোন করার তেমন সুযোগ নেই এখন । তাই ফেসবুক একমাত্র সাধন হতে পারে মনের মানুষটার কাছে পৌঁছানোর মনে করে সে ল্যাপ টা অন করলো । এর আগে পর্যন্ত সত্যবতীর মধ্যে এরকম ব্যাকুলতা , উদগ্রীব স্বভাব কোনদিন কারুর চোখে পড়ে নি । কিন্তু ওই যে কথায় আছে , প্রেমে পড়লে সব মানুষ ই বদলে যায় । সুতরাং , সত্যবতীর ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় কী করে ? ফেসবুকে অন হতেই সত্যবতী তো হতবাক !! একদম অন্যরকম এক প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে তার সামনে , সৌজন্যে সেই পাগল ছেলেটা , সন্দীপন –
" আর তো কিছুক্ষন ।। সময়ের পাল্লায় সেই সময় এসে দাঁড়িয়েছে ,
একদিন সন্দীপন যখন নিজের প্রিয় অংশটুকু
সযত্নে পাঠিয়ে ছিল পৃথিবীর কাছে ।।
সেদিন থেকে এইদিন ; সত্য ; ১৩২ খানা ঋতু পেরিয়ে এসেছ
বেড়েছে বয়স , বেড়েছে অভিজ্ঞতা , চিনেছ পৃথিবীটাকে
অনেকটা ।। আরও পথ চলতে বাকি ,
অনেক অধ্যায় জীবনে আসতে বাকি , আমি ধন্য
এ পথে তোমার সঙ্গী হতে পেরে ।।
ভবিষ্যৎ চিনি না ; কিস্সু জানি না
শুধু বুঝি এটুকুই , সত্য , কোনদিন পালিয়ে যাব না
তোমাকে ছেড়ে ।।
২২ এর দোরগোড়া আজ খোলা ।। স্বাগতম জানাতে হয় তোমায় ।। তবে আড়ম্বর দিয়ে নয় ,
এ জীবন্ত দেবীর আজ
অভিষেক হোক সামান্য টুকু রেখে দেওয়া ভালবাসায় ।।
মহাভারত থেকে ব্যোমকেশ ; সর্বত্রই তুমি ছিলে ,
কোথাও প্রেমিকা হয়ে তো কোথাও নায়িকা হয়ে ।।
সত্য , তোমায় ছাড়া ব্যোমকেশ যেমন অধরা ; ঠিক তেমনি
একটুকু সোহাগ ছাড়া এ বুদ্ধিমতি , সত্যবতী আমার --
তার ২২ এর এই মুহূর্ত টুকুও খুবই পাতলা ।।
ডাকহরকরা এসে গেছে , মেঘের চিঠি হাতে নিয়ে --
চোখ খোল এবার : ২২ এর আগের পর্বেও আবার
ব্যোমকেশের জীবনে সত্যবতী ; তোমাকেই যে দরকার ।। "
মেসেজটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনের মধ্যেই আজ কেঁদেছে সত্যবতী । ভাল লাগছে না তার ,মনে হচ্ছে যেন পৃথিবী থেকে কেউ তাকে দূরে সরিয়ে রেখে দিয়েছে আজ । তবু সমস্তটাই নিয়তি বলে মেনে নিয়ে সে পরের দিন আবার বেড়িয়ে পড়েছে পরীক্ষা দিতে । সন্দীপন যেমন লক্ষ তার , তেমনই তার লক্ষ বিন্দু চাকরি পাওয়াটা সন্দীপনেরও যে লক্ষ তাই ...
৩৩।।
আজ রবিবার । সন্দীপন একদিকে ব্যস্ত যেমন ঘরের কাজে , সত্যবতীও সে জানে পরীক্ষা নিয়ে আজও ব্যস্ত আর তাই গুড মর্নিং শোনার জন্য হাজার ইচ্ছা হলেও , সে নিজেকে অনেক সংবরঙ করে রেখেছে আজ । ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটা । প্রতিদিনের মতো মায়ের ফোন এসেছিল আজও । মায়ের সাথে কথা বলে , সে সবে একটু ঘর দুয়ার পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়েছে কি হয়নি আচমকা মোবাইলের শব্দ তাকে আকৃষ্ট করতে শুরু করলো । বেশ স্বাভাবিক ভাবে ফোনটা তুললেও , ওপাশ থেকে ভেসে আসা গলার শব্দে বেশ অবাক হলো সন্দীপন । সত্য ফোন করেছে তাকে ! সে কি ঠিক শুনছে ! স্বপ্ন নয়তো এ কোন ! এসব হাজার প্রশ্ন যখন ভেসে উঠছে সন্দীপনের মনে তখন ওপাশ থেকে ভেসে এলো শব্দ যা তার কানে নয় , ছুঁয়ে গেলো সোজা হৃদয়ে ,
------- হ্যালো । গুড মর্নিং । কি করছিলে ? কোথায় আছো এখন ?
সন্দীপন শান্ত গলায় উত্তর দিলো ,
------- তোমার মনে বসে আছি । তোমার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাজ করছি ।
সত্যবতী বেশ বিরক্ত হয়েই উত্তর দিলো ,
------ মজা করার সময় নেই এখন । তুমি বর্ধমান আসোনি !
------ বর্ধমান !
সন্দীপন বেশ অবাক হয়েই উত্তর দিলো এবার ।
------- হ্যাঁ গো । আমি আজ পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে যখন বসে অপেক্ষা করছিলাম , তখন তোমার মতোই একজনকে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে যেতে দেখলাম । কিছু বুঝতে পারলাম না । মনে হলো যেন তুমি এসেছো এখানে । তাই...
সত্যবতী উত্তর দিতেই , সন্দীপন ফোনের ওপাশ থেকে হা হা হা হা করে উচ্চকণ্ঠে হাসতে লাগলো । তারপর হাসি থামিয়ে বললো ,
------- ভোপাল থেকে বর্ধমান কি কম দূর গো !
সত্যবতী আর কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিলো ,
------- মা কে মিথ্যে বলে একটু আড়াল থেকে ফোন করছিলাম । এখন আসি । সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কল করবো তোমায় ।
এই বলে সে ফোন কেটে দিল । সন্দীপনও পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও সে বেশ বুঝতে পারছিল যে , তার হৃদয়ে যে আঘাত লেগেছে সে আঘাতে আজ দুজনই সমান ভাবে আহত । ভালোবাসার এ অপরূপ অবস্থা এত জলদি যে সে খুঁজে পাবে তা মোটেও জানা ছিল না তার । সেই স্বাদের আরও অংশিদার হতে এখন সন্ধ্যার অপেক্ষাই ভরসা তার কাছে ।
তখন দুপুর প্রায় দুটো । সত্যবতীর ফোন আসবে না আজ আর বাড়ির কাজও শেষ । এমন অবস্থায় সন্দীপন নিজের গদির ওপর শরীরটাকে অল্প এলিয়ে বিশ্রামে মগ্ন যখন , ঠিক তখন ভেসে আসা ফোনের রিংটোনে চেতনা ফেরে তার । লেখালেখির জগতে তার অন্যতম বন্ধু ও ভাই নিজাম আলীর নাম জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনের ওপর । বাড়ি ছাড়ার বহু মাস পরে যোগাযোগ আজ তাদের । ফোনটা নিজামই করেছে । বলে রাখি লেখালিখির জগতে পা রাখার সময় থেকে যে মানুষটির সাথে তার পরিচয় ও ধীরে ধীরে সম্পর্ক গভীর হওয়া , সেই নিজাম । প্রথম থেকেই নজরুল ভক্ত ও নজরুলের আদর্শেই চলে এসেছে ছেলেটি । ঠিক কে ঠিক আর ভুল কে ভুল বলাটা তার অভ্যেস । তাই বহু মানুষের চোখে সে আজও খারাপ । তবে সন্দীপনের সাথে তার মিল বিশাল আর তাই আজও তারা একসাথে চলতে পারছে । অবশ্য নিজামের আরও একটা দিক আছে । তার কথা আর একদিন বলবো ।
বর্তমানে দুজনে মিলে একটি পত্রিকা চালিয়ে থাকে , নাম অপরাজেয় । কিছু মানুষের অহংকার, কিছু পত্রিকাওয়ালাদের দাম্ভিকতার সম্মুখীন হয়ে হঠাৎই ঠিক করলো তারা , গুণমান না রেখে শুধু চেনা পরিচিতির বসে লেখাকে প্রাধান্য দেওয়ার যে রীতি , তা ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে । বজ্র কলমের চার হাত এক করে জন্ম নিল অপরাজেয় । প্রথম প্রথম তারা কিছুই জানতো না। জানতো না কিভাবে একটা সংগঠন বানাতে হয়। শুধু পাঠক, সাহিত্যকে ভালোবেসে তাদের যাত্রা শুরু হলো । নবীন দের নবীনত্ব, প্রবীনের অভিজ্ঞতা কে পাথেয় করে এগিয়ে চললো তারা । তারপর ধীরে ধীরে অনলাইন থেকে অফলাইন সর্বত্র অপরাজেয় হলো তারা । তরুণ কলমচির স্বপ্নের নাম হয়ে উঠলো অপরাজেয় ।
আজ সন্দীপনের বাঙলা ছাড়ার পর দীর্ঘদিন পত্রিকা বন্ধ । নিজামের এই কল সন্দীপনকে ইতিহাস আর বর্তমানের মাঝখানে দাড় করিয়ে রেখে দিল , বেশ কিছুক্ষণ । তারপর তৃতীয়বার মোবাইল বেজে উঠতেই উত্তর গেল ,
----- বল নিজু ।
নিজাম নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো ,
------ কি ব্যাপার গো সন্দীপন দা । অপরাজেয় , নিজাম সব ভুলে অজ্ঞাতবাসে চলে গেলে একদম করে । প্রেম টেম করছো নাকি ।
সন্দীপন মনে মনে মুচকি হেসে উত্তর দেয় ,
----- না ঠিক তা নয় । তবে কি জানিস তো আমি বাংলা ছেড়ে ভোপাল চলে এসেছি । নতুন জায়গা তো তাই সব খেই হারিয়ে যাচ্ছে । তোর খবর বল ? অপরাজেয় নিয়ে কি ভাবলি ?
নিজাম এবার বেশ সিরিয়াস একটা টোন টেনে বলে উঠলো ,
----- সে জন্যই তো আমাকে ফোন করতে হলো । কিছু নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম । সময় আছে শোনার ।
সন্দীপন নিজামের ওই কায়দা করা ভঙ্গিমায় হেসে ফেললো এবার । শান্ত গলায় বললো ,
----- বলো সোনা । ক্যায়া হুকুম হ্যায় মেরে আকা ?
নিজাম এবার সত্যিই বেশ সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিলো ,
------ অনেক ইয়ার্কি হয়েছে । এবার মন দিয়ে শোনো । আমাদের পত্রিকা থেকে উঠে আসা শ্রেষ্ঠ তরুণদের বই বের করলে কেমন হয় ।
নিজামের কথা শেষ হতে না হতে এপাস থেকে উত্তর গেল ,
------ উত্তম প্রস্তাব । তবে অপরাজেয় একা করবে না । বই প্রকাশিত হবে কোন প্রকাশনীর সাথে যৌথ ভাবে ।
নিজাম সন্দীপনের কথায় আপত্তি করলো না কারন সে জানতো যে প্রকাশক হিসাবে তারা রেজিস্টার্ড নয় ।
------ বেশ এ বিষয়ে তুমি দায়িত্ব নাও । কার বই করবে সে সিদ্ধান্ত তোমার হাতেই দিলাম ।
সন্দীপন , নিজামকে অভয় দিয়ে বললো ,
----- তুই নিশ্চিন্তে থাক ।
এই বলে সে ফোন কেটে দিয়ে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আবার ।
৩৪।।
অপেক্ষা আর তপস্বার মধ্যে বড় অদ্ভুত মিল । দুটিই মানুষকে ধীর স্থির হতে শেখায় । দুটি থেকেই লব্ধ যে প্রসাদ , তা বড়ই মিষ্ঠ আর মধুর ; অমৃত বললেও কম হয় । অপেক্ষমান ব্যক্তি আর গুণী তপস্বী নিজের ফল লাভের ঔৎসুক্য সকলকে প্রদর্শিত করে না , ফলে সেই পরম মুহূর্তে দুয়ের হাতেই নেমে আসে চরম সুখ । সাফল্য বিরাজ করে অপেক্ষা আর তপস্বার ছত্রছায়ায় ।
সত্যবতীর সাথে আজ বহুদিন ভালোভাবে কথা হয়নি সন্দীপনের । ভালোবাসার জন্মদিনে কিছু তো দিতে পারেইনি , শুভেচ্ছা জানাতে পারেনি সে । তবু সে দিকভ্রান্ত না হয়ে তপস্বী একজন অপেক্ষমান । দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো আর অবশেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা , তবু সত্য ডাক না দেওয়ায় মনের ভেতর অস্থির হয়ে উঠছিল তার । তবু ওই যোগির মত তপস্বায় মগ্ন সে , সমস্ত মানসিক অবস্থা তাই ক্রমাগত হজম করে চলেছে নিজের ভেতরে , শুধু পাতা জুড়ে কিছু অক্ষরের সারি ফুটে উঠলো সন্ধ্যা তারা হয়ে ,
" অনন্ত এ তপ , বসে চেয়ে মেঘের দিকে
মৃদু বাতাসে বুঝি ডাক এই এলো ধেয়ে
আসে না , তবু অপেক্ষায় যোগির সন্ধানি হৃদয়
সত্যের অমৃতকুম্ভ " ।
তবু সকাল থেকে অনেকগুলো ঘন্টা কেটে গেছে এভাবেই যখন প্রতীক্ষার পারদ ভেঙে পড়ল বরফের বর্ষায় । শীতল মেঘলা বাতাসের আগমনী সংগীত বেজে উঠলো ওই ছোট মুঠোফোনে । তখন সন্ধ্যা প্রায় আটটা ।
------ হ্যালো গলু ।
এটুকু বলেই মিষ্টি হাসির শব্দে কেঁপে উঠলো সত্য ।
উত্তর গেল বিন্দু বিলম্ব ছাড়াই ,
------ হ্যালো । জন্ম দিনের ও পরীক্ষার অনেক অনেক শুভেচ্ছা ।
------ বাবা এত উৎকণ্ঠা কিসের ! আমি কি পালিয়ে গেছি নাকি কোথাও ! তোমার সাথেই তো রয়েছি বলো । তোমার মতো ছেলে পাওয়া আমার অনেক জন্মের পুণ্যের ফল গো । এখন আমিও বলতে পারি আমি খুশি , এখন আমিও সুখি হয়ে দেখিয়ে দিতে পারি ।
সত্যবতী এক বুক আদর মিশিয়ে বলে চললো ।
------ তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে আমিও মুচড়ে গেছিলাম গো । আর তাই আজ পরীক্ষা দিয়ে ফিরেই একটু বাজার যাওয়ার নাম করে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েছি । জানো তোমার লেখাগুলোর মধ্যে প্রাণ আছে । ওই জন্মদিনে লেখা কবিতাটা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ উপহার । থ্যাংক ইউ গলু ।
------- এ আর এমন কি । কি পেরেছি দিতে তোমার প্রথম জন্মদিনে বলো ।
সত্যবতীকে মাঝপথে থামিয়ে সন্দীপন বলে উঠলো ।
সত্যবতী একদম নিচু গলায় , রীতিমতো আদর ভরে জবাব দিলো তাকে ,
------- তুমি ভালোভাবে বাংলায় ফিরে এসো । এর থেকে বেশি কিছু চাই না । তবু যখন তুমি আমায় কিছু দিতেই চাইছো তখন সেটা না হয় যেদিন তুমি প্রথমবার দেখা করতে আসবে আমার সাথে , তার আগে চেয়ে নেবো । যা চাইবো দেবে তো আমায় ?
সন্দীপন ধীর স্বরে উত্তর দিলো ,
------ তুমি চেয়েই দেখো ।
------ বেশ । তাই কথা রইল তাহলে । আজ আসি । শরীর ভীষন ক্লান্ত । ঘুমাবো একটু ।
------ এসো । ভালো থেকো ।
এই বলে মোবাইলের লাইনটা কেটে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ নিজের জায়গায় বসে রইল সন্দীপন । রামায়ন ভীষন স্মরণে আসছে তার । রাজা দশরথ সম অবস্থা তার । প্রতিজ্ঞা , ভবিষ্যতের কোন অজানা প্রতিজ্ঞার জন্য , দশরথকে বহু হারা করেছিল । এখানে সে খুশি হয়েও , সেই অধ্যায়েই বিচরিত বারবার । প্রেমিকার চাওয়া সেই না চাওয়া উপহার আজ শুধুই বিধাতা জানেন আর বিধাতা হাসছে ঘুরে চলা চাকার দিকে তাকিয়ে ।
৩৫।।
সকালের রোদ্দুর , দুপুরের অফিস আর রাতের ঘুম সবই ঠিক চলছিল সন্দীপনের জীবনে । এক নতুন উদ্যমে জীবন এগিয়ে চললো সন্দীপনের জন্য । এর পাশাপাশি সাহিত্য , ম্যাগাজিন সব মিলিয়ে এক অন্য সন্দীপনকে দেখছিল সবাই । কর্ম যার জীবনের শর্ত সেও যে কি করে নিজের ভালোবাসার জন্য সময় বের করে আনে এই ভেবেই সকলে অবাক ।
আজ সন্ধ্যা থেকে চরম ব্যস্ততা সন্দীপনের জন্য । অপরজেয়র পক্ষ থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজ । এরই মাঝে সত্য ফোন করলে সে বলে ,
------- দেখো । আজ এই ম্যাগাজিন এর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিন । তাই নিয়ে আমি একটু ব্যস্ত । কাল ফোন করবো তোমায় , প্রমিস ।
সত্যবতী ঘ্যান ঘ্যান করে ওঠে এতে ,
------ কি এসব ম্যাগাজিন , বই নিয়ে পড়ে থাকো । দেখো আমাকে বিয়ে করতে হলে এসব ছাড়তে হবে তোমায় ।
সন্দীপন , সত্যের কথায় বেশ অবাক হয়ে উত্তর দেয় ,
------- এসব কি বলছো তুমি ! সাহিত্য ছেড়ে দেবো । দেখো বাবু এসব আমার কাছে প্রচণ্ড দামি জিনিস । তবু .... তুমি যখন বলছ , এসব ছেড়ে দেবো । তবে এই কাজটা করে নিয়ে ।
সত্যবতী ফোন কেটে দেয় " বেশ , বেশ "বলতে বলতে ।
সন্দীপন নিজের কাজে ডুবে যায় আবার । ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে । ঘন ঘন ফোন আদান প্রদান চলে এরই মধ্যে । প্রচুর তর্ক বিতর্কের পর , অপরাজেয়র পক্ষ থেকে প্রায় রাত ৯ টায় পোস্ট করা হয় ,
" শীঘ্রই আসছে দুঃশাসন ধরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ; প্রকাশক সারমেয় , সহযোগিতায় অপরাজেয় " ।
শুভেচ্ছা বার্তার বর্ষায় শীঘ্রই ভিজে উঠলো চারপাশ । সন্দীপনের আনন্দ এবার দ্বিগুন হলো , চতুর্গুন হলো , পঞ্চগুলো হলো ; যখন জেগে থাকা ওই রাতে মেঘ পিয়নের চিঠি এলো নেমে ; শুভেচ্ছা অফুরান। সাথে ডাক দিয়ে উঠলো বোকা মুঠো বন্দি যন্ত্রটা । সত্যের ডাকে সত্যটুকু উপেক্ষা করেই বন্ধ হলো ফেসবুক ; চললো কথা বাইরে আর ভেতরে উঠলো ঝড় যার আভাস সে রাতে পায়নি সম্পাদক । তখন শুধুই কথা বলা ।
------- সরি । আমি একটু বেশিই রেগে গেছিলাম তখন
ওপাশ থেকে বললো সত্যবতী ।
------ সরি বলতে নেই গো । তোমার ভালো লেগেছে , এই তো অপরাজেয়র জন্য শ্রেষ্ঠ । কবিতা , সাহিত্যের এই পৃথিবীও মানুষের জন্য । ওদের শিক্ষা দেওয়া , এ কি খারাপ কাজ বলো ।
রাতের নীরবতা ভেদ করে ফিসফিসিয়ে ভেসে এলো সন্দীপনের বাক ।
------ তবে নিজের দিকটাও দেখতে হবে তো গলু । সংসার ধর্ম পালন করা এক অতীব কঠিন কাজ । আমাদের বিয়ে , তারপরের প্রজন্ম এসবের প্রতি দায়িত্ব তো কম নয় বলো । সাহিত্যের সেবক হও , নিশ্চিন্তে হও ; কিন্তু যে লাল সিঁদুর পড়িয়ে আমার দায়িত্ব তুমি নিতে চাইছো তার দিকটাও তো ভেবে দেখা উচিত তোমার , তাই না । ভালোবাসার প্রতি আমার যে দায়িত্ব তার পালন করতে গিয়েই এত কিছু বলতে হচ্ছে তোমায় । আমাদের সংসার সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে , আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন যে সন্তান আসবে আমার গর্ভে তার ভবিষ্যৎ সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে । সাহিত্যর প্রতি তোমার যেমন দায়িত্ব আছে , তেমনই স্বামী হিসাবে দায়িত্ব , বাবা হিসাবে দায়িত্ব ; এসব উপেক্ষা তুমি করতে পারো কি ?
তাই , বাঁধা দেবো না তোমায় । শুধু বলবো হিসাবি হও । এবার ঘুমিয়ে পড়ো সোনা । অনেক খাটনি খেটেছো আজ । শুভ রাত্রি ।
সত্যবতী ফোন কেটে দিলেও , সন্দীপন বাকহীন পড়ে রইল দীর্ঘক্ষণ । মনে মনে ভাবনার স্রোত তার মধ্যে উত্থাল পাতাল করছে এখন । সত্যের কথার মধ্যে এক অন্য সত্য খুঁজে পাচ্ছে সে । সময়ের সাথে সাথে সত্য হয়ে উঠছে তার ভবিষ্যৎ , সত্যের কথাতেও তাই খুঁজে পেয়েছে সে । তবু সাহিত্য ! স্বপ্ন ! ভ্রমন দেশ দেশান্তরের পথে , মানুষের জীবন সভ্যতা --- এসবের কি হবে এমন দোলাচলের মধ্যে কখন নিদ্রা দেবী তার চোখে নেমে এসেছে সে টেরও পাইনি আজ ।
৩৬।।
" একটা ভোর যখন আবার বাঁচতে শেখায় । শুধু খেয়াল রেখো ভোরটুকু না সমাধিস্থ করে দেয় কেউ মাঝরাতে । অপেক্ষায় থেকো অক্ষরেরা , ফিরবো আবার মানুষের মন্দিরে । ফিরবো তবে আগে অপেক্ষাকে বলে এয়েছি গো
অপেক্ষায় বেঁচে থেকো " ।
আজকের সকালের মিঠি মিঠি হাসি বড়ই রহস্যময় । ঘুম চোখ বন্ধ করেও সন্দীপন দিব্বি শুনতে পাচ্ছে তাদের আগমনি । তারই মাঝে সকালের চা হাতে গরম গরম ডাক আসে ,
------- গুড মর্নিং গলু ।
চোখ খুলে কানে টেনে নেওয়া মোবাইলটা হাই তুলে উত্তর দেয় ,
------ গুড মর্নিং ।
------ এখনো ওঠো নি । আর কত ঘুমাবে শুনি । এবার কিন্তু ভোপালের জলের ট্যাঙ্ক উল্টে দেবো মাথায় ।
উত্তর আসে দূর থেকে । ধরমরিয়ে উঠে বসে সন্দীপন ।
------ নাআআআআ ।
চিৎকার করে জানায় সে ।
সত্যবতী হা হা করে হাসতে শুরু করে এবার । তারপর হাসি থামিয়ে নিয়ন্ত্রিত উত্তর দেয় ,
------- বাবা । এত ভয় ....
সত্যবতীর কথা শেষ না হতেই উল্টো দিক থেকে ভেসে আসে ভয়ের এক স্বর ,
----- আমায় মেরে ফেলবে । মেরো না । মেরো না । আমি কিছু করিনি ।
সত্যবতী সন্দীপনের চিৎকার শুনে বেশ ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে ,
------- কি হয়েছে গলু ! কারা মেরে ফেলবে ! কি হয়েছে বলো ।
কিছুক্ষণ কোন শব্দ আসে না ফিরে । তারপর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় , ধীরে ধীরে আওয়াজ ফিরে আসে আবার ,
------ কিছু না । স্বপ্ন .... কিছু জন আমায় মারবে বলে তাড়া করেছে । আমি দৌড়াচ্ছি আর পিছনে ওরা । এখন কেউ নেই কোথাও .... স্বপ্ন ছিল .... স্বপ্ন বাস্তব হয় না কোনদিন ।
সন্দীপন থেমে থেমে হলেও বলে চলেছে ,
----- অফিস বেরোবো গো । আসি এখন ।
----- হ্যাঁ এসো । দুগ্গা দুগ্গা । সাবধানে যেও ।
মন না চাইলেও সত্য ফোনটা কেটে দিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসে নিজের কামড়ায় । ওদিকে সন্দীপন স্নান সেরে তৈরি হয়ে অফিস বের হয় ঠিকই ; তবে একটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে , " সব স্বপ্ন সত্যি হয় না , কিন্তু , সকালের ???
অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে আজ উৎকণ্ঠা পিছু ছাড়ে নি তার । বারবার মনে হচ্ছে যেন এক অশুভ কিছু হতে চলেছে । তার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ট্রেনিং চলাকালীন মন আজ অন্যমনস্ক । এসব কিছুই নজর এড়ায়নি ট্রেনার মিস্রাজির । তবু সব সইছিল এতক্ষন সব । এবার আর না পেরে সন্দীপনকে ভরা ক্লাসের মাঝেই জিজ্ঞাসা করলেন ,
----- দাদা কেয়া বাত হ্যায় ! আজ বড়ে বেচয়ন লগ রহে হো ।
বেশ কয়েকবার জানতে চাওয়া হলেও , সন্দীপন নিজের খেয়ালেই এড়িয়ে গেল সব ।
তখন সন্ধ্যে ৭ টা । নিজেকে একটু হালকা করতে একটা সিগারেট ধরিয়ে সবে দু টান দিয়েছে সে , মোবাইল বেজে উঠলো হঠাৎ । সন্দীপন নিজেকে শান্ত রাখতে বেশ কয়েকবার ফোনটা এড়িয়ে গেলেও , দশম কলের পর ধৈর্য চ্যুতি হলো তার । মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতেই নিজামের নাম স্ক্রিনের ওপর জ্বলজ্বল করতে দেখলো সে । আস্তে করে সবুজ বোতামটা টিপতেই প্রচন্ড চিৎকার ভেসে এলো ওপার থেকে ,
----- এ তুমি কি করলে সন্দীপন দা ? উই হ্যভ বিন রুইন্ড । ফেসবুক দেখো এখনি ।
নিজামের কথাগুলো সন্দীপনকে প্রায় অর্ধেক মেরে ফেলেছিল , আর বাকিটা ফেসবুক পোষ্ট পূরণ করে দিল । সারা রাত ধরে আগুনে ছারখার হওয়া অপরাজেয় তার মন ভেঙে চুরমার করে দিল । এ ভয়ানক অগ্নি কাণ্ডের উৎস , সারমেয় প্রকাশনীর কর্ণধার রূপময় ঘোষের পোষ্ট ,
" অপরাজেয় পত্রিকা তরুণদের ভুল বুঝিয়ে লেখা নিচ্ছে । দুঃশাসনকেও লেখা দিতে বাধ্য করা হয় । আমাদের অনুমতি ছাড়াই আমাদের নাম প্রকাশক হিসাবে ব্যবহার করা হয় । ফেসবুকে সেটি পোস্ট করে জানিয়েও দেয় অপরাজেয় কর্ণধার সন্দীপন দত্ত । অথচ লেখকের প্রাপ্য কি সে নিয়ে তারা আমাদের সাথে কোন আলোচনা করে নি । লেখককেও এ বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয় । আইনত ব্যবস্থা নিতে পারতাম , তবে সন্দীপনের সাথে আমাদের সম্পর্কের খাতিরে আমরা সে পথে হাঁটছি না । লেখকের কাছেও আমার অনুরোধ তারা এ পথ থেকে বিরত থাকুন । তার বই তার সম্মতি নিয়ে সারমেয় ভবিষ্যতে নিশ্চই প্রকাশ করবে ।
ধন্যবাদ " ।
৩৭।।
সারাটা শরীর জুড়ে আজ শুধুই ব্যর্থতার প্রতীক । হতাশ হয়ে বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা । আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে , সে চলে গেলে সত্যবতীর কি হবে । আবার মনে হচ্ছে সত্য এতে মুক্তি পেয়ে যাবে এই দায়িত্ব হীন মানুষটার থেকে । কাল কি কি হয়েছিল তার প্রমান তো নেই যে সে কোন আওয়াজ তুলবে , ওই রূপময়ের বিরুদ্ধে । কিন্তু এও তো ঠিক , আজ সে চুপ করে গেলে কাল এই একই জিনিস অন্যের সাথেও হবে । কিছুই মাথায় আসছে না তার আর তাই সত্য থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় মনে হলো তার । আস্তে আস্তে ম্যাসেজ করে লিখে পাঠালো সে , যেন আজ তাকে একটু একলা ছেড়ে দেয় সত্যবতী ।
অন্যদিকে সত্যবতী মুঠোফোনে আসা ম্যাসেজটি পড়েই আঁতকে উঠলো । মনে এক অদ্ভুত চিন্তা স্থান করে নিলো তার । পড়ার টেবিলে বসে থাকলেও মন এক অন্য দিকে প্রবাহিত হচ্ছে । সুযোগ বুঝে এক দু বার ফোন করলো কিন্তু কেউ তুললো না । এতে চিন্তা আরও গভীর হলো । হোয়াটস এপ থেকে ম্যাসেজ করলেও আজ শুধুই ব্যর্থতা ফিরে এলো । একদিকে ভেঙে পড়া ছেলেটা যখন নীরব বসে আছে তখন অন্যদিকে সত্যের মনে এক অদ্ভুত ছটফটানি । ফেসবুকের পাতা খুলে ভেবেছিল একবার শুভ দা কে জানাবে , কিন্তু সেখানে ইতিমধ্যেই ছেড়ে যাওয়া সন্দীপনের লেখাটি তাকেও স্ট্যাচু করে দিলো এই ভর সন্ধ্যায় ,
" আমি বিদ্রোহী
বিদ্রোহ করেছি নিজের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করেছি নিজের বস্তা পচা আদর্শের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করেছি এমন হাজার হাজার
নীতির বিরুদ্ধে যা এতদিন ধরে জন্ম দিয়েছে
এক পঙ্গু সমাজ , পঙ্গু সংস্কৃতির ।
আমি বিদ্রোহী
হাজার হাজার অভিশাপ তাই আমার মাথায়
সিঁদুর হয়ে জড়িয়ে থাকে
সত্যি , সমাজের কাছে বরাবরই দায়
অসহায় করে দেয় যে অসহ্য দাওয়াই ।
বন্ধুগন , আমি জানি
এই সমাজ আমাকে নাম দেবে না ,
সম্মান দেবে না
কোন মনে আমি আশ্রয় পাবো না
হৃদয়ের ভালোবাসা পাবো না
সবাই আঙ্গুল তুলবে আর চিৎকার করে
আমায় পাগলের শ্রেণীতে স্থান দেবে ---
কারন
তারাও ভীত আমার এই সামন্তী আগ্রাসনে ।
তাই আমি বিদ্রোহী , কলম আমার অস্ত্র
স্বপ্ন ভালোবাসাময় সংসার " ।
সত্যবতী কিছুই বুঝতে পারছে না , শুধু সকালের স্বপ্ন সত্যি হলো না তো ছাড়া । সাহস করে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে হতাশ যখন সে , তখন হঠাৎই মোবাইলে ভেসে উঠলো একটা ম্যাসেজ , সন্দীপনের । রূপময়ের পোস্টটা পাঠিয়েছে সে , সাথে লেখা ; আই নিড হেল্প প্লিস । প্রতিটি অক্ষর সত্যবতীর দুচোখ ভিজিয়ে দিয়ে গেলো বারবার । সে বিশ্বাস করে ওই অক্ষরগুলো এক বিন্দুও সত্যি । আর তাই সন্দীপনকে ফোন করে বসলো সময় নষ্ট না করে । সন্দীপন কিছু বলার আগেই বললো ,
------ আজ বিশ্রাম নাও । তুমি সত্য যখন , তখন সত্য বলছে তোমার কিছু হবে না । আর শোনো , নিজের আনন্দের পাশাপাশি এবার থেকে নিজের উড বি কে দুঃখগুলো শেয়ার করতে শেখো । আর কোন কথা নয় । চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ো । কাল সব শুনবো । সকালে ফোন কোরো , দশটার পর । গুড নাইট গলু ।
৩৮।।
পরের দিন সকাল মোটেও স্বাভাবিক ছিল না সন্দীপনের জন্য । হতাশা যে এখনও গ্রহণ ঘটিয়ে রেখেছে তা তার চেহারা দেখলেই স্পষ্ট । তবু তো সকলকে স্বাগত জানাতে হয় নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে । সন্দীপনও তাই করলো । দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে এলে সত্যবতীর ফোন এসে হাজির হলো । তখন প্রায় সাড়ে দশটা । সন্দীপন বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই , কি করে তাকে বলবে কি ঘটে গেছে । তবু বলতে হবে , কারন সত্যবতী না জেনে ছাড়বে না কিছুতেই । অগত্যা সব বলে দিল সে , বসন্তের বুকে কিভাবে শীতের প্রলেপ আটকে দিয়েছে ওরা ।
সব শুনে সত্য বললো ,
----- রূপময়ের পোষ্টটা একবার দেখতে পারি ।
সন্দীপনের মনে তখন অদ্ভুত দোলাচল । একবার মনে হচ্ছে , কি হবে দেখিয়ে আবার মনে হচ্ছে , সত্যকে না দেখানো কি উচিত হবে একফোঁটাও । এই গভীর ভাবনায় চুপ করে গেছে সে , নিস্তেজ হয়ে পড়েছে যেন ।
ওদিকে সাড়া না পেয়ে , সত্যের মনে চিন্তা বেড়ে চলেছে । সে বেশ বুঝতে পারছে যে কতটা অসহায় হলে , একজন মানুষ এতটা ভেঙে পড়তে পারে । সে ধারণা করতে পারছে সন্দীপনের অবস্থা ঠিক কি হয়ে আছে এখন । তবু যদি তার কথায় কিছুটা সাহস জন্ম নেয় , এই ভেবে সে আস্তে করে বললো ,
------- দেখো , ভেঙে পড়ে তো কোন লাভ নেই । উঠে দাঁড়াও । প্রতিবাদী হও । তুমি তো অন্যায় করো নি , তাহলে ভাঙছো কেন !
সন্দীপন এতক্ষনে ধীর কণ্ঠে উত্তর দিলো ,
------ প্রতিবাদ ! কে শুনবে প্রতিবাদ । সবাই তো তারই পক্ষে । রূপময়ের ওয়ালে গিয়ে দেখো , কত মানুষ তার দিকে । কত মানুষ তার পক্ষে ।
------ সকলে নয় । নিজের এই হবু স্ত্রীর কথা ভুলে যেও না । সুখে দুঃখে স্বামীর পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীর দায়িত্ব । তুমি ভাবছো আমি স্ত্রী হলাম কবে ! তবে শোনো পরিনিতা হতে মনের মিলন প্রয়োজন । আর আমাদের সে মিলন আগেই হয়েছে । তাই ওঠো , প্রতিবাদ করো ।
সত্য উত্তর দিলো । তবে সন্দীপনের কোন উত্তর এলো না আবার । সত্য উল্টোদিক থেকে যখন ক্রমাগত ডাক দিয়ে চলেছে তখন ফেসবুকে আসা কিছু লাইন উত্তর হয়ে ভেসে উঠলো সামনে তার । একদিকে ওই পোষ্ট আর অন্যদিকে সন্দীপনের গলা ,
------ আমরা করবো জয় , নিশ্চয় ।
এই বলে সন্দীপন ফোন কেটে দিলেও , ফেসবুক জুড়ে যে বিস্ফোরণ হয়েছে এই মাত্র সত্যবতী অবাক হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে শুধু ,
" বিপ্লব আসে না প্রেমহীনা
ভালোবাসা বিদ্রোহ জাগায়
নিজের বলে কাছে ডাকে নি যাকে
তার জন্য কি জীবন দেওয়া যায় !!
আমি বিদ্রোহী হয়েছি
তোমার ভালোবাসা আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে
নারী যন্ত্রনা , দারিদ্র , মানবিকতা চিনিয়েছে ।
আমি ভালোবেসেছি তোমায়
খাঁটি ভালোবাসা
আর তাই বিপ্লবী পাগল মন বারবার
বেঁচে উঠেছে বিদ্রোহী হয়ে প্রেমে -- মানুষের ।
আজ থেকে অপরাজেয় ঘোষণা করছে ; সর্বত্র বয়কট হোক টিম সারমেয় । অপরাজেয় কোন অবস্থায় সারমেয়র সাথে কোন কাজ করবে না ।
সম্পাদক
অপরাজেয় পত্রিকা "
সন্দীপনের ঘোষণায় আগুন জ্বলে উঠলো সারা সাহিত্যের বাজারে । সারমেয় ও অপরাজেয় ; সন্দীপন ও রূপময় ; দুপক্ষই তখন এক প্রতিষ্ঠিত নাম , দুপক্ষই অনলাইন দুনিয়ায় বাজার কাপাচ্ছে যখন , তখন এই বয়কটের ডাক এক নতুন কুরুক্ষেত্রের সূচনা করবে সাহিত্যের বাজারে তা আর বলতে বাকি থাকে না । তবু এত কিছুর পরেও সারমেয়র চুপ করে থাকাটা সন্দীপন ঠিক মেনে নিতে পারছিল না ।
ওদিকে সারমেয়র ওপর নেমে আসা এই অস্থির সময়ে নিজেদের সংযত রাখতে রূপময় বিকেল ৫টায় একটি টেলি মিটিংয়ের ডাক দেয় । মিটিংয়ের খবর সারমেয় গোষ্ঠীর রূপশ্রী সেন , দেবাঞ্জন হালদার ও লেখক দুঃশাসনকে ডাকা হয় । সেই মতো সকলেই হোয়াটসএপে ঠিক ৫টায় টেলি কনফারেন্স-এ যোগ দেয় । সভার প্রথমে সকলকে স্বাগতম জানিয়ে বক্তব্য রাখতে বলা হয় দেবাঞ্জনকে । জলপাইগুড়ি থেকে যোগ দেওয়া দেবাঞ্জন হালদার সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু করেন ,
------ দেখুন , অপরাজেয় আমাদের বয়কটের ডাক দিয়েছে । আমি জানি এতে আমাদের কিছু আসবে যাবে না । কিন্তু আমাদের সম্মান ওরা মিথ্যা গল্প ফেঁদে নষ্ট করার যে প্রচেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়ানো দরকার । ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সমস্ত সত্যি কথা আমাদের পাবলিকলি তুলে ধরা উচিত ।
------ দেবাঞ্জন একদম ঠিক বলেছে । আমাদের সম্মান আগে দেখা উচিত ।
রূপশ্রী , দেবাঞ্জনকে সমর্থন করে উত্তর দেয় ।
------ একদমই তাই । বাজারে যেমন রটবে , লোকে তেমন খাবে । এটা ভুলে গেলে চলবে না ।
দেবাঞ্জন বলে ।
রূপময় চুপ করে সব শুনে যাচ্ছিল । এবার সে মাথা তুলে তাকালো একবার । তারপর আস্তে আস্তে মাইকটা কাছে টেনে নিয়ে বলতে শুরু করে ,
----- তোমাদের স্বাধীনতায় আজ অবধি আমি হস্তক্ষেপ করি নি , আজও করবো না । তাই তোমরা যা ইচ্ছে করতে পারো । তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন কিছু বলার পক্ষপাতি নই । আমাদের কাজ আমাদের পরিচয় হবে এ আমি বিশ্বাস করে এসেছি আর আজও করি । সঠিক কাজের মধ্যে দিয়ে সারমেয়র সম্মান বেঁচে থাকবে ।
এইটুকু বলে সে মিটিং ঘোষণা করে দিলো ।
সেদিন বিকেলের মিটিং শেষ হয়ে গেলেও , সবকিছু শেষ হলনা সে বিকেলে । রূপময়কে সকলে ফোন করে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো যাতে সে মুখ খোলে , বক্তব্য রাখে পাবলিকলি । কিন্তু সে রাজি হলো না । অবশ্য এ কাজে সে বাকিদেরও বাঁধা দিলো না ।
অবশেষে সেদিন সন্ধ্যায় ফেসবুকে নেমে এলো দেবাঞ্জনের এক ঘোষণা ,
" ঠগ , জোচ্চর হতে সাবধান । অপরাজেয় করার নাম করে এক সম্পাদক লেখকদের ঠকাচ্ছেন । তাদের বয়কট করুন আজই এখনই " ।
জবাব এলো প্রায় শেষ সন্ধ্যায় , সন্দীপনের পোষ্ট হয়ে তার দেওয়ালে ।
" আমার পরাজয়ের স্বাক্ষী এই শহরের প্রতিটা মঞ্চ । প্রায় অধিকাংশে যাই , পিছনের সিটটায় বসি আবার ফিরে আসি । দেখি মঞ্চের ওপরে কত ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডস , তাদের কত কত কমেন্টস । সামনের সারিতে ভুড়ি ভুড়ি লাইকস । স্ট্যাটাসগুলোর অনেক ফলোয়ার্স । আমার সঙ্গে স্বপ্ন শুধু ।
পিছনে বসে থাকা একাউন্টটি জানে তার ক্ষমতা । তেল কেনার পয়সা নেই । তাই একাডেমি বা নন একাডেমি কোনটাই স্বপ্ন জাগায় না । পিছনের সিটটাতেই খুশি একটি আশায় -- একদিন সন্ধ্যা তারা হয়ে লগ ইন করলে , মানুষের ভিড় দেখতে পাবে , নিজেরই কবরে ।
এর থেকে বড় অপরাজেয় কি কেউ হতে পারবে " ??
৩৯।।
ভয়াবহ এই অগ্নি স্রোতে বাংলা সাহিত্যের যে একটি বড় ক্ষতি হতে চলেছে তা বলার দাবি রাখে না । একদিকে যেমন সারমেয় বারবার পোষ্ট করে চলেছে এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে অপরাজেয় একটি মিথ্যে প্রতিষ্ঠান , তেমনই অন্যদিকে সন্দীপন বারবার সারমেয়র দিকে আঙ্গুল তুলে চলেছে এই ঘটনার জন্য । অবশেষে হঠাৎ ই রূপময় ফেসবুকে পোষ্ট করে জানায় সেদিন কিভাবে অপরাজেয় দুঃশাসনকে মিথ্যা বলে তার লেখা তুলে নিয়েছিল তার কাছ থেকে । কমেন্টস করে দুঃশাসন সায় দেয় তার কথার । সন্দীপন পোষ্টটি দেখা মাত্র রেগে আগুন হয়ে ওঠে এবং নতুন একটি পোস্টে সব লিখে পাবলিককে জানাবে বলে মনস্থির করে । এদিকে রূপময় পোস্ট করলে নিজাম তৎক্ষনাৎ ফোন করে সন্দীপনকে । নিজামের কল প্রথমে রিসিভ না হলেও , দু তিন বারের প্রচেষ্টায় তুলে নেয় সন্দীপন এবং রেগে তেলে বেগুনে হয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে ,
------ কিসব অসভ্যতামি শুরু করেছে দেখছিস ? আজ এদের সমস্ত সত্যি ফেসবুকে খুলে দেবো । মুখোশ টেনে ছিড়ে দেবো দেখ ।
নিজাম সন্দীপনের সব কথা মন দিয়ে চুপ করে শুনছিলো এতক্ষন , এবার শান্ত হয়ে বললো ,
----- তুমি , সত্যবতী দিদিকে লাইনে নাও । আমি জানি তুমি কাউকে কিছু না জানাও , দিদিকে ঠিক বলেছো । তারপর কিছু কথা বলবো । তোমরা দুজনেই স্থির করো , আমি ঠিক না ভুল । এভাবে একা একা তোমায় বোঝাতে পারবো না আর তোমার একটি পদক্ষেপ এই মোক্ষম সময়ে ওদের পক্ষে লাভজনক হতে পারে । মনে রেখো , রূপময় অনেক চিন্তা ভাবনা করে , পরিকল্পনা করে এই চাল দিয়েছে । তাই মাথা ঠান্ডা করো । দিদিকে লাইনে নাও ।
সন্দীপন তখনও রাগে ফুঁসছে । নিজামের কথায় কান না দিয়ে সে রেগে উত্তর দিলো ,
------ দিদির কি প্রয়োজন । যা বলার আমাকে বল ।
নিজাম এবার বেশ গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো ,
------ তুমি দিদিকে কনফারেন্সে নেবে কি না ! বলেছি না , আমার একার পক্ষে তোমাকে বোঝানো সম্ভব নয় । আর যদি এটা না করো , আমি আর কিছু বলবো না । তোমার যা ইচ্ছে হয় করো । কিছু উল্টো হয়ে গেলে সব দায় কিন্তু তোমার ।
সন্দীপনের কাছে অগত্যা আর কোন উপায় রইল না । একপ্রকার বাধ্য হয়ে সত্যকে ফোন লাগালো সে । সত্যবতী তখন নিজের ঘরে বসে পড়াশুনা করছে আর বাবা মা দুজনে বেরিয়েছে একটু তখন , ঠিক এমন একটা সময়ে প্রিয় মানুষের ফোন এলে কেউ কি দেরি করে । কানে এয়ারফোনটা লাগাতেই ওপাশ থেকে এক কম বয়সী গলা ভেসে এলো ,
------ নমস্কার দিদি । আমি নিজাম । সন্দীপন দার ভায়ের মতো । পত্রিকা নিয়ে যে গন্ডগোল চলছে তা তুমি সবই জানো । সহ সম্পাদক হিসাবে কিছু উপদেশ দিতাম , কিন্তু আমি জানি দাদা নিজের ছাড়া তোমার কথা মানে । যদি মনে হয় আমি একটুও ভুল , মানা করে দিও ; আর নাহলে সন্দীপন দা কে বুঝিয়ে বলে দিও একটু , প্লিস ।
সত্যবতী বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তা করে নিল আর তারপর উত্তর এলো ,
----- হ্যাঁ , আমি সবই জানি । এও জানি এই লড়াই এক অতি ভয়ঙ্কর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে । একে থামানো দরকার নাহলে ....
আবারও কিছুক্ষন নিজের মনের মধ্যে কিছু ভাবনা ভেবে নিয়ে সে বললো ,
------ শুনি । তুমি কি বলতে চাও ।
সন্দীপন এতক্ষন চুপ ছিল । এবার সেও সত্যের কথায় কথা মিলিয়ে বলে উঠলো ,
------ এবার বলে ফেলো দেখি । দিদিও আছে সামনেই । বলে ফেলো ।
নিজাম কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিলো ,
------ সরাসরি ওদের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করো সন্দীপন দা ।
------ সে কিরকম ?
নিজামের কাছে জানতে চায় সত্যবতী ।
নিজাম শান্ত গলায় বলে যে ওরা যে পোষ্ট করেছে তার কমেন্টসে দাদা সমস্ত আসল ঘটনা দিক । এতে ওরা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হবে নতুবা এই পোষ্ট করা থেকে সরে যাবে । ত্রিসম্মতিক্রমে ঠিক করা পরিকল্পনা সেদিন এভাবে কাজ করবে ভাবে নি তারা । অপরাজেয় সম্পাদক কমেন্টসে লিখে জানায় সেদিন কি ঘটেছিল । সে রূপময়কে প্রশ্ন করে যে সেদিন সে রূপময়কে ফোন করে নি ? রূপময়কে সব পরিষ্কার করে বলে নি ? রূপময় আংশিক সম্মতি জানায়নি সেদিন এ বিষয়ে ?
এরপর দিন কেটে রাত নেমে এলেও রূপময়ের পক্ষ থেকে এই সমস্ত কোন উত্তর বা ঘোষণা আসে না । ফেসবুক নিস্তব্ধ হয়ে যায় , ঠিক যেন ঝড়ের পূর্ব মুহূর্ত কোন । অপেক্ষা চলছিল যখন সন্দীপন , সত্যবতী আর নিজামের দিকে ; তখন প্রায় রাত দশটায় এক ভিডিও কনফারেন্সে মিলিত হতে আহবান জানায় রূপময় ঘোষ ।
----- আমরা এই গভীর রাতে আজ এখানে কেন মিলিত হয়েছি , জানা আছে ? না । নেই । কেউ জানে না । শুধু আমি ছাড়া । কিছু কথা আজ তোদের সকলের সাথে ভাগ করে নিতে চাই । সারমেয় আজ সত্যি বিপদের মধ্যে ।
রূপময় বলে চললো আর বাকি সকলে চুপ করে শুনে চলেছে তার কথা ,
------ আজ আমি সেই রাতের সমস্ত ঘটনা বলছি । এর অনেকটাই তোরা জানিস না । তোদের আমি বলেছিলাম যে সন্দীপন আমায় ফোন করে বই করাবে বলেছিল । বলিনি যেটা তা হলো সন্দীপনের কথায় আমিও সম্মতি দিয়েছিলাম । আমি পরের দিন ফেসবুকে ওই পোস্ট করে অন্যায় করেছি । তাই সারমেয়তে থাকার কোন অধিকার আমার নেই ।
বাকিরা বেশ অবাক হয়ে একসঙ্গে বলে ওঠে ,
------ তুমি ছাড়া সারমেয় অনাথ হয়ে যাবে ।
কিন্তু রূপময় কারুর কথা না শুনে ফেসবুকে নিজের ইস্তাফার কথা ঘোষণা করে দেয় , অবশ্য কারণটা অজ্ঞাত-ই রেখে দিয়েছিল সে ।
গভির রাতে ফোনটা বেজে উঠতেই সন্দীপন এক ঝটকায় সেটি রিসিভ করে চিৎকার করে ওঠে , য়াহু । ওপাশ থেকে সত্যবতী শান্ত গলায় একটা মিষ্টি হাসি হেসে বলে ওঠে ,
------ জয় মুবারক । আমি জানতাম আমার গলু কোনদিন ভুল করতেই পারে না । তাই সে জিতবেই জিতবে । এবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো । কাল অফিস যেতে হবে তো আবার ।
সত্যবতী ও সন্দীপন পরস্পরকে ভালোবাসার তিনটে শব্দ বলে ঘুমিয়ে পড়ে এরপর ।
৪০।।
আজ ৪ঠা নভেম্বর । এ জি অফিসে ছুটির জন্য দরখাস্ত আগেই করেছিল সে । সেই অনুযায়ী সাত থেকে এগারো তার ছুটি মঞ্জুর করে অফিস । আজ রাতের ট্রেনে রিসার্ভেশন আগেই করা ছিল । তাই সেদিক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে জামা কাপড় প্যাকিং নিয়েই ব্যস্ত সে । অফিস থেকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বেড়িয়ে পড়ে সে আজ । তারপর কিছু জিনিস কিনে নিয়ে পৌঁছে যায় নিজের ফ্ল্যাটে ।
সন্ধ্যা থেকেই কাজ চলতে থাকে দ্রুত গতিতে । একটা ব্যাগে জামা প্যান্ট , মা ও মাসির জন্য কিনে আনা শাড়ি প্যাকিংয়ে ব্যস্ত যখন সে আজ , তখন মায়ের ডাক এসে উপস্থিত হয় তার ফোনে । ফোন রিসিভ করে বেশি কথা বলার সুযোগ পায়নি সে , শুধু জানায়
----- আজ রাতে ট্রেনে চাপবো । ওই ১১:৩০ । ওখানে পৌঁছাবো রবিবার সকালে । একটু পড়ে স্টেশন যাবো । তখন ফোন করছি ।
মা বেশ কড়া গলায় বলে দেয় ,
----- রাস্তায় বেড়িয়ে ফোন করতে হবে না । রাতে ট্রেনে চেপে কল কোরো একটা আর সাবধানে এসো । দুগ্গা দুগ্গা ।
এই বলে মা ফোন কেটে দেয় । সন্দীপন আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
তখন রাত ১০:৩০ । স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই সে বুঝে নেয় , অনেকখন অপেক্ষা করতে হবে আজ ; কারন ট্রেন ১ ঘন্টা লেট ঘোষণা হচ্ছে মাইকে । ঘোষণা শুনতে শুনতেই তাই সে ওয়েটিং রুমের দিকে পা বাড়ায় এবার ।
ওয়েটিং আর কতক্ষন করা যায় । তাই মোবাইলটা বের করে সত্যবতীকে ফোন করে সে । ফোনের সন্দীপনের নাম ভেসে উঠতেই সত্য এক লাফ দিয়ে সেটা তুলে নেয় , তারপর বলে ওঠে ;
----- ট্রেন এলো ? কবে আসছো তুমি ?
সত্যর অবস্থা দেখে তার মা পাস থেকে হো হো করে হেসে ওঠে কিন্তু সে ধমক দিয়ে মা কে চুপ করিয়ে দিয়ে আবার বলে ওঠে ,
----- কবে আসছো তুমি ?
সন্দীপন এতক্ষন পরিস্থিতির মজা নিচ্ছিল । এবার শান্ত গলায় উত্তর দেয় ,
----- রবিবার । স্টেশনেই বসে আছি । ট্রেন লেট আছে । প্রায় ১ ঘন্টা । আচ্ছা তুমি কি উপহার নেবে বলো নি তো ? এখনো সময় আছে । বলো । জন্মদিনে কি চাই সোনার ?
প্রশ্নটা শুনে সত্যবতী বেশ অপদস্তুতে পড়ে গেল । তাই সে টয়লেট করতে যাওয়ার অছিলায় বিছানা ছেড়ে টয়লেটে উঠে গেল । টয়লেটের ভেতর থেকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো সে ,
----- তুমি আসছো । এটাই বড় উপহার আমার জন্য । আর যদি কিছু দিতেই চাও , তবে পড়ন্ত বিকেলের রোদ মেখে আর্মেনিয়ার ধারে দাঁড়িয়ে কপালে কিছু চুমু দিতে পারো আমায় ?
উত্তরটা শুনে সন্দীপন বেশ অবাক হলেও , ছোট্ট হাসি হেসে জানালো ;
------ বেশ । তাই দেবো । আজ রাখি । ঘুমিয়ে পড়ো এবার । গুড নাইট ।
সত্যবতী টয়লেটের দরজা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিলো ,
----- তোমাকেও গুড নাইট । ভালোভাবে এসো ।
দুজনেই এরপর মুচকি হেসে ফোন কেটে দিলো ।
দুলন্ত ট্রেনের কামড়ায় নিস্তব্ধে বসে বসে , নীরবে ঘুমিয়ে কখন যে বর্ধমান পার করে গেছে সে , সে বুঝতেই পারে নি কিছুই । ওদিকে কাঁচা ঘুম চোখে তাড়া , ক্লাসের জন্য ; ভেবেছিল , একবার চোখাচোখি হয়ে যাবে নিশ্চই । কিন্তু রাত জাগা যে চোখে ঘুম জড়িয়ে আছে এখনো , সে চোখ প্রথম দর্শনের আনন্দ পাবে বলে মনে করতে পারে কি ? হন হন করে বেড়িয়ে আসা ভিড় , তবু সে চোখ খুঁজছে হাওড়ায় সেই মানুষটাকে । মনের তর সইছে না আর , মিলন কে জানে হবে আর কত ক্ষণে ।
লোকালে চেপেই ফোন করেছিল সত্যবতী , জানতে কোথায় সে ? স্টেশনে দাঁড়িয়ে একবার মনে করে দেখলো এখন , বলেছিল
------ জিনিসগুলো বাড়িতে রেখে দিয়েই আসছি । হাওড়া স্টেশনে ১ নম্বরের বাইরেটায় দাঁড়িও । ওখানেই থাকবো আমি ।
কিন্তু কোথাও তো দেখা নেই । এদিকে এত ভিড় ! চিনতে পারবে তো আমাকে । এমন নানা ভাবনা গিলে খেয়ে চলেছে তাকে । হঠাৎ এক অচেনা হাতের ছোঁয়ায় হতচকিত হয়ে পিছন ফিরে তাকায় সে । পিছনে ফিরতে ফিরতে তার মন ভীষনভাবে বলছিল যে এ হাত নিষ্পাপ , এ হাত তার জন্য , তারই কাছের কেউ । আর বাকিটা , পিছন ঘুরে সে অবাক .... টু শব্দ নেই কারুর গলায় , পারিপার্শিক কিছু নিত্য কলহ ছাড়া ।
একসঙ্গে দুজন পায়ে পা মেলালেও , অনেক সময়ই বাক রুদ্ধ থেকে বলে চলে অনেক কথাই । সত্যবতীর সাথে সন্দীপনের প্রথম চোখাচুখি হওয়ার পর , দুটি শরীর চলেছে অনেক দূর । বাসের সিটে পাশাপাশি বসে থাকা মুখদুটো কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । পার্ক স্ট্রিট স্টপেজ আসতে তারা নেমে পড়লো ঠিকই , তবে কথা তখনও ফুটছে না কারুরই মুখে । তারপর একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে সত্যবতী , সন্দীপনের দিকে প্রথমবার ফিরে তাকালো । হা করে দেখে চলেছে সে মনের মানুষটাকে । আজ সে দাঁড়িয়ে তার সামনে । তারপর লাজুক স্বরে ফুটে উঠলো কথা , সামনাসামনি প্রথমবার ,
------ আমাকে আমার কাছ থেকে ছিনতাই করার জন্য ধন্যবাদ । আজ সত্যি বলতে ক্লাস করার ইচ্ছে একটুও ছিল না । হয়তো তোমার ফোন যখন এলো , তখন এটাই বলতাম , কিন্তু তার মধ্যে ওই হাত দুটো ....
সত্যবতী এক বুক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের মধ্যেই হারিয়ে গেল আর সন্দীপন হো হো করে হাসতে লাগলো তার কথায় ।
রেস কোর্সের পাস দিয়ে হেঁটে চলে গেছে পথ । হাতে হাত ধরে কলকাতার বুকে বহু দিন পর একসাথে এগিয়ে চলেছে দুই অভিন্ন হৃদয় । কত দিনের পর এ দেখা তাদের । মাঝে মাঝে খুনসুটি আর দুষ্টুমি , ভালোবাসাকে আরও মাখো মাখো করে দিচ্ছে । প্রায় আধ ঘন্টা এগিয়ে যেতে না যেতেই সত্যের চোখে ধরা পড়লো এক অদ্ভুত তৃপ্তি । উৎফুল্ল মুখ তার যেন অনেক কিছুই বলতে চাইছে , কিন্তু পারছে না । সন্দীপন ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে আর দেখে চলেছে তার হৃদয়কে এভাবেই অনেকক্ষন ধরেই , তারপর , সাবধানে সত্যবতীকে হঠাৎ মাঝপথে থামিয়ে হাতের মুঠোটাকে শক্ত করে ধরে বলে উঠলো ,
----- জীবনটা আজ তোমাকে দিলাম । ছেড়ে যেও না কোনদিন ।
সত্যবতী ভাবেনি এমন মুহূর্ত সে কারুর কাছ থেকে পাবে কোনদিন , জনবহুল পথে দাঁড়িয়ে এ ভাবে কেউ বুকে টেনে নেবে কাছে । এ মুহূর্ত তার কাছে শত চুমুর থেকেও মিষ্টি । তবু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সে বলে উঠলো ,
----- কোথাও যাবো না । যাবার জন্য তোমায় ডাকে নি আমি । শুধু ভালোবাসা দিয়ে যেও এভাবেই । ' ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে ... ' । এবার বলো দেখি আজকের দিনটা কিভাবে কাটানো যায় ?
সন্দীপন সত্যবতীকে রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসে আগে , তারপর , মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় । কোন পরিকল্পনা নেই যে আজ । সে তো শুধু সত্যের সাথে দিন কাটাতে চেয়েছিল । কোন পরিকল্পনা তো করে রাখেনি আর । তবু , এ কথা কি বলা যায় আর তাই নরম গলায় উত্তর দেয় ,
---- তুমিই বলো ।
সত্যের মুখে সেই এক কথা ,
----- না না তুমি বলো ।
আর এভাবে কথা চালানের মধ্যেই দুপুরের রোদ ঝাঁপিয়ে পড়লো বড় রাস্তায় । প্রেমিক প্রেমিকাদ্বয়-ও নিস্তার পায় না । সে কি জানে ভালোবাসার মানে ! এ অসহ্য রোদ্দুরের তাপে তপ্ত দুজনে পেক্ষাগৃহের শরনে যাবে বলেই স্থির করে ও সেই উদ্দেশ্যেই ক্যাব বুক করা হয় । সাইলেন্ট সুপারস্টার আজ স্ক্রিনের ভেতরে নয় শুধু , বাইরেও চলবে ; এ কাহিনী কেউ বোঝে না ; শুধু ওরা ছাড়া । প্রথম মিলনের প্রথম সেশন শুরু হলো বুঝি এবার ।
৪১।।
ক্লান্ত সন্ধে তখন মিটমিট করে হাসছে । ওলার পিছনের সিট দুটোতে তখনও খুনসুটি আর ঝগড়া । ঘড়ির কাঁটা দুটো তখন পাঁচ আর তিনের ঘরবন্দি । হালকা হাওয়া আর পড়ন্ত রোদ , আজ আনন্দের গান শীষ দিচ্ছে দু ঠোঁটে বারবার । ছোয়াটা কত গভীর তা সময় বলবে , এখন শুধুই উপভোগ্য হোক ওদের কামনা ।
বেজে ওঠা মোবাইলের কন্ঠে ভেসে এলো গান , " যদি তারে নাই চিনি গো সেকি ... " । আস্তে করে ফোনটা কানে ধরে সত্যবতী গলাটা বেশ গম্ভীর করে বলে উঠলো ,
----- হ্যালো । হাওড়ায় ঢুকছি । ট্রেন ধরবো তারপর । তারপর বাড়ি ।
এটুকু বলেই কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে সটান লাইনটা কেটে দিলো ।
সন্দীপন অবাক হয়ে সব দেখছিল এতক্ষন ধরে । এবার সত্যবতীর দিকে তাকিয়ে সে সংশয়টা ছুড়েই দিলো ,
------ কে ছিল ? মা নিশ্চই ।
সত্যবতী বেশ লাজুক ভাব করে ঘাড়টা ওপর নীচে নেড়ে দিলো একবার । সন্দীপন এতে আরও অবাক হয়ে বলে বসলো ,
----- মায়ের ফোন কেটে দিলে কথা না বলে !
সত্যবতী এবার সন্দীপনের ঘাড়ের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে জানালো যে এ মায়ের রোজের অভ্যেস । আর তাই প্রশ্নগুলো তার জানা । জানা প্রশ্ন পেয়ে সে উত্তরও দিয়ে দিলো এক সাথে । সন্দীপন সত্যের কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো । আর আমাদের সত্যবতী , চুপ করে তার বুকে মুখ গুজে বসে উপভোগ করতে লাগলো ভালোবাসা ।
অনেক কথা বলতে হয় না , নীরবতায় প্রকাশ্য হয়ে ওঠে ওরা । ঠিক যেমন আজ ওলার মধ্যকার নীরব ভাষ্যকার দুইজনা ; কথা বলছে ঠিকই , তবে গোপনে ।
সিনেমালয় পথের আগে সৃষ্ট ওদের প্রেম , আপাতত কমা পড়লো হাওড়ার লোকালের হুইসালে । দিন কেটে রাত নেমে এলো ঠিকই , তবে প্রেম কি শেষ হয় ! পরদিন থেকে তাদের অফিসিয়াল প্রেম দিবস শুরু , একথা ভুলতে পারছে না সত্য কোনভাবে । ফেসবুকের পাতায় তাই যার ভাষা বলতে নেমে আসতো এতদিন কিছু ছবি আর বোকা বোকা কিছু কথা ; তার ওয়ালেও রাতের অন্ধকারে লিখে গেল হৃদয় একটা আস্ত কবিতা ----
" জানি আবার একদিন দেখা হবে ,চোখে চোখেই না বলা কথাগুলো
কাব্যের পাতা হয়ে ফুটে উঠবে , আমার কাছে তুই , আর তোর কাছে আমি ; এক গোটা পৃথিবী ; সুস্থ স্বাভাবিক ; শুধু দুজন পাগল আমরা সকলের চেয়ে দামি ।।
আমার গলায় তোর হাত দুটো জড়িয়ে ধরবে ,চোখের জল
হারানো কিছুর প্রাপ্তির আনন্দে বাঁধ ভাঙবে দুদিকেই ,
ভিজে যাবে শরীর , তবু এ সুখের কি শেষ হয় কোনোদিন ??
ভালোবাসি , তোকে ভীষণ ভালোবাসি বলে উঠবো ;
প্রথমে তুই আর তারপর আমি ।।
তাহলে বলিস নি কেন , হতভাগী ;
চেয়েছিলাম , তবু পারিনি একটিবার ,তুই যদি খারাপ ভাবিস ।। কিন্তু তুই তো পারতিস ?
চেয়েছিলাম খুব , তবে এখানেও ভয় ; রাগ করে যদি তুই কোথাও হারিয়ে যেতিস ।। স্বপ্ন , এসব স্বপ্ন , আমি রোজ দেখি আর স্বপ্নেই ভবিষ্যতের কত ছবি আঁকি ।।
তুই বিশ্রাম কর বরং , বিশ্বাস কর স্বপ্নই একদিন গড়ে তুলবে
স্বপ্ন পূরণের পথে , এক পথের গঠন ।। শুধু ভেঙে পড়িস না , তোর ভেঙে পরা মুখ আমার একটুও ভালো লাগে না ।।
বিশ্বাস কর , আবার একদিন দেখা হবেই " ।।
পরেরদিন সকাল থেকেই আকাসে রোদ মেঘের লুকোচুরি খেলা । ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে গেছে সত্যের । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল সাতটা , এদিকে সাজুগুজু করতে এখনও অনেক বাকি তার । সন্দীপনের ঘুম অবশ্য যখন ভাঙলো , তখন প্রায় সাড়ে আটটা , তাও ভোপাল থেকে আসা একটা ফোন কলের শব্দে ।
---- আরে দাদা , ঠিক ঠাক পহচ গয়ে হো না ,
ওপাশ থেকে ভেসে এলো অজিতের কন্ঠস্বর । সন্দীপন হাই তুলে নিতে নিতে জানায় ,
---- ঠিক ঠাক নহি । বহত সহি আ গয়ে হম । ঔর আকর ....
কিছু বলতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো সে । সত্যবতী নিয়ে সে কিছুই বলতে রাজি নয় সে । গোপন কথাটি গোপনেই থাক । আর কথা না বাড়িয়ে পরে কল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে ফোনটা কেটে দিলো আর তারপর হরিণের গতিতে তৈরি হয়ে নিতে ছুটলো সে ।
৪২।।
নন্দনের বুকে নন্দিত দুজন , নিজস্বীর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া দুজন এখনো বোঝে নি , কিভাবে দিনটা পেড়িয়ে যাচ্ছে । স্রোতের গা বেয়ে তারাও চলেছে । ক্লান্তি তাদের কিছুতেই গ্রাস করতে পারে নি আজ , আর পারে নি বলেই হয়তো অজ্ঞাত থেকে জ্ঞাত হতে পারেনি তারা । বেলা বাড়ছে আর ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে যাচ্ছে অন্তরে ।
এমনই এক অবস্থায় সত্যবতী আর সন্দীপন এসে বসলো রবীন্দ্রনাথের মূর্তির তলায় , দেখলে মনে হতে বাধ্য শিষ্য আর গুরুর আলাপ বিলাপের গল্প । গুরুদেব যেন ভালোবাসা শিখিয়ে দিচ্ছে তাদের । এরই মাঝে সত্যর মাথা এসে সন্দীপনের কাঁধ স্পর্শ করতেই , সে বুঝতে পারলো সত্য নিদ্রার কবলে । তাই হালকা ঝাকুনি দিল আর এতেই কোনমতে চোখ খুলে তাকালো সত্য আবার । তারপর মুখটা কানের কাছে নিয়ে এসে আস্তে করে বললো ,
----- খুব খিদে পেয়েছে । ঔধ ১৫৯০ এ যাবো । একটা ক্যাব বুক করো না গো ।
এইটুকু বলে সত্যবতী , সন্দীপনের গলা জড়িয়ে ধরে আবার চোখ বন্ধ করে নিল ।
----- ওই সত্য ওঠো এবার । আমরা রেস্টুরেন্টে এসে গেছি ।
সন্দীপনের গলার স্বরে উঠে বসলো সত্যবতী এবার । দুটো হাই তুলে দরজা খুলে এগিয়ে গেল সে হোটেলের দিকে । কালীঘাটের কাছেই অবস্থিত রেস্টুরেন্টটি বেশ পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী । ভেতরটি বেশ পরিষ্কার , পরিচ্ছন্ন আর খাওয়া দাওয়া ; সে এক এলাহি ব্যাপার । বসার জায়গাগুলি এক একটি বড় সিংহাসন আর সামনের টেবিলে মুঘল বাবুর্চিরা মোগলাই পরিবেশন করে চলেছেন । সত্যবতী আর সন্দীপন পাশাপাশি দুটি জায়গা দখল করে বসে পড়লো আর তারপর ভোজ পালা সাঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত চললো নানা খুনসুটি , হাসি আর অবশ্যই নিজস্বী । বিল পে করে রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে বেরোবার মুখে সত্য হঠাৎই সন্দীপনকে পিছন থেকে টেনে নিয়ে হাত টা হাতের শৃঙ্খলে বেঁধে নিল আর তারপর গুটি গুটি পায়ে , পা মিলিয়ে চলতে চলতেই বলে উঠলো ,
----- আমি সারাটা পথ ঘুমিয়ে ছিলাম , তাই না ? আর তুমি হাতটা লম্বা করে মাথায় বালিশের মত রেখে দিয়েছিলে। তাই তো ?
সন্দীপন বিশেষ কিছু বললো না , শুধু হু বলে এগিয়ে চললো ।
সত্যবতী অবশ্য নিজের খেয়ালেই বলে চললো ,
------ একা পেয়েছিলে আজ আমায় । সুযোগ নিতেই পারতে । কিন্তু কোন সুযোগ নাওনি তুমি । উল্টে আমার জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে গেছো ।
সন্দীপন বেশ অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল , তবে একটা ধর্মতলাগামী বাস চলে আসায় সে মুহূর্তে কোন উত্তর দিলো না ।
বাসের ভিতর আজ বেশ ফাঁকা । পিছনের কোনার সিটে দুজন পাশাপাশি গিয়ে বসলো । সন্দীপনের মুখে কোন কথা নেই । বেশ কিছু দূর যেতে না যেতেই সত্যবতী একই প্রসঙ্গ আবার পেস করলো । সন্দীপন তখন ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত থাকায় কোন উত্তর দিলো না আবার । তবে কিছুক্ষণ পর সত্যের দিকে ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো ,
----- ভালোবাসা মানেই কষ্ট । ভালোবাসা মানেই বেদনা । সুযোগ নিলে তো ভালোবাসা হতো না । জীবন সঙ্গী হিসেবে যাকে ঠিক করে রেখেছি , তার শরীর নিয়ে খেলবো ; তাও তার ইচ্ছে ছাড়া , সেটা ধর্ষণ হবে ; আদর নয় । তুমি আমার জীবন আর জীবনের জন্য ওই টুকু কষ্ট সহ্য করা যায় , তবে ... ( বেশ কিছুক্ষণ বিরাম নিয়ে ) ... আমি প্রেমিক । ধর্ষক নই ।
সন্দীপনের কথায় সত্যবতী অবাক হয়ে গেল এবং তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে ।
৪৩।।
------ হ্যালো , তুমি কোথায় ? আমাকে একলা ছেড়ে কোথায় চলে গেলে তুমি ?
আতঙ্কে , ভয়ে , কাঁদো কাঁদো গলায় মোবাইলে ভেসে এলো সত্যবতীর কন্ঠস্বর । সন্দীপন কয়েক মুহুর্ত আসে পাশে তাকিয়ে নিয়ে উত্তর দিল ,
------ মনে হচ্ছে আমি ময়দান তাঁবুর কাছে আছি । তুমি কোথায় ?
সত্যবতী প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়েছিল । তার ওপর কান্নার স্রোতে বাঁধ দিতে গিয়ে কথাগুলো হোঁচট খাচ্ছিল বারবার । সেই অবস্থাতেই প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলে উঠলো সে ,
------- যেখানে ফেলে গেচিলে । ফাঁকা রাস্তায় । চলে এসো । এখুনি । খুব ভয় করছে ।
সন্দীপন নিজেকে শক্ত করে উত্তর দেয় যে সত্য যেন না ঘাবরায় । সে আসছে ।
তারপর সে রাস্তা পার করে পেছনে হাঁটা লাগায় , যদিও গন্তব্য কত দূর তার বিন্দু বিসর্গ জানা নেই কিছুই । এদিকে এগিয়ে চলেছে সময় , ওদিকে এগিয়ে চলেছে পাগল হয়ে ওঠা সন্দীপন ও তার হৃদয় আর অন্যদিকে মুহুর্মুহু বেজে ওঠা রিংটোনে এক আতঙ্ক ,
--- তুমি কোথায় ?
সত্যবতী-র কাতর প্রশ্নগুলো আজ নিরুত্তর দেখে সন্দীপন আরও বিচলিত হয়ে পড়ে । গতি বারে পায়ের , গতি বারের মোবাইলের কান্নার অন্তর্বতী সময়ের । অবশেষে নিরুপায় ছেলেটি একটা ধার দেখে দাঁড়িয়ে , সত্যকে বলে
---- আশেপাশে কেউ আছে তোমার ?
সত্য কয়েক মুহূর্ত ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দেখে চারপাশ , তারপর করুন স্বরে ভেসে আসে তিনটি অক্ষর ,
---- পু লি স ।
"পুলিস ! বেশ চমকে উঠেই সন্দীপন উত্তর দিল , মানে কোন রাস্তার মোড়ে বা থানায় ।" কিছুই ঠিক করে বুঝে উঠতে পারছে না সে যখন , তখন পাশ দিয়ে এগিয়ে আসা এক ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে বেশ উদগ্রীব স্বরে বলে উঠলো সে ,
---- একটু হেল্প করবেন দাদা । আমরা দুজন ছিলাম । বাসে করে ফিরছিলাম , হঠাৎ বাসটা কোন এক সিগন্যালের কাছে দাঁড়ায় । সে নেমে পড়লেও আমি নামতে পারি নি । কোথায় , কোন জায়গায় কিছুই বুঝতে পারছি না ।
ট্যাক্সি ওয়ালা বেশি কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে আসতে বললে সন্দীপন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হলো বটে তবে প্রাক সন্ধ্যা মুহূর্তে বেশ কিছু পথ খোঁজা খুঁজি করেও সত্যের ঠিকানা না পাওয়ায় অস্থিরতা আবার গ্রাস করলো তাকে । এদিকে তার অস্থির হৃদয় আর ওদিকে সত্যের ক্রমাগত ফোন --- দুদিক সামলাতে সামলাতে তার অবস্থা বেশ কাহিল । সূর্যের শেষ লাল রংটাও এবার দুপ করে নিভে গেল আর সাথে সাথে কালো অন্ধকারে গ্রাসিত হলো গোটা শহর । এ পথ ভালো কিছু দিয়ে যেতে পারে না , তবে বহু অন্যায় এ পথে প্রায়শই ঘটে যায় আর সে আশঙ্কাই ট্যাক্সি আর দুই বাহকের মনকে আরও চিন্তিত করে তুলছে বারবার ।
ঘড়িতে তখন ছটা । শীতের সন্ধ্যায় রাত ঘন নিবিড় হয়ে উঠেছে খুব । রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান । শুধু কিছুজনের বাড়ি ফিরতি ভিড় চোখে পড়ছে । ট্যাক্সি আর দুই মাহুত এমনই এক পথের ধারে দাঁড়িয়ে চিন্তায় মগ্ন , জায়গাটি কোথায় ! এরই মাঝে সমস্ত নীরবতা ভেঙে দিয়ে মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো । এবার কিন্তু সব স্বাভাবিক ছিল না আর । ওপাশ থেকে এবার যা ভেসে এলো , তা সন্দীপনের মুখের রঙ বেশ ফ্যাকাসে করে দিল নিমেষে ।
---- হ্যালো । আপ সত্যবতী নাম সে কিসিকো জানতে হ্যায় ।
গলাটা বেশ গম্ভীর আর সেই গম্ভীর স্বরটি সন্দীপনের মুখ থেকে হা শোনা মাত্রই পুনরায় বলে উঠলো ,
----- ম্যায় ট্রাফিক হাওয়ালদার বোল রহা হু । সত্যবতী মেরে ইহা ব্যায়ঠি হ্যায় । ট্রাম লাইন কে পাস ওয়ালা ক্রসিং আকে লে যাও উসে ।
এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিলো সে আর সন্দীপন ; মনে হলো শীতে গরমের অভিজ্ঞতা করে ফিরছে আজ ।
৪৪।।
শীতের রাত্রি । লোকাল ট্রেনের ভিড় আজ বেশ কম । তাই সিট পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি সন্দীপনকে । ধর্মতলার আজকের সন্ধ্যাটা সন্দীপনের চোখে মুখে এখনও লেগে আছে । ট্রাম লাইনের ধারে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে তার একবার হলেও মনে হয়েছিল যে সে নিশ্চিত দোষী । নাহলে এভাবে কি আর পারতো কষ্ট দিতে ।
সত্যবতীর চোখ মুখ তখন প্রচন্ডই আতঙ্কিত , যখন তার প্রেমিকের দুটো হাত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে । দুজনের চোখেই জল আর দুজনের মুখেই নিস্তব্ধতা । প্রায় মিনিট পনেরো ; কেটে গেল এভাবেই । তারপর সন্দীপনের হাত দুটো জড়িয়ে নিয়ে সত্যবতী বলে উঠলো , বলা তো নয় যেন একগুচ্ছ অভিমানে মান ভাঙলো এবার ,
---- ভালোবাসার মানুষটিকে বুঝি এভাবে একা ফেলে চলে যেতে হয় ? জানো এই নির্জন অন্ধকারে কী ভয় করছিলো আমার ! তিনটে মাতাল এপাস থেকেই আসছিলো আর আমি একা একজন মেয়ে । ভাগ্যিস ওই পুলিস আংকেল ...
সত্যের কথা শেষ হতে না হতেই সন্দীপন তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিলো আর সত্যের ঘামে ভেজা মাথায় চুম্বন করে চললো , বার চারেক তো হবেই । সত্য প্রথমে কোন বাঁধা না দিলেও , কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্দীপনের হাত সরিয়ে বলে উঠলো ,
----- থাক । থাক । আর ঐ মিথ্যে মিথ্যে ভালোবাসা দেখাতে হবে না ।
সন্দীপন অবশ্য এই মুহূর্তের নেশায় আজ পুরোপুরি মাতাল । প্রথম জীবনে পান করা হুইস্কির নেশাও এত চড়তো না । আর সেই অবস্থায় সে তার সত্যর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো ,
--- রাতের চাঁদ তারা আজ দেখো মেঘের আড়ালে
মৃদু হাওয়ায় আজ মন যেতে চায় তোমার মনে হারিয়ে
ভুল করেছি , প্রাশ্চিত্ত করবো বলে
ক্ষমা করে জড়িয়ে নাও , তোমার ঐ মায়াজালে ।
সত্য অবশ্য আজ এসবে কান দিল না একটুও । উল্টে সন্দীপনের হাত ধরে টেনে নিয়ে , চেপে বসলো হাওড়া গামী একটি বাসে ।
এসব মনে করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে আজ , টেরই পাইনি সন্দীপন । বেশ জেদ করেই ভালোবাসাটিকে পৌঁছাতে তো চলে গেছিল তখন , তবে এখন চোখ খুলতেই সে বুঝতে পারলো , ট্রেন এখন হাওড়া প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে । ঘুমের ঘোর আরও কিছুটা কাটতেই সে বেশ বুঝতে পারলো যে সে চন্দননগর থেকে হাওড়াগামী ফিরতি ট্রেনে বসে আছে , যেটি এই মুহুর্তে তার গন্তব্যে পৌঁছে ; বর্ধমান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । হুড়মুড়িয়ে উঠে সে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো ঠিকই , তবে এসমস্ত ঘটনা শুনে সত্যের সাথে আগামিতে তার বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়ার টিকিটটি তার চিরকালের মত বাতিল হয়ে গেল ।
আগামি দিনটা এলো সূর্যের হাত ধরে , তবে , অনেক মানা নিজের মধ্যে নিয়ে এবার । হাওড়ার ভিড় আজ প্রচন্ডই । মূল কারণ অবশ্য বৃষ্টি । সত্যবতী এসে যখন পৌছালো তখন অবশ্য রোদ হাসছে আকাশ জুড়ে , যদিও সন্দীপনের দেখা নেই কোথাও । ফোন করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা করুন গলা ,
---- প্রায় পৌঁছে গেছি । দুটো মিনিট অপেক্ষা করো ।
যদিও দু মিনিটের এই অপেক্ষা প্রায় ত্রিশ ছুঁয়ে গেলো আজ , ফলত্ব যা হওয়ার তাই হলো ; আপাত ক্ষণস্থায়ী অভিমান ; হাজার অভিযোগ , মেজাজ গরম ।
গরদের শাড়ি আর লাল ব্লাউজের কম্বিনেশনটা বেশ মানিয়েছে সত্যকে , নিজের মনে বলে চলেছিল সে ; যদিও ভিড় মলে দৃষ্টি তার আজ শুধুই ওর দিকে । সল্টলেকের আবহাওয়া মোটেই ভালো নেই আজ । যে রোদ্দুর বুকে নিয়ে ওলা সফর শুরু হয়েছিল কাঁধে মাথা এলিয়ে তাই শেষ হলো বৃষ্টি ঘেরা এক সকালে । সকলে বৃষ্টিতে ভিজে স্নান যখন , তখন নায়কের মাথায় ঘামের ফোঁটা --- কারন ভাবি শ্বশুরমশাই আসছেন তার সাথে দেখা করতে । এই চিন্তা নিয়েই সে মল উপভোগ , ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তুলতে ব্যস্ত করে রাখলো নিজেকে ।
একটু বৃষ্টি কমতে ভাবি শশুর মশাই এলেন । মেয়ের মোবাইলে ফোন করে ডেকে পাঠালেন মলের ফটকের সামনে । এতক্ষন উৎকণ্ঠা চেপে রাখলেও , সন্দীপনের মাথা এবার যেন কেমন অসাড় হয়ে পড়ছে । সত্যবতীকে ডেকে তাই বললো ,
---- বাবার সাথে দেখা করে কি বলবো ?
সন্দীপনের প্রশ্নটা সত্যকে কিছুটা অবাক করে দিলেও , সে নিজেকে শান্ত রাখলো শুধু এই ভেবে যে প্রথম দেখা করার অভিজ্ঞতা সবার জন্যই সমান হয় । তারপর সন্দীপনের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার দুটো হাত চেপে ধরে উত্তর দিল ,
----- নিজেকে সাধারণ রাখো । তুমি যেমন তাই থাকবে । ভয়ের কিছু নেই , আমি আছি তো ।
এই বলে তারা নেমে এলো মূল ফটকের সামনে , যেখানে বাবা ইতিমধ্যেই ভেজা মাথায় অপেক্ষমাণ ।
সাময়িক এই প্রশ্ন উত্তর পর্বর রেস যে একদিনে কাটবে না তা সন্দীপন বেশ ভালোই জানে , তবে সত্যবতীকে জীবনে স্থান দেওয়ার , নিজের শক্তি বানাবার যে অঙ্গিকার সন্দীপন মনে মনে করে ফেলে এগিয়ে চলেছে তাতে এমন পর্ব জীবনে প্রায়ই আসবে । আর এসব যেমন আসবে তেমন-ই সেগুলো ভুলেও যেতে হবে । ফোকাস হতে হবে শুধুমাত্র সত্যবতী --- খাদ্য ভবনে দাঁড়িয়ে বলে চলা বিশ্বদীপ দা র কথাগুলো আজ বড়ই সত্যি বলে বুঝতে পারছে সে । আর তাই ভাবি শশুর মশাইয়ের সাথে গড়ে ওঠা সাময়িক কথাবার্তা ছেড়ে সত্যবতীতেই ফিরে এলো সে --- প্রথমে গরম মোমোর দোকানে আর দিনের শেষে সিনেমার কর্নার সিটে খুঁজে নেওয়া ঠোঁট আর নরম বুকের উষ্ণ স্পর্শ ; যেন পৃথিবী বদলে দিয়েছে তার । সত্যের পূর্ণ সমর্থনে বাড়িয়ে দেওয়া দুটি ঠোঁটে জীবনের প্রথম চুমুতে যে নেশা পেয়েছিল , তা একবারে সীমাবদ্ধ তো হয়ইনি , বরং তিনতিন বারের ছোয়ায় ঠোঁটের সাথে হাত তার খুঁজে নিয়েছিল ব্লাউজের আড়াল ।
" রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্ ।
ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্ ।। "
৪৫।।
সেই রাত সন্দীপন আর সত্যবতীকে দিয়েছিল নতুন উত্তাপ । দুধ ফুটে উদলে উঠল এই প্রথম । আলতো করে শুরু হওয়া খুনসুটি আজ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে । পরের দিন শরীর ক্লান্ত , তাই সেভাবে পরিকল্পনা করা হলো না আর , ফোন অবশ্য চালু ছিল দুপক্ষেই । শরীর , মন যখন একবার এক হয়ে যায় , তখন , নতুন করে দেখা করার প্রয়োজন হয় না । ভালোবাসা জেগে ওঠে প্রতিবার গঙ্গার কিনারায় ।
তখন বিকেল ৪টে । মোবাইলটা যখন প্রথমবার বেজে উঠলো তখন দুটো ঢুলু চোখ ঢুলছে । ওপাশ থেকে নরম গলা ভেসে এলো এবার ,
---- আজ দেখা হবে না গো !
সন্দীপন তখনও ঘুমের পৃথিবী লেপ্টে হারিয়ে আছে । সব শুনেও ঘুমের মধ্যে থেকে ভেসে এলো অচেনা স্বর ,
---- হ্যালো । কে ? কোথায় ? কেন ? কি জন্য ?
সত্য অবশ্য বারবার বলে চলেছিল তবু সন্দীপনকে একটুও উঠতে না দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো এবার ,
----- এই শালা উঠলি । চুপচাপ চন্দননগর চলে আয় ।
এমন মেজাজে রীতিমতো থতমত খেয়ে উঠে বসলো সে এবার ।
---- আসছি আসছি ।
নিজের মধ্যেই বলে চললো সন্দীপন ,
---- শান্ত মা , শান্ত হও এবার । আমি আসছি । আসছি । আসছি ।
পরক্ষনেই মা কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে উঠলো সে ,
----- মা । আমার ফিরতে দেরি হবে । একদম চিন্তা করবে না । খুব জরুরি কাজ আছে , যেতেই হবে ।
এদিকে এটুকু বলে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সন্দীপন যখন বাইরে বেড়িয়ে এলো , তখন মুঠোফোনের ওপাশ থেকে হেসে ওঠা স্বর , সন্দীপনকে বেশ অস্বস্তিতে ঠেলে দিয়েছে একথা বলা যায় । আজ বিকেলের স্পর্শে আদর ছিল মুঠো মুঠো , স্পর্শ ছিল দুই ঠোঁটে । নীরবে কোনায় বসে ছিল ওই , পড়ন্ত বিকেলের লাল ঠোঁট ছিল লালিমা মাখা অপর জোড়ায় আটকে ; একজোড়া হাত ছিল লোমশ শরীর আঁকড়ে আর এক জোড়া ওপরের নরম পুষ্প বৃন্তে ।
এভাবেই বিকেল কেটে সন্ধ্যা হয় । ফরাসি নগরের গির্জায় বেজে ওঠে ঘন্টা । বিচ্ছেদ নেমে আসে দুই পৃথিবীতে । চতুর্থ দিন এক মিলন মেলায় মেতে উঠে । সত্যবতী স্বপরিবারে উপস্থিত ছিল এদিনের দুপুরে । তারপর ট্রেন এলো । ভরে উঠল প্যাসেঞ্জারে । বড়ই অদ্ভুত এই সময় । সত্যের চোখে জল আর বুকে স্মৃতির অর্ধেক ভাগ । ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়ালো ওরা এবার । সত্য করুণ কন্ঠে বলে উঠলো এবার ,
----- আবার কবে আসবে ?
সন্দীপনের মনটাও আজ ভালো নেই । কোনমতে বললো সে ,
----- খুব জলদি ।
----- চলো না , আমরা এখনই বিয়ে করে নিই । তারপর তোমার সাথে থাকবো । কত্ত মজা হবে ।
সন্দীপন মিনিট কয়েক থমকে দাঁড়ালো এবার , তারপর ধীরে উত্তর দিল ,
---- এখন নয় । সময় আসুক । তারপর রানী করে নিয়ে যাবো তোমায় ।
সিগন্যালের রং এখন সবুজ । ট্রেনে চড়ে বসলো সন্দীপন এবার । সত্যের চোখে তখনও জল , যেন শেষ বিদায় তার । এদিকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে আর ওদিকে সত্যের মনে ভেসে উঠছে সন্দীপনের সেই লাইনগুলো আজ ----
" আকাশ ভর্তি তারা আর দুপাশে লাল গোলাপ ফুল
হালকা হাওয়ায় উড়ে যায় রেশমি চুল ।।
কি সুন্দর না ! কি মনোরম দৃশ্য এখানে
কি অদ্ভুত মিষ্টতা দু চোখ যায় যেখানে ।।
মন ভরে গেল তোমায় দেখে আজ এতদিন পরে
হাসি মুখে মাথা নেড়ে চলে এলাম রেলকামরার ঘরে ।।
তুমি বোধহয় চিনতেই পারনি আমায় ,
আর শত ব্যস্ততায় আজ আমারও একটুও নেই সময় ।।
রাত গভির হল , ঘুম নেমে এল কামরা জুড়ে
আমি কিন্তু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সিগারেট হাতে অনেক দূরে।।
স্টেশন , ব্রিজ , সব নিমেষেই হারিয়ে গেল
কিছু পেরিয়ে গেছে আর কিছু মিনিটখানেক দাঁড়াল ।।
ওপাশের দরজা তখনও খোলা
আলো আঁধারি খেলায় তোমার স্মৃতির মেলা ,
জানি তুমি পর আজ আমার কাছে
তবু কিছু কথা ভাগ করে নিতে কি কোন মানা আছে ?
এই তো সেদিন এমনই একটা রাত
কামরার ভিতরে আমি , নিচে তুমি আর মাঝে দুটো হাত
চেপে ধরে চলেছিল সাথে সাথে বেশ কিছুটা পথ
তারপর উঠে এলে তুমিও ভিতরে , ছেড়ে গেল সাথ ।।
আর এ পথে ঘন্টা চারেক বাকি
সেটুকু কি বোঝ তুমি না কি ,
অনেক কথা তোমায় বলতে বাকি রঞ্জিনি
যেকথা তোমায় আজও বলা হয় নি ।।
অভিমানে চলে গেলে সেদিন অনেক দূরে
আমিও সেদিন ঠিক করেছিলাম দেখব না ফিরে ,
তারপর সংসার বাঁধলাম ; সাথে কলম ও সাদা খাতা
বিয়ে করলাম না বুঝেই , নাম কবিতা ।।
সঙ্গে সঙ্গেই থাকি দুজন মিলে
মন হলেই বেরিয়ে পড়ি - পাহাড় , নদী বা ঝিলে ।।
জানো , খুব অভিমানী , কিছুতেই ধরা দেয় না সহজে
কি জানি কি মনে করে ; নিজেকে নিজে ।।
এই দেখ , সকাল হয়ে এল ,
জনহীন রেল স্টেশনে ; ট্রেন থামল ।।
কবিতার হাতে হাত ধরে নেমে পড়লাম
ভাগ্যে মেলে একটা রাত যখন তোমায় কাছে পেলাম ।।
ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে , চতুর্দিক নীরব
ধীরে ধীরে ধোয়াঁয় মুছে যাবে ফেলে আসা সব ।।
তুমি তো অনেক দূরে যাবে ; তাড়া হুড়ো নেই
হয়ত আবার কোনদিন দেখা হয়ে যাবে এই পথেই ।।
সোহাগ , শাঁখা , সিঁদুর এসব আজ শুধুই তোমার
আর তুমি চিরকালের তার ,
আর আমার জীবন শুধুই তোমার কবিতার
আর কবিতার মধ্য দিয়ে আজও তুমি আমার ।। "
৪৬।।
ট্রেন ছুটে চলেছে নিজের গতিতে । সামনে মা বসে আছে তার , তবু সন্দীপনের মন যেন হারিয়ে যাচ্ছে বারবার সেই পুরোনো ফেলে আসা রসালো দিনগুলোতে । মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অপ্রাপ্তি লেগেই আছে তার , কিছুতেই স্থির রাখা যাচ্ছে না । একবার উঠছে , কিছুক্ষন পায়চারি সেরে এসে আবার বসে পড়ছে নিজের আস্তানায় । দেখতে দেখতে রাত নেমে এলে অতৃপ্ত হৃদয় , এক ফোঁটা তৃপ্তির তৃষ্ণায় মোবাইল ঘোরালো চেনা সেই সত্যের ঠিকানায় । একবার , দুবার , তিনবার এভাবেই দশবার কেটে গেলেও ফোনের ওপাশ থেকে কোন শব্দ এলো না ভেসে আর । উদ্বিগ্ন মনে সামনের টেবিলে মোবাইলটা নামিয়ে রাখলো সে ।
মা অনেকক্ষন ধরেই সব দেখে চলেছিল আধ খোলা চোখে । এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
---- বাবাই ! কি হয়েছে রে ? বেশ অস্থির মনে হচ্ছে তোকে ।
মায়ের ডাকে ছুটে চলা ট্রেনটির মতোই , তার মন ব্রেক কষলো এবার । কি উত্তর দেবে কিছু স্থির না করতে পেরে সে বলে উঠলো ,
---- কিছু নয় তো ! কি হবে ....
ইতিমধ্যে গতি আবার আগের মাত্রায় ফিরে এলে , ট্রেনটি এগিয়ে চললো ঠিকই , নিজের খেয়ালে আর তার মন , বেসামাল হয়ে ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল আজ । সাধের এপেলটি টেবিল থেকে পড়ে ভেঙে গেল যেমন , তেমনই রাত বারোটা পেরিয়ে গেলেও ভাঙা ফোনটিতে কোন ফোন এলো না আজ ।
---- তাহলে কি সব শেষ ! এই শেষের ছবিই কি ভেসে উঠলো আজ মোবাইলের ভগ্ন চেহারায় !
এমনই ভাবনা চোখে নিয়ে সে রাত কেটে গেল তার । ভোর বেলায় ছোট্ট করে একটি ম্যাসেজ পাঠালেও , উত্তর এলো সেই দুপুরের পর , কারন ছ ঘন্টা এ পথে শুধুই জঙ্গল ; মানুষ , নেটওয়ার্ক , কিছুরই দেখা মেলা ভার আর এ অজ্ঞাতবাস কাটতে হয়ে যায় প্রায় দুপুর এগারোটা । আর কিছুটা গেলেই কাটনি ...
দুপুরে নেটওয়ার্ক আসার পর সন্দীপন ম্যাসেজ চেক করলে দেখে উত্তর এসেছে ---
ওপরে জ্বলজ্বল করছে তার লেখা ....
"তোমার সাথে হয়তো কোনদিন দেখা হবে না আমার , তুমি হয়তো কোনদিন জানবে না আমার পরিচয়
হয়তো কোনদিন এ ঠোট বলবে না ভালোবাসার তিন অক্ষর তোমায় । উৎসর্গ হয়ে মরে যাবে কবিতা আমার ,
তোমার অপেক্ষায় ।
তুমি অন্যের হাতে তুলে দিয়েছ নিজের হৃদয় ---
কোন অধিকারে আর বলা যায়
বিশ্বাস আমার তবু পথ চেয়ে থাকে
যদি কোনদিন তোমায় ফিরিয়ে আনে এপথে সময় ।
তুমি বিজয়ী ; তুমি চেষ্টা ; তুমি নতুন কিশলয়
গোপনে রেখে সখী , ভালোবাসাবাসি ; কথা বলি রাতভোর ।
তুমি বোঝনা কি সব ? হয়তো বুঝেও বলোনা
হয়তো পরীক্ষা নিচ্ছিলে আমার , এ মহা বিশ্ব সভাঘর
হয়তো আমি তোমার যোগ্য নয় ।
ভয় হয় জানো । যদি সব ভেঙে হারিয়ে যাও কোনদিন ।
ব্যাপ্ত নীল আকাশ কবেই দিয়েছি তোমায়
এ কবিতা তোমার জন্য । বন্দি করো তোমার বাহুডোরে আমায় । ভেসে যেতে চাই তোমার এলোকেশে ,
শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে জীবনের গতিপথে ..... সুখ যত তোমার হোক , দুঃখগুলো দিও আমায় .....
সখী , একদিন এসো রূপসীর কোলে
মিলন হোক , একবার , ঘন বাঘমুন্ডির জঙ্গলে
চলো উড়ে যায় দুজনে , কাঁসাই এর ওপারে
সিঁদুর ওই মেঘ চলো লেপে দিই কপালে তোমার ।
আর তো ভয় নেই । তোমার রাত জাগবে এখন আমার পাশে আজীবনকাল ।
কাঞ্চি .... ও কাঞ্চি ...
ব্যাপ্ত নীল আকাশ কবেই দিয়েছি তোমায়
এ কবিতা তোমার জন্য । বন্দি করো তোমার বাহুডোরে আমায় " ।
আর নিচে উত্তরে আসা ...
" রাধার পালে লেগে যায় হাওয়া
কৃষ্ণ দোলে বাঁশির ডালে
মন কেমনের দিনগুলো তার
কৃষ্ণের কথা বড্ড মনে ধরে ।
নিজের সাথে কাটে না সময়
উত্থলা মন কানহার ছবি আঁকে
রাধা পারে নি , হেরে গেছে
নীল যমুনা আজও আছে
শুধু কৃষ্ণের সুর ওঠে না বাঁশিতে আর ।
দুচোখের জলে এমন কতই হারিয়ে যায়
বালুকাচর ফাঁকা হয়ে এলে মনে হয়
সেদিন কেষ্টর সাথে পারি নি কেন পাড়ি দিতে
খুঁজে নিতে সুখের আশ্রয় , তিন অক্ষরের মায়াখেলায় জড়িয়ে " ।
এদিকে গতি কমে আসে ধিরে ধিরে । কাটনি স্টেশনে এখন আধা ঘন্টার বিরাম । ভোপাল পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত ঘনিয়ে এলো আকাশে । মুঠোফোনের বেজে ওঠা চিৎকারে আজ আর কোন তোয়াক্কা না করেই সন্দীপন তার মাকে নিয়ে এগিয়ে চললো স্টেশনের বাইরে । একটা ফাঁকা জায়গা দেখে এসে দাড়ালো তারা । কাঁধ থেকে ব্যাগগুলো নীচে নামিয়ে পকেট থেকে খুব সামলে ভাঙা মোবাইলখানা বার করলো সে , তারপর সত্যবতীকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে তারা নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেছে । ক্লান্ত মেজাজের মাঝেও সন্দীপন চাইলো আরও কিছুটা সময় কেটে যাক না এভাবেই ; সত্যরও মন আজ এই স্মৃতিখন্ডগুলো ছেড়ে দিতে চাইছে না আর তাই সে আস্তে করে বলে উঠলো ,
------ আর কিছুটা সময় .... আবার কবে আসবে গো ?
সন্দীপন মুচকি হেসে জবাব দিল ,
----- মা একলা দাঁড়িয়ে । বাড়ি যাই এখন । রাতে না হয় আমি কল করবো তোমায় ।
সত্যের আজ বাঁধা দেওয়ার কিছু নেই । বলারও কিছু নেই । তবু অনেক সময় মানুষ সেই সব কথা বলে ফেলে অন্যভাবে , যা তারা মুখে পারে না বলতে । মোবাইলের স্ক্রিনটা সত্য পাগলের মত চুমু খেতে থাকলে , সন্দীপন বেশ গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয় ,
----- এসব কী হচ্ছে কী ? সত্য !!!!!
কিন্তু সত্য আজ কিছুই শুনতে রাজি নয় । ওদিকে মায়ের ডাক ভেসে আসতে শুনে , সন্দীপন ফোনটা কেটে দিতে বাধ্য হলো এবার । তারপর মুখটা ঘুরিয়ে উত্তর দিলো সে ,
----- যাচ্ছি মা ।
৪৭।।
---- নতুন ফ্ল্যাটে সুস্বাগতম ।
সদোর দরজা ঠেলে মা কে বললো সন্দীপন । তারপর আস্তে আস্তে ব্যাগগুলো তুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তারা । নতুন ঘর , নতুন জীবন মায়ের বেশ পছন্দ । হয়তো তাতে আড়ম্বর নেই , তবে শান্তি আছে ভরপুর । মা ফ্ল্যাটের চারপাশ ফিরে তাকালো একবার তারপর হাসি মুখে সন্দীপনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
------ বেশ লাগছে কিন্তু । খুব সুন্দর হয়েছে । কত পড়ছে বাবাই এই ঘরটার ?
মায়ের প্রশংসা শুনতে কোন ছেলের ভালো না লাগে ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রশংসা পেয়েছে সে আজ । তবে সে সব বিন্দুমাত্র টের পেতে না দিয়ে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলো সে ,
------ মাসে ৬০০০ টাকা , ইলেকট্রিসিটি বিল আলাদা । এছাড়া ওই ৪০০ টাকার মত মাসে লাগে মেন্টেনেনসের জন্য ।
------ ৬০০০ !
ছেলের কথায় বেশ আঁতকে উঠে মা বলে ওঠে ।
------- এর থেকে সস্তা এখানে পাবে না । ভোপাল প্রচণ্ড দামি একটা শহর । এটা অনেক সস্তায় পেয়েছি মা ।
উত্তর দেয় সন্দীপন ।
------- দেখ বাবাই , খুঁজলে সব পাওয়া যায় । এর থেকে সস্তা বাড়িও নিশ্চই পেতিস ।
মা , ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে নরম গলায় বলে চলে ,
------- পেতিস না । বল । ওই টুকু মাইনে । কিছু তো বাঁচাতে হবে এবার ।
সন্দীপন প্রথমে মায়ের কথায় কান না দিয়ে বিছানা পাততে শুরু করলেও , এই নীরবতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না । এক কথা শুনতে শুনতে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বলে উঠলো সে এবার ,
----- পেতাম । পেতাম । ভোপালের বাইরে পেতাম । রোজ অফিস আসতে ভোর বেলা বেড়াতে হতো আর বাড়ি যেতে রাত হয়ে যেত । ভালো হতো সেটা .... বিরক্ত করে মারে , মা-টা । যেখানে যাবে ....
মা ছেলেকে রেগে উঠতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে ঘর ঝাঁট দিতে ও বিছানা করতে ব্যস্ত করে তুললো নিজেকে । মায়ের নীরবতা সন্দীপনকেও নীরব করে দিল এবার , তবে মনের মধ্যেকার এক গুচ্ছ অভিমান জমিয়ে সে এসে দাড়ালো ব্যালকনিতে এবার । বেশ বড় চওড়া ব্যালকনিটি তার । সেখানেই এক ধারে চুপ করে বসে মোবাইল ঘেঁটে চললো সে , আসলে ঘাঁটা নয় , কবিতা লিখে চলেছিল সে আবার ; সত্যের ইনবাক্সে ।
" ভালোবাসা , ভিড়িয়েছিলেম ঘাটে
তখন বসন্ত , চারিদিক ফাগুনে ফাগের মেলা ।
জনতার ভিড় ঠেলে দেখেছি মনের দরজা খুলে
বসে তুমি --- শ্বেত পুষ্প যেন বাগিচায় ।
বলেছিলাম , ভালোবাসি
জবাবে এলো ভেসে এলোকেশি
একমুঠো হাসি আর প্রশ্রয়
দীর্ঘ পথ চলার ।
ওই স্নিগ্ধ কোমল চোখে তারপর থেকে
কতবার হারিয়েছি জীবন , হিসেব নেই ।
বিশ্বাসের ডোর শক্ত হয়েছে
যত দিন গেছে -- পরিচয়ে ।
আজ যখন সারা পৃথিবীর দরজায় তালা ঝুলছে
তখন দূর থেকে -- শয়নে , স্বপনে অথবা জাগ্রত নয়নে
দেখি ভবিষ্যত ।
কৃষ্ণ - রাধা চুড়ে মিলন নেমেছে
জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে দু-জোড় হাত
ফাগুনে ফাগের মেলা আবার ।
হয়ত এসব কাব্য মনে হবে , তবে
এতো কাব্য নয় --- প্রেয়সিকে লেখা বসন্ত পত্র এক " ।
মনের চিঠিখানা পেতে না পেতেই ভেসে এলো উত্তর সত্যের গলায় , সন্দীপনের মুঠোফোনে সোজা ---
----- খুব মিস করছি গো আজ তোমায় ।
ভালোবাসি এ তো প্রাচীন কথা । আজ কথা নয়
এ মুখে শুধুই নীরবতা আর নীরবতার মাঝে ....
বিশ্বাসী তুমি , গোলু আমার ।
এ পাস থেকে মিষ্টি হেসে সন্দীপনের উত্তর গেলো , সত্যের ফোন কেটে দেওয়ার আগে
----- ভালোবাসি তোমাকেও , বিশ্বাস করি গুলটি , এ গলুর সবসময় ।
তারপর হোয়াটস এপে গুড নাইট ফুটে উঠতেই দুই মোবাইল অফলাইন হয়ে গেল আজ ।
৪৮।।
---- দাদা , উহ লড়কি কৌন থি আপকে সাথ ?
এক ক্লাস ভর্তি ছেলে মেয়ের মাঝখানে পাণ্ডেজির ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটা সন্দীপনের কাছে যে একটা বড় অসস্তিকর ছিল , তা তার চোখ মুখ দেখেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল । ফেসবুকে এই এত দিন ধরে যে পরিমান কাপল পিকচার তারা ছেড়েছে তাতে এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক । খানিক সামলে নিয়ে নিজেকে উত্তর দিলো সে , ধীর স্থির ভাবে ,
----- মেরি উড বি ।
কথাটা শেষ হতে না হতেই পুরো ক্লাস জুড়ে এক আনন্দের রোল ছড়িয়ে গেল । সকলে একত্রে চিৎকার করে বলে উঠলো ,
----- মুবারাকহো দাদা । জোড়ি আচ্ছি লগ রহি হ্যায় ।
সন্দীপন কি বলবে ভেবে না পেয়ে , ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে রয়ে গেল । ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজছে । বার চারেক কেঁদে উঠে মুঠোফোনখানাও চুপ করে গেল আজ এই মেঘমুক্ত বিকেলে ।
সকাল বেলায় অফিস আসার পথেই রেল দপ্তর থেকে তার সাধের বাইকখানা ছাড়িয়ে এনেছিল সে । বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে এলে ফাঁকা পথ জুড়ে হাহাকার পড়ে রইল শুধু । বাইকের বা বাইক আরোহির কোন সন্ধান নেই এখনো । ঘড়িতে ন'টা বেজে এলে মায়ের মন কেমন যেন কূ ডেকে ওঠে ঠিকই --- তবে সেই মুহূর্তটুকু ভাগ করে নিতে ছুটে আসে না কেউই । অচেনা শহর আরও অচেনা মনে হলে , কোন চেনা হাত স্বান্তনা দেয় না আজ । ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে গভীর রাতে --- তবে খবর হয়ে । টিপু সুলতান নার্সিংহোম থেকে খবর এলো কলিগ মারফত ,
" সন্দীপন হাসপাতাল মে হ্যায় , বেহোস "....
খবরটি শোনা মাত্রই পাগলামির সমস্ত সীমা ভেঙে বৃদ্ধা ছুটে বেড়িয়ে আসে ভোপালের পথে । পরনের আধ ছেঁড়া শাড়িটির-ও খেয়াল নেই তখন তার । যতই হোক মা তো !!!!
আই সি ইউ-র লাল হয়ে ওঠা বিছানায় ঘুমন্ত সন্দীপন ; ফাঁকা পথ ধরে গভীর তারাদের পাস কাটিয়ে ছুটে চলা কিছু বাইক আর ড্রয়ারের মধ্যে পড়ে থাকা নিস্তব্ধ মোবাইল যার হৃদয়জুড়ে অনেক না বলা কথা যা থেমে গেছিল আজ বিকেলে এজি-র সামনে ।

