আরও একবার বসন্ত
আরও একবার বসন্ত
সামনের জামগাছটায় বসে থাকা কোকিলটা অনর্গল ‘কুহ কুহ’ করে ডাকছে। শুনে মনে হচ্ছে, এই ডাকের মধ্যে আছে ঋতুরাজ বসন্তকে তার হৃদয়ের সুপ্ত প্রণয় প্রেরণ বার্তার ইঙ্গিত। বসন্তের আগমনের ছোঁয়া লেগেছে গাছগুলোর ওপর। সবুজ কচিপাতা আর সদ্য জন্মানো কুঁড়িগুলোর মধ্যে একটা নতুন ভাব জমে উঠেছে। বসন্তের দুপুরের মিঠে রোদ এসে পড়ছে শার্সি টানা জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা ক্ষীণ আলো আর ঘরের ভিতরের হালকা বাল্বের আলো যেভাবে একসাথে মিশে গিয়েছে, সেই ভাবে মিশে গেছে দুটো শরীর। প্রেমের উষ্ণতায় উন্মত্ত দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তেই ছায়া এসে পড়েছে আলোর বিপরীত দেওয়ালে। কিছুটা স্পষ্ট, আবার কিছুটা ধোঁয়াশার মধ্যে ফুটে উঠছে রঙিন মুহূর্তগুলো। কিন্তু তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে হালকা ধোঁয়ায় সবকিছু যেন হিজিবিজি হয়ে গেল। সুখের শীৎকার পরিণত হল অনেকগুলো মানুষের বিকট হাসির কলরবে...
অয়ন্তি এক ঝটকা দিয়ে ঘুম থেকে জেগে বিছানায় উঠে বসল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নিশুতি রাতে মাথার ওপর পাখার আওয়াজটাও যেন তিক্ত অনুভূতি জাগাচ্ছে। হঠাৎ তার বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করতে লাগল। সে ঘরের চারিদিকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। চারিদিক একবারে নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। খানিক পড়ে তার নজর গিয়ে পড়ে সামনের টেবিলের ওপর। সে সামনের টেবিল থেকে জল ভর্তি গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জলটা পান করে একটু ধাতস্ত হয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে দেখে এখন সবে রাত তিনটে বাজে। ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। সে বিছানা থেকে নেমে জানলার ধারে গিয়ে নিজের মনকে বলল, “জানি না এই দুঃস্বপ্ন আর কত দিন আমাকে তাড়া করে বেড়াবে? মন থেকে তো সব মুছেই ফেলেছি। তবুও অবচেতন মন তাকে কি করে বোঝাব? নেই নেই, সত্যি এর উত্তর আমার আজও জানা নেই। শুধু জীবন স্রোতের টানে বয়ে চলেছি।” অয়ন্তি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। কিন্তু একটা অহেতুক আশঙ্কায় সে দু’চোখের পাতা আর এক করতে পারল না। তাই বাকি রাতটা তার বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কেটে গেল।
ভোরবেলা অয়ন্তির মা ঠাকুর ঘরে যাওয়ার সময় দেখল, অয়ন্তি রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে। সাধারণত অয়ন্তি রবিবার একটু দেরিতে ওঠে। কিন্তু আজ ভোর ভোর তাকে উঠতে দেখে তার মা একটু অবাক হলেন। তিনি বললেন, “কিরে আজ এত ভোর ভোর উঠেছিস, আজ তো তোর স্কুল নেই। যাক উঠে পড়েছিস যখন ভালই হয়েছে। হাতের কাজগুলো সেরে নিই। তারপর তোর সাথে কথা আছে।” অয়ন্তি কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল, তাই মায়ের কথাগুলো কতটা তার কানে পৌঁছাল, সেটা বলা মুশকিল। তবু সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের মনে কাজ করতে লাগল।
একটু বেলায় জলখাবারের সময় অয়ন্তির কাছে তার মা–বাবা কথাটা পারল। বাবা বললেন, “তুই তো সবই বুঝিস। সব কিছু তো তোর মতামত নিয়েই হচ্ছে। আর তাছাড়া এটা করা ছাড়া আমাদের হাতে তো এখন আর কোন উপায় নেই। এতদিন আমরাও তোর মতেই একমত হয়েছি। হ্যাঁ একসময় আমরাও তোকে অনেক কটূ কথা বলেছি, বকাবকি করেছি। কিন্তু তুই সব সহ্য করে লড়ে গেছিস। হয়তো সত্যি তোর চলার পথে এখন আর কাউকে দরকার নেই। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা, আমরা সবাই নিরুপায়। আমাদের যা করতে হবে সব ওর মুখ চেয়ে করতে হবে। আমাদের এই পোড়া কপালে এটাই সৌভাগ্য যে সপ্তর্ষির মতো একজন উদার মনের মানুষকে পেয়েছি। আমি ওর সাথে কথা বলেছি, শুধু তুই এবার নিজে দেখে শুনে কথা বলে নিলেই শান্তি। আজ বিকালে সপ্তর্ষি তোর সাথে দেখা করতে চায়। আর তুইও চেয়েছিলিস ওর সাথে বিয়ের আগে একবার দেখা করে কথা বলে নিতে। যদিও আমরা সব কিছু বলেছি ওকে। তবে আমরা যে ভাবে বলেছি তুইও সেই ভাবে এক কথা বলিস মা।” অয়ন্তির মনের ভিতর কোনো এক সমুদ্রের ঢেউ যেন এক নিমিষে তার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে দিল। সে কোনো উত্তর দিতে পারলো না। অয়ন্তি শুধু মাথা নেড়ে তাঁদের কথায় সম্মতি জানিয়ে ঘরে চলে গেল।
বসন্তের ছোঁয়া লেগে সবুজ পাতাগুলোর মধ্যে একটা আনন্দের হিল্লোল জেগে উঠেছে। ন্যাড়া গাছের ডালগুলো নতুন ভাবে, নানা রঙে সেজে উঠেছে। এক একটা গাছের ফাঁক থেকে শোনা যাচ্ছে কোকিলের মিষ্টি কুহু কাকলি। শীতের প্রত্যাবর্তন আর গ্রীষ্মের আগমনের প্রাক্কাল সময়টা সবসময় এক অদ্ভুত শিহরণ জাগায়। বলা যায়, একবারে মিষ্টি প্রেমের সুগন্ধি অনুভুতির শিহরণ। তবে অয়ন্তির কাছে সব ঋতুই সমান। তার জীবন মানে সকালে উঠে একটা প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুলে পড়াতে যাওয়া। তারপর ফিরে নিজের বুটিক সামলানো। অর্থের প্রয়োজন মেটাতে মেটাতে জীবন কেটে যাচ্ছে। সকাল আর সন্ধ্যের হিসাব এখন তার কাছে অনাবশ্যক ভাবাবেগ। সে আজ কিছুটা সময় নিয়ে বেড়িয়েছে। হাতের টুকিটাকি কাজগুলো সেরে একটা পার্কের কাছে এসে ধুলো মাখা বেঞ্চে এসে অয়ন্তি বসে পড়ল। সে চারিদিকটা তাকিয়ে দেখল, প্রকৃতি যেন অয়ন্তিকে রাঙা মেঘে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার জন্য, সোনালী রোদ তার নরম গালকে স্পর্শ করেছে। এই পার্ক থেকে আর মিনিট পাঁচেক হাঁটা পথ গেলেই সেই রেস্ট্রুরেন্ট, যেখানে সপ্তর্ষি তার জন্য অপেক্ষারত আছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কুণ্ঠাবোধ তার পা দুটোকে অবশ করে দিল। মাথাটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল, তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। সামনের সব দৃশ্য কেমন নিমিষে ঝাপসা হয়ে এল। আর মনের গহন থেকে স্পষ্ট হতে থাকলো দশ বছর আগের অতীতের ছেঁড়া পাতাগুলো...
অয়ন্তি আর তার কলেজের বন্ধুরা মিলে এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে এসেছে সুন্দরবনের কাছে একটা রিসর্টে। শীতের মরশুম যদিও শেষের দিকে। বলা যায়, বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। এইসময় এখানে পর্যটকদের ভিড়টা একটু কম হয়। অয়ন্তি আগাগোড়াই বেশ প্রাণ চঞ্চল প্রকৃতির। তাই সবার সাথেই বেশ সহজে মিলেমিশে যেতে পারে। তার মধ্যে একটা আলাদা রকমের সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য্য ছিল। যেই সৌন্দর্য পুরুষ মনকে আকর্ষিত করার ক্ষমতা রাখত। তবে বহু পুরুষের হৃদয়ে অয়ন্তি থাকলেও অয়ন্তির হৃদয়ে বসবাসের অনুমতি বা ইশারা এখনও কেউ পায়নি। এক সপ্তাহের এই ট্যুরের সবরকম দায়িত্ব ছিল তার আর দীপ্তর ওপর। একদিন পর দীপ্ত একটু দোনামোনা করতে করেতে অয়ন্তিকে এসে বলল, “অয়ন্তি, শোন আমার দুজন বন্ধু আসছে, ওরা আমাদের সাথে থাকবে, আমি তাই একটু বেশি করে মাংস কিনে এনেছি। আমরা তো ১০ জন এসেছে নয় আর দু’জন বাড়ল। তোদের সবার কোনো অসুবিধা নেই তো?”
অয়ন্তি প্রথমে একটু বিরক্তি বোধ করলেও বন্ধুত্বের খাতিরে দীপ্তর কথায় সম্মতি জানাল। একটু বেলার দিকে দীপ্তর বাকি দুই বন্ধু এসে উপস্থিত হল। দীপ্ত সবার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু অয়ন্তির সাথে পরিচয় হলো না। সে কোথায় গেছে জানতে চাইলে সবাই জানায়, “জানিস তো ও কিরকম একটা খাম খেয়ালি। দেখ সামনের বাগানে ঘুরতে গেছে হয়তো।” দীপ্ত তার বন্ধু শুভ আর জয়কে বলল, “চল তোর সাথে অয়ন্তির আলাপ করিয়ে দিই। ও হলো আমার গ্রুপের হেড ইনচার্জ।”
শুভ বলল, “তাহলে তো আগে আলাপ সারতে হয়।” দীপ্তর সাথে ওরা দুজন বাগানে গিয়ে দেখে সারি সারি ফুলে হাত বুলিয়ে আপন মনে অয়ন্তি গুনগুন সুরে কি যেন একটা গান গাইছে।
দীপ্ত কৌতুকের স্বরে বলে, “কার জন্য গান গাইছিস? পাত্র দেখবো নাকি?” অয়ন্তি কিছুটা চমকে উঠে দীপ্তর দিকে ঘুরে তাকায়। “আরে তুই? কখন এলি?” বলে দীপ্তর দুই বন্ধুর দিকে এক নজর দেখে সে আবার বলে “এই তোর দুই বন্ধু?” দীপ্ত ওদের সাথে অয়ন্তির আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে সেদিনের পর থেকে অয়ন্তির মনের ঘরে একটা বদল ঘটে। যে অয়ন্তি কোন ছেলেকেই সেভাবে পাত্তা দিত না। সে কারণে অকারণে দীপ্তর বন্ধুদের একটু বেশি খাতির যত্ন শুরু করে দিয়েছিল। প্রথমদিকে অয়ন্তির বন্ধুরা আন্দাজ করেছিল জয়ের প্রতি অয়ন্তি হয়তো একটু বেশি অনুরক্ত হয়ে উঠেছে। কারণ জয় অত্যন্ত সুপুরুষ। তাই জয়ের প্রেমে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জয় যে অয়ন্তিকে পছন্দ করে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু মনের ঠিকানা কার কোথায় বাঁধা, তা হয়তো স্বয়ং ভগবানই জানে। সবার আন্দাজ যে ভুল, সেই ভ্রম দূর হল, দু-তিন দিন পরেই। একদিন রাতে জয়, দীপ্ত আর বাকি কয়েকজন রিসর্টে ফিরে এসে জানায় যে, জঙ্গলের ফেরার পথে তারা বাঘের গর্জন শুনে প্রাণপণে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু তারা জঙ্গল থেকে ফেরার পথে শুভকে আর দেখতে পাইনি। এই কথা শুনে অয়ন্তির উৎকণ্ঠায় ও ভয়ে পাগলের মতো অবস্থা হয়। দিশাহারা হয়ে সে ছুটে যায় জঙ্গলের রাস্তার দিকে, কারোর কোন কথাই তার কানে আসে না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জঙ্গলে ঢোকার মুখে শুভর সাথে দেখা হয়ে যায়। শুভর প্রশস্ত বুকের মাঝে মুখ রেখে জড়িয়ে ধরে অয়ন্তির সে কি কান্না! আবেগের বশে দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সে মনের কথাটা সর্ব সম্মুখে শুভকে বলেই দিল। সেদিনই সবার ধারণাটা যে ভুল ছিল, তা প্রমাণিত হল। সবাই এটা ভেবে অবাক হল যে, জয়ের মতো সুপুরুষ, বিত্তশালী ছেলেকে ছেড়ে শুভর মতো কৃষ্ণবর্ণ, একবারে সাদামাটা ছাপোষা, আবার বয়েসে দশ বছরের বড় ছেলেকে শেষে পছন্দ করল অয়ন্তি! জয়ও যে ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখে নি, তা বেশ বোঝা গেল। তবু নিজের অনুভুতিটা সংবরণ করে সে সেখান থেকে চলে গেল। সাথে সাথে বাকি সবাইও ঘরে চলে গেল।
এদিকে শুভ দুহাত দিয়ে অয়ন্তির চোখের জল মুছে বলল, “অয়ন্তি, তুমি আমাকে...আমি ভেবেছিলাম তুমি জয়কে পছন্দ করো। কিন্তু আমার মতো একটা বাউন্ডুলে ছেলের মধ্যে কি দেখলে বল?”
অয়ন্তি লজ্জানত চোখে জানায়, “বনজ ফুলের মতো এক বন্য ও অনন্য মনের অধিকারী তুমি। যার চরিত্রের মধ্যে শহুরে সভ্যতার কৃত্রিমতা নেই। সবটাই যেন তোমার সহজাত গুণ। এমন মানুষকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়? তাই আমিও অগত্যা তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তুমি কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?”
“তোমাকে ফেরাই কি করে? তোমাকে তো প্রথম দেখাতেই ভালবেসে ফেলেছি, কিন্তু তুমি এত সুন্দরী আর গুণী। তাই তুমি কি ভাববে, এই ভেবে আমি মনের কথা মনে রেখে দিয়েছিলাম।”
দুজনের ভালোবাসা এই কয়েকদিনেই বন্য প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে উঠতে থাকল। যুগল কপোত কপোতীর মতো সবসময় একসাথে বেড়াত। কিন্তু দেখতে দেখতে ছুটি কাটানোর দিনগুলো শেষ হয়ে এল। কাল সবার যে যার বাড়ি ফেরার পালা। অয়ন্তির মনটা দিনের আলোকে ঢেকে রাখা মেঘের মতো কালো হয়ে গেল। সে নদীর ধারে মনমরা হয়ে বসে আছে। শুভ পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কি হল? এমন মন খারাপ করে বসে আছ কেন? আমি কি তোমাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছি নাকি? তুমি বাড়ি যাও। আমি ক’দিন পরই তোমার সাথে আসানসোলে দেখা করতে যাব। এখন মন খারাপ না করে রিসর্টে চল। সবাই মিলে মাতলা নদীতে নৌকা চড়তে যাব।”
“না, এখানেই আর কিছুক্ষণ থাকি আমরা। ওখানে তো সবাই আছে। আমি তোমার সাথে একা থাকতে চাই এই মুহূর্তগুলো।” অয়ন্তি কথাগুলো বলতে বলতে শুভ দিকে তাকিয়ে দেখে, সে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখের সামনে হাত নাড়াতেই শুভ সম্বিৎ ফিরে বলল, “হ্যাঁ তুমি বেশ কি বলছিলে? জানো অয়ন্তি এই ক’দিনে আমি তোমাকে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি, যে তোমার থেকে চোখ সরাতে পারছি না। আমারও তোমার কথা খুব মনে পড়বে। যতদিন না আমি কলকাতা থেকে আসানসোল যাচ্ছি, ততদিন আমরা রোজ ফোনে কথা বলব।” দুজনের কথার মাঝে হঠাৎ করে অয়ন্তির ফোনটা বেজে ওঠে। অয়ন্তি ফোনটা রিসিভ করতেই তার বাবা-মা তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় আর খানিকক্ষণ তাঁদের সাথে এটা সেটা কথা বলা নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে যায়। ফোনটা রেখে অয়ন্তি দেখে আশেপাশে কোথাও শুভ নেই। সে ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিকে গিয়ে ‘শুভ শুভ’ বলে হাঁক দেয়। কিন্তু কোন সাড়া পায় না। তখনই কোথা থেকে এক গোছা খলিশা ফুল এনে অয়ন্তির চুলে গুঁজে দিয়ে শুভ বলে, “তোমার আজ জন্মদিন! আমাকে একবারও বললে না?”
অয়ন্তি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল যে সে জানলে কি করত? শুভ ওর প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে কপালে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে ভালবাসা আর শুভেচ্ছা দুই জানাল। অয়ন্তি লাজুক দৃষ্টিতে শুভর দিকে একবার তাকিয়ে, হাতটা জড়িয়ে ধরে। তারপর ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘আজকের দিনটা আমার কাছে খুব মুল্যবান।”
দুজনে অনেকটা সময় এক সাথে কাটিয়ে দুপুরে আবার রিসর্টে ফিরে এল। কিন্তু রিসর্টে বাকি বন্ধুরা তখন ছিল না। ওদের আসতে দেরি দেখে তারা মাতলা নদীতে নৌকা চড়তে বেরিয়ে গেছে। শুভ অয়ন্তিকে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু অয়ন্তি আর যেতে চাইল না। তবে শুভ কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেল। ফিরে এল একটা বেতের তৈরি ব্যাগ নিয়ে। অয়ন্তির হাতে দিয়ে বলল, “এটা তোমার জন্য আমার তরফ থেকে আরেকটা ছোট্ট উপহার।” অয়ন্তি আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুভকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরল। ক্রমশ দুজনের মনের মধ্যে ভালবাসার উচাটনটা কেমন যেন বাড়তে লাগল। একটা সময়ে বন্ধ দরজার আড়ালে ওদের ভালবাসাটা সব সীমা ছাড়িয়ে একে অপরকে ক্রমশ কাছে টেনে নিল। অয়ন্তির শরীরের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে মিশে গেল শুভর হাতের আঙুলের আদুরে স্পর্শ। দুজনের ঠোঁটের মাঝে সব পিপাসার ঠিকানা খুঁজে পেল ওরা। তাদের দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের মধুর সাক্ষ্য হয়ে উঠেছে বসন্তের প্রকৃতি ও সুকণ্ঠী কোকিল। দুজনে ঠিক কি ভুল করছে সে হিসাব তাদের ভালবাসার মাঝে সেই মুহূর্তে উপলব্ধ হল না। দেখতে দেখতে অস্তগামী সূর্যের আলো ম্লান হয়ে বাইরের প্রকৃতি হলুদাভ কমলা হয়ে উঠেছে। এদিকে ভালবাসার পূর্ণতার আনন্দে অয়ন্তি শুভকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি আসানসোল এসে আমার বাড়িতে কথা বলবে। আমার একটু একটু ভয় লাগছে, যদি...” অয়ন্তির কথা শেষ করার আগেই শুভ বলল, “ভয় কিসের? তুমি কি ভাবছ আমি তোমাকে ভুলে যাবো বা ঠকাব? কোনদিন নয়। আমি ক’দিনের মধ্যেই তোমার বাড়ি যাবো। তুমি ঠিকানা তো আমকে ফোনে পাঠিয়েছ। আমি নতুন চাকরিটায় জয়েন করেই চলে যাবো তোমার কাছে। তোমার বাবা-মাকে গিয়ে বলব আমার জীবনের এই স্থায়ী বসন্তকে সারাজীবন আগলে রাখতে চাই। আপানাদের অনুমতিটুকু চাই শুধু। কি এমন ভাবে বলব তো? এখন তুমি তৈরি হয়ে নাও। ওরা হয়তো এখনি ফিরবে।”
পরের দিন ভোরে উঠে অয়ন্তি ব্যাগ গুছিয়ে শুভর ঘরে যায়। দুপুরে সবাই একসাথে ফিরে যাবে। কিন্তু শুভর ঘরে গিয়ে জয়ের কাছ থেকে জানতে পারে শুভ ভোরেই বাড়ি চলে গেছে। কেন চলে গেছে এইরকম হঠাৎ করে, কেউ জানে না। অয়ন্তির কাছে এই কথাগুলো কোন একটা অজানা শঙ্কার মতো মনের দরজায় কড়া নাড়া দিল। দুপুরে অয়ন্তি আর বাকি সবাই যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হল। অনেকবার সে শুভকে ফোন করে কিন্তু সে ফোন আর তোলেনি। সেদিন অয়ন্তির চোখের কোণে জমা বিন্দু বিন্দু জলকণার খবর কেউ রাখেনি। আর এই দশ বছর পড়ে সেই জলের ফোঁটা বর্তমান না থাকলেও, থেকে গেছে সেই জলের দাগ। শুভর সেই চলে যাওয়া আর ফিরে আসা হয়নি। অয়ন্তি এই দশটা বছরে শুধু বয়েসে নয় মনের দিক থেকেও অনেক অনেক বেশি পরিণত আর কঠিন হয়ে উঠেছে। সমাজ, নানা লোকের নানান মন্তব্য, উপদেশ সব কিছু উপেক্ষা করে তার মেয়ে জিয়াকে সে একা হাতে মানুষ করেছে। হয়তো বাকি জীবনটাও সে এইভাবে একা লড়াই করে কাটিয়ে দিত, কিন্তু তা আর হল না। অসুস্থ জিয়ার একমাত্র আবদার তার শুধু মা নয়, সাথে বাবাকেও পাশে চাই। তাই জিয়ার মুখ চেয়ে সে বিয়ে করতে রাজি হয়। অয়ন্তির বাবার এক কলিগের ভাইয়ের ছেলে সপ্তর্ষির সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়। যদিও অয়ন্তি তাকে এখনও দেখেনি। বাবার কথায় আজ তার সাথে প্রথম আলাপ করতে যাচ্ছে। অয়ন্তির বাবা তাকে লোক লজ্জা এড়ানোর জন্য একটা ছোট্ট মিথ্যে বলতে বলেছে। বলেছে সপ্তর্ষিকে যেন বলে জিয়ার বাবা মারা গেছে, মানে অয়ন্তি বিধবা। কিন্তু অয়ন্তির মন এই মিথ্যে বলায় সায় দেয় না। শুভর প্রতি হাজার অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, জমা থাকলেও সে কি করে তাকে মৃত বলবে? কারণ এখনও মনের কোন এক ছোট্ট কোণে সে ভালবাসার জায়গাটা অধিকার করে বসে আছে। অয়ন্তি বেঞ্চে বসে সাতপাঁচ এই নিয়ে ভাবতেই থাকে। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে তার সম্বিৎ ফেরে। সে ফোনটা রিসিভ করতেই উৎসাহিত কণ্ঠে জিয়া বলে “হ্যালো মা, তুমি বাবাকে আনতে গেছো। বাবাকে বল আমি অপেক্ষা করছি...তোমরা তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
“আচ্ছা সোনা। তুমি ভালো মেয়ের মতো ওষুধ আর খাবার খেয়ে নাও। তুমি যা চাও তাই হবে। এখন রাখি সোনা।” চোখের জল মুছে অয়ন্তি মনে মনে ঠিক করল। না জিয়ার জন্য তাকে সবটা খুশি খুশি মেনে নিতে হবে। সে উঠে আবার রেঁস্তোরার দিকে রওনা দিল। রেঁস্তোরার জানলার দিকের সিটে সপ্তর্ষির অপেক্ষা করার কথা। অয়ন্তি পিছন থেকে দেখল, একটা বেশ লম্বা চওড়া পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক জানলার দিকে মুখ করে বসে আছে। ধীর পায়ে, আনত মুখে হেঁটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। হাত জোড় করে ‘নমস্কার’ জানিয়ে বিপরীত দিকের সিটে বসল। সপ্তর্ষি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু অয়ন্তি সেই একই ভাবে চোখের দৃষ্টি টেবিলের দিকে নামিয়ে বসে রইল। কোন এক অস্বস্তি, মনের দোলাচল তাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দিচ্ছে না। খানিক বাদে অয়ন্তির মুখে কথা ফুটল। সে আমতা আমতা করতে করতে বলল, “আপনি তো বাবার কাছে আমার ব্যাপারে সব শুনেছেন। আমার জিয়া খুব মিষ্টি মেয়ে। ওর একটাই বায়না বাবাকে পাশে চায়। বাবার মুখে শুনেছি আপনি খুব ভাল মনের মানুষ। কিন্তু একটা সম্পর্ক শুরু করার আগে আমার মনে হয়...সব সত্যিটা জানা উচিত। আপনি যা জেনেছেন তার বাইরেও অনেক কথা আছে। যা আমার মনে হয় আপনাকে বলা উচিত। আমি আসলে বিধবা বা বিবাহিত কোনটাই নয়। আমি...”
“হ্যাঁ আমি জানি।” কথাটা শুনে অয়ন্তি চমকে ওঠে। সে সহসা সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে যায়। এ কি দেখছে সে, দু-তিনবার চোখ রগড়ে দেখে না সে তো ভুল দেখছে না। তার সামনে যে শুভ বসে আছে। তাহলে সপ্তর্ষি কই! সে কি ভুল টেবিলে এসে বসে পড়েছে। কি করবে না করবে কিছু ভেবে পায় না। তার গলা বুজে আসে। কথা আটকে যায় মুখের মধ্যে। বয়েসের ভারে চেহারার অনেক পরিবর্তন হলেও সে যে সঠিক চিনেছে, সে বিষয়ে দ্বিমত নেই।
“শুভ তুমি? তুমি এতদিন পর এখানে কি করতে এসেছ?” অয়ন্তি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল।
“আমি সপ্তর্ষি মণ্ডল।”
“বাহ সব জায়গায় নাম পাল্টাও বুঝি? এ কি নতুন তামাশা? আমার তোমার সাথে কোন কথা থাকতে পারে না।”
“তোমার আমার সাথে কথা না থাকলেও আমার তোমার সাথে অনেক কথা আছে।”
“আমি শুনতে চাই না। আমি আসছি।” অয়ন্তি উঠে চলে যেতে চাইলে তার হাতটা টেনে ধরে সে বলে, “তোমাকে তো শুনতেই হবে। আমার ডাক নাম শুভ। বন্ধুদের কাছে আমি ওই নামেই পরিচিত। তুমি সেই ক’দিনে আমার সম্পর্কে সেইরকম জোর দিয়ে কিছু জানতে চাওনি। আর আমারও কিছু জানানো হয়নি। সুন্দরবন থেকে আমাদের ফেরার আগের দিন রাতে আমার বাড়ি থেকে ফোন আসে। আমার দাদু মৃত্যু সজ্জায় আমাকে দেখতে চায়। আমি দাদুর প্রিয় বড় নাতি ছিলাম। খবরটা শুনে আর স্থির থাকতে পারিনি। তাই ভোর হতেই বেড়িয়ে পড়ি। তোমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলে বলে আর জানাতে পারিনি। তবে জয়কে বলেছিলাম তোমাকে জানিয়ে দিতে যে দাদুর শরীর খারাপ তাই চলে যাচ্ছি এখনি। এদিকে বাড়ি ফিরে এসে দেখি দাদুর যায় যায় অবস্থা। মৃত্যু সজ্জায় দাদুর শেষ ইচ্ছা ছিল দাদুর দেখা পাত্রীর সাথে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। আমি যখন সুন্দরবনে এসেছিলাম, তখন দাদু আমার জন্য নিজে পাত্রী পছন্দ করে, একরকম কথা পাকা কথা দিয়ে রেখেছিল। পুরানো খেয়ালের মানুষ দাদুর ধারণা ছিল তার পছন্দই শেষ কথা। আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানতাম না। দাদুর শেষ ইচ্ছা ছিল মরার আগে আমার বিয়েটা দেখে যাবে। বাড়ির চাপে, পরিস্থিতির চাপে আমার দুদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। তোমাকে কিছু বলার বা জানানোর সাহস আর আমার ছিল না। তাই তোমার ফোনটাও ধরার সাহস পাই নি। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। বর্তমান নিয়ে বাঁচার জন্য তোমার নাম্বার, তোমার স্মৃতি সব মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো একদিনের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি।”
অয়ন্তি রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “কে বলেছে পারনি। বাহ বেশ তো বিয়ে করে, বাড়ির কর্তব্য পরায়ণ ছেলে হয়ে, নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছ। তা বিবাহিত হয়ে আমার সাথে বিয়ের নাটক করতে এসেছ কেন? মেয়ে ঠকানো কি তোমার ব্যাবসা।”
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সপ্তর্ষি আবার বলতে শুরু করল, “মেয়ে ঠকানো? জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছি? ভালো বলেছ। আচ্ছা অয়ন্তি সত্যি করে বলত সব কি মনের মতো করে গোছানো হয়? আমরা শুধু সুখ খুঁজে যাই, কিন্তু সত্যি কি সুখ পাই?”
“কেন তুমি তো পেয়েছে।”
“তাই বুঝি। অয়ন্তি আমি তোমাকে ভালোবেসে অন্যকে আপন করেছিলাম। কিন্তু বিয়েটাই হয়েছিল। মনের মিল হয়নি। তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে সে গল্পের ইতি হয়। আর আমিও ভালবাসাহীন সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্তি পাই। তোমাকে ভালবাসে আমি পারিনি তাকে কোনদিন আপন করতে। আর লজ্জায় তোমার কাছেও যেতে পারিনি। ভেবেছি হয়তো তুমি আমাকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করেছ। আর তোমার বয়েসটাও তখন অল্প ছিল। ভেবেছি তুমি হয়তো আমাকে ভুলে গেছো। এই ভেবে আর তোমার কাছে যাইনি। চাকরির ট্রান্সফার নিয়ে দিল্লি চলে যাই। সারা জীবনটা একাই কাটাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আমার বাবা তোমার ছবিটা আমাকে পাঠায়। বলে কাকার বন্ধুর বিধবা একটা মেয়ে আছে। আমাকে একটা ছেলে দেখে দিতে বলে। তোমার ছবি দেখে তোমার সাথে দেখা করার লোভটা আর সামলাতে পারিনি। আমার মাথায় হাজার প্রশ্নের ভিড় জমে। আমি নিজেই বিয়ে করতে চাই জানিয়ে তোমার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে বলি। কারণ আমার আনেক কিছু জানার আর বলার ছিল তোমাকে...”
অয়ন্তি কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার কিছু জানার বা বলার নেই। বলে হাত ছাড়িয়ে রেঁস্তরা থেকে বেড়িয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পার্কের সেই বেঞ্চটায় এসে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সপ্তর্ষি তার পাশে এসে বসে। অয়ন্তির হাতে হাত রেখে বলে... অয়ন্তি আমি কি তোমার আর আমাদের সন্তান জিয়ার বন্ধু হতে পারিনা? রাতের আঁধার ঠেলে ভোরের আলো হয়ে, নেড়া গাছে বসন্তের নতুন পাতার মতো হয়ে সব শূন্যতার অবসান ঘটিয়ে, তোমাদের দুজনের মাঝে পূর্ণতা খুঁজে নিতে চাই। অয়ন্তি, যদি আমি তোমার চির বসন্ত হই, তুমি কি ফিরিয়ে দেবে আমায়...”
সমাপ্ত

