আমাদের শহর
আমাদের শহর
ভূমিকা
ভালোবাসা কোনো গল্প নয়, কোনো কবিতা নয়, কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়—ভালোবাসা হলো এক ধরনের প্রতীক্ষা। একজন আরেকজনের চোখে মায়া খোঁজে, স্পর্শে প্রশ্রয় খোঁজে, আর শেষমেশ ভালোবাসার মানে খোঁজে। এই গল্প সেই প্রতীক্ষার, সেই চোখে মায়া খোঁজার, সেই অভিমানের কান্না আর প্রতিশ্রুতির রাত্রির গল্প। এই গল্প রাফি ও তিথির—"আমাদের শহর"।
আমাদের শহর
লেখক: বাবলু
সেদিন ছিল এক শ্রাবণবৃষ্টি ভেজা দিন। আকাশ যেন ভিজিয়ে দিতে চাইছিলো সব অভিমান, সব ব্যথা। মা প্রতিদিনের মতো বকাঝকা করছিলেন, “এই বৃষ্টিতে কোথাও যাইস না।” কিন্তু কে শোনে কার কথা? বৃষ্টি আমার চিরকালই প্রিয়। হাতে ছাতা নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি শহরের পথে।
রাস্তার ধারে একটি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়েকে দেখে চোখ আটকে যায়। ভিজছে, একা, নির্ভার। তার চোখে ছিলো এক ধরণের বিষণ্ণ মায়া, যেন কোনো অনুচ্চারিত কবিতা। আমি দূর থেকে তার কিছু ছবি তুলে নিই। হঠাৎ সে আমাকে ডেকে বলে, “পারমিশন ছাড়া ছবি তুলছেন কেন?” আমি একটু লজ্জা পেয়েই বলি, “যখন কোনো অপূর্ব কিছু দেখি, তখন সেটা ধরে রাখাই ভালো।”
ওটাই ছিল আমাদের প্রথম দেখা। মেয়েটির নাম তিথি—সে নিজেই বললো পরদিন এই একই জায়গায় এসে ছবিগুলো দিতে। পরদিন ওর কমলা রঙের ড্রেস, খোলা চুল, কাজল আঁকা চোখ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ—সব মিলিয়ে আমি যেন থমকে গেছিলাম। ও জিজ্ঞেস করলো, “কি দেখছেন এভাবে?” আমি একটু হেসে বললাম, “আপনাকেই দেখছি।”
সেদিন থেকেই আমাদের গল্প ধীরে ধীরে শুরু। ছবি দেওয়া, কথাবার্তা, মেসেঞ্জারে যোগাযোগ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব। সে একদিন একটা শাড়ি পরা ছবি পোস্ট করেছিলো। আমি কমেন্ট করেছিলাম। রিপ্লাই এলো। কথা হলো। আমি ট্রিট চাইলাম, বললাম কফিতে চলি। সে রাজি হলো না। রাতেই বললো, “কাল বিকেল চারটায় জামালখানে আসেন।”
আমি পাঞ্জাবি পরে ঠিক ৪:০২ মিনিটে হাজির। সে লাল ড্রেসে, কপালে টিপ, কিন্তু হাতে চুড়ি ছিলো না। আমি বললাম, “চলুন, একটা চুড়ি কিনে দেই।” চুড়ি কিনে আমরা এক টং দোকানে বসে রঙ চা খেলাম। ওর চোখে চোখ পড়লে আমি হারিয়ে যেতাম।
আমরা দিনে দিনে ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবেসে ফেলেছি, আর বুঝতে পারতাম সেও করে—তবে বলতো না। একদিন জিজ্ঞেস করলো, “তোমার প্রেম মানে কি?” আমি বললাম, “প্রেম মানে আত্মশুদ্ধি। এখনকার জেনারেশন প্রেমকে শরীরের মিলন মনে করে, আমি মনের মিলন বিশ্বাস করি।” সে চুপ করে শোনে।
এক বছর পর, আমি তাকে প্রপোজ করি। সে কিছু না বলে চলে যায়। দুইদিন কোনো খোঁজ নেই। আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। তারপর সে মেসেজ পাঠায়—দেখা করতে চায়। দেখা হলে বলে, “আমার পরিবার অনেক ধনী, তুমি গরিব, তারা মানবে না। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”
সে চায় আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। কিন্তু আমি তখনো কলেজ শেষ করেছি মাত্র। চাকরি নেই। সংসারের দায়িত্ব নিতে ভয় পাই। আমি বলি, “তুমি বাসায় যাও, আমি ভেবে দেখি।” চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আমি সহ্য করতে না পেরে বলি, “চলো পালাই।” অনেক কষ্টে সে রাজি হয়।
১২ মার্চ, রাত ১০টা। আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। সে আসছে না। ফোন বন্ধ। পরে জানতে পারি—তার বাবা দেখে ফেলেছিলো। তাকে ঘরবন্দী করে রাখা হয়েছে।
কয়েক মাস পর আমি ঢাকায় চাকরি পাই। অনেক কষ্ট করে যোগাযোগ করে তাকে নিয়ে আসি। কাজি অফিসে দুজন সাক্ষী নিয়ে বিয়ে করি। তারপর আমাদের সংসার জীবন শুরু হয়। সে আজ আমার স্ত্রী। সেদিনের বৃষ্টি ভেজা মেয়ে আজ আমার ঘরের মানুষ।
তার বাবা খোঁজ করেছে অনেক, পুলিশ দিয়ে খুঁজেছে। তিন বছর কেটে যায়। আমাদের একটা ছেলে হয়। সে তার বাবা-মাকে দেখতে চায়। আমি বলি, “চলো যাই।” সে খুশিতে ছেলেকে বলে, “কাল নানু বাড়ি যাবো।” আমরা গিয়ে দাঁড়াই তার বাড়ির সামনে।
দরজা খুলে তার বাবা তাকিয়ে থাকে। তিথি কাঁদে। বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, “কই ছিলি মা? তোরে তো সারাদেশে খুঁজেছি।” মা এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকি, মুহূর্তটা উপভোগ করি। সবাই মেনে নেয়।
এরপর দুইদিন থেকে ফিরে আসি। সংসার চলতে থাকে। আমাদের একটা কন্যা সন্তান হয়। আজ আমাদের বিয়ের ২১ বছর পূর্ণ হলো। আমাদের সন্তান ১৮ পেরিয়ে গেছে। আমরা এখন পুরো একটা সুখী পরিবার।
তিথি এখনো সেই মায়াবী, সেই প্রেমময়ী। আমি এখনো তার চোখে প্রেম খুঁজি, সেই প্রথম দিনের মতো।
“প্রেম যদি শুদ্ধ হয়, তবে সে-ই শেষ সত্য। দেহ নয়, মায়াই প্রেমের আসল রূপ।”
