Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Imraj Hasan

Drama

3  

Imraj Hasan

Drama

দুয়ার

দুয়ার

5 mins
1.4K


দুয়ার - ইমরাজ হাসান বাতি নিভে গেল। এতোক্ষণ একটা ম্যাড়মেড়ে হলদে আলো ঘরের ভিতরটাকে জাপটে ধরে রেখেছিল, এখন অন্ধকার। যদিও অমাবস্যা নয়, তবুও রাঢ়ের মরুভূমির মতো গ্রীষ্মের ন্যাড়া মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায়;একখণ্ড প্রাচীন শিলা-আঁধারের মতো কালো ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশ থেকে দক্ষিণের বুড়ো শিব মন্দিরের যে ছুঁচালো মাথাটুকু দেখা যায়, সেটাকে রাহুর হাঁ'য়ের মতো গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। আউশজমিতে অন্ধকারের সেই ছায়া একবার পাক খেয়ে রুনুর মুখের উপরে এসে পড়ছে। জোলের জমি থেকে সাহসী শেয়ালের দল আরও সাহসী হয়ে জমিল শেখের পাঁদাড়ে এসে চাপ অন্ধকারের মতো জমা হয়৷ রুনুর ভয় লাগে। দাদিকে হাঁক দেয় সে। যদিও সে জানে, ডাক দিয়ে কোনো লাভ হবে না। 'পেত্যেক সঞ্জেবেলায় একবাটি মুড়ি খাওয়া বাদে দাদি আফিম খায়। এখন সকাল অবধি ধুত হয়ে থাকবে সে, কুনু হুঁশ থাকবে না।' একথা ভেবেই রুনুর ভয়টা আরও চেপে বসে। রুনুর বাড়ির কাছে আরও কয়েকটা বাড়ি। গ্রাম থেকে তাদের বাড়িগুলো একটু দূরে, আউশ মাঠের মাঝে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দু বা মুসলিম কোনো পাড়ার লোকজন তাদের সাথে তেমন মেলামেশা করেনা। ছেলেমেয়েরা তাদের সাথে খেলতে চায় না। রুনু ছেলেবেলায় তার মা'কে জিজ্ঞাসা করতো, 'মা আমরা হিদুঁ না মোছলমান?' তার মা কোনো উত্তর দিত না। তখন রুনুর মনে একটা চাপা কষ্ট তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। সে ছুটে যেত শ্যাওড়া তলার পীর আস্তানায়। সেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই আসে মানত রাখতে। ঘন্টার পর ঘন্টা সেই ছায়ায় বসে রুনু বুঝেছিল যে, 'তারা হিঁদু'ও লয়, মোছলমান'ও লয়। তারা উদের খেদমতগার'। ঈদের সময় তাকে তার বাপ নতুন জামা কিনে দিত না, আবার ধর্মরাজ পুজোতেও লয়। সে নতুন জামা পেতো বৈশাখ মাসে ধান উঠলে। এখানে কোনো বাড়ির সাথে কোনো বাড়ির মিল নেই। সবাই যেন সবাইয়ের শত্রু এখানে। প্রত্যেক সঞ্জেবেলায় ঘরের পুরুষেরা কেউ ঘরে না, বদলে অন্য অন্য লোক আসে। তারা ঘরে ঢুকলেই দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়। কখনও কখনও রায়েদের ছোট ছেলে, জয় দা'ও আসে রোকসানাদের বাড়িতে। রুনুর বুকটা তখন কেমন জানি চিনচিন করে।


রুনু ঘরের বাইরে দাওয়ায় এসে বসে। সামনে কয়েকটা নীচু পোড়ো জমি আর একটা জল যাওয়ার নালা। তার ওপারেই গ্রাম শুরু। ওপারে মোল্লাদের বিশাল খামার আর দোকান। দোকানে অনেক রাত অবধি হ্যাচাকের আলো জ্বলে। দোকানের সামনে দিঘির পানিতে সে আলো যেন অন্য এক দুনিয়া তৈরি করে। একদৃষ্টে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুনু ফিরে আসে ঘরে। তারপর কি যেন একটা হাতড়াতে থাকে। অথচ কিছুতেই খুঁজে পায় না সেটা। সে আবার হাঁক দেয় দাদিকে। কুনু সাড়া নাই। এখন তার থাকার মধ্যে বাড়ির সামনে বুড়ো বেলগাছটা আর এই দুয়ার। শেয়ালের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত দুয়ার। কাছেই একপাল শেয়ালের চলাফেরার শব্দ শুনতে পায় সে৷ হটাৎ একখানা ছবি ভেসে ওঠে জমাট অন্ধকারে৷ মা বেঁচে থাকতে দিনগুলো। ভেসে ওঠে মা'য়ের মরে যাওয়ার রাত। সেদিনও এমনই আঁধার। ঘরের এককোণে একটা লম্ফ জ্বলছে। একটা রঙিন চাটাইয়ে হাঁ করে মা শুয়ে আছে। বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রাত বাড়ার সাথে সাথে শেয়ালের আঁচড়ের দাগ ফুটে উঠছে মা'য়ের বুকে। রাত হয়েছে বলে দাফন করা যায় নি লাশ। সারারাত সে আর দাদি লাশ আগলে বসে। সেই দিন থেকে দুয়ারে শেয়ালের আঁচড় শুনতে পায় রুনু। যেন একটু ফাঁক পেলেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়বে একপাল শেয়াল। তার পরের কথা রুনু ভাবতে পারে না। মা'য়ের লাশ চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে, বুকের ক্ষত দেখায়। দুয়ারে খচমচ একটা শব্দ হতেই, রুনুর ঘোরটা কাটে। তার ছোট্ট বুকটা, যেখানে এখনও মাংসপিণ্ড গজায়নি তা সজোরে ওঠানামা করতে থাকে। তার মনে হয় তার বুকে এখনও মাংস গজায়নি বলেই শেয়ালেরা দরজা ভেঙে ঢোকে না, বাইরে আড়িপেতে অপেক্ষা করে মাংস গজানোর। আঁশটে একটা গন্ধে ভরে যায় ঘরের ভিতরটুকু। রুনু হাত বাড়িয়ে লম্ফ জ্বালিয়ে ঘরের কোণে দাদির একেবারে কাছ ঘেঁষে আবার ডাক দেয়, 'দাদি! এ দাদি! উঠ! আমার ভয় লাগচে' ওপাশ থেকে জবাবের বদলে একটা গোঁ গোঁ শব্দ শোনা যায়। তার ভয় এখন একফালি বুক ছাপিয়ে গোটা ঘর দখল করে। কিসের যেন আশঙ্কায় রুনু সোঁদা মাটির দেওয়ালের সাথে নিজের দেহটাকে মিশিয়ে ফেলতে চায়। রুনু দাদির দিকে তাকায়। তার মনে হতে থাকে, 'দাদি ইচ্চা করে এরম করচে, দাদিই হয়তো বা শিয়ালগুলানকে ডেকেচে। এখন নেশার ভান করচে'। লম্ফ নিয়ে সে এগিয়ে যায় দাদির দিকে, দাদির মুখের কাছে আলো তুলে ধরে৷ দাদির ঠোঁটের কোণে আবছা একটা হাসির রেখা দেখে সে।


মুসলিম পাড়া থেকে ইশার আজানের শব্দ পাগল ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঘুরপাক খেতে থাকে তাদের ঘরের চারপাশে। সময়খানি যেন থেমে যেতে চায়। রুনুর মাংস খেতে চায়। রুনুর মন চায় এখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে। রাঢ়ের এই রুক্ষ মাঠ পেরিয়ে সে চলে যাবে এমন যায়গায়, যেখানে শেয়ালের দল নেই, ভাপাধানের কটু বাতাস নেই। যেখানে মানুষ আছে। চাঁড়ালগোরের মাঠ পেরিয়ে, প্রাচীন পাকুড় গাছ পেরিয়ে সে পালাতে চায়। কিন্তু কোথায় পালাবে সে! তিন ক্রোশ দূরে নিগন স্টেশনের বাইরে সে যে কিছুই চেনে না। বাপ বেঁচে থাকতে চড়কের মেলায় ওখানে নিয়ে যেত। চুড়ি, আলতা আর পাঁপড় কিনে দিত বাপ। কিন্তু এখন যে সে একলা। দুয়ারের বাইরে শেয়ালের দল ওৎ পেতে বসে। তাদের নজর এড়িয়ে সে পালাবে কি করে৷ আর দাদি! তার কি হবে! 'না, দাদি তার আর আপন কেউ লয়। সেই ডেকেচে শিয়ালের দলকে। সেই বুজবে তার কি হবে'। ঝোড়ো হাওয়ার দাপট এসে লাগে বেলগাছটায় আর দুয়ারে; রুনুর সম্বলদুটি কাঁপতে থাকে তার মতোই। যেন এক্ষুণি বাতাসের হাত লেগে খসে খসে পড়বে সব। নিগন স্টেশনের একমাত্র রাতের ট্রেনের আওয়াজ ভেসে আসে বাতাসে। ঠিক একই সময়ে রুনুর সম্বলদুটো ভেঙে পড়ে হুড়মুড় শব্দ করে। রুনু ছুটতে থাকে। রাঢ়ের খোলা মাঠ যেন চেপে চেপে ধরে তার পা। হিলহিলে সাপের মতো অন্ধকার তার বুক চেপে ধরতে চায়। তাকে শ্বাস নিতে দেবে না কিছুতেই। এই মাঠটুকু পেরোতেই হবে তাকে। মাঠটুকু পেরোলেই স্টেশন ঘরের আলো, মানুষ। একটু দূরে একপাল শেয়ালের নখের আঁচড় পড়ে মাটিতে। চাঁড়ালগোরের প্রাচীন পাকুড় গাছের নীচে নরকের গভীরের আঁধার। সেখানে কান পাতলে শোনা যায়, ঝোড়ো বাতাস ছাপিয়ে শেয়ালের কচি মাংস চেবানোর শব্দ, পাঁজরের হাড় চেবানোর শব্দ।নিগন স্টেশন থেকে একমাত্র রাতের ট্রেন চলে যায়। একখণ্ড প্রাচীন শিলা-আঁধারের মতো কালো, গ্রাস করে সবটুকু।



Rate this content
Log in

More bengali story from Imraj Hasan

Similar bengali story from Drama