আমাদের আস্থা নন্দিতা দাসগুপ্ত
আমাদের আস্থা নন্দিতা দাসগুপ্ত
আমার কর্মজীবনের প্রায় সবটাই কেটেছে স্কুলে I দুষ্টু মিষ্টি ছোট বড় নানান মাপের পড়ুয়াদের সান্নিধ্যে থেকে আমার জীবন যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে নানা দিক থেকে।
কখনো বসেছি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মতামত বিনিময় করার প্রয়াসে , আবার কখনও
বসেছি তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে i
সঠিক সমাধান খুঁজে পেলে আমার আমার আনন্দ হতো I
স্কুলের প্রিন্সিপাল থাকাকালীন যে স্মৃতিগুলি তৈরি হয়েছিল ,তার সবটাই যে মধুর তা নয় i
টক ,মিষ্টি , ঝালে সমৃদ্ধ এই অভিজ্ঞতা গুলি আমাকে ছাত্র-ছাত্রীদের ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গেএক নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে দিয়েছিল I
এই সম্পর্কগুলি আমার কর্মজীবনে একটি সুদৃঢ় ভীত তৈরি করেছিল I এই ভিতটা একটা বড় আধার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই ব্যস্ত কর্মজীবনেI
পারস্পরিক সমতা.সমবেদনা, হৃদ্যতা ও সমভাগী হওয়ার উদ্যোগ - এই ছিল সেই আধারের উপকরণ আর আমার রোজকার কাজকর্মের শক্তির জোগান্দার।
এবার আসল কথায় আসি I
শিক্ষক শিক্ষিকারা প্রিন্সিপালের ঘরে সহসা ঢুকতে উদ্যত হন না যদি না ডাক পড়ে।
যদি নিজের থেকে ঢুকে পড়েন তাহলে বুঝতে হবে হয় ছুটির দরখাস্ত দিতে বা অন্য শিক্ষকের সঙ্গে সংঘাত মীমাংসা করতে I
মাঝে মধ্যে ছাত্র -ছাত্রীদের পঠন পাঠন অথবা তাদের সমস্যা কঠিন আকার ধারণ করলে ওনারা আমার দ্বারস্থ হতেন I বুঝতাম এখন সমাধান ওদের আওতার বাইরে I এমন সংকটে প্রিন্সিপালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য গতি নেই I
এক শান্ত সকালে আমার ঘরে ঢুকে এলো আমাদের ক্লাস ফাইভ ডি এর ক্লাস টিচার রচনা পালিওয়াল। হাসিখুশি রচনা আজকে থম্থমে মুখ নিয়ে আমার সামনের চেয়ারটিতে বসলো।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ধরা গলায় বলল “ ম্যাম , আমি আর পারব না I আমি আস্থার বাবাকে অনেক বুঝিয়ে ও পারছি না I এবার আপনি কথা বলুন I”
ওর দিকে জলের গেলাস এগিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম “কি হয়েছে ,খুলে বলবে ? “
“আস্থাকে ওর বাবা জো।নাল অ্যাথলেটিক্সে এ অংশ গ্রহণ করতে দেবেন না জানিয়েছেন। স্পষ্ট বলেছেন “মেয়েকে পড়াশুনোর জন্য স্কুলে পাঠাচ্ছি কিন্তু ও শুধু খেলাধুলাই করতে শিখছে। ” উনি বলেছেন , সামনের বছর আর এই স্কুলে রাখবেন না আস্থাকে I
রচনার কথা নতুন কোন বার্তা দিল না I আস্থার বাবার এই জেদ আগেও শুনেছি আমরা।
আস্থা খেলাধুলায় যতই মেডেল পায ,ওর বাবা এই এক অদ্ভুত জেদ ধরে বসেন I
পেরেন্ট টিচার্স মিটিংয়ে এবং আলাদাভাবে অনেকবার আস্থার বাবাকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে যে আস্থা যে বিষয়ে ভালো করতে পারে সেটা করতে দিন কিন্তু কোন ফল হয়নি।
অথচ আস্থার দুই দাদাও এই স্কুলেরই ছাত্র I পড়াশুনায় খুব ভালো না হলেও ওরা খেলাধুলায় খুব ভালো। কিন্তু বাবা ছেলেদের বিশয় কোনদিন এই ধরনের কথা বলেননি I তাদের এই স্কুলে রাখতে কোন আপত্তি নেই তার।
রচনা কে আশ্বাস দিলাম যে আমি ব্যাপারটা নিয়ে আস্থার বাবার সাথে কথা বলবো I
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে রচনা ক্লাসে ফিরে গেল I
স্পোর্টস টিচারকে ডেকে তাকে ও আশ্বাস দিলাম যে আস্থার ট্রেনিংয়ে কোন ভাটা না পড়ে I ওর ট্রেনিং যেন আগের মতই চলতে থাকে।
এবার আস্থার সম্পর্কে বলি। ছোটখাটো ফর্সা উজ্জ্বল চেহারা I হাসলে মনে হয় একটা শক্তিশালী এনার্জি ফুটছে ওর মধ্যে।
আস্থা যখন খেলার মাঠে ট্র্যাক ট্রেনিং করতো তখন মনে হতো ও হাওয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে I ওর সমকক্ষ কেউ ছিল না। এই দুর্দান্ত প্রতিভাকে আমাদের সাজ্জান কৌর কোচ করে ট্র্যাক এবং ফিল্ডের সুপারস্টার করে তুলেছিল I
আস্থার নিজস্ব প্রতিভা ও স্পোর্টস টিচারের অক্লান্ত পরিশ্রম তাকে পৌঁছে দিয়েছিল সিবিএসইর জোনাল স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপে I টিচার এর দারুন বিশ্বাস, যে আস্থার গোল্ড মেডেল ধার্য I
ওদিকে আমাদের সমবেত প্রচেষ্টা চলতো ওর পড়াশোনার দিকটা আরেকটু উন্নত করবারI আমরা সবাই চাইতাম যে আস্থা যেন বুঝতে পারে ওর দুর্বলতা টা কোথায় এবং যে এনার্জি নিয়ে
ও খেলার মাঠে নামে সেই একই উদ্যম নিয়ে পরীক্ষার হলেও যেন এই ছোট্ট যুদ্ধটা জিতে নিতে পারে।
আস্থা কিন্তু বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ? সমস্যা একটাই ছিল।
পরীক্ষার হলে আস্থা জানা প্রশ্নের উত্তর অসম্পূর্ণ রেখে আসতো পরীক্ষার খাতায় I
সময়সীমা ব্যাপারটাশুধু খেলার মাঠেই সে বুঝতো I পরীক্ষার হলে সে প্রত্যেক বার সময়ের সাথে লড়াই করে হেরে যেত। এই বার বার হেরে গিয়ে তার একটা ভয় জন্মে ছিল I কিছুতেই সেটা কাটিয়ে উঠতে পারতো না। ফলে ক্রমশ জানা উত্তরগুলিও ভুল করে আসতে লাগলো।
আমার সামনে এখন দুটো সমাধান খোঁজার দায়িত্ব I প্রথম হল আস্থার বাবাকে বুঝিয়ে তার অযৌক্তিক জেদ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনা এবং দ্বিতীয় হল আস্থার শিক্ষা বিষয়ক ক্ষমতা কে পরিপূর্ণতা দেওয়া I
আস্থার বাবাকে ডেকে পাঠানো মিটিং এর জন্য এক বৃথা চেষ্টায় পরিণত হলো। উনি ফোন তুললেন না I আমিও তৈরি ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পাঠালাম ওনার বাড়িতে সব বিবৃতি দিয়েI
চিঠির কোন জবাব এলো না কিন্তু রচনাকে ফোন করে জানানো হল যে আসতে পারবেন
না I ওনার সময় নেই। আরো জানিয়ে দিলেন যে আস্থাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করার
প্রক্রিয়া তিনি শুরু করে দিয়েছেন।
সত্যি বলতে কি .একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। হাতে একটু সময় পাওয়া গেল যে I
আস্থার জোনাল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বিষয় আশেপাশে বেশ কিছু বিরুপাত্মক প্রশ্ন উঠলেও আমি নিজে ঢাল হয়ে দাঁড়ালাম। যা হবে দেখা যাবে I
এখন প্রসঙ্গ দ্বিতীয় সমাধানটি খুঁজবার I তাই নিয়ে মাথায় তোলপাড় চলছিল I
পরদিন সকালবেলা আজ থাকে ডেকে পাঠালাম I ও সদ্য ট্রেনিং করে ক্লাসে ফিরছিল।
আস্থার সঙ্গে ওর দৈনন্দিন রুটিন নিয়ে অনেক কথা বললাম I গল্পে গল্পে জিজ্ঞাসা করলাম ওর বাবার কথাI হঠাৎ কথা বন্ধ করে মুখটা নামিয়ে নিল আস্থা।
আস্তে করে বলল “সামনের বছর আমি আর এই স্কুলে থাকবো না ম্যাম, কারণ আমি পড়াশোনা করি না শুধু খেলি।“
আমি বাক্য হারা I কি বলি এই ছোট্ট শিশু কে?
হঠাৎ কি মনে হলো , জিজ্ঞাসা করলাম “তোমার প্র্যাকটিস কেমন চলছে ?”
আবার সেই মুখ ভর্তি ঝকঝকে হাসি I বলল “খুব ভালো ম্যাম I”
জিজ্ঞাসা করলাম “ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছো তো ?” বলল “মা আপনার কথা মত আমাকে এক্সট্রা টিফিন দেয়। আর সকালে উঠে আমি রোজ স্প্রাউট খাই I ”
“খুব ভালো I আমি কিন্তু কাল সকালবেলা তোমার ট্রেনিং দেখতে আসবো।
তোমার সঙ্গে আবার কালকে কথা হবে I এখন ক্লাসে যাওI ”
আস্থা প্রায় নাচতে নাচতে ক্লাসের দিকে রওনা হল I
পরদিন আমি হাজির হলাম স্কুলে ৭টার সময়। আস্থা তার দুই দাদার সাথে ঢুকলো।
এই ছোট্ট মেয়েটির অসাধারণ প্রতিভা দেখে ওকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ট্রেনিংয়ের জন্য I বাকি ছাত্র-ছাত্রীরা ওর থেকে অনেক বড় ছিল।
ট্রেনিং শেষে আবার আমি আর আস্থা মুখোমুখি। আস্থার কাপে দুধ আর আমার কাপে
চা I জিজ্ঞাসা করলাম “আচ্ছা আস্থা দৌড়াবার ঠিক আগে কিভাবে মনঃসংযোগ করো?”
ও বলল “শুধু ফিনিশিং লাইন দেখি Iআর কিছু চোখে পড়ে না। তারপর প্রাণপণে লড়িI”
আস্তে করে বললাম “আজ তো ইউনিট টেস্ট আছে অংকের I প্র্যাকটিস করেছো ?”
মাথা নাড়ল I বললাম “অংক মন দিয়ে টুকে নেবে তারপর একবার মিলিয়ে নেবে।
ডিজিট ভুল হলে ফলস স্টার্ট হবে কিন্তু I আর ফিনিশিং লাইন হল তোমাদের ক্লাসের দেয়াল ঘড়ি I ওটার দিকে নজর রেখো I”
বেস্ট অফ লাক বলে ক্লাসে যেতে বললাম।
আস্থার অংকের টিচার ইন্দ্রাণীকে ডেকে পাঠালাম। সবটা খুলে বললাম।
আর ও বললাম ওর পেপারটা পরীক্ষা হওয়ার সাথে সাথেই চেক করে আমার কাছে নিয়ে আসতে।
পরদিন আস্থার জোনাল প্রতিযোগিতাI I যথা সময় আস্থাকে এবং অন্য প্রতিযোগীদের নিয়ে স্পোর্টস টিচার আমার ঘরে ঢুকলো I ওদের সবার জন্য পারমিশন স্লিপ তৈরি করে
দেওয়া হল এবং যথারীতি ওরা বেরিয়ে পড়ল।
আমিও অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ ইন্দ্রাণীর গলা শুনে ওকে আসতে বললাম I ইন্দ্রাানির হাতে আস্থার অংকের খাতা I
আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ইন্দ্রানী ভীষণ উত্তেজিত গলায় বলল “ম্যাম আস্থা
ভালোই করেছে অংকে। এই বছরের যত অংক পরীক্ষা, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে এইটাতে।“
আস্থার ওপর আমাদের সকলের যে বিশ্বাস সেটাই যেন প্রমাণ করল এই অংকের খাতা I আমরা সবাই বুঝতে পারলাম যে এবার আস্থা ওর পরীক্ষায় ফলাফল উত্তরোত্তর ভালো করবে। কারণ যে বাধাটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না সেটা আস্তে আস্তে কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত। স্পষ্ট পাওয়া গিয়েছে।
আস্থা আমাদের জোনাল প্রতিযোগিতায় নিরাশ করেনি I শুধু স্বর্ণপদক ই নয় সে এক নতুন রেকর্ড তৈরি করেছিল ২০০ মিটারে I সেদিন স্বর্ণপদক টার থেকেও বেশি ঝকঝক করছিল আজ তার হাসিটা I
আমাদের সবার যে বিশ্বাস ছিল ক্রমশ পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়গুলি তে বেশ দ্রুত গতিতে উন্নতি দেখাতে লাগলো I আস্থা শুধু মাত্র ক্লাসের পরীক্ষাতেই নয় - সে ফাইনাল ইউনিট টেস্টে বেশ ভালো রেজাল্ট করলো। এতটাই ভালো যে তার প্রথম দশ জনের মধ্যে স্থান হল I
না না . গল্পের এখানেই শেষ নয়।
একাডেমিক বছরের শেষ সপ্তাহের পেরেন্ট টিচার মিটিং এর জন্য সব ব্যবস্থাপনা দেখাশোনা করতে করতে বাড়ি ফিরতে বিকাল হয়ে গেল।
সব অভিভাবকদের চিঠি পাঠানো হয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহ আগেই I আস্থার বাবাকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে I যদিও ওনার কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি I
মনটা আমার বেশ খারাপ I বারে বারে আস্থার মুখটা ভেসে উঠছে।
স্কুলের একাডেমিক বছর এর সমস্ত ফাইনাল ফলাফল সব অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হবেI I তাই সেখানে কোন ভুল ,ত্রুটি মার্জনা হবে না I আমাদের স্কুল জীবনের এইএক নির্ভুল নিয়ম I
প্রত্যেক অভিভাবককে সময় ধার্য করে দেওয়া হয়েছে। তারা নির্ধারিত সময় উপস্থিত হয়ে টিচারদের সঙ্গে যাতে কথাবার্তা বলতে পারেন তার জন্যই এত ব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত I
শনিবার সকালের অনেকটাই কেটে গেল টুকিটাকি কাজ সারতে I কেবল অফিসে ফিরে
বসেছি , এমন সময় দরজায় টোকা I
আনন্দের সীমা রইল না যখন আস্থার বাবা নিজেই যেচে এলেন হাতে এক বাক্স মিষ্টি আর কোলে আস্থা I আস্থার গলায় আজ যেন পদকটা আরো জল জল করছে I
আস্থার বাবাকে বসতে বললাম I কিন্তু বার বার নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম এত বড় উত্তরণ !
এ কি সত্যি ?
আস্থাকে কোলের থেকে নামিয়ে ওর বাবা বললেন “ওকে আপনিই রাখুন ম্যাম I আমি ওর মর্ম বুঝিনি I “
আমার জীবনের এই স্মৃতিটি আমি কোনদিনও মুছবে না I আস্থা ওর বাবার কোলে মেডেল
পরে আর দুজনের উজ্জ্বল হাসিমুখ I
এক রুড়ীবাদী যাদব পরিবারে জন্মে আস্থা কে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে সে শুধু খেলার মাঠেই নয় পড়াশোনাতেও প্রথম সারিতে দাঁড়াতে পারে আর তাই সে পারে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে I
কন্যা সন্তান যে পুত্র সন্তানের সমকক্ষ বা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ তার প্রমাণ দিতে হল আস্থাকে I মেয়ের এই উন্নতিতে আস্থার বাবা নিজের পরিবারের মেয়েদের বলে দিয়েছিলেন “আস্থার মতো হও।“
আজ এত বছর পরে লিখতে বসে আস্থার সেই কচি মুখটা স্পষ্ট মনে পড়ছে I এই স্মৃতি
ছবিতে ধরা যায় না I এ রকম ঘটনা প্রত্যেক টিচারের নিজের পড়ুয়ার প্রতি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও স্নেহ ভালবাসার আস্থা I
নন্দিতা দাসগুপ্ত
