উল্টোপুরান
উল্টোপুরান


"অর্ক ওঠ বাবা, তোর না আজকে কী একটা জরুরী মিটিং আছে দশটার সময়। এখন না উঠলে লেট হয়ে যাবি তো অফিসে। ওঠ ওঠ..."
আটটা বাজতে চললো, এদিকে এখনো ছেলেটার ওঠার নাম ই নেই, বড্ড ঘুমকাতুরে, একবার বিছানায় গেলে আর ওঠার নাম ই করতে চায় না। যদিও অফিসে কাজের ও ভীষণ চাপ, পর্ণাদেবী বোঝেন। তাই তো ওর ঘুমিয়ে থাকা মুখখানি দেখে বড্ড মায়া হয় ওনার, মনে হয় ভগবান তো ওর জীবনের সব কিছু ই কেড়ে নিয়েছে , উনি আর ওর ঘুমটা নাই বা কেড়ে নিলেন। ইচ্ছে করে না ডাকতে,তবুও শেষমেষ ডাকতেই হয়।নাহলে তো আরেক বিপদ! ঘুম থেকে উঠে যেই দেখবে দেরী হয়ে গেছে ওমনি চেঁচামেচি শুরু করে দেবে ডাকোনি কেন ডাকোনি কেন বলে।
"এহঃ আটটা দশ বেজে গেছে,আরো আগে আমায় ডাকেনি কেন মা ?! বড্ড দেরী হয়ে গেল আজ।"
"আমি তো সেই সাড়ে সাতটা থেকেই ডাকা শুরু করেছি, তুই যা কুম্ভকর্ণ উঠলে তো! এখন যা তাড়াতাড়ি স্নান টা সেরে আয়। আমি টিফিন রেডি করছি।"
অর্ক স্নানে ঢুকে গেলে রান্নাঘরে খাবার বানাতে গেলেন পর্ণা দেবী। বাড়িতে যদিও সব কাজের লোক ই রয়েছে, অর্ক ওনাকে কিছুই করতে দিতে চায় না তবুও এই রান্নার কাজটা নিজে হাতেই করেন উনি। ভালো লাগে করতে, আপনার লোক বলতে গেলে তো এই অর্কই একমাত্র পড়ে রয়েছে ওনার, ওকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতে বড্ড ভালো লাগে। বরাবরই একটা ছেলের ভীষণ শখ ছিলো ওনার। তাইতো হসপিটালে যখন প্রথম শুনেছিলেন ওনার মেয়ে হয়েছে তখন সত্যি বলতে একটু মুষড়েই পড়েছিলেন উনি। শ্রীর বাবা তখন বলেছিল আরে এখন কিছুদিন মেয়েটাকে মানুষ করে নাও তারপর দেখবে মেয়ের বিয়ে দিয়ে কেমন জামাইকেও নিজের ছেলের মতো ভালোবেসে ফেলেছ। তখন মুখ বেঁকিয়ে পর্ণা দেবীই ওর বাবাকে বলেছিলেন "পর কখনো আপন হয়না গো।" ইশ আজ ওই লোকটা থাকলে কত খুশি হতেন।
বছর সাতেক আগে শ্রী আর অর্ক র বিয়েটা হয়েছিল। ওনারাই দেখে শুনে দিয়েছিলেন। ওনার ভাসুরের ছাত্র ছিল অর্ক। সেখান থেকেই সূত্রপাত। কোঁকড়া চুলের এই ছেলেটা প্রথম থেকেই ওনার মনে জায়গা করে নিয়েছিল। কেন জানি না ওর চোখ দুটো দেখে বড্ড নিজের লাগতো ছেলেটাকে। দু বছর বাদে ওদের একটা মেয়েও হয়েছিলো। পর্ণা নাম দিয়েছিলেন সংযুক্তা আদর করে ডাকতেন সঞ্জু বুড়ি। বেশ ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। হঠাৎই গত বারের আগের পুজোটা কালবৈশাখী র ঝড়ের মতো সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে গেলো ওনার জীবন থেকে। সঞ্জু তখন তিন বছরের। পুজোর ছুটিতে ওরা গ্যাংটক গেছিলো তিন জনে মিলে। সঞ্জু বুড়ির তখন কতো আনন্দ, ফোনে দিদু কে রোজ রাতে গল্প করতো আজ কতো বড় পাহাড় দেখেছে, পাহাড় গুলো সব বিশাল উঁচু, ওর কত ইচ্ছে ছিলো ওঠার কিন্তু মাম্মা পাপা কেও নিয়ে যায়নি, তাই ওর খুব রাগ হয়েছে। দিদু যেন বাড়ি আসলে খুব করে বকে দেয় মাম্মা পাপা কে। আরো কতো কথা। হঠাৎ ই ফেরার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ওদের গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করলো। সোজা খাঁদের মধ্যে পড়লো। শ্রী আর সঞ্জু বুড়ি ওখানেই শেষ। শুধু অর্ক আর গাড়ির ড্রাইভার কী ভাবে যেন বেঁচে গেল।এদিকে ওর বাবা খবরটা শুনে সামলাতে পারলেন না, হার্ট অ্যাট্যাকে চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে, ওনাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই। মেয়ে, নাতনি, স্বামীকে হারিয়ে পর্ণা যেন তখন পাথরের মত হয়ে গেছিলো, একা হাতে লড়াই করেছিলো যুদ্ধের বিরুদ্ধে। একটাই লক্ষ্য ছিলো অর্ক কে বাড়ি ফিরিয়ে আনা। তারপর দিন কেটেছে, ছোটবেলা থেকে মা বাবা হারানো অর্কর শাশুড়ি মা থেকে মা হয়ে উঠেছে পর্ণা, মা ছেলে যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে জীবনে বেঁচে থাকার প্রত্যেকটি নিঃশ্বাসে, প্রত্যেকটি স্পন্দনে।
"মা আমি আসলাম,দরজা টা দিয়ে দাও।"
অর্ক র গলার আওয়াজে চমক ভাঙলো পর্ণার। দরজার সামনে এগিয়ে আসতেই অর্ক বলে উঠলো
'মনে আছে তো,আজ বিকেলে কিন্তু গয়নার দোকানে যাব। রেডি হয়ে থাকবে মা,আমি ফোন করলেই নীচে নেমে আসবে,আমি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।ভুলে যেও না যেন। আচ্ছা ছাড়ো, আমি দুপুরে টিফিনের সময় মনে করিয়ে দেব আরেকবার।"
অর্ক চলে গেল। পেপারটা খুলে সোফায় বসল পর্ণা। যদিও মনটা একেবারেই নেই পেপারের হেডলাইনসের উপর। মুখে সরাসরি সেরকম না বললেও পর্ণা ভালো ভাবেই জানে, তৃষিতার জন্যই কিছু একটা কিনতে যাবে অর্ক আজ। মা র পছন্দ খুব ভালো বলে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। তৃষিতা কে প্রথম যেদিন দেখেছিলেন বাড়ির নারায়ণ পুজোয় সেদিনই বুঝেছিলেন এই মেয়ে অর্ককে ভালোবাসে। অন্যান্য সব কলিগদের সাথে তৃষিতা ও এসেছিল ওনাদের বাড়ি।অর্ক বলেছিল তৃষিতা নাকি ডিভোর্সি।বিয়ের কয়েক মাস বাদেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বরের সাথে। তারপর অর্ক আর তৃষিতার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, আস্তে আস্তে তা আরো এগিয়েছে। সত্যি বলতে পর্ণা খুশিই হয়েছেন, উনি তো আর সবদিন থাকবেন না, ছেলেটার একাকিত্ব এর জীবনকে গুছিয়ে দিতে যদি কেউ আসে তাহলে ক্ষতি কী!! অর্ক কোনোদিনই কিছু গোপন করেনি ওনার কাছে। দিনের শেষে মায়ের সঙ্গে সব গল্প না করলে ছেলে টার পেটের ভাত হজম ই হয়না যেন। শুধু যে কথা টা অর্ক বেমালুম চেপে গেছে সেটা হলো তৃষিতা আর ওর মা বাবার ওনার অর্কর সঙ্গে থাকার বিষয়টি পছন্দ না হওয়া।
এ কথা তৃষিতার মা বাবা নিজে এসে ওনাকে বলে গেছে।
"দেখুন বুঝতেই পারছেন,তৃষিতা আর অর্ক একে অপরকে ভালোবাসে। ওরা ওদের জীবন টাকে নতুন করে শুরু করতে চাইছে। তাই ওদের বিয়ের পর যদি ওদের পার্সোনাল লাইফে আপনি ইন্টারফেয়ার করেন তাহলে অর্ক র নিজের অতীতের কথা আরও বেশি করে মনে পড়বে। ও চাইলেও শ্রী আর ওর মেয়ের কথা ভুলতে পারবে না। তাই আপনাকে বিনীত অনুরোধ আপনি ওদের লাইফ থেকে সরে যান। জানি আপনারকেও নেই সেরকম দেখার মতো। কিন্তু এ শহরে আজকাল তো অনেক ওল্ড হেরিটেজ হোম চালু হয়েছে।তারই ভালো কোনো একটাতে চলে যাবার ব্যবস্থা করুন। না এখনই যাবার কথা বলছি না। তাহলে অর্ক বিয়েতে রাজিই হয়তো হবে না। এক দু মাস বাদে..আপনি চাইলে আমরা আপনাকে ফিনান্সিয়ালি ও হেল্প করতে পারি।"
সেদিন রাতে বন্ধ ঘরে অনেকদিন বাদে খুব কেঁদেছিল পর্ণা। অর্ক কে ও নিজের ছেলের মতো ভালোবেসেছিল, অর্ক ও তো নিজের মায়ের জায়গা টাই দিয়েছিল ওকে। তাহলে কেন.. কেন ?! না বৃদ্ধাশ্রম এ যাবার জন্য তাঁর খারাপ লাগেনি, তিনি তো ধরেই রেখেছিলেন একদিন না একদিন ওনাকে যেতেই হবে ওখানে।তাঁর খারাপ লেগেছে অন্য জায়গায়।অর্ক নিজে মুখে বলতে পারত না কথা টা!! তাহলে উনি হাসিমুখে সরে দাঁড়াতেন কোনো কষ্ট ই থাকত না ওনার। শুধু শুধু পরের লোক কে দিয়ে বলার কী দরকার ছিলো! এটা তো কম অপমান নয় ওনার কাছে। তবে কী সত্যিই পর কখনো আপন হয়না!!
পরে ভেবেছেন হয়তো অর্ক লজ্জা পেয়েই বলতে পারেনি নিজে মুখে কিছু।সত্যিই তো অর্ক র অতীতের একমাত্র চিহ্ন পর্ণা নিজেই। অর্ক যদি সব কষ্ট ভুলে জীবন কে নতুন করে শুরু করতে চায় তবে কী মা হয়ে ওনার উচিত না ছেলের পাশে দাঁড়ানো। ফিক্সড ডিপোজিট এর টাকা গুলো দিয়ে একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে নিতে পারবেন উনি।
ব্যস্ত রাস্তার উপর দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে। মিউজিক সিস্টেমে কী একটা বাংলা গান বেজে যাচ্ছে। দেড় লাখ টাকা দিয়ে একটা হীরের আংটি কিনেছে অর্ক। এতোটা দামী না কিনলেও পারত।সামনে ফ্ল্যাট কিনবে বলছে,তারপর নতুন সংসার খরচা তো কম নয়! বুঝে শুনে না খরচ করলে পরে নিজেরাই সমস্যায় পড়বে। থাক,পর্ণা অত ভাবছেন কেন,ওদের জীবন,ওদের সংসার,ওরা ঠিক সামলে নেবে।
"অর্ক এদিকে কোথায় যাচ্ছিস ?! বাড়ি তো......"
"রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি বুঝলে। আজ রাতে ডিনার টা বাইরেই করব। তোমাকে আর বাড়ি গিয়ে কষ্ট করে রান্না করতে হবে না..."
"তৃষিতা কে তাহলে আংটি টা আজকেই দিবি ?!"
"তৃষিতা!! এর মধ্যে ও কোথা থেকে আসছে।"
"না আংটি টা কিনলি তো, তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম আজই ওকে দিয়ে দিবি কিনা.."
"ওয়েট আংটি কিনেছি তো তোমার জন্য। ভুলে গেছ আজ মাদার্স ডে না।তোমার একমাত্র ছেলের তরফ থেকে ছোট্ট উপহার তোমায়। সারাবছর তো এতো জ্বালাতন করি তারই পুরস্কার বলতে পারো। হা হা ... আর শোনো তৃষিতার কথা ভুলে যাও। ওর সাথে কালই ব্রেকআপ করে দিয়েছি আমি।"
বাকস্তব্ধ হয়ে যায় পর্নাদেবী।
"সে কী রে, কেন ????"
"আর বলো না, ও এর ওর মা বাবা র দু জনেরই বক্তব্য তোমাকে সঙ্গে নিয়ে থাকা যাবে না। হাওয়ায় ভাসুক ভালোবাসা, আমার এক মা কে আমি ছোটো বেলাতেই হারিয়েছি, তোমার মেয়ে ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এখন তোমাকে তো আমি মরে গেলেও ছাড়ছি না, এই শুনে রাখো।"
চোখ দুটো দিয়ে আপনাআপনিই জল বেরিয়ে আসতে লাগলো পর্ণা দেবীর।
"তবে কী সারা জীবন বুড়ো মারই দেখভাল করে যাবি! আমার বৌমার মুখ দেখার স্বপ্ন টার কী হবে!"
"মায়ের জন্য বৌমা আনতে তো আপত্তি নেই, তবে তাকেই আনবো যে আমাকে আর আমার মা কে দুজনকেই সমান ভাবে ভালোবাসবে।"
আর কিছু বলতে পারলেন না পর্ণা দেবী।হান্ড্রেড ওয়ান পয়েন্ট জিরো টু এফ এমে তখনো বেজে চলেছে নচিকেতার গানটা,
"স্বামী স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ান জায়গা বড়ই কম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম............"