শ্মশানচারিনীর মোহজালে
শ্মশানচারিনীর মোহজালে
তন্ত্রসাধক ও শাক্তদের মতে শক্তির উৎস, ব্যাপ্তি, সঞ্চয় ও সত্যতা ১০ টি ভিন্ন রূপে ব্যক্ত করা যায়। এই ১০ টি ভিন্ন রূপই হল দশমহাবিদ্যার প্রকাশ ও প্রতীক। এগুলি হল, কালী,তারা,ত্রিপুরাসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনী ।
একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন দেবী ধূমাবতীর প্রতি আমি প্রবলভাবে আসক্ত হয়ে পড়ি। দিদিরা তখন কলকাতায় থাকতো, মুদিয়ালীতে একটি বহুতল ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে। ওদের ছাদে উঠলেই দেখা যেত, খানিক দূরে বামদিক ও ডানদিকে ঘেঁষে অবিরাম ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে ও আবছা করে দিচ্ছে সংলগ্ন অঞ্চল। প্রথমদিকে কিছুই বুঝতে পারতাম না, কিন্তু বড়ই কৌতূহল হতো। তবে , কিছুদিন পর ছোট কাকার সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করলাম। জানতে পারলাম, বামদিকে শিরিটি ও ডানদিকে কেওড়াতলা মহাশ্মশান। সেকালে দশমহাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনারও প্রবল নেশা তৈরী হয়েছিল আমার। কেবলই ওই ছাদে যাওয়ার জন্য একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতাম। ধীরে ধীরে ওই চিতার ভস্মরাশি থেকে উদ্ভূত ধূমের স্বরূপ অলক্ষ্মীর (জ্যেষ্ঠা দেবী) প্রতি নিদারুণভাবে আকর্ষিত হয়ে পড়ি। দেবী ধূমাবতী বিধবাবেশী, কূলহীন, ভিটেহীন, অতি ভয়ংকর রূপসম্পন্ন দেবী, যিনি চিতার ছাই-ভস্ম মেখে অহরহ শ্মশানভূমিতে বিচরণ করেন। সধবাবেশ তাঁর মোটেই পছন্দের নয়। সাদা বস্ত্রের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ। নারীশক্তি যখন সংহারের অতি বিকট রূপ হিসেবে প্রকাশ পায়, তখনই দেবী ধূমাবতীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
রক্তনেত্রা তীক্ষদন্তী কর্মফল পেটিকায় যার দক্ষিণ কড়ের শোভাবর্ধন করে, যিনি মদ্য ও মাংসপ্রিয়, সেই কলহ-বিচ্ছেদ পটীয়সি জরতি মূর্তিধারণী দেবীও মায়ের এক রূপ। অশ্বোহীন রথ বা সাদা ও কালো কাক তাঁর বাহন। খিলখিল করে যে অট্টহাসি তিনি হাসেন, তা যে কোনো মানুষের হাড় হিম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এরূপ নিরাভরণ ও কুৎসিত রূপ কোনো দেবীরই প্রত্যক্ষ করা যায় না। তিনি একহাতে কুলো ও আর এক হাতে বরদামুদ্রা ধারণ করে থাকেন। কথিত আছে, দক্ষযজ্ঞের ফলস্বরূপ সতীর দেহ অগ্নিদগ্ধ হলে, সেই অগ্নির কালো ধোঁয়া থেকে ধূম্রের ন্যায় দেবী , ধূমাবতীর আবির্ভাব ঘটে। হ্যাঁ, তিনি কদাকার, ভিটেহীন, উগ্রচন্ডা, অন্ধকার কূপকূপে পরিত্যক্ত গৃহ আর শ্মশান তাঁর প্রিয় বিচরণস্থল। মৃতের স্তূপে তাঁরই লীলাখেলা চলে, অন্ধকারের মাদকতায় ঘনঘন নিঃশ্বাসে সমস্ত শ্মশানভূমি হয়ে ওঠে তাঁর অবাধ বিচরণক্ষেত্র, লীলা চলে সারা রাত, যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্রম্মমূহুর্ত উপস্থিত হয়।
তবে, মায়ের এই রূপটিকেও ভক্তি করা বাঞ্ছনীয়। কেবলমাত্র, সৌম্যমূর্তির পূজো করা হয় না তো বাস্তবে, শুধু চক্ষুসূখে কী লাভ !!?? মা তো আর ভাগের হন না। তাই ভক্তিতেই বা বিভেদ কিসের ভিত্তিতে!? মায়ের কদাকার রূপটাও, কদাকার হাসিটাও তো নিতে হবে। ভাগের ভালোবাসার কোনো অর্থই হয় না। অনেক কিছুই পড়া হতো দশমহাবিদ্যার ব্যাপারে ওই সময়। প্রায়ই দিদিদের বাড়ি গিয়ে থাকতাম। একদিন ভোরবেলা আচমকাই ঘুমটা ভেঙে গেল। ওই সময় সচরাচর কিন্তু আমার ঘুম ভাঙে না। নভেম্বর মাস, গায়ে মোটা চাদর বিছিয়েই শুয়েছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি চাদরটা পায়ের কাছে সরিয়ে রাখা। এদিকে ঠান্ডাও কিন্তু কিছু কম না সেই দিন। যাই হোক, আবার চাদরটা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু, এবার বিভ্রাট ঘটল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই মনে হল, হঠাৎ কেউ যেন আমার পা দুটি ধরে ১৮০° ঘুরিয়ে দিল। ভয়ার্ত হয়ে আমি বিছানা ছেড়ে সোজা উঠে দাঁড়ালাম।কয়েকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ার পর, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ পড়তে দেখি উত্তর-পূর্ব দিকে আকাশটা ধোঁয়ায় কেমন যেন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই,ঘড়িটা ঢংঢং করে বেজে উঠলো। ঘড়িতে তখন রাত ৩ টে বেজে ১০ মিনিট। হঠাৎই মনে পড়ল, আজ তো দীপান্বিতা অমাবস্যা। মধ্যরাতে অন্নভোগ, ফল ও পশুবলির মাধ্যমে ধূমধাম করে মায়ের আরাধনা চলছে নিশ্চয় শ্মশানভূমিতে। যতক্ষণ শ্মশানকালী পূজা চলতে থাকে, ততক্ষণ একের পর এক মৃতদেহও চিতায় জ্বলতে থাকে। মহাশ্মশানের ব্যাপারে এইরকমটাই শৈশব কাল থেকে শুনে আসছি।
বুঝতে দেরি হল না যে, শ্মশানের দিকে পা করে শোয়াটা মোটেই উচিত হয়নি। ধূম্রবর্ণা দেবী রুষ্ট হয়েছেন। সম্বিত ফিরতেই দুহাত তুলে মা কালীর কাছে ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে নিলাম। তারপর আর কখনো এরূপ ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার হইনি।
