শেকড়ের স্বীকারোক্তি আমি নই
শেকড়ের স্বীকারোক্তি আমি নই
আমি নই কেবল এক গাছ—
আমি নিঃশব্দে জন্ম নেওয়া এক জীবন, যার কান্না কারো কানে পৌঁছায় না, আর যার ভালোবাসা কেউ মনে রাখে না।
প্রথম আলো যখন আমার পাতার কোণে এসে পড়েছিল, আমি শিশুর মতো কেঁপে উঠেছিলাম। তখন আমি জানতাম না, জীবনের প্রতিটি রশ্মি আমাকে শুধু বড় করবে না, গলা টিপে ধরবেও একদিন।
শুরুতে সবাই খুশি ছিল আমার নিয়ে।
“বাহ, কত সুন্দর গাছ!”—বলত পাশ দিয়ে হাঁটা মানুষগুলো। আমি হাওয়ার সঙ্গে দুলতাম, পাখিরা ডাকে ভরিয়ে রাখত আমার ডালপালা। ছোট ছোট বাচ্চারা আমার ছায়ায় লুকোচুরি খেলত, আর আমি সবটুকু দিয়ে হাসতাম।
কিন্তু সময় গেল… আমি বড় হতে লাগলাম।
বড় হওয়াটা যেন আমার অপরাধ হয়ে দাঁড়াল।
কারো ঘরের রোদ বন্ধ করে দিলাম, কারো উঠোনে পাতাঝরা ঝামেলা বাড়ালাম, আবার কারো মাথার ওপর ছায়া ফেলে দিলাম—তাদের মতে, আমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠলাম।
তখন তারা এল করাত নিয়ে…
একটা, দুইটা, দশটা বার—চিৎকার করেছিল আমার শরীর, কিন্তু শব্দ বেরোল না। আমার গায়ে হাত চালানো করাতগুলো যেন বলল,
“তুই তো গাছ—তোর চিৎকার কেউ শোনে না।”
আমি কেটে পড়লাম।
একটা বিশাল ট্রাক আমাকে নিয়ে গেল। আমার শরীর টুকরো টুকরো করে কাগজে রূপান্তর করল—আর সেই কাগজে কেউ লিখল তার জীবনের গল্প, কেউ পরীক্ষার খাতা বানাল, কেউ বানাল প্রেমপত্র, কেউ বানাল সরকারি ফাইল।
আমি কথা বলিনি, তবু সবাই আমার শরীরে নিজের কথা লিখল।
আমার আরেকটা অংশ গেল দরজা হয়ে—ঘরের ভিতরে মানুষ যখন সুখ-দুঃখ ভাগ করছিল, আমি চুপ করে সব শুনছিলাম।
কেউ জানে না—একটা দরজা কত গল্প শুনে।
আমার কিছু অংশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো—তাতে কারো রান্না হলো, কেউ গরমে হাত সেঁকলো, কেউ আবার শীত থেকে বাঁচল।
আমি পুড়লাম, তবু তাদের হাসি দেখেই তৃপ্তি পেলাম।
আমি কি কষ্ট পাইনি?
পেয়েছি—প্রতিটি চেরা, প্রতিটি পোড়া দাগ আমার ভিতরের আর্তনাদ হয়ে আছে।
কিন্তু আমি চেয়েছি… শুধু একটাই জিনিস—
তাদের জীবন হোক সুন্দর।
আমাকে কেউ মনে রাখেনি,
তবুও আমি গর্বিত।
আমি মানুষের ঘরে জায়গা করে দিয়েছি, তার জ্ঞানে আলো জ্বালিয়েছি, তার জীবন বাঁচিয়েছি—আমি তা-ই গাছ, যে সব দিয়ে দেয়, কিছু চায় না।
