পরিযায়ী পাখি
পরিযায়ী পাখি
অনীক আনমনা হয়ে বড়ো ঝিল টার পাড়ে বসে ছিল।চারি দিক টা শান্ত,একটু বেশিই যেনো।হয় তো দুপুর বেলা বলে এরম মনে হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল কিন্তু অনীকের কাছে আরো অনেক কারণ ছিল সেটা মনে হওয়ার। গত ৫–৬ মাস তার ভালো যাচ্ছিল না।একের পর এক চাকরির পরীক্ষায় সে বসছিল কিন্তু কোনো টাতেই লাভের লাভ করতে পারছিল না।এদিকে বাড়িতে বাবার শরীর ভালো না।সব মিলিয়ে সে ভীষণ মন মরা হয়ে ছিল।ছোটো থেকে সে পড়াশোনা তে ভালই,কিন্তু এখন তার নিজের উপর থেকেও আস্থা টা উঠে যেতে বসেছে।বাড়িতেও তার থাকতে ভালো লাগেনা এই কারণে।তাই কিছুটা মন হালকা করার জন্য এখানে আসা।সে বরাবরই একটু একলা একলা থাকতে পছন্দ করে,মন খারাপের দিন গুলোতে সে এই ঝিলের পাড়ে এসে বসে আর সেখানে ভিড় করা পরিযায়ী পাখি দের দেখেই তার মন ভালো হয়ে যায়।কিন্তু আজকে যেনো কোনো কিছুই তার পক্ষে নেই। চার পাশে কোনো পাখির দল নেই যাদের দেখে তার মন ভালো হবে,আকাশ টাও মুখ ভার করে রেখেছে,দুশ্চিন্তার মেঘে।এই অবস্থায় অনীক ভাবছিল উঠেই যাবে হঠাৎ করেই তার নজরে পড়লো একটা বাচ্চা ছেলে দূরে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে কি একটা করছে।কৌতূহল বশত সে তার কাছে গেলো এবং দেখলো সে মন দিয়ে কিছু একটা আঁকছে।বাচ্চাটির রুগ্ন শরীর,গায়ে একটা পাতলা সোয়েটার(সেদিন মেঘলা হওয়ায় ঠাণ্ডা টা একটু বেশিই ছিল)তাও কিছু জায়গায় ছেঁড়া এবং একটা হাফ প্যান্ট।কিন্তু তার মনোযোগ ছিল দেখবার মত।তাই অনীক সেখানে হেঁটে এলেও সে বিন্দু মাত্র টের পায়নি।"কি করছো?"অনীক পিছন থেকে ডাকতে সে চমকে উঠলো।সে বললো সিনারি আঁকছি,পাশে বসো তুমিও দেখবে।তার মিষ্টি গলার স্বরে অনীক তার ভারাক্রান্ত মন হওয়া সত্ত্বেও হেসে ফেললো এবং তার পাশে বসলো।বসে দেখতে থাকলো ছেলেটির শিল্পকর্ম। অনীক তাকে জিজ্ঞেস করলো কোন ক্লাসে সে পড়ে।ছেলেটি বললো ফাইভে পড়ি।কৌতূহলী হয়ে সে আরো জিজ্ঞেস করলো বাড়িতে কে কে আছে?ছেলেটি সারল্যের সাথে বললো "আমি বাবা আর মা।"কিছুক্ষন চুপ থেকে সে আরো বললো:"জানো তো আমার বাবার খুব অসুখ করেছে।ঘর থেকে বেরোতেই পারেনা।"এই শুনে অনীকের ভারাক্রান্ত মনটা যেটা কিছুটা হালকা হয়েছিল আবার কিছুটা ধাক্কা খেলো।সে বললো "তাহলে তোমার মা কে একাই বাইরে বেরিয়ে সব করতে হয়?"উত্তরে ছেলেটি জানালো মা বাড়ী বাড়ী গিয়ে কাজ করে এবং সে নিজেও রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করে স্কুলে যাওয়ার আগে আর সন্ধ্যা বেলা।অনীক শুনে অবাক হয়ে তাকে আরো প্রশ্ন করলো:"তা তোমার এত কিছু করতে কোনো কষ্ট হয় না?"উত্তরে ছেলেটি জানালো যে তার বাবার অসুখ সারানোর জন্য সে করছে তাই তার কষ্ট হয় না।আর মন খারাপ হলে সে এখানে এসে ছবি আঁকে আর তার মন তক্ষুনি ভালো হয়ে যায়।এই টুকু একটা বাচ্চা ছেলের এতটা পরিণত বোধ দেখে অনীক অবাক বিহ্বল দৃষ্টি তে চেয়ে ছিল তার দিকে।এখন যেনো তার ৫–৬ মাসের ব্যর্থতা,ক্লান্তি,দুঃখ নেহাতই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।ছেলেটি তাকে প্রশ্ন করলো:"তুমি এখানে প্রথম এসেছো?"অনীক বললো "না,আমারও যখন মন খারাপ হয় এখানে ঝিলের পাড়ে এসে বসি আর পরিযায়ী পাখি দের দেখে মন ভালো করার চেষ্টা করি।ছেলেটি বললো "তার মানে তোমার মন খারাপ?"ছেলেটির সরল মনের এই প্রশ্ন শুনে অনীক হেসে ফেললো।বললো "হ্যাঁ মন তো একটু খারাপ কিন্তু আজকে তো পরিযায়ী পাখি দেখতেই পেলাম না যে মন ভালো হবে!"ছেলেটি বললো:"আচ্ছা আজকে তুমি আমার আঁকা টা দেখে মন ভালো করে নাও।"অনীক তাকিয়ে দেখলো তার আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে,কি চমৎকার এঁকেছে ওইটুকু ছেলেটি।সে প্রশংসা করে বললো "বাঃ!দারুন এঁকেছ তো।পুরো আসল মনে হচ্ছে!"ছেলেটি বললো "নাহ আজকে অতটা ভালো হয় নি অন্য দিনের মতো।"অনীক তার এই জবাব শুনে আরো যেনো মুগ্ধ হয়ে গেলো।মনে মনে সে চমকিত হয়েছিল তার কথা বার্তা শুনে,বাইরে থেকে তা ঢাকার জন্য বললো "আরে তাও বেশ এঁকেছ।পরের বার আরো ভালো হবে নিশ্চই।"ছেলেটি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো "এবার চলি বুঝলে,আমাকে এবার কাজে যেতে হবে।"অনীক তাকে পকেট থেকে ১০ টা টাকা বের করে দিতে চাইলো কিন্তু সে জানালো "মা বলেছে এমনি এমনি কারোর থেকে টাকা নেওয়া নাকি অন্যায়।"অনীক তাও তাকে জোর করলো কিন্তু সে আরো বললো "না গো তুমি রাখো,আমি এটা নিলে মা খুব বকবে।"এই বলে সে দৌড় লাগালো আর যেতে যেতে বলে গেলো"ওই দেখো কত পাখি!"অনীক ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো একঝাঁক পরিযায়ী পাখি ঝিলের পাড়ে ভিড় করেছে,আকাশে আর একটাও মেঘ নেই,ঝিলের জল আকাশী রঙে রঙিন,পাখি দের কলকলানি তে প্রাণ ফিরে এসেছে চারি দিকে।অনীক অনেকটা চাঙ্গা তখন,বুখ ভরা শ্বাস তার।
